১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
তৃতীয় নয়ন

একটি লেখা প্রসঙ্গে

একটি লেখা প্রসঙ্গে - ছবি : নয়া দিগন্ত

বিশিষ্ট লেখক-অনুবাদক অধ্যাপক আবদুস সেলিম প্রতি বৃহস্পতিবার দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে তার স্মৃতিকথা ‘স্মৃতির অতলতলে’ লিখছেন ধারাবাহিকভাবে। এর প্রথম কিস্তিতে (২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ সাল) তিনি ১৯৭২ ও ’৭৮ সালে তার কলকাতা সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এতে বলছেন, বিখ্যাত সাহিত্যিক ও কবি বুদ্ধদেব বসু প্রসঙ্গে। ‘(তার স্ত্রী) প্রতিভা বসুকে দেখলাম এক উচ্ছল প্রাণবন্ত নারী হিসেবে। আমাদের সাথে তাদের সীমিতভাবে সাহিত্যালোচনা হলেও মূল আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ঘুরেফিরে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের পরিস্থিতি। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু একটি রাজনৈতিক ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যেটি আমাদের দু’জনের কাছেই (অপরজন লেখক মরহুম আবদুল মান্নান সৈয়দ-প্রবন্ধের লেখক) প্রীতিকর শোনায়নি। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের) শিল্পসাহিত্য ও রাজনীতি যে পথে এগোচ্ছিল, তা বাঙালি ও বাংলা ভাষার জন্য ঠিকই ছিল; কিন্তু বর্তমানে ভারত বা পশ্চিমবঙ্গের সাথে অধিক মাখামাখিতে সেটি কতটা স্বশাসনিক থাকবে বলা যায় না। কারণ একটি বিশাল দেশের ছত্রছায়াতে থেকে ক্ষুদ্র বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবেই ওই বিশাল দেশের রাজনীতি ও শিল্পসাহিত্য ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়বে; বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ভাষা যেহেতু একই। আমরা বিষয়টিকে তখন ‘ইভেসিভ বা পরিহারযোগ্যভাবে গ্রহণ করেছিলাম।’

আবদুস সেলিম ও আবদুল মান্নান সৈয়দের কাছে কবি বুদ্ধদেব বসুর ওপরের কথাটা তখনকার পরিস্থিতিতে ভালো না লাগাই স্বাভাবিক। তবে পরবর্তীকালে বোধ হয় আমরা অতটা সতর্ক থাকতে পারিনি সে বিষয়ে। তাই আজ রাজনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিশেষ পড়শিদের এত বেশি উৎপাত। বুদ্ধদেব বসু মূলত ‘বাঙাল’ বা এই বাংলাদেশের মানুষ। তার ছোটবেলা কেটেছে বিক্রমপুর ও নোয়াখালীতে। পরে পড়েছেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই তার টান থাকা স্বাভাবিক বাংলাদেশের প্রসঙ্গে। কলকাতায় গিয়ে এত দিন পরও তাই এ দেশকে ভুলতে পারেননি। অতএব, ‘ঘটি’ আর ‘বাঙালের’ দ্ব›দ্ব সম্পর্কে তিনি ভালোই ওয়াকিবহাল ছিলেন।

বুদ্ধদেব বসু বিখ্যাত ‘কল্লোল গোষ্ঠী’র লোক প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্তের মতো নন। তবে তিনি এই বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বাঙালি জীবনানন্দ দাশের মতো। জীবনানন্দ বরিশালের মানুষ।

অধ্যাপক আবদুস সেলিম ও মরহুম আবদুল মান্নান সৈয়দ স্বাভাবিকভাবেই দেখা করতে আগ্রহী ছিলেন কবি বিষ্ণু দে’র সাথে। আবদুস সেলিম লিখছেন, কিন্তু আলাপচারিতার একপর্যায়ে আলাপের পরিবেশটা বেশ ভারী হয়ে এলো- যখন বিষ্ণু দে বলেন, “দেশ স্বাধীন করার পর আপনাদের কবি-সাহিত্যিকদের পরবর্তী অগ্রগণ্যতা হওয়া উচিত আপনাদের বাংলা ভাষার পরিশুদ্ধি। যেমন- পূর্ববাংলার বাংলা ভাষা থেকে আব্বা, আম্মা, পানি জাতীয় ফারসি বা আরবি শব্দগুলোর পরিবর্তে বাবা, মা, জল শব্দ ব্যবহার নিশ্চিত করা। আমরা দু’জনই, সৈয়দ ভাই ও আমি, প্রাথমিকভাবে একটু হতবাক হয়েছিলাম এবং ফলে তাৎক্ষণিক তখন কিছু বলতে পারছিলাম না। তেমনি বলার ঔচিত্য নিয়েও দ্বিধান্বিত ছিলাম; কারণ যে মানুষটি এ কথা বলছেন তিনি অবশ্যই আমাদের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, যার কবিতা পড়ে দীর্ঘ দিন আমরা যারপরনাই মোহাচ্ছন্ন। অনেকটা পরে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ উত্তর দিলেন, এ কাজটি আমাদের কাছে তেমন জরুরি নয় এ কারণে যে, আমরা যে জীবনযাপনে অভ্যস্ত, তাতে এসব শব্দ আমাদের সঙ্গী হয়ে গেছে- এর পরিশুদ্ধির কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে এসব শব্দের বিকল্প হিসেবে বা সমার্থকরূপে কেউ যদি বাবা, মা বা জল ব্যবহার করে, তাতেও আমাদের কোনো সমস্যা নেই।’ আমি নিজেও হতবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে, ভাষা তো আসলে সদাসঞ্চরমান যে ভাষা অপর ভাষা থেকে যত বেশি গ্রহণ করতে পারে সে ভাষাই তো তত সমৃদ্ধ হয়। তা ছাড়া ভাষা তো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কোথায় যেন একটা খটকা লাগল- বুদ্ধদেব বসু কি এমন বিষয়েই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন!

বিষ্ণু দে যখন মারা যান, (সম্ভবত ১৯৭৯ সালে) তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (আবদুস সেলিমের মতো) ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। এক সহপাঠী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘জানিস, বিষ্ণু দে আমাদের স›দ্বীপের লোক।’ তবে বিষ্ণু বাবুর জীবনীতে তার জন্মস্থান ‘কলকাতা’- এটিই লেখা আছে। এখন মনে হয়, সে সহপাঠীও সেলিম- সৈয়দের বা আরো অনেকের মতো ‘মোহাচ্ছন্ন’। এ জন্যই সে বলেছিল, বিষ্ণু দে আমাদের বাংলাদেশের মানুষ! মোহ মানে অতিরিক্ত কিছু যা থাকা অনুচিত। আর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যে জবাব দিয়েছেন, তার শেষের কথা প্রসঙ্গে বলতে হয়, তিনি উদারতার পরিচয় দিলেও আসলে ‘জল’-এর মতো বহু শব্দ যতই আমরা চালু করার চেষ্টা করি না কেন, এ দেশের জনগণ তা গ্রহণ করে না- এমনকি ‘ঈশ্বর’কেও। তারা সাধারণত মুসলমান বলে ‘আল্লাহ’কেই চিনে; ‘ঈশ্বর’ বা ‘ভগবান’ নয়। আমাদের সমাজে শহুরে কিছু লোক সদুদ্দেশ্যে ‘ঈশ্বর’ ব্যবহার করলেও সাধারণ মানুষ তা মেনে নেয় না। কারণ তাদের কাছে ‘ঈশ্বর’ হচ্ছেন সম্প্রদায় বিশেষের; সবার ব্যবহৃত শব্দ নয়! তারা ‘বিধাতা’ বা ‘সৃষ্টিকর্তা’ কিংবা ‘স্রষ্টা’কেও মেনে নেবে, তবুও ‘ঈশ্বর’ তাদের আপন নয়! এ যেন ঢাবির সাধারণত অমুসলিম ছাত্রদের স্বেচ্ছায় জগন্নাথ হলের অঃঃধপযবফ হওয়ার মতো ঘটনা। অথচ আমরা ‘অসাম্প্রদায়িক’ হওয়ার কতই না কোশেশ করছি। এই বাস্তবতা থেকে সবার শেখার আছে অনেক।

কবি নরেশ গুহের সাথেও আবদুস সেলিমের দেখা হয় ১৯৭৮ সালে কলকাতায়। সেলিম লিখেছেন, তার সাথে আমাদের বেশ হৃদ্যতা হয়েছিল। তার কাছ থেকে পরবর্তীকালে কয়েকটি আড্ডায় জীবনানন্দ দাশ বিষয়ে আরো কিছু জেনেছিলাম। যেমন- জীবনানন্দ দাশ নাকি সব সময়ই রাস্তার উল্টো দিক থেকে পরিচিত কাউকে আসতে দেখলে রাস্তা পার হয়ে অন্য প্রান্তে চলে যেতেন, যাতে এ পরিচিতের সাথে কথা বলতে না হয়। কিন্তু একবার কবি নরেশ গুহ, তখন তিনি অপেক্ষাকৃত তরুণ-রাস্তার উল্টো দিক থেকে জীবনানন্দকে আসতে দেখে যখন ভাবছেন, কবি তাকে এড়িয়ে যাবেন, ঠিক তখনই তিনি সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন, কবি তা না করে সরাসরি তার কাছে এসে বললেন, ‘কিছু কবি আছে যারা মানুষের সাথে মিশতে পারে এবং মানুষও তাদের বেশ পছন্দ করে, যেমন নজরুল।’ যখন নজরুল অনেকটা পরিত্যক্ত, তখন জীবনানন্দের এই মানসিকতা প্রশংসনীয়। জীবনানন্দের ভক্তদের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।


আরো সংবাদ



premium cement
শিবপুরে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারীর নিহত চকরিয়ায় ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৩ গাজা মানবিক নরকে পরিণত হয়েছে : জাতিসঙ্ঘ প্রধান রাফা হামলার পরিকল্পনা ইসরাইলের ত্যাগ করা উচিত : চীন গাজা যুদ্ধে নতুন যে কৌশল অবলম্বন করল ইসরাইল হাসপাতালের শৌচাগারে মিলল নবজাতক শিশু ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিসিডিপি গঠন করা হবে : পরিবেশমন্ত্রী অননুমোদিত জমি ভরাট কার্যক্রমের সন্ধান পেলে দ্রুত ব্যবস্থার নির্দেশ ভূমিমন্ত্রীর ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক ব্যক্তিকে গলা কেটে হত্যা ইসরাইলকে পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাতের ব্যাপারে সতর্ক করলো আইআরজিসি

সকল