২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
অবলোকন

মালয়েশিয়া ও নেপাল: নির্বাচনোত্তর চ্যালেঞ্জ

মালয়েশিয়া ও নেপাল: নির্বাচনোত্তর চ্যালেঞ্জ - ছবি : সংগৃহীত

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ মালয়েশিয়ায় বহুল আলোচিত নির্বাচনের পর আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে ঐক্য সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সরকারের অন্তর্ভুক্ত জোটগুলোর মধ্যে আনোয়ারের পাকাতান হারাপান জোট ছাড়াও রয়েছে আহমদ জাহেদ হামিদীর নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাশনাল ও জোহারির নেতৃত্বাধীন সারাওয়াকের জিপিএস জোট। এই তিন জোট এবং আরো কিছু দল ও স্বতন্ত্র সদস্য মিলিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকছে ঐক্য সরকারের ওপর। সরকারের বাইরে এখন কেবলই থাকছে বিরোধী পেরিকাতান ন্যাশনালভুক্ত দুটি দল বারাসাতু ও পাস।

আপাতদৃষ্টিতে মালয়েশিয়ায় একটি স্থিতিশীল শাসন প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। যদিও দেশটির জটিল রাজনৈতিক সমীকরণে অস্থিরতা তৈরি হতে সময় লাগে না। এবারের রাজনৈতিক সঙ্কটের যেমন গভীরতা অনেক বেশি তেমনি এর উত্তরণ সম্ভাবনাও উজ্জ্বল। রাষ্ট্রটির গভীর ক্ষমতা বলয়ের বড় অংশই এখন সম্ভবত একটি স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে এনে মালয়েশিয়াকে পুরনো সমৃদ্ধির ধারায় এগিয়ে নিতে চাইছেন।

অন্য দিকে, দক্ষিণ এশিয়ার হিমালয় কন্যাখ্যাত দেশ নেপালে সংসদের পূর্ণ মেয়াদ শেষে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শাসক জোট সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেলেও জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে নতুন দূরত্ব ও হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। নেপালি কংগ্রেসের সাথে জোট করে মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ও মাধব চন্দ্র নেপালের ইউনিফাইড সোশ্যালিস্ট কমিউনিস্ট পার্টি আসনপ্রাপ্তিতে এক ধরনের বিপর্যয়ে পড়েছে। লাভবান হয়েছে নেপাল কংগ্রেস। এতে কেপি শর্মা অলির ইউনাইটেড নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ঐক্যের আলোচনা নতুন করে শুরু হয়েছে। ফলে নেপালে কারা নতুন সরকার গঠন করবে তা নিয়ে আবারো অনিশ্চয়তা হাতছানি দিচ্ছে।

অনেক চ্যালেঞ্জ আনোয়ারের, রয়েছে আশাও
ক্ষমতার একেবারে দ্বারপ্রান্ত থেকে ছিটকে পড়ে ২৪ বছর জেল-জুলুম আর রাজপথে সংগ্রামের পর আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আর ঠিক এ সময়টাতে আনোয়ারের প্রতি নানা ধরনের বিশ্বাস ভঙ্গের অন্যতম পক্ষ ড. মাহাথির মোহাম্মদের ৯৭ বছর বয়সে জামানত হারানো হারের মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটেছে বলে মনে হয়। মাহাথিরকে এখন মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে অতীতের বিষয় ভাবা শুরু হয়েছে।

আনোয়ার ইব্রাহিম এমন একসময় তিন গুরুত্বপূর্ণ জোটের এক ঐক্য সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন যখন মালয়েশিয়া নানা ধরনের গভীর সঙ্কট মোকাবেলা করছে। এর মধ্যে একদিকে বহু বিভক্ত রাজনৈতিক ধারার মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় সাধনের চ্যালেঞ্জ যেমন রয়েছে, তেমনি জাতিগত অবিশ্বাস ঘৃণা সৃষ্টির পরিবেশকে একটি ধারায় প্রবাহিত করে আবারো মালয়েশিয়াকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নেতৃত্বে প্রাসঙ্গিক করে তোলাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সে সাথে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন কাঠামোতে যে ভঙ্গুরতা সৃষ্টি হয়েছে সেটি কাটিয়ে ঐক্যবদ্ধ মালয়েশিয়াকে উন্নয়নের গতিপথে ফিরিয়ে আনার বিষয়টিও নতুন নেতৃত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

আনোয়ার ইব্রাহিমকে একেবারে স্বল্প সময়ে যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে তা হলো জোটভুক্ত দলগুলোর যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা। এ ক্ষেত্রে পাকাতান জোটভুক্ত তিন দল পিকেআর, ডিএপি ও আমানাহ রয়েছে এক দিকে। অন্য দিকে বারিসান ও জিএসপি জোট থেকেও মন্ত্রী নিতে হবে। এর বাইরে সাবাহর জিআরএস আর ওয়ারিসানও সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। আনোয়ার সম্ভবত এ ক্ষেত্রে বিতর্কহীন ফর্মুলা অনুসরণ করে মন্ত্রিসভা গঠন করতে চাইবেন। সেই ফর্মুলা হতে পারে তার সম্ভাব্য ২৬ সদস্যের মন্ত্রিসভার সদস্য হবেন সংসদ থাকা আসনের ভিত্তিতে। আর ঐক্য সরকারের অন্তর্ভুক্ত জোটগুলোই প্রস্তাব করবে মন্ত্রী হিসাবে কারা তাদের প্রতিনিধি হবেন।

এই ফর্মুলা অনুসারে বারিসান ন্যাশনাল থেকে জাহিদ হামিদী অথবা মোহাম্মদ হাসান হতে পারেন উপপ্রধানমন্ত্রী। সাবাহ সারওয়াক থেকে জোহারি হতে পারেন দ্বিতীয় উপপ্রধানমন্ত্রী। প্রতি পাঁচজন সংসদ সদস্যের জন্য নেয়া হতে পারে একজন মন্ত্রী। এ হিসাবে পিকেআর ও বারিসান থেকে ছয়জন করে ডিএপি থেকে আটজন আমানাহ থেকে এক বা দু’জন এবং জিএসপি থেকে চারজন আর জিআরএস ও ওয়ারিসান থেকে একজন মন্ত্রিসভায় স্থান পেতে পারেন। আর নিজ নিজ দল বা জোট তাদের পক্ষ থেকে কে কে মন্ত্রী হবেন তা নির্ধারণ করবেন।

আনোয়ার দায়িত্ব গ্রহণের পরই তার অগ্রাধিকার কী হবে তা তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, সংখ্যাগুরু মালয়দের অধিকার ও ধর্মীয় বিশ্বাস সংরক্ষণে ঐক্য সরকার ভূমিকা রাখবে, একই সাথে নিশ্চিত করবে অন্য জাতিগোষ্ঠীর ন্যায়ানুগ অধিকারও। আনোয়ার এর মধ্যে মালয়েশিয়ার সব জাতিগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে প্রাথমিক পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। তিনি ইসলাম এবং অন্য ধর্মের অনুসারীদের ভুল ধারণা দূর করতে প্রত্যেক জুমায় মুসলমানদের জন্য বক্তব্যের পাশাপাশি অমুসলিমদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে ইসলামের মৌলিক যে বক্তব্য রয়েছে তার উপর আলোকপাত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি সামাজিক ঘৃণা ও উত্তেজনার পরিবেশের পরিবর্তে সংহতি ও সমন্বয় জোরদার করবে। আর ঐক্য সরকার গঠনের ফলে সরকারে সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যাবে।

এর পাশাপাশি আনোয়ার জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও উন্নয়ন-বিকাশে গতি আনার চেষ্টা শুরু করেছেন, যার অংশ হিসাবে ৯০ এর দশক পর্যন্ত দেশটিতে যে মূল্য স্থিতি রক্ষা বা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিল সেটি ফিরিয়ে আনছেন। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মূল্য নিয়ন্ত্রণের কাঠামো ভেঙে দেয়ার পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন। স্থানীয় ও বৈশ্বিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এই প্রচেষ্টা গতি পেলে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সাথে সাথে বিদেশী শ্রমিকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে বাংলাদেশ নেপাল পাকিস্তানের মতো দেশের উদ্বৃত্ত শ্রমিকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে, অন্য দিকে স্থানীয় কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রগুলোতে শ্রমিকের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হবে না। এর সুবিধা পাবে সব পক্ষ।

এটি ঠিক যে, বলা যত সহজ বাস্তবে করা তার চেয়ে অনেক কঠিন। তবে আনোয়ার ইব্রাহিমের অতীত যারা পর্যবেক্ষণে রেখেছেন তারা বিশ্বাস করবেন যে তিনি যা বলছেন তা করার ক্ষমতা রাখেন। তার প্রাথমিক পদক্ষেপে এর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রা রিংগিতের দাম বাড়তে শুরু করেছে। শেয়ারবাজারের সূচক ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে স্থবির বিনিয়োগের গিঁট আবার খুলতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানোর পোস্ট কমে আশাবাদ বিস্তৃত হতে শুরু করেছে।

সঙ্ঘাতমুখর বৈশ্বিক পরিস্থিতিও আনোয়ারের জন্য একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। এক দিকে সক্রিয়তাবাদী চীন, অন্য দিকে চীনের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে বেপরোয়া আমেরিকা। এই দুইয়ের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য আনা সহজ নয়। ওআইসি ও মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও রয়েছে সঙ্ঘাতমুখরতা। সৌদি ও ইরান বলয়ের মাঝখানে রয়েছে মধ্যপন্থী তুর্কি বলয়। এই তিন বলয়ের মধ্যে সংযোগ ও সমন্বয় আনতে পারাটা আনোয়ারের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া মুসলিম বিশ্বের চারটি জ্বলন্ত সমস্যা ফিলিস্তিন, রোহিঙ্গা, কাশ্মির ও সিরিয়ার সঙ্কট রয়েছে। এর প্রতিটিতে মালয়েশিয়ার ভূমিকা রাখার অবকাশ রয়েছে।

আগামী ১৯ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার সংসদে প্রথম অধিবেশন আস্থা ভোটগ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হবে। এর আগেই সরকার গঠনের কাজ শেষ করে আনতে হবে। আনোয়ার ঐক্য সরকারের অনেক পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হলেও বিরোধী আসনে থাকবে শক্তিশালী পাস ও বারসাতুর ৭৩ আসনের এক-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের একটি ব্লক। সব মিলিয়ে মালয়েশিয়াকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া হবে ৭৫ বছর বয়সী পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ আনোয়ার ইব্রাহিমের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ তিনি জয় করতে পারবেন বলে আশা করা যায়। মালয়েশিয়ার শক্তিশালী সুলতানরা এই যাত্রায় আনোয়ারকে সমর্থন দিয়ে যাবেন বলে মনে হচ্ছে।

নেপালে আবার ঘোড়া কেনাবেচার রাজনীতি
নেপালে জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর বেশ কয়েক দিন পেরিয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ ফলাফল আসেনি। তবে নির্বাচনী ফলের একটি পূর্ণ চিত্র বোঝা যাচ্ছে। এই চিত্র অনুসারে কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন বিরোধী নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনাইটেড) সর্বাধিক ২৮ শতাংশের মতো ভোট পেলেও জোটগত সমীকরণে প্রধানমন্ত্রী দেউবার নেপাল কংগ্রেসের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

নেপালের সংবিধানে এমন এক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয় যেটি দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশে নেই। নেপালের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের অভিনব দিকটি হলো এতে একটি মিশ্র নির্বাচনপদ্ধতি রয়েছে, যেখানে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সংসদের ৬০ ভাগ সদস্য (কেন্দ্রীয় সংসদে ২৭৫ এর মধ্যে ১৬৫ জন) নির্বাচিত হচ্ছেন প্রত্যক্ষ প্রতিদ্ব›িদ্বতায় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্তির ব্রিটিশ পদ্ধতিতে। বাকি ৪০ ভাগ আসনে (কেন্দ্রে ১১০ আসন) রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রার্থী তালিকা দেবে সেখান থেকে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে ক্রম অনুসারে সংসদ সদস্য বাছাই করা হবে। ১৮ বছর ও এর বেশি বয়সের ভোটাররা দু’টি ব্যালটের একটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থী এবং আরেকটিতে দলের পক্ষে ভোট দেন। এই ব্যবস্থায় কম ভোট পেয়ে অনেক বেশি আসনপ্রাপ্তির অসম ব্যবস্থা যেমন এড়ানো যায় তেমনি দলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা না করে দলের মনোনীত হয়ে সংসদে যেতে পারেন।

এবার ১৬৫টি আসনে যে সরাসরি নির্বাচন নেপালে অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে ১৫৫টির ফলাফল অনুসারে শাসক জোটের তিন দল সোয়া শ’ আসনে জয় পাচ্ছে। চূড়ান্ত ফলাফলে আরো ৪-৫টি আসন বাড়তে পারে। এখন পর্যন্ত পাওয়া ফল অনুসারে ইউনাইটেড নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি সবমিলিয়ে ৭৪টি আসন পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার নেপালি কংগ্রেস পেয়েছে ৮৬টি আসন। মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি পাচ্ছে ৩২টির মতো। মাধব চন্দ্র নেপালের ইউনিফাইড সোশ্যালিস্ট কমিউনিস্ট পার্টি পাচ্ছে ১০টির মতো আসন। রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি লাভ করছে ২১টি, রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি ১৫টি, পিপলস সোশ্যালিস্ট পার্টি ১০টি আসন পাচ্ছে। লোকতান্ত্রিক সমাজবাদী পার্টি পাচ্ছে চারটি এবং নেপাল উনমুক্তি পার্টি লাভ করছে তিনটি আসন। এর বাইরে ছোট ছোট দল ও স্বতন্ত্র সদস্যরা গোটা দশেক আসনে জয় পেতে চলেছে।

নির্বাচনপূর্ব জোট হিসাব করা হলে ১৩৮ আসনের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কংগ্রেস-মাওবাদী-সোশ্যালিস্ট জোটের সরকার গঠন খুব একটি কঠিন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে শাসক জোটে নেপালি কংগ্রেসের ফল ভালো এলেও জোটের অংশীদার মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ও মাধব চন্দ্র নেপালের নেতৃত্বাধীন ইউনিফাইড সোশ্যালিস্ট কমিউনিস্ট পার্টির ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। এ দুটি দলের নেতারা নেপালি কংগ্রেসকে দোষারোপ করতে শুরু করেছেন। তারা দলের আদর্শের সাথে নেপালি কংগ্রেসের ধ্যান-ধারণার মিল না থাকায় জনগণের মধ্যে তাদের দলকে সমর্থন কম করার প্রবণতাটি এবার পাঠ করছেন।

এর ফলে এর মধ্যে কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির সাথে মাওবাদী নেতাদের আলোচনা ও মতবিনিময় শুরু হয়েছে। নির্বাচনে জোট বা আলাদা দল হিসাবে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলো দেউবার কংগ্রেস বা ওলির ইউএমএল এই যেকোনো দলের নেতৃত্বে জোট সরকার গঠন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে পুষ্প কুমার দহল প্রচণ্ড ও মাধব চন্দ্র নেপালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে। এই দুটি দল এক হওয়ার একটি কথা উভয় দলের নেতারা বলেছেন। ফলে আগের মতো কমিউনিস্ট দলগুলো এক হলে দুয়েকটি মাদেসি দলের সমর্থনে নেপালি কংগ্রেসকে বাদ দিয়েও সরকার গঠন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। এ ধরনের ইঙ্গিত নিয়ে এর মধ্যে নেপালি রাজনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে। এ ব্যাপারে মেরুকরণে চীন ও ভারতীয় স্বার্থের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এ নিয়ে সক্রিয় হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও।

নেপালি কংগ্রেস, সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র), সিপিএন (ইউনিফাইড সোশ্যালিস্ট), পিপলস সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং রাষ্ট্রীয় জনমোর্চার জোটগতভাবে ৫ আগস্ট ২০২২-এ সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে ১৫ আগস্ট, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাবুরাম ভট্টরাইয়ের নেতৃত্বে নেপাল সোশ্যালিস্ট পার্টি সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র) এর নির্বাচনী প্রতীক ও ইশতেহারের অধীনে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ৯ অক্টোবর পিপলস সোশ্যালিস্ট পার্টি জোট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং জোট সাতটি আসনে লোকতান্ত্রিক সমাজবাদী পার্টিকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয়।

এবারের নির্বাচনী ফলাফলের একটি চিত্র স্পষ্ট হওয়ার পর সিপিএন-ইউএমএল চেয়ার এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি গত বৃহস্পতিবার সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র) প্রধান পুষ্প কমল দহলকে টেলিফোন করেছেন এবং প্রস্তাব করেছেন যে তারা যেন একসাথে কাজ করতে পারেন। দুই নেতা ১৫ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে কথা বলেছেন বলে দহলের একজন সহযোগী জানিয়েছেন। দহল নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল না হওয়া পর্যন্ত ওলিকে অপেক্ষা করতে বলেছেন বলে জানা গেছে। ওলি একই সাথে প্রধানমন্ত্রী ও নেপালি কংগ্রেসের সভাপতি শের বাহাদুর দেউবাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

একজন মাওবাদী নেতা বলেছেন, ‘যেহেতু আমরা ক্ষমতাসীন জোটের মূল সদস্য, আমরা নির্বাচনের ফলাফল এবং ভবিষ্যৎ পথ নিয়ে প্রথমে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করব এবং তার পরই সিদ্ধান্ত নেবো কোন পথে যেতে হবে।’ অন্য দিকে মাওবাদী কেন্দ্রের দ্বিতীয় স্তরের নেতাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষাকারী একজন ইউএমএল নেতা বলেছেন, ‘আমাদের দল সবার সাথে আলোচনার জন্য উন্মুক্ত। তবে আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হবে নেপালি কংগ্রেস ছাড়া সরকার গঠন করা।’

ইউএমএল নেতা উল্লেখ করেন, মাওবাদী কেন্দ্রের দ্বিতীয় স্তরের নেতারা নির্বাচনের ফলাফল দেখে হতবাক হয়েছেন, বিশেষ করে নেপালি কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী অংশীদারিত্ব যে তাদের পক্ষে আসেনি সেটি তারা উপলব্ধি করেছেন। মাওবাদী কেন্দ্র ২০১৭ সালের মূল নির্বাচনে ৩৬টি সংসদীয় আসন জিতেছিল, তারা এইবার মাত্র অর্ধেক সংখ্যায় জয়ী হতে চলেছে। নেপালি কংগ্রেসের সাথে তাদের অংশীদারিত্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেনি। অন্য দিকে, মাধব নেপাল সঙ্কটে পড়েছেন, কারণ তার দল একটি জাতীয় পার্টির মর্যাদার জন্য ন্যূনতম ভোট পেতে লড়াই করছে। এই অবস্থায় নেপালি কংগ্রেস ছাড়াই পরবর্তী সরকার গঠনের নেতৃত্ব দিতে পারবে ইউএমএল।

ইউনিফাইড সোশ্যালিস্টের একজন নেতা বলেছেন যে তার দল ইউএমএলের সাথে কাজ করার পরিবর্তে মাওবাদী কেন্দ্রের সাথে ঐক্য পছন্দ করে। এখন দুই দলের মধ্যে একীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। দুই দল এক হলে পরে ইউএমএলের সাথে ঐক্য সম্ভব হবে।

ইউএমএল চেয়ারম্যান ওলি বৃহস্পতিবার ফলাফল নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন এবং দেশে সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। ওলি বলেন, আগে আমরা আশা করেছিলাম যে নির্বাচন সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারসহ স্থিতিশীলতা আনবে, কিন্তু ফলাফলে দেখা যায় কোনো দলই সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। এখন ঘোড়া কেনাবেচার ব্যবসা শুরু হবে।

একটি নতুন সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ম্যাজিক সংখ্যা হলো কেন্দ্রে ১৩৮ এবং সংখ্যাটি প্রতিটি প্রাদেশিক পরিষদের জন্য ভিন্ন। তবে এখন পর্যন্ত, নেপালি কংগ্রেস, সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র), সিপিএন (ইউনিফায়েড সোশ্যালিস্ট), রাষ্ট্রীয় জনমোর্চা এবং লোকতান্ত্রিক সমাজবাদী পার্টির ক্ষমতাসীন জোট একটি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন মেরুকরণে এসব দল একই অবস্থানে না-ও থাকতে পারে। সেটি হলে পুরো রাজনৈতিক অবস্থা পাল্টে যেতে পারে।

রাজনৈতিক এ পরিবর্তনের সময়ে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোর ভূমিকার পাশাপাশি থাকে বাইরের শক্তির প্রভাব ও কার্যক্রম। নেপালে এ ধরনের প্রভাব বিস্তারে ভারত ও চীনের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। নেপালি কংগ্রেসকে ভারত-বান্ধব আর ইউএমএলকে চীন-বান্ধব দল বলে বিবেচনা করা হয়। স্বাভাবিকভাবে এই দুই দেশ চাইবে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল দলের নেতৃত্বে সরকার গঠন হোক। চীন যদি মাওবাদী ও সোশ্যালিস্ট কমিউনিস্ট পার্টিকে ইউএসএলের সাথে সমঝোতায় রাজি করাতে পারে তাহলে দেশটিতে আবারো চীনপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, কাজটি খুব সহজ নয়। দিল্লি চাইবে না কোনোভাবে এই সমীকরণ কাজ করুক।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement