২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সমকালীন প্রসঙ্গ

দুনিয়ার নিকৃষ্টতম মিথ্যাবাদীর পরিণতি

দুনিয়ার নিকৃষ্টতম মিথ্যাবাদীর পরিণতি - ছবি : সংগৃহীত

খুব ছোটবেলা থেকেই মুসায়লামাতুল কাজ্জাব সম্পর্কে গল্প শুনে আসছি। লোকটি ছিল ভণ্ড নবী ও অবিরত মিথ্যা বলার ওস্তাদ। মানবজাতির ইতিহাসে বহু কুখ্যাত মিথ্যাবাদীর উপদ্রবে বিশ্ববাসী বহুবার আক্রান্ত হয়েছে। কোনো কোনো মিথ্যাবাদী আমির-ওমরাহ-রাজা-বাদশাহ-শাহেনশাহ-সম্রাট পর্যন্ত হয়েছিল এবং মিথ্যার আগুনে দগ্ধ করে জীবন্ত মানুষকে আলুপোড়া করে তারপর লবণ-মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে আলুভর্তা বানিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়েছে। কিন্তু মিথ্যাবাদী হিসেবে তারা কেউই মুসায়লামার মতো কুখ্যাতি অর্জন করতে পারেনি। কারণ কোনো মানুষের নামের সাথে মিথ্যাবাদী উপাধির লকব লাগানোর মতো কুর্কীতি কেবল মুসায়লামার পক্ষেই সম্ভব ছিল।

চলমান সময়ে আমার মনে হঠাৎ করে মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের কথা কেন মনে এলো তা বলার আগে এই নরপশু সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলা আবশ্যক। লোকটি আল্লাহর রাসূল সা:-এর জমানায় বাস করত এবং নজদ অঞ্চল অর্থাৎ আজকের সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ অঞ্চলের একজন মস্তবড় প্রভাবশালী গোত্রপতি ছিল। তার ভণ্ডামি-মিথ্যাচার ও সত্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করার যে কুখ্যাতি তা জাজিরাতুল আরব পার হয়ে সারা দুনিয়ার সর্বকালের ইতিহাসের কালিমা হয়ে আছে। আল্লাহর রাসূল সা:-এর ওফাতের পর লোকটি নিজেকে নবী দাবি করে বসে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তলোয়ার হাতে নেয়।

মিথ্যাবাদী কাজ্জাবের কারণে ইয়ামামার যুদ্ধে হাজার হাজার কুরআনের হাফেজ শহীদ হওয়ার পর প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা: যারপরনাই বিচলিত হয়ে পড়েন। কারণ ৬৩২ সালে রাসূল সা:-এর ওফাতের পর অনেক ভণ্ড নবী, কাফের ও মুশরিক একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে মদিনাকেন্দ্রিক মুসলিম খিলাফত তছনছ করে দিতে চাইল। মদিনার ওপর আক্রমণকারী প্রথম ব্যক্তিটির নাম ছিল তুলাইয়্যা বিন খুয়াইলিদ বিন নওফেল আল আসাদ। লোকটি প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় মুসলিমদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে বাধ্য হলেও তার কুকর্মের কারণে নব্য মুসলিম সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।

রাসূল সা:-এর জীবদ্দশায় বাইজানটাইন অর্থাৎ পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের অধীন সিরিয়ায় অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। নতুন খলিফা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের সাথে সাথে কোনোরকম কালবিলম্ব না করে হজরত আবু বকর রা: সিরিয়ায় অভিযানের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে বিরাট এক সৈন্যদল পাঠান। মদিনাকে অরক্ষিত ভেবে তুলাইয়্যা যখন যুদ্ধ শুরু করে ঠিক একই সময়ে ওমানে বনু আসাদের গোত্রপতি লাকিত বিদ্রোহ করে বসে এবং ওমান, ইয়েমেন উত্তর আরবের বিস্তীর্ণ অংশে প্রবল গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে নব্য খিলাফতকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এসব বিশৃঙ্খলার সুযোগে মিথ্যাবাদী কাজ্জাব ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে ৬৩২ সালের ডিসেম্বর মাসে ইয়ামামার প্রান্তরে মুসলিম সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর আগে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মুসায়লামা পরপর দু’টি যুদ্ধে মুসলিম সেনাপতি ইকরামা ও সুরাইবিল ইবনে হাসানাকে পরাজিত করে। ফলে ভণ্ড নবীর শিবিরে আনন্দের বন্যা বইতে থাকে এবং মুসলিম সৈন্যশিবিরে কান্নার রোল পড়ে যায়।

উল্লিখিত অবস্থায় খলিফা হজরত আবু বকর রা: হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদকে ইয়ামামার প্রান্তরে পাঠান এবং সেনাপতি ইকরামা ও সুরাইবিলকে নয়া সেনাপতির অধীন যুদ্ধ করার নির্দেশ দেন। ইয়ামামার যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে হাজার হাজার মুসলিম বীরযোদ্ধা শহীদ হন এবং মুসায়লামার ৩৩ হাজার সৈন্য মারা পড়ে। মুসাইলামা তার অবশিষ্ট সাত হাজার সৈন্য নিয়ে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে এবং একসময় সদলবলে ধ্বংস হয়। ভণ্ড নবীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অসংখ্য যুদ্ধকে সম্মিলিতভাবে রিদ্দার যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে, যার একটি যুদ্ধের নাম ইয়ামামার যুদ্ধ।

একজন মিথ্যাবাদীর অধীন ৪০ হাজার ভয়ঙ্কর অস্ত্রধারী মিথ্যাবাদী যোদ্ধার বিরুদ্ধে মুসলিম সৈন্যদের প্রায় দেড় বছরের অবিরত যুদ্ধে অগণিত মুসলিম সৈন্যের শহীদ হওয়া এবং ৪০ হাজার মিথ্যাবাদীর মৃত্যু ও তাদের সাহায্যকারী অনুরূপ আরো অর্ধলাখ মিথ্যাবাদীর মৃত্যুর মাধ্যমে যে সত্যের রাজনীতি, ন্যায়নীতির খিলাফত এবং সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা পরবর্তী প্রায় এক হাজার ২০০ বছর ধরে সারা দুনিয়ার রাজনীতির আলোকবর্তিকায় পরিণত হয়েছিল।

মুসায়লামাতুল কাজ্জাব সম্পর্কে আর বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না। এবার আমি আপনাদের বলব কেন আমার মনে হঠাৎ করে মহাকালের সর্ব নিকৃষ্ট এই মিথ্যাবাদীর নামটি এলো। আমার মনে প্রশ্ন এলো, আমাদের সমাজ-সংসার-রাষ্ট্র সর্বত্র যে ত্রিভুজ মিথ্যার কবলে পড়েছে তা মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের জমানায় ছিল কি না! বিষয়টি একটু জটিল বিধায় কিঞ্চিৎ বিস্তারিত আলোচনা আবশ্যক। প্রথমেই বর্তমান জমানার বাংলাদেশের কথা বলে নেই। আমরা বলতে গেলে সবাই মিথ্যায় বিভ্রান্ত হচ্ছি এবং মিথ্যার অত্যাচার ও জুলুমে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছি। সরকার-রাষ্ট্র-রাজনৈতিক দল-আমলা-কামলা-ব্যবসায়ী ও নিরীহ জনগণ পরস্পরকে মিথ্যাবাদী বলে গালি দিচ্ছে। চার দিকে মিথ্যার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠার কবলে পড়ে আমরা কমবেশি সবাই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছি। একদল মিথ্যা বলে বড়াই করছে- মিথ্যা বলার তৃপ্তিতে উল্লাস করছে আর অন্যদল মিথ্যা শুনতে বাধ্য হচ্ছে এবং মিথ্যা ভাষণে অতিষ্ঠ হতে হতে ক্রমেই মানসিক ভারসাম্যহীনতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

চলমান মিথ্যার রাজ্যের ভুক্তভোগী হিসেবে আমার মনটিও আপনার মতো প্রায়ই ভার হয়ে থাকে। বড় বড় পদে থেকে সম্মানজনক কুরসিতে বসে এবং জীবনের ডিপারচার লাউঞ্জ অর্থাৎ এক পা দুনিয়াতে এবং অপর পা কবরে রেখে মানুষ কিভাবে নির্বিকারচিত্তে অবিরত মিথ্যা বলতে পারে তা দেখে আমার বারবার মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের কথা মনে পড়ে যায়। আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে, বর্তমান যুগের মিথ্যাবাদীরা যেভাবে প্রতিপক্ষকে নির্বিচারে মিথ্যাবাদী বলছে তা কি মুসায়লামার যুগে সে নিজে এবং তার সহযোগীরা করত? অর্থাৎ মুসায়লামা কি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারত যে, তার প্রতিপক্ষ হজরত আবু বকর রা: অথবা হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা: তারই মতো মিথ্যা বলে (নাউজুবিল্লাহ)! অথবা সে কি কোনো দিন তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ করেছে?

দ্বিতীয়ত, আমার মনে এই প্রশ্ন বারবার উত্থিত হতে থাকে, কোনো একজন মিথ্যাবাদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের প্রায় দুই লাখ লোকের প্রাণহানি হলো এবং প্রায় দেড় বছর ধরে অবিরত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলো। সাধারণ জনগণ এবং তাদের নেতারা যদি মিথ্যাচার মেনে নিতেন এবং বর্তমান জমানার লোকজনের মতো নিজেদের চোখ কান বিবেক বুদ্ধি মিথ্যার কাছে বিসর্জন দিতেন তবে কি এমন পরিণতি হতো? কেন ইসলামী হুকুমতের ওপর কোনো বিদেশী শক্তি কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা আক্রমণ চালায়নি। কেন ইসলামের কথা বলে মিথ্যা ও ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে ভণ্ড নবী সেজে মুসায়লামা মাঠে নেমেছিল এবং কিভাবে ৪০ হাজার অস্ত্রধারী সৈন্য ও লাখ লাখ মিথ্যাবাদী অনুসারী পয়দা হয়েছিল।

আমরা যদি উল্লিখিত ইতিহাস পর্যালোচনা করি এবং নিজেদের আমল-আখলাক ও দুনিয়া-আখিরাতের পরিণতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করি তবে খুব সহজেই বুঝতে পারব, মিথ্যার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও মিথ্যাবাদীকে নিকৃষ্টতম নরপশু আখ্যা দিয়ে তাকে প্রথমত মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের গোত্রভুক্ত করে সমাজ সংসার রাজনীতি অর্থনীতি থেকে বিচ্যুত করা এবং তার বিরুদ্ধে শারীরিক-মানসিক অর্থনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে না তোলা পর্যন্ত আমাদের পক্ষে কাক্সিক্ষত মাকামে পৌঁছা অসম্ভব বিষয়। এখানে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট, মিথ্যাবাদী মুসায়লামা কিন্তু প্রথম দু’টি যুদ্ধে তার মিথ্যাবাদী বাহিনীকে দিয়ে যুদ্ধ করে মুসলিম বাহিনীকে পরাস্ত করেছিল এবং তৃতীয় যুদ্ধে সাঙ্গোপাঙ্গ-পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও তাঁবেদারসহ সমূলে ধ্বংস হয়েছিল। সুতরাং মিথ্যার বিরুদ্ধে বিজয়ের জন্য যেমন অবিরত চেষ্টা দরকার তদ্রুপ মিথ্যার সাময়িক বিজয়ে বিমর্ষ না হয়ে মুসায়লামার চূড়ান্ত পরিণতির কথা স্মরণ করে উজ্জীবিত হওয়া আবশ্যক।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement