২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
অবলোকন

আরাকান আর্মি কি বাংলাদেশের জন্য হুমকি?

আরাকান আর্মি কি বাংলাদেশের জন্য হুমকি? - ছবি : সংগৃহীত

মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে রাখাইনে যুদ্ধরত আরাকান আর্মির সাফল্যগাথা নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাঝেমধ্যে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। কিন্তু এই সশস্ত্র গ্রুপটির কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বা স্বার্থের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই গভীর মূল্যায়ন কমই হয়। রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পেছনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ভ‚মিকা সবাই জানেন, কিন্তু এ সময় আরাকান আর্মি বা তাদের রাজনৈতিক ফ্রন্টের ভ‚মিকাও মূল্যায়ন করার দাবি রাখে। এই ভ‚মিকা কেবলই মিয়ানমার বা রাখাইনে থাকলে সেটির তাৎপর্য হয়তো বা এ দেশের জন্য খুব উল্লেখযোগ্য হতো না। কিন্তু এই সশস্ত্র দলটি তাদের সংযোগকে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গ্রুপ পর্যন্ত সম্প্রসারণের উদ্বেগজনক খবর আসছে। এমনকি এর সাথে বড় বৈশ্বিক শক্তির সংশ্লেষ থাকার খবরও পাওয়া যাচ্ছে, যা এ দেশের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ তৈরি করছে।

ইতিহাস ও বর্তমান
আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যভিত্তিক একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেটি ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) এর সামরিক শাখা। আরাকানিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি তুলে এক যুগ আগে এর সাংগঠনিক উদ্যোগ শুরু হয়। রাখাইন নৃগোষ্ঠীর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এই সংগঠন নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সামনে তুলে আনতে চায়। বর্তমানে এ সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন কমান্ডার ইন চিফ মেজর জেনারেল তোয়ান মারত নাইং এবং ভাইস ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিয়ো টোয়ান আং।

কাচিন সঙ্ঘাতে আরাকান আর্মি কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির (কেআইএ) সাথে মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী-তাতমাদো এর বিরুদ্ধে লড়াইও করেছে। আরাকান আর্মির বেশির ভাগ সৈন্য মূলত কেআইএ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষিত। ২০১৪ সাল থেকে আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে নিজস্ব প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করে। মিয়ানমার পিস মনিটরের মতে, ২০১৪ সালে আরাকান আর্মির দেড় হাজারের বেশি সৈন্য ছিল। ইরাবতী পত্রিকা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে উল্লেখ করে যে, আরাকান আর্মির বেসামরিক শাখায় আড়াই হাজারের বেশি সৈন্য এবং ১০ হাজার কর্মী রয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আরাকান আর্মির প্রধান দাবি করেন যে, গোষ্ঠীটির ৩০ হাজারেরও বেশি সৈন্য রয়েছে। এর অস্থায়ী সদর দফতর কাচিন রাজ্যের লাইজায় যা চীনা সীমান্তের অদূরে এবং এর উপর বেইজিংয়ের বিশেষ প্রভাব দৃশ্যমান হয়।

সঙ্ঘাত ও সমঝোতা
আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার জান্তার আনুষ্ঠানিক কোনো যুদ্ধ বিরতি নেই। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে দুই পক্ষের মধ্যে সময়ে সমঝোতা বা যুদ্ধ বিরতি হয়। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চলাকালে এবং তাদের বাংলাদেশ ভ‚খণ্ডে ঠেলে দেয়া আর রোহিঙ্গা ভূমিগুলোতে রাখাইনদের দখল প্রতিষ্ঠার কাজে আরাকান আর্মি ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠনের ভ‚মিকা ছিল তাতমাদোর একই কাতারে। সু চির সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদায় করার পর সামরিক জান্তাবিরোধী গণআন্দোলন এবং পরবর্তীতে জাতীয় ঐক্য সরকার গঠন ও তাদের মিলিশিয়ার সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়। এই সময় আরাকান আর্মি প্রতিরোধকারীদের সাথে কোনো যোগসূত্র রাখেনি। অধিকন্তু এই সময়টাতে আরাকান আর্মিকে রাখাইনে একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তেমন একটা বাধা দেয়নি; আবার এই সঙ্ঘাতমুখর সময়েই আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে অঘোষিত যুদ্ধ বিরতি পালন করে।

তাতমাদো এর সাথে আরাকান আর্মির এই সম্পর্কে মধ্যস্থতার ভ‚মিকায় থাকতে পারে বেইজিংয়ের বিশেষ প্রভাব। আরাকান আর্মির পূর্বসূরি সংগঠনের নেতা বউ রাজা ও তার সহযোগীদের আন্দামানে নিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এই সংগঠনের নেতাদের সাথে ভারতের সাথে অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয় এবং চীনের কাছাকাছি এক সংগঠনে পরিণত করে এটিকে। মিয়ানমারের ব্যাপারে চীনের গত কয়েক দশকের নীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশটি মিয়ানমারের সব সরকারের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখেছে আবার একই সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোর সাথেও সম্পর্ক রক্ষা রেখেছে। মিয়ানমার থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ওয়া স্টেটের সব কর্মকাণ্ড চীনা পৃষ্ঠপোষকতায় চালিত হয়, যেখানে নেপিডোর কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই। একইভাবে আরো অনেক জাতিগত গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রিত ভ‚খণ্ড রয়েছে যাদের সাথে একদিকে মিয়ানমারের সরকারের যুদ্ধ রয়েছে, অন্য দিকে তাদের সাথে গভীর সম্পর্ক বজায় রেখেছে বেইজিং। মিয়ানমার সরকারের চীনের পাশাপাশি দিল্লি ও মস্কোর সাথে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে এর ভ‚মিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়।

এর মধ্যে সু চির ঐক্য সরকার ও তার মিলিশিয়া বাহিনী আর কয়েকটি স্বাধীনতাকামী দলের সাথে বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রক সম্পর্ক নেই। এসব সংগঠনকে জান্তাবিরোধী লড়াইয়ে সরাসরি সমর্থন দিচ্ছে পশ্চিমারা। স¤প্রতি আমেরিকান এক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যেসব সংগঠন সরাসরি চীনা প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় তাদের সবাইকে পশ্চিমারা সামরিক সহায়তা দান করবে। আর তাদের নেগেটিভ তালিকার মধ্যে ওয়া স্টেট কেপিআই ও আরাকান আর্মিও রয়েছে। চীনের কাছে তাদের বিকল্প জ্বালানি পাইপলাইন রুটের জন্য রাখাইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কারণে বেইজিং সামরিক জান্তার পাশাপাশি আরাকান আর্মির সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলে বলে মনে করা হয়।

বাংলাদেশের জন্য কি গুরুত্বপূর্ণ
আরাকান আর্মির সাথে চীনের সুসম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য আপাতত তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হবে না। কিন্তু আরাকান আর্মির বাংলাদেশ নীতিটিই ঢাকার নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। আরাকান আর্মি ও এর রাজনৈতিক সংগঠন ইউএলএ-এর সা¤প্রতিক ইতিহাসে কখনো রোহিঙ্গাদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল না। রাখাইনরা কয়েক শত বছর ধরে আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের তাচ্ছিল্য করে বাঙালি বলেই অভিহিত করে আসছে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত গণহত্যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সমান্তরাল ভ‚মিকা ছাড়াও আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা মূল ধারার সংগঠনের সাথে সা¤প্রতিক সময়ে সঙ্ঘাতে লিপ্ত হয়েছে একাধিকবার। আরাকান আর্মিকে রাখাইনের বড় অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে দিয়েছে জান্তা সরকার। আর এর মধ্যে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরএসও নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে একাধিকবার হামলা চালিয়েছে। যদিও প্রতিবারই তারা পাল্টা আঘাতের শিকার হয়েছে।

বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীদের সাথেও মাঝেমধ্যে সঙ্ঘাতের ঘটনা ঘটে আরাকান আর্মির। ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট আরাকান আর্মি এবং বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে বান্দরবান জেলার থানচির বড় মোদক এলাকায় উভয় পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। বাংলাদেশ ভ‚খণ্ডে বিজিবি তাদের ১০টি ঘোড়া বাজেয়াপ্ত করলে ২০১৫ সালের ২০ আগস্ট আরাকান আর্মি বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সাথে সঙ্ঘর্ষে লিপ্ত হয়। ২০১৬ সালের অক্টোবরে উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী ও বার্মিজ নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের পর আরাকান আর্মি একটি প্রেস বিবৃতি প্রকাশ করে বলে যে, তারা ‘বর্বর বাঙালি মুসলিম সন্ত্রাসী’ আর এই সহিংসতাকে উত্তর আরাকানে বাঙালি ইসলামিক মৌলবাদী জঙ্গিদের তাণ্ডব বলে অভিহিত করে আরাকান আর্মি।

আরাকান আর্মির প্রায় পুরোটাই রাখাইন জনগোষ্ঠী দিয়ে তৈরি। এদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের একাধিক নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠীর সাথে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজাতি পয়েন্টগুলোকে কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারের সামরিক গোয়েন্দারা বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে আরাকান আর্মিকে ব্যবহার করতে চায়। যদিও বাংলাদেশের অনেকেই মনে করে যে, আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে যাতে তারা বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে কৌশলগত বন্ধু হতে পারে। তবে সত্য হলো আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের অংশ হিসেবে কাজ করে বলে মনে হয়।

রহস্যজনক তৎপরতা
সাম্প্রতিক সময়ে, মানব পাচারকারী গোষ্ঠীর তাৎপরতার ব্যাপক বৃদ্ধি দেখা গেছে রাখাইনের ভেতরে থাকা রোহিঙ্গাদের অন্য দেশে পাঠানোর জন্য। এই সব পাচারকারী দল আরাকান আর্মি বা মিয়ানমার সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর হঠাৎ করেই যে আরাকান আর্মি তাদের শক্তি ও অস্ত্রশস্ত্র বৃদ্ধি করতে শুরু করেছে তা কোনো না কোনো অবয়বে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া একটি বিদ্রোহী সংগঠনের পক্ষে অসম্ভব বলে মনে করা হয়। একইভাবে, তারা বাংলাদেশের ভ‚মিতেও তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হলো, বেশির ভাগ বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য অঞ্চলে তাদের গোপন নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছে, যা তাদের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা থাকার বিষয়টির ইঙ্গিত দেয়।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও আরাকান আর্মির মধ্যে একটি মৌখিক চুক্তি হয়েছিল বলে জানা যায় যার ফলে মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের এক বছর পর্যন্ত সময়ে প্রায় সব বিদ্রোহী মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যোগ দিলেও আরাকান আর্মি ছিল নীরব। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এই জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের গ্রেফতার ও হয়রানি করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধু মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত, বুথিদাউং, রাথেডাং, এএনএন এবং পেলাত্তোয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ সময় আরাকান আর্মির রাজনৈতিক শাখা, ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) এবং তাদের ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা নিরাপদে বাস করে যখন আরাকান আর্মির সাথে লড়াইয়ের নামে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গানশিপ ব্যবহার করেছে, বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে, বাংলাদেশ সীমান্তে হেলিকপ্টার থেকে মর্টার নিক্ষেপ করেছে। এসব কারণে জান্তা ও আরাকান আর্মির এই যুদ্ধ খেলাটি একটি সম্পূর্ণ নাটক বলেই অনেকের কাছে মনে হয়।

প্রাথমিকভাবে, মিয়ানমার সরকার আরাকান আর্মিকে গোপনে সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যাতে তারা আরাকানে জাতিগত নির্মূলের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে। গত ২২ অক্টোবর আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা সংহতি সংস্থার (আরএসও) ক্যাম্পে হামলা চালায়। এতে আরএসও’র ১৩ সদস্য নিহত হয়। প্রশ্ন হলো, যদি আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের পক্ষে এবং তাতমাদোর বিরুদ্ধে থাকে তাহলে কেন তারা আরএসও’র ওপর হামলা করল? তাদের ক্যাম্প দখলের ব্যর্থ চেষ্টা করল?

আরাকান আর্মি বর্তমানে বাংলাদেশ সংলগ্ন মিয়ানমারের অনেক সীমান্ত চৌকি নিয়ন্ত্রণ করছে, যা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কোনো যুদ্ধ ছাড়াই তাদের কাছে ছেড়ে দেয়। মিয়ানমার বাহিনী বাংলাদেশকে চাপ দিতে আরাকান আর্মিকে বেছে নিয়েছে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন। এই গ্রুপটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে তিনটি জিনিস করছে। প্রথমত, বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে রাখাইনে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করা। আর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা ও অন্যান্য মাদক সরবরাহ এবং চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ কামাই করা। এ ছাড়া আরাকান আর্মি পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু উপজাতীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয় এবং তাদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখে। একই সাথে জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে আরাকান আর্মি গোপনে সাহায্য করে যাতে তারা রোহিঙ্গাদের শরণার্থী করে রাখতে এবং বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে রাখতে পারে।

আরাকান আর্মি তাদের মাফিয়া কার্টেল এবং মানব পাচারকারী ছোট ছোট দল ব্যবহার করছে যাতে বাকি রোহিঙ্গাদের আরাকানের মাটি থেকে নির্বাসিত করা যায়। তারা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে কর আদায় করে এবং ভেতরে ভেতরে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও ধর্ষণ করে রাখাইনজুড়ে আইডিপি ক্যাম্পের বাইরে তাদের রাখাইন ত্যাগ করতে বাধ্য করে। তারা মংডুতে রোহিঙ্গা জনগণের একজন বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতাকেও হত্যা করেছে। ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, আরাকান আর্মি তাদের নিজেদের রাখাইন জনগোষ্ঠীর এলাকার চেয়ে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় বেশি সক্রিয়, যা সরাসরি বার্মার জান্তার সাথে তাদের সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়।

অভিযোগ রয়েছে, আরাকান আর্মি একটি ড্রাগ মাফিয়া পরিচালনা করছে, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশিক্ষণ ও রসদ সরবরাহ করছে বাংলাদেশী পার্বত্য অঞ্চলের অভ্যন্তরে। তারা বাংলাদেশে প্রতি মাসে কমপক্ষে ৫০ লাখ পিস ইয়াবা সরবরাহ এবং বিক্রি করে। আর নিজেদের উৎপাদিত আফিম বিক্রি করতে বাংলাদেশ ভ‚খণ্ডকে ব্যবহার করে। যেহেতু তারা আফিম চাষ করে তাদের জমিতে তাই এটা অসম্ভব নয় যে, তারা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে, সিগারেট, ইয়াবা থেকে আফিম পর্যন্ত সব চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি তারা গরু চোরাচালানের টাকাও সংগ্রহ করে। প্রতি মাসে তারা কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা উপার্জন করে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে। বিস্ময়কর তথ্য হলো যে, মিয়ানমার জান্তা সামরিক বাহিনীর মেডিক্যাল কোর ল্যাব-এ ইয়াবা উৎপাদন করা হয় আর আরাকান আর্মির সাথে যৌথভাবে তা বিক্রির নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হুমকি হলো, আরাকান আর্মি পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু উপজাতি যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে আর একই সাথে তারা অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় অবাধে বিচরণ করছে। আরাকান আর্মির সদস্যদের অনেক আত্মীয়স্বজন রয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে। এক তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় ছয় হাজার যুবক সক্রিয়ভাবে কাজ করছে যারা আরাকান আর্মির কাছ থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছে। আরাকান আর্মি চাইলে তাদের দিয়ে সর্বাত্মক গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে পারে। বান্দরবানের গহিন জঙ্গলের অনেক স্থানেই রয়েছে আরাকান আর্মির সদস্যরা। রাঙ্গামাটি এমনকি খাগড়াছড়িতেও তাদের অবস্থানের খবর পাওয়া যায়। এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য সত্যিই ভীতিকর। বিশেষত তাদের সাথে একটি বৃহৎ শক্তির সংবেদনশীল সম্পর্ক থাকায় বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা উদ্বেগ বাড়ছে।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement