১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হেফাজতে মৃত্যু আইন : বিচার প্রার্থীর বঞ্চনা

-

বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের সদস্যভুক্ত রাষ্ট্র। জাতিসঙ্ঘের যেসব মানবাধিকার ও নির্যাতনবিরোধী সনদ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো জাতিসঙ্ঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ, ১৯৪৮ ও নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দণ্ডবিরোধী সনদ-১৯৮৪। বাংলাদেশ উভয় সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৫) এ উল্লেখ রয়েছে- কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারো সাথে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। সংবিধানে এ অনুচ্ছেদটির দফা (৫) জাতিসঙ্ঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ-১৯৪৮-এর ৫ অনুচ্ছেদের অনুবলে সন্নিবেশিত। জাতিসঙ্ঘ নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দণ্ডবিরোধী ১৯৮৪ সনদের অনুচ্ছেদ ২ দফা (১) ও অনুচ্ছেদ ৪ এ উল্লেখ রয়েছে- সনদটিতে স্বাক্ষরকারী প্রতিটি দেশ নির্যাতন, নিষ্ঠুর, অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ডকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে নিজ নিজ দেশে আইন প্রণয়ন করবে। উভয় সনদে স্বাক্ষরের ফলে সংবিধানে যেমন নির্যাতন ও নিষ্ঠুর আচরণবিরোধী বিধানের সন্নিবেশন ঘটেছে অনুরূপ নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ বিষয়ে আইন প্রণীত হয়েছে। শেষোক্ত বিষয়ে প্রণীত আইনটি নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩ নামে অভিহিত।

প্রতিটি আইন প্রণয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩ প্রণীত হয়েছে, আইনটির দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত শিরোনাম এবং সংজ্ঞা অবলোকনে প্রতীয়মান হয়, এটি প্রণয়নের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সরকারি কর্মকর্তা অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে থাকাকালীন কোনো ব্যক্তির নির্যাতন ও নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যু সংঘটন রোধ। আইনটিতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর সংজ্ঞার পাশাপাশি উভয় অপরাধের সাজার বিষয় উল্লেখ রয়েছে।

আইনটিতে ‘নির্যাতন’ অর্থ কষ্ট হয় এমন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন; তা ছাড়া বল প্রয়োগ বা ভয়-ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় বা তথ্য সংগ্রহও নির্যাতন হিসেবে গণ্য হবে।

হেফাজতে মৃত্যুর যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে- ‘হেফাজতে মৃত্যু’ অর্থ সরকারি কোনো কর্মকর্তার হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু। তা ছাড়া অবৈধ আটকাদেশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক গ্রেফতার বা জিজ্ঞাসাবাদকালে মৃত্যুও হেফাজতে মৃত্যুর অন্তর্ভুক্ত হবে।

আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে অপরাধের যেসব সাজার উল্লেখ রয়েছে তা হলো- মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড ও সম্পদের বাজেয়াপ্তি। প্রচলিত আইনের সর্বোচ্চ সাজা হলো মৃত্যুদণ্ড এবং তদনিম্নের সাজা হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আমাদের দেশের প্রচলিত আইনের মধ্যে দণ্ডবিধি হলো মূল দণ্ড আইন। এ আইনটি আমাদের এ উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসনাধীন থাকাবস্থায় ১৮৬০ সালে ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশরা প্রণয়ন করে। দণ্ডবিধিতে মৃত্যু সংঘটন খুন হিসেবে অভিহিত। দণ্ডবিধির ভাষ্য অনুযায়ী, মৃত্যু সংঘটনের অভিপ্রায়ে সম্পাদিত কাজ খুন বা নরহত্যা। দণ্ডবিধিতে খুন বা নরহত্যার একমাত্র সাজা হলো মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩-এর ধারা ১৩ তে আইনটির অপরাধগুলোর উল্লেøখ রয়েছে। ধারাটিতে বলা হয়েছে- ‘কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন করলে তা ওই ব্যক্তির কৃত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে; তা ছাড়া অপরাধ সংঘটনে উদ্যোগী হওয়া, সহায়তা বা প্ররোচিত করা বা ষড়যন্ত্র করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।’ আইনটির ধারা ১৫ তে সাজার বিষয়ে বলা হয়েছে- ‘কোনো ব্যক্তি ধারা ১৩-এর অধীন অপরাধ সংঘটন পরবর্তী অর্থাৎ নির্যাতন সংঘটন পরবর্তী দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ আইনটিতে নির্যাতনের কারণে সংঘটিত মৃত্যুর সাজার বিষয়ে বলা হয়েছে- ‘এ ক্ষেত্রে দোষী সাব্যস্ত হলে অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩ একটি বিশেষ আইন বিধায় এটিকে আপাতত বলবৎ অন্যান্য আইনের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এ আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের বিচার কেবল দায়রা জজ আদালতে অনুষ্ঠানের বিধান করা হয়েছে। এ আইনের অধীন দণ্ডনীয় সব অপরাধ আমলযোগ্য, অআপসযোগ্য ও জামিন অযোগ্য হলেও অপরাধী নারী বা শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে অভিযোগকারী পক্ষকে শুনানি-অন্তে আদালতের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে জামিন দেয়ার বিধান রয়েছে।

আইনটিতে নির্যাতিত ব্যক্তি স্বয়ং অথবা নির্যাতিত ব্যক্তির পক্ষে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। নির্যাতিত ব্যক্তি তার নির্যাতন হওয়া বিষয়ে আদালতে অভিযোগ দায়ের করলে আদালত কর্তৃক তাৎক্ষণিকভাবে তার বিবৃতি লিপিবদ্ধের পর একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক দিয়ে তার দেহ পরীক্ষার আদেশের বিধান রয়েছে। চিকিৎসকের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আদালত কর্তৃক পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের বিধান রয়েছে। বিবৃতিটি লিপিবদ্ধের পর আদালত বিবৃতির কপি সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপার বা ক্ষেত্রমতো তদূর্ধ্ব কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছে প্রেরণকরত মামলা দায়ের করবেন এমনতর বিধান আইনটিতে রয়েছে। পুলিশ সুপার কর্তৃক আদালতের আদেশ প্রাপ্তির পর ঘটনা তদন্ত-অন্তে প্রতিবেদন পেশের বিধান রয়েছে। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনের ভিত্তিতে আদালত কর্তৃক বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেয়ার বিধান রয়েছে।

তৃতীয় পক্ষ কর্তৃক দায়রা জজ আদালত অথবা পুলিশ সুপারের নিম্নে নয় এমন কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছে নির্যাতনের অভিযোগ দায়েরের বিধান রয়েছে। পুলিশ সুপার বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দায়ের করা হলে তদকর্তৃক তাৎক্ষণিক মামলা দায়ের ও অভিযোগকারীর বক্তব্য লিপিবদ্ধকরত অভিযোগকারীকে মামলার নম্বর ও অভিযোগ বিষয়ে গৃহীত ব্যবস্থাদির বিষয়ে অবহিত করার বিধান রয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তা গৃহীত ব্যবস্থাদি বিষয়ে দায়রা জজ আদালতকে অভিযোগ দায়েরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট পেশ করবেন মর্মে বিধান রয়েছে।

নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনটির ক্ষেত্রে কোনো অপরাধ যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধের হুমকি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অথবা জরুরি অবস্থায় অথবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা সরকারি কর্তৃপক্ষের আদেশে করা হয়েছে এরূপ অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।

আইনটিতে তদন্তকার্য ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে ও তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের ভিত্তিতে অতিরিক্ত ৩০ দিনের মধ্যে তদন্তকার্য সম্পন্নের কথা উল্লেখ রয়েছে। আইনটিতে আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার নিরাপত্তা নিশ্চিতের নির্দেশ দেয়ার উল্লেখ রয়েছে।

নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩ প্রণয়ন পূর্ববর্তী যেমন এ দেশে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর একাধিক ঘটনা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে, অনুরূপ আইনটি প্রণয়ন পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ অবধি এর ছেদ পরিলক্ষিত হয়নি। নিষেধাজ্ঞা পরবর্তীও যে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর অবসান ঘটেছে এমন দাবির অবকাশ এখনো সৃষ্টি হয়নি।

কোনো ব্যক্তি কর্তৃক সংঘটিত অপরাধ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। অপরাধীর মৃত্যু ব্যতীত একজন ব্যক্তি স্বীয় কৃত অপরাধ থেকে অবমুক্ত হন না। একজন ব্যক্তির কৃত অপরাধ সময় দ্বারা বারিত নয়। অপরাধীকে আইনের আওতায় সোপর্দ করে তার বিচারের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারের ওপর ন্যস্ত। হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বিষয়ে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়ার উদাহরণ আশাব্যঞ্জক নয়।

আমাদের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে- সংবিধান ও আইন মেনে চলা দেশের প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। সংবিধান ও আইন মেনে না চলা সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস ও প্রত্যয় পরাহত করে। সংবিধানের ভাষায়- একজন নাগরিকের এরূপ কাজ অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত; কিন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত যাদের মাধ্যমে সংবিধান ও আইনের প্রয়োগ ঘটে তারা তাদের কার্য সম্পাদনে সফল নাকি বিফল এটি নিরূপণের দায়ভার যাদের ওপর ন্যস্ত তাদের কি কখনো জবাবদিহিতার আওতায় আনা গেছে!

সাম্প্রতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, বিভিন্ন জেলায় দায়রা জজ আদালতে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বিষয়ে একাধিক মামলা দায়ের হলেও বিচার প্রার্থীরা আইনটির সুনির্দিষ্ট প্রতিকার প্রাপ্তির ব্যত্যয়ে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়ে চলেছেন। ন্যায়বিচারের এ ধরনের বঞ্চনা আইনের শাসন ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থার পরিপন্থী, যা প্রকারান্তরে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের এ রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়েছে, তার ভিতমূলে আঘাতসম।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
Email : iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement