২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
উৎসের উচ্চারণ

মালেক বিন নবীর উন্নয়নতত্ত্ব ও মুসলিম বিশ্বের চিন্তাসঙ্কট

মালেক বিন নবীর উন্নয়নতত্ত্ব ও মুসলিম বিশ্বের চিন্তাসঙ্কট - ছবি : সংগৃহীত

আধুনিক মুসলিম জ্ঞানকাণ্ডে মালেক বিন নবী (১৯০৫-১৯৭৩) গুরুত্বপূর্ণ এক নাম। আলজেরিয়ান এ দার্শনিক সমকালীন মুসলিম চিন্তার বিনির্মাণে আপন সক্রিয়তার জন্য বিখ্যাত। আলজেরিয়ার কন্সটান্টাইনের দারিদ্র্যপীড়িত এক এলাকা থেকে তার উঠে আসা। রক্ষণশীল ঐতিহ্য লালন করছিল তার পরিবার বহু পুরুষ ধরে। তার পড়াশোনার শুরু আলজেরিয়ার পাবলিক স্কুল থেকে। ১৯২৫ সালে স্নাতক সমাপন করে প্যারিসে যাত্রা করেন। লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ এ সফর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। দেশে কাজ শুরু করেন বিচার আদালতের কেরানি হিসেবে, ১৯২৭ সাল থেকে। সামান্য চাকরি, কিন্তু দেশের বাস্তবতা গভীরভাবে বোঝার চেষ্টায় সময়টি ছিল মগ্ন। ফ্রান্সে তিনি যেতে চেয়েছিলেন বিশেষভাবে। একটি বৃত্তি মিলে গেল। যা সংরক্ষিত ছিল প্রযুক্তিগত অধ্যয়নের জন্য। প্রকৌশলী হওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকলেন তিনি। ফ্রান্সে গিয়ে জড়িয়ে পড়লেন বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তায়। বিয়ে করলেন ফরাসি এক মেয়েকে।

ইসলাম কীভাবে জীবনের পুনর্জাগরণের পথ নির্মাণ করে, এর বয়ানে তিনি সরব হলেন তখন থেকেই। প্রকাশ করতে থাকলেন নিজের মতামত। অচিরেই মালেক বিন নবী একটি শ্রদ্ধেয় নাম হয়ে উঠল। ১৯৫৪ সালে আলজেরিয়ান বিপ্লবের ঘোষণার পরে তিনি যখন কায়রোতে চলে এলেন, তাকে বরণ করল কায়রো। সেখানে তার বুদ্ধিবৃত্তিক জোরদার কণ্ঠস্বর বাঙময় হতে থাকল। যা কায়রো থেকে উচ্চারিত হয়ে কম্পন তৈরি করত আলজেরিয়ার নগরে ও গ্রামে, ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক আয়োজনেও। ফরাসি অধীনতা থেকে আলজেরিয়া স্বাধীন হলো ১৯৬২ সালে। মালেক বিন নবী দেশে ফিরলেন এবং ১৯৬৭ সাল অবধি দেশটির উচ্চশিক্ষার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেন। পরে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে তিনি চিন্তার চর্চায় আত্মনিবেদন করলেন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, এর ফসল-সম্ভারের সৃষ্টি, সমৃদ্ধি, বিকাশ ও বিস্তারে নিয়োজিত হলেন।

দীর্ঘ দিন ধরে মুসলিম লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের সমাজে আত তাখাল্লুফ বা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অনগ্রসরতাকে সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রশ্নে ছিলেন বিভক্ত। মুসলিম দুনিয়ার সামাজিক স্থবিরতার জন্য কেউ দায়ী করেছেন অজ্ঞতা ও অশিক্ষাকে। কেউ দায়ী করেছেন প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবকে। কেউ আবার দায়ী করেছেন ঔপনিবেশিকতাকে। আত তাখাল্লুফ বা পশ্চাৎগামিতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার প্রচেষ্টাগুলো শেষ অবধি হতাশ হয়েছে প্রায়ই। এই সব প্রচেষ্টা মূলত মনোযোগী ছিল তাখাল্লুফের লক্ষণ ও ফলাফল অন্বেষণে। ভেতরগত সামাজিক কারণের প্রতি তাদের দৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেছে নেহাত কম। এসব অনুসন্ধানের আগে ও পরে আরব এবং মুসলিম বিশ্ব সমানমাত্রায় অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতায় ভুগছে।

বৃহত্তর অনগ্রসরতার প্রেক্ষাপটে আরব ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশের মনোযোগের প্রধান দিক হবে বৃহত্তর উন্নয়ন, এটিই ছিল স্বাভাবিক। তাদের মধ্যে মালেক বিন নবী একটি অগ্রগণ্য ও ব্যতিক্রমী অধ্যায়। তিনি স্বতন্ত্র সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের প্রশ্নে পদ্ধতিগতভাবে চৈন্তিক অবদানের কারণে। তার চিন্তাতরঙ্গিত প্রগাঢ় পৃষ্ঠাগুলো মুসলিম দুনিয়ার সামাজিক উন্নয়ন বিতর্ককে নতুন আয়তন দান করেছে। তাখাল্লুফ মোকাবেলায় মালেক বিন নবীর চিন্তা একক সামর্থ্যে একটি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের প্রদান করে। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের পথ ধরে একটি ব্যাপক দৃষ্টিকোণ সরবরাহ করেন বিন নবী, যা ভ‚গোলবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানীদের কাজের সাথে আত্মীয়তা রক্ষা করে। ফলে বিন নবীর দৃষ্টিভঙ্গি এই সব জ্ঞানমার্গ থেকে সমর্থিত হয়েছে নানাভাবে। আত তাখাল্লুফ বা পশ্চাৎপদতা ও প্রতিবন্ধিতার মোকাবেলায় মালেক বিন নবী আরব ও মুসলিম বিশ্বের উন্নয়ন এবং সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে যে প্রস্তাবনা পেশ করেন, তা মুসলিম দুনিয়ার তাখাল্লুফকে উপনিবেশবাদ, অজ্ঞতা বা দারিদ্র্যের পরিণতি মনে করে না; বরং একে deprivation of civilization বা সভ্যতার বঞ্চনা হিসেবে নির্ণয় করার ক্ষেত্রে সফল হয়। এ সমস্যার প্রতিবিধানে বৃহত্তর বিবেচনার জন্য বিন নবী পেশ করেন নিজের সুপারিশগুলোও।

তার স্মৃতিগ্রন্থ ‘memories of a witness on the century’ ধারণ করেছে তার বিচিত্র মতামত। এতে তুলে ধরেছেন তার বুদ্ধিবৃত্তিক যাত্রাপথের রূপরেখা। তার অন্বেষা ছিল ক্রিয়াশীল জ্ঞান-বিজ্ঞান। স্বদেশ ও ইসলামী দুনিয়ার ওপর ইউরোপীয় দখল, লুটমার ও আধিপত্যের সমাপ্তির তালাশে তিনি নিয়োজিত করেন চিন্তাকে। প্রথম ইউরোপীয় মহাযুদ্ধের (১৯১৪-১৮ খ্রি.) শুরুতে স্বাধীনতার চেতনা সবল হয়ে ওঠে আলজেরিয়ায়। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব সামনে আসে, তাদের বিকাশ ও সক্রিয়তা বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও সংগঠন প্রতিষ্ঠাকে নিশ্চিত করে। ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ও ন্যাশনাল আলজেরিয়ান মুভমেন্ট নবজাগ্রত স্বাধিকার চেতনার মশাল বহন করছিল। বেন বেল্লার নেতৃত্বে আলজেরিয়ার সর্বত্র ফরাসি শক্তির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে প্রবল প্রতিরোধ। গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ফরাসি দখলদারদের কদমকে কাঁপিয়ে দেয়া হয়। স্বাধীনতা আন্দোলন ক্রমেই জোরালো হতে থাকে। মালেক বিন নবী তখন আলজেরিয়ায় ফরাসি উপনিবেশ এবং সেখানকার রাজনীতিতে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাবের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তদন্ত করেন এর পেছনের কারণ নিয়ে। স্বাধীনতা আন্দোলনকে যা শক্তি সরবরাহ করছিল। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৬ সালের মধ্যে আলজেরিয়ায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। অন্য স্বাধীনতাকামীদের মতো মালেক বিন নবী এ জন্য ফরাসি অপশাসনকে দায়ী করেন। ফরাসিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদ জোরদার হয় বিশেষভাবে।

মালেক আলজেরিয়ায় চলমান আন্দোলনগুলোর ভুল ও সীমাবদ্ধতাকেও নিরীক্ষণ করেন। তার বয়ানে দেখেন অপরিণতি, ভারসাম্যহীনতা ও ভ্রান্তি। এর কারণ হিসেবে বস্তুনিষ্ঠ চিন্তার অভাবকে দায়ী করেন। ফ্রান্সের কাছ থেকে রাজনৈতিক অধিকার পাওয়ার আশায় আলজেরীয় নেতারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫ খ্রি.) প্রথম দিকে ফরাসিদের পক্ষ নেয়। তবে অচিরেই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। ১৯৪৩ সাল থেকে আন্দোলন হয় একমুখী; আর কিছু নয়, সরাসরি স্বাধীনতা। এ আন্দোলনের পথ ছিল চড়াই-উতরাইয়ে ভরা। ১৯৪৫ সালের ১ মে জনতার বিক্ষোভে ফরাসি বাহিনীর গুলি ও গণহত্যা, নিষ্ঠুর ফরাসি জেনারেল জেকুই ম্যাসুর বর্বরতা, স্বাধীনতাকামী নেতা মেসালি হাজকে গ্রেফতার ও তার অনুসারীদের বসতিগুলো পুড়িয়ে ফেলা, আট হাজার আলজেরীয়কে হত্যা, আলজেরিয়াজুড়ে ফরাসিদের ওপর ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের পাল্টা আক্রমণ, প্রচণ্ড যুদ্ধ- যা অব্যাহত থাকে ১৯৫৫ থেকে ১৯৬২ সাল অবধি। এর মধ্যে প্রাণ দিতে হয় আলজেরিয়ার সাড়ে তিন থেকে ১০ লাখ নাগরিককে। উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেয় ২০ লাখের অধিক মানুষ। অবশেষে আলজেরিয়ায় স্বাধীনতা এলো ১৯৬২-এর ১৮ মার্চ; ইভিয়ান চুক্তির মাধ্যমে।

স্বাধীনতার পর দেশে ফিরলেন মালেক বিন নবী। ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের নেতা আহমেদ বেন বেল্লা হলেন আলজেরিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি। তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অবলম্বন করছিলেন। এ প্রেক্ষাপটে একটি বিকাশমান প্রাগ্রসরতার মোড়ক উন্মোচনে মালেক বিন নবীর উদ্যম ও প্রয়াস ছিল বিরতিহীন। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে তিনি আহ্বান করেছেন প্রতিটি প্রহরে। উনিশ শতকীয় সংস্কৃতির মর্মমূলে ছিল তার দৃষ্টি। আপন সময়ে বিদ্যমান পৃথিবীকে বিশ্লেষণ করতে মনোযোগী ছিল তার কলম। এ বিশ্লেষণ ছিল অন্তর্দৃষ্টিময়। তিনি তালাশ করছিলেন সংস্কৃতির সারমর্ম ও সভ্যতার নবজন্মের সামর্থ্যকে। সংস্কৃতিকে তিনি সংজ্ঞায়িত করেন The Conditions of Renaissance (1948) গ্রন্থে। সংস্কৃতি তার বিচারে জনগণের হয়ে ওঠার উপায়। এর মধ্যে রয়েছে নান্দনিক, নৈতিক, বাস্তববাদী ও প্রযুক্তিগত মূল্যবোধ। মূল্যবোধগুলো যখন স্পষ্ট হয়, তখন এর মধ্যে জন্ম নেয় বিভিন্ন সংজ্ঞা, সূত্র ও ধারণা। নতুন ধারণার জন্ম একটি গতিশীল সমাজের সমান্তরাল, এটি সমাজের অভ্যন্তরীণ জীবনীশক্তির সমার্থক, নতুন ধারণাগুলো সমাজ ও সভ্যতাকে প্রাণবন্ত অগ্রগতির দিকে নিয়ে যায়।

বিন নবীর আরেক বিখ্যাত গ্রন্থ The Question of Culture (1954) বিশ্লেষণ করে সামাজিক অবনতি আর স্থবিরতাকে। সমাজে বিদ্যমান ধারণাগুলোর সাথে সামাজিক অনগ্রসরতার সম্পর্ক প্রগাঢ়। সমাজ সংগঠনে জীবনীশক্তি ও রক্ত চালনা জরুরি। বিদ্যমান ধারণাগুলো হয় একে চলমান রাখে, নয় গতিরোধ করে। প্রতিটি সমাজে টিকে থাকা ধারণাগুলোকে অনুসরণ করে অন্যান্য সামাজিক বৈশিষ্ট্য। সামাজিক অভিযোজনে থাকে ধারণার প্রভাব। সমাজ যেভাবে ও যে প্রক্রিয়ায় বিকশিত হয়, এর চরিত্র নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ বহু উপাদান থাকে ধারণার পকেটে। যে সমাজ চলমান, সে চলমান চিন্তাগুলোর সাথেই চলমান। এমনতর এক সমাজের বিকাশে থাকে নানা পর্যায়। এসব পর্যায় প্রকৃতপক্ষে সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের বিভিন্ন রূপ। এরকম একটি পর্যায় হতে পারে আন নাহদা বা রেনেসাঁ, যদি সমাজ বিকাশের কোনো স্তর আন নাহদা (রেনেসাঁ) হয়ে ওঠে, এর মানে দাঁড়াবে সমাজ সেই পর্যায়ে এসে চমৎকার ধারণাগুলোর একটি স্থাপনা ও ব্যবস্থার ফসল উপভোগ করছে। ধারণাগুলো নিশ্চিত করেছে একটি ক্রিয়াশীল সিস্টেম, যা সেই নির্দিষ্ট সমাজের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার একটি উপযুক্ত সমাধান দিতে পারে।

বিন নবী দেখান ধারণার প্রভাবক শক্তিকে। তার বিচারে ধারণারা একই উপায়ে সমাজে প্রভাব বিস্তার করে না। দুই ধারণার প্রভাব কাজ করবে দুই উপায়ে। হয় তারা সামাজিক জীবনের মাত্রা ও মানের প্রবৃদ্ধির কারণ হবে; অথবা তারা হবে সমাজে সংক্রামক কারণগুলোর কারণ বা ভূমিকা। দ্বিতীয় স্তরের ধারণাগুলো সামাজিক বিকাশ ও বৃদ্ধির দুশমন। এরা সামাজিক অগ্রগামিতাকে কঠিন ও অসম্ভব করে তোলে। মুসলিম দুনিয়া এরকম ধারণাগুলোর চারণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। উনিশ শতকে জাতিগুলোর সম্পর্ক নির্ভর করত একটি জাতির অবস্থান ও ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে। দেখা হতো কারখানা, কামান, নৌবহর এবং স্বর্ণ মজুদের পরিমাণ। বিংশ শতাব্দী একটি নতুন বিকাশের সূচনা করে। যেখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মূল্যবোধ হিসেবে আইডিয়া বা ধারণাগুলোকে উচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়। উন্নয়নের এই নতুন মাত্রাকে দৃঢ়ভাবে বুঝতে পারেনি অনুন্নত অনেক দেশ। তারা আটকে ছিল হীনম্মন্যতার কমপ্লেক্সে। পুরনো উন্নয়ন ধারণার পেছনে তারা দৌড়াচ্ছিল, ভাবছিল বস্তুর ওপর ভিত্তি করে ক্ষমতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হবে। এ ছিল এক বিকার ও পরাজিত মোহ। তারা উন্নয়ন দেখছিল যন্ত্রে, দৃশ্যমান স্থাপনা ও রূপে।

মুসলিমরা নিজেদের দেখছিল অনুন্নত অঞ্চল ও ভ‚খণ্ডের বাসিন্দা হিসেবে। তাদের প্রধান এক অংশের মনে ইতোমধ্যে এই ধারণা বাসা তৈরি করে থাকবে যে, তারা উন্নত দেশে বসবাসকারীদের চেয়ে নিকৃষ্ট। উন্নতদের চেয়ে তারা যে আলাদা, সেটি ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে নয়, অন্য কারণে। কী সেই কারণ? হীনম্মন্যতার ফলস্বরূপ মুসলিমরা ধরে নিলো এর কারণ বস্তুর ব্যবহার। তাদের আছে উন্নত বস্তু ও ব্যবহার সামগ্রী, আমাদের নেই। নিজেদের তাখাল্লুফের জন্য তারা দায়ী করল নিজেদের অস্ত্রের অভাব, যন্ত্রের অভাব, ব্যাংকের অভাব, উন্নত স্থাপনায় সুসজ্জিত শহরের অভাবকে। এই অভাববোধ তাদের আরো বেশি হতাশা ও আরো বেশি হীনম্মন্যতার দিকে হাঁকাতে থাকল। তাদের মনস্তাত্ত্বিক স্তরে অনগ্রসরতার বোধ ও সেইজনিত বেদনা ও হতাশা কাজ করছিল। বস্তুত মনোজাগতিক সেই বিকারের গোড়ায় ছিল ধারণার বিকার।

মানসিক এই স্তর থেকে জন্ম নেয়া কাজ সামাজিক কার্যকারিতা হারাতে থাকে। চেষ্টাগুলো ফলাফল দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। হতাশা ও প্রান্তিকতা নানাভাবে মাথা তুলতে থাকে। নিজেদের তাখাল্লুফের সমাধান একটি অসম্ভব ব্যাপার হিসেবে বিবেচিত হতে থাকল অনেকের কাছে। অনেকেই হয়ে উঠলেন নির্বিচারী। কিন্তু মুসলমানদের উচিত ছিল বস্তুর থাকা না থাকাকে অনগ্রসরতার জন্য দায়ী না করা। তাদের তাখাল্লুফ ধারণার স্তরের সাথে সম্পর্কিত। সেখানে তাদের দৃষ্টি ও মনোযোগ ছিল সবচেয়ে কম। যদিও নতুন বিশ্বের বিকাশ ক্রমবর্ধমানভাবে আদর্শগত এবং তা বুদ্ধিবৃত্তিক মানদণ্ডের ওপর নির্ভর করে। মুসলিমরা পাশ্চাত্যের অনুকরণ করেছে নানা দিক থেকে। কিন্তু বুঝতে পারেনি পশ্চিমা উন্নয়নের প্রাণভোমরাকে। পশ্চিমা সভ্যতার উন্নয়নের প্রাণবস্তু হলো পশ্চিমাদের কর্মবৃত্তিক ব্যাপকতা এবং চিন্তাবৃত্তিক সক্রিয়তা। এই দুই জায়গায় মুসলিমরা থেকে গেছে স্থানুর মতো। মালেক বিন নবী মুসলিম সমাজের সমালোচনা করেছিলেন নানা দিক থেকে। নিজেদের অনগ্রসরতার জন্য একদল মুসলিম নিজেদের পূর্বপুরুষদের দ্বারা নির্মিত সভ্যতাকে তিরস্কার করেছে। আরেক দল মুসলিম পুরাতন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার চার পাশে ঘুরে চলেছে, তারা নতুনের সাথে অগ্রগতির সেতু তৈরি না করে অতীতের মাটিতে গুপ্তধনের তালাশে ব্যস্ত থেকেছে। উভয়েই ছিল ভুল।

মালেক বিন নবী দেখান, ইসলামের স্বর্ণযুগে যা অর্জন করা হয়েছিল, তার আলো ও ঐতিহ্য আমাদের খুব দরকার; কিন্তু আজকের পরিপ্রেক্ষিতে যা জরুরি, সেটি হলো নবীদের দ্বারা বাস্তবায়িত মডেলটি বোঝা ও ধারণ করা, কুরআন যাকে বয়ান করেছে। তাদের পরিবর্তন-ব্যবস্থায় নিহিত রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হওয়া জরুরি। ব্যাখ্যাগুলোর পুনর্পাঠ জরুরি ও আরো জরুরি হলো সেগুলোর প্রয়োগ।

সমকালীন সমাজকে সমৃদ্ধ করা ইসলামে গতিশীলতার অংশ। কিন্তু সেই গতিশীলতা নিশ্চিত করছে না নিছক অতীতচারী কিংবা হতাশাবাদী; কোনো অংশই। ফলে স্বআরোপিত মনের উপনিবেশ মুসলমানদের নৈতিক ও মানসিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করেই চলছে। মনের বন্দিত্ব মানসিক অবক্ষয় নিশ্চিত করে, এটি যেমন সত্য, তেমনি মালেকের মতে নৈতিক অবক্ষয় বুদ্ধিবৃত্তিক অচলাবস্থা ও ভ্রষ্টতা ডেকে আনে। এ ধারণাকে তিনি ব্যাখ্যা করেন Islam in History and Society (1954) গ্রন্থে।

আরব, ইসলামিক এবং পশ্চিমা সাংস্কৃতিক বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য অধ্যয়ন করেছিলেন বিন নবী। সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়ন ও অবনমন সম্পর্কিত তার উপলব্ধি প্রকাশ করেছিলেন স্থিতধী ভাষ্যে। ইবনে খালদুন, আল্লামা ইকবাল প্রমুখের উত্তরাধিকার অবলম্বন করলেও চিন্তায় তার মৌলিকত্ব ছিল দৃষ্টিগ্রাহ্য। বস্তুগত উন্নয়ন চিন্তার সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা তিনি ধরিয়ে দেন। যা মুসলিম দুনিয়াকে উন্নয়নের যথার্থ সড়ক থেকে রেখেছে অনেক দূরে। উন্নয়ন শুরু হবে উন্নয়ন ধারণার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে। যার কেন্দ্রে আছে মানুষ, মানুষের চিন্তা ও যাপনের অগ্রসর মডেল; মানুষ ও সমাজের সামর্থ্য বৃদ্ধি। বিন নবীর ধারণাগুলো চিত্তাকর্ষক ও অসাধারণ। সমাজ ও সভ্যতা অধ্যয়ন এবং মুসলিমদের অবনমনকে অতিক্রমের প্রশ্নে তার প্রস্তাবনা বিশেষভাবে দাবি করে আমাদের মনের স্বাধীনতা, চিন্তার সামর্র্থ্য ও কাজের যথার্থতা, যার অভাব একটি অনগ্রসর জাতিকে উঠে দাঁড়াতে দেয় না।

লেখক : কবি, গবেষক

71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement