১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসলাম বিচারে আর্নেস্ট রেনানের বিকার

-

সময়টা ১৮৮৩ সালের ২৯ মার্চ। ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনান সোরবোনে আলোচনা করলেন ‘ইসলাম এবং বিজ্ঞান’ বিষয়ে। সেখানে তার দাবিগুলো ছিল আধুনিক ইসলামোফোবিয়ার পূর্বসূরি। সেই বক্তৃতার ১১০ বছর পরে প্রকাশিত স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনের মতোই ছিল তার দাবির অভিঘাত, যা মুসলিম বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। খণ্ডণমূলক অনেকগুলো রচনা সামনে আসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই রেনানের খণ্ডনে অন্তত সাতটি রচনা প্রকাশিত হয়, বিংশ শতকেও জারি থাকে এই ধারা। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ভূমিকা রাখেন জামালউদ্দীন আফগানি।

ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের চোখ দিয়ে ধর্মীয় ও সভ্যতাগত পার্থক্য দেখার চেষ্টা করেন রেনান। সেখানে ইউরোপের তুলনায় মুসলিম সমাজের পশ্চাৎপদতা তার মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে। মুসলিমদের পশ্চাৎপদতার জন্য তিনি দায়ী করেন ইসলামকে। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও চিন্তার স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা তার আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পায়। সেখানে ইসলামের ভূমিকা নিয়ে যৌক্তিক তদন্তের চেয়ে তিনি পাইকারি দোষারোপ করেছিলেন মূলত। অগ্রগতির মৌলিক প্রয়োজন হিসেবে বুদ্ধির মুক্তি, গোঁড়ামির পরিহার, অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের বিদায় নিশ্চিত করার আহ্বান ছিল তার কণ্ঠে। যদিও মানবতার বিবর্তনীয় অগ্রগতির জন্য ঈশ্বরের পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে খ্রিষ্টধর্মের ওকালতি করেন তিনি। রেনানের বিচারে ধর্ম মানবীয় বৈশিষ্ট্যের সর্বোত্তম অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আছে আদর্শবাদ, বস্তুগত স্বার্থ অতিক্রম, আত্মত্যাগ, ভালো ও সত্যের অন্বেষণ। তিনি চেয়েছিলেন ধর্ম ও বিজ্ঞানের হাত ধরাধরি। কিন্তু ইসলামে এই হাত ধরাধরির সম্ভাবনা তিনি দেখেননি। তার মতে, ইসলাম মানবপ্রগতির সহায়ক নয়। ফলে মুসলিমরা হচ্ছে ইসলামের প্রথম ভিকটিম। দুনিয়াজুড়ে তারা বঞ্চিত হচ্ছে প্রগতি থেকে, উন্নয়ন থেকে।

রেনানের জবাবে সোচ্চার আফগানি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছিলেন লড়াকু, যুক্তিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ এবং শেষ পর্যন্ত আধুনিক বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির প্রতি তার ছিল অঙ্গীকার। সমাজজীবনে ধর্মের প্রচলিত অনুশীলনকে সমালোচনামূলক অনুসন্ধানের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি। আফগানি সঙ্গত কারণেই সামনে আনেন সভ্যতা, যুক্তিবাদ ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির পথে ইসলামের প্রবর্তনাগুলো। ভূগোল হিসেবে পাশ্চাত্য এবং ধর্ম ও সংস্কৃতি হিসেবে যা কিছু খ্রিষ্টীয়, তাকে অগ্রাধিকার দেয়ার অধিপতিসুলভ মন কিভাবে রেনানকে সত্যচ্যুত করেছে, তা আফগানির বিশ্লেষণে উঠে আসে।

তবে আফগানি তার মন্তব্য শেষ করেন যে জায়গায় এসে, তা হলো ধর্ম এবং দর্শনের মধ্যে বিরোধ যতদিন থাকবে ততদিন মানবতা থাকবে। আর এ বিরোধে মুক্তচিন্তার জয় হবে না। কারণ বুদ্ধি যখন একেবারে মুক্ত হয়, তাকে স্বেচ্ছাচারী হতে কে বাধা দেবে? কিন্তু স্বেচ্ছাচারী বুদ্ধি শেষ অবধি মানুষের আত্মার ওপরই অত্যাচার করে।

আফগানির এ অবস্থান মুসলিম চিন্তকদের অনেকের সমালোচনার শিকার হয়। আফগানিকে লক্ষ্য করে বৈরুতে নির্বাসিত মুফতি আবদুহুর রহস্যময় বার্তা এর নজির হতে পারে। আপন গুরুকে লক্ষ্য করে আবদুহু লিখেন, ‘ধর্মের তরবারি ছাড়া ধর্মের মাথা কাটবেন না।’

যদিও সেই সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপথে আফগানির মন্তব্য প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে, তবুও একজন যুক্তিবাদী হয়েও আফগানি যুক্তিবাদের হাতে জীবনের ব্ল্যাঙ্কচেক দিতে রাজি ছিলেন না। তার জন্যও চেয়েছিলেন একটি সীমা। কিন্তু আবদুহু সম্ভবত এখানে আধুনিক যুক্তিবাদের সামর্থ্যরে প্রতি অধিক সমীহ পোষণ করেছিলেন। আফগানির সমালোচনার জবাবে রেনান পিছুটানসহকারে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। তিনি বলেন, ‘ইসলামের রয়েছে সুন্দর দিক। যেহেতু এটি এক ধর্ম, তাই আমি কখনো প্রবল আবেগে আচ্ছন্ন না হয়ে মসজিদে প্রবেশ করিনি, আমি কি এটি ঘোষণা করেছি?’ তা সত্ত্বেও রেনান তার ঘৃণাবিষাক্ত ও বর্ণবাদী অবস্থান থেকে সরে আসেননি। উনিশ শতকে মানুষে মানুষে মিল ও অমিলের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে পশ্চিমা নেতৃত্বে নতুন যে শ্রেণিবিন্যাসের বিকাশ হয়, তাতে বিদ্যায়তনগুলোতে নতুন ফ্যাকাল্টি যুক্ত হয়। ফিলোলজি, নৃতত্ত্ব ও ধর্মীয় অধ্যয়নেও নতুন শাখাগুলো স্থান লাভ করে। এই শ্রেণীকরণের ফলে যে জ্ঞানের উৎপাদন হয়েছিল, তা ডারউইনের প্রস্তাবিত বিবর্তনবাদের ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। এর দাবি হলো, বিবর্তনীয় অগ্রগতির ফলে মানুষ যেমন বিভিন্ন জাতি ও সভ্যতায় বিভক্ত হয়েছে, তেমনি বিভিন্ন ধর্মের জন্ম হয়েছে। ফলে প্রগতির ধারাবাহিকতায় প্রয়োজন ধর্মের নতুন বিন্যাস ও সংস্কার। ইউরোপে এ প্রচেষ্টা খ্রিষ্টধর্মকে বিশেষ আয়তন ও চরিত্র দিলো এবং তাকে মানবজাতির চূড়ান্ত ধর্ম হিসেবে দাবি করল। সে চাইল অন্যান্য ধর্মের অতি-যুক্তিধর্মী বিকাশ। এ সময় ধর্মের ঐতিহ্য এবং আচারকে আদিম অতীতের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে এর পরিবর্তে স্বতন্ত্রভাবে এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা এবং নীতিশাস্ত্র হিসেবে স্বর্গীয় ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। ফলে মানবজাতির জন্য ঈশ্বরের অভিপ্রায়কে যারা স্বীকার করেন, তারাও একে আরো বিকশিত করার জন্য ধর্মের সংস্কারের লড়াইয়ে নিয়োজিত হলেন। রেনান এ লড়াইয়ের এক অগ্রদূত। তিনি ক্যাথলিক ধর্মের ঐতিহ্যকে আক্রমণ করার পদ্ধতি হিসেবে বৈজ্ঞানিক যুক্তি ব্যবহার করেন। তিনি মানবজাতির বিবর্তনীয় অগ্রগতির জন্য ঐশ্বরিক ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে খ্রিষ্টধর্মকে নবায়ন করার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এতকাল খ্রিষ্টীয় দুনিয়া যিশুকে যে অর্থে জানত, তিনি সেই অর্থ পুনর্গঠনের চেষ্টায় শরিক হন। ‘যাতে যিশুর আসল অর্থ মানুষ জানে আর সামাজিক অগ্রগতির জন্য ধর্মকে কাজে লাগানোর উপায় বেরিয়ে আসে!’ ১৮৬০ সালে জবাব des deux mondes এ প্রকাশিত তার প্রবন্ধ ‘আধুনিক সমাজে ধর্মের ভবিষ্যৎ’ তার সেই প্রকল্পকে ব্যাখ্যা করে। এতে তার শেষ দাবি ছিল, পৃথিবী সর্বদাই ধর্মীয় হবে এবং বৃহৎ অর্থে খ্রিষ্টধর্মই ধর্মের শেষ শব্দ। প্রোটেস্টান্টবাদই ছিল রেনানের আস্থার ঠিকানা। যেহেতু খ্রিষ্টধর্মে প্রোটেস্টান্টবাদ নিজেকে বদলাতে সক্ষম। আর সেই সক্ষমতা কোনো নিয়মের বেড়াজালে বন্দী নয়। গির্জা জাতীয় যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়মের পক্ষপাতী, তারা তাদের নিয়তিকে বরণ করবে। আগামী থেকে হারিয়ে যাওয়াই ওদের নিয়তি।

অপর দিকে, আফগানি বিজ্ঞানকে অভিজ্ঞতাবাদ এবং যুক্তিবাদের ওপর ভিত্তি করে একটি পদ্ধতি হিসেবে বুঝেছিলেন। সমালোচনামূলক অনুসন্ধান হিসেবে একে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ধর্মে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের পক্ষে কথা বলেন। এ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় পাঠ্য ও ঐতিহ্যের পুনর্বিচার করতে বলেন। যুক্তিবাদের অভিপ্রায় তিনি ঢালাওভাবে প্রত্যাখ্যান করেননি। ঐতিহ্যের সাথে যুক্তিবাদের দ্রবীভূতকরণ ছিল তার অন্বেষা। গভীর বিচারে আফগানি ছিলেন রেনানের তুলনায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। বাস্তবতার প্রতি তার বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গীকার ছিল স্পষ্ট।

রেনান ইসলামের জন্য খ্রিষ্টধর্মের ভাগ্যকে বেছে নিয়েছিলেন। যেন সে, ইসলাম, কালের চাহিদার হাতে নিজেকে সঁপে দেয়। তাকে যেন যেকোনো পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত ও যোগ্য করা যায়। কিন্তু ইসলাম যেহেতু আপন মৌলিক সত্যে অনমনীয়, আপন স্থাপনার কোনো অংশকে সে যেহেতু বাদ দিতে বা বদলে দিতে রাজি নয়, ফলে রেনানের চোখে ইসলাম এক সমস্যা। মোকাবেলার প্রক্রিয়ায় যাকে হয় পুনর্গঠন, নয় পরিহার করা উচিত। রেনানের সেই দৃষ্টি শতাব্দীর পথ পেরিয়ে আজো উঁকি দেয় বহু মুসলিমের চিন্তায় ও বয়ানে।

রেনান ও তার নিকট বা দূরবর্তী অনুসারীরা ভুলে যান ইসলাম পরিবর্তনের জন্য কখনোই অপ্রস্তুত নয়। মানবপ্রগতি তার অন্যতম অন্বেষা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তার নীতি হলো মাসলাহা বা সর্বাঙ্গীণ উপযোগ। পশ্চিমা উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা আলাদা। এই মাসলাহার বিচারে ইসলাম বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার- উন্নয়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তির গতি-প্রকৃতিকে দেখে। এসব উদ্ভাবন ও অগ্রগতির প্রতি ইসলাম ইতিবাচক এবং এর প্রতি সে উদ্দীপনা জোগায়। কিন্তু এর ব্যবহারে কল্যাণকে নিশ্চিত করতে হবে। বৃহত্তর মানবকল্যাণের জন্য কোথাও যেন সে হুমকি না হয়ে ওঠে। সে জন্য দেয় বিধি-বিধান। যা জন্ম নেয় ইসলামের বুনিয়াদি নীতিমালা থেকে। এসব নীতিমালা ইসলামের স্থিতিস্থাপকতা নিশ্চিত করে। ফলে প্রতিটি বাস্তবতায় গতিশীল হয়েও ইসলাম আপন নীতিমালার বুনিয়াদে স্থিতিশীল।

পরিবর্তনশীল যুগপ্রেক্ষিতকে ইসলাম স্বীকার করে। ইসলামের মূলনীতি যুগ-বাস্তবতা ও প্রতিষ্ঠিত সামাজিক প্রথা-প্রক্রিয়া বা উরফকে আইনের এক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, ইসলামী আইনের চার বুনিয়াদি ভিত্তির একটি হলো ইজমা বা নিজ নিজ কালে উম্মতের প্রজ্ঞা-প্রতিনিধিদের বৃহত্তর ঐক্য, এর পরেরটি হলো কিয়াস বা যুক্তি। যুক্তির মাধ্যমে ইসলামে প্রবর্তিত বিধানের সংখ্যা বিপুল। কিন্তু ইজমা বা কিয়াসের ক্ষেত্রে ইসলামের মৌলিক নীতিমালার উল্লঙ্ঘন চলবে না। মৌলিক ঐশী নীতিকে উপেক্ষা না করে প্রতিটি কাল, সমাজ, ভূগোল ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার চাহিদা ইসলাম কবুল করে। সেই অনুযায়ী শাখাগত বিধির (মাসয়ালা) বিবর্তন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এর মানে হলো, ইসলামে বিবর্তন ও প্রগতি আপন নিয়মে চলমান। ফলে মধ্যযুগীয় খ্রিষ্টবাদের সাথে মানবপ্রগতির যে সঙ্ঘাত ঘটেছিল, ইসলামে এমন কিছুই ঘটার অবকাশ নেই। কিন্তু রেনান গির্জাকেন্দ্রিক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা দিয়ে ইসলামকে চেয়েছেন বিচার করতে। ফলে খ্রিষ্টবাদের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, ইসলামের জন্যও একই ফলাফলের প্রস্তাব করেছেন।

ইসলামী বিশ্বের অনগ্রসরতাকে রেনান ইসলামের ফলাফল হিসেবে ভেবেছিলেন। ইসলামের মধ্যে কল্পনা করেছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার প্রতিকূল সাংস্কৃতিক পরিবেশ। উপনিবেশিত মুসলিম সমাজে নিশ্চল যে বাস্তবতা ছিল, রেনানের বিচারে সেটি ইসলামী বিশ্বাসের প্রকৃতি থেকে জন্ম নিয়েছে। আর একেই তিনি প্রকৃত আরব চরিত্র হিসেবে চিন্তা করেছিলেন। এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি দাবি করেন, মধ্যযুগে মুসলিমরা বিজ্ঞান ও দর্শনের সব মহান অর্জনগুলো হেলেনীয় বা গ্রিকদের থেকে ধার করেছিল। এগুলো বিকশিত হয় ইরানি, স্পেনিশ ও মধ্য এশীয়দের হাতে। যারা ইতঃপূর্বে আরব নাম গ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের সারাংশ রেনানের চোখে আরব ব্যাপার। আর আরবরা সেকালে কিংবা পরবর্তীতে মুসলিম বিশ্বের যেকোনো বৈষয়িক বা রাজনৈতিক অগ্রগতিকে বাধা দেয়।

রেনানের এই ভ্রান্তি ছিল হতাশাজনক। মুসলিমদের সামাজিক অবস্থান দিয়ে ইসলামকে মূল্যায়ন করা এক প্রাচ্যবাদী প্রবণতা। এটি এমন এক ঔপনিবেশিক অন্যায়, যা মুসলিমদের সর্বস্ব লুঠ করে তাদের লুণ্ঠিত অবস্থার জন্য দায়ী করে তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে! কিন্তু ঐতিহাসিক বিচারে দেখা যায়, ইসলামের দাবি ও শিক্ষা থেকে মুসলিমদের বিচ্ছিন্নতার ফাটলগুলো পতনকালে খুব বেশি লক্ষণীয়। ইসলাম জীবনের জন্য যে অগ্রগতি ও সাফল্যের প্রতিশ্রুতি দেয়, তা যেহেতু নির্ভর করে ইসলামের অনুবর্তিতায়, ফলে মুসলিমরা সেই অগ্রগতি লাভ না করলে এর দায় ইসলামের নয়; বরং ইসলাম থেকে তাদের বিদ্যমান দূরত্বের। রেনান ব্যাপারটিকে একেবারে উল্টে দেন এবং মুসলিমদের অনগ্রসরতাকে ব্যাখ্যা করেন বস্তুনিষ্ঠতাকে অগ্রাহ্য করেই। তিনি ভুলে যান ইসলাম কখনোই আরব ব্যাপার নয়। আরবদের সাফল্য-ব্যর্থতা দিয়ে ইসলামের মূল্যায়ন করা সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক জবরদস্তি। আরব চরিত্রের প্রশ্নে তার বিচারও বর্ণবাদী, প্রান্তিক। জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদের অবদান ও সৃষ্টিশীল ভূমিকা নিয়ে তার মূল্যায়নও একপেশে। আরবদের বৈজ্ঞানিক ও সৃষ্টিশীল মনকে অস্বীকার করলে আধুনিক পৃথিবীর জন্মসূত্রকেই অস্বীকার করা হয়। অনারব মুসলিমরা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার যে চর্চা করেছেন, এর মর্মমূলে নিহিত ছিল ইসলামের প্রণোদনা। মুসলিমদের জ্ঞানচর্চা কখনোই নিছক গ্রিকদের অনুকরণ ছিল না। গ্রিক মন ছিল দার্শনিক। মুসলিমরা গ্রিক দর্শনকে বিনাবাক্যে গ্রহণ করেননি। সবচেয়ে বেশি গ্রিক প্রভাবিত বলে পরিচিত আল কিন্দি, আল ফারাবি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদরাও গ্রিকদের সমালোচনা করেছেন। তাদের দর্শনের কিছু দিকের সাথে ইসলামের সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন, কিছু দিকের সংশোধন করেছেন, কিছু বিষয়কে নবরূপায়ণের ধারায় গ্রহণ করেছেন। এগুলোর সবটাই সৃজনশীল কাজ। পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক তদন্ত গ্রিকদের মধ্যে ছিল না। পৃথিবীকে এটি উপহার দেন মুসলিমরা। বস্তুত প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ছাড়া আজকের পৃথিবীকে কল্পনা করাও অসম্ভব। সেখানে গ্রিকদের অর্জন নেই বললেই চলে। এ অর্জনের দরোজা খুলে পৃথিবীকে এগিয়ে নেয় মুসলিম সভ্যতা। নির্মাণ করে মৌলিক তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি। পশ্চিমা সভ্যতা যার সুফল ভোগ করেছে দেদার। রেনানের দৃষ্টিভঙ্গি তাই পশ্চিমা দুনিয়ায় নানা দিক থেকে প্রত্যাখ্যাত হবে, এটিই ছিল স্বাভাবিক। পশ্চিমা পণ্ডিতদের অনেকেই তখন রেনানের ভ্রান্তি এড়াতে চেয়েছেন। তারা ইসলাম ও মুসলিম সভ্যতাকে অধ্যয়ন করছিলেন এবং ন্যায্য দৃষ্টিভঙ্গি অনুসন্ধান করছিলেন। ফরাসি পলিম্যাথ গুস্তাব লে ভনের (১৮৪১-১৯৩১) La Civilisation des Arabes (1884) এ ধারার ভালো দৃষ্টান্ত। তিনি তার কাজে আরব সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ইসলামের বয়ান করেন ঐতিহাসিকতায় যথাসাধ্য আঘাত না করে। তার বই অভিনন্দিত হয়। বইটির জন্য ধন্যবাদ জানাতে মুফতি আবদুহু ১৯০৩ সালে লে ভনের বাসায় হাজির হন। সুইস-জার্মান প্রাচ্যবিদ এডাম মেটযের (১৮৬৯-১৯১৭) বিখ্যাত Die Renaissance des Islam, ফরাসি বিদ্যাবাগীশ ব্যারন কারা ডে ভক্সের (১৮৬৭-১৯৫৩) Le mahométisme; le génie sémitique et le génie aryen dans l'Islam, (1897) Avicenne (1900) La doctrine de l'Islam (1909), অগ্রগণ্য জার্মান প্রাচ্যবিদ কার্ল ব্রোকেলম্যানের (১৮৬৪-১৯৫৬) দুই খণ্ডের এবং chichte der arabischen Litteratur (1898) মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তি, ইসলাম ও সৃজনশীলতা এবং বিশ্বসভ্যতায় মুসলিমদের বরেণ্য ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। মুসলিমদের বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চায় মৌলিকত্ব ও প্রভাবশালী অবদান কৃতজ্ঞতার সাথে বরিত হয় পশ্চিমা এসব ভাষ্যে, যা স্পষ্টতই রেনানের অনৈতিহাসিকতাকে প্রত্যাখ্যান করছিল।

লেখক : কবি, গবেষক
ইমেল : 71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement