২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন ও লাল ঢেউ

-

আমেরিকার গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা মাপার একটি ব্যবস্থা হলো মধ্যবর্তী নির্বাচন। ক্ষমতাসীন দল যদি জনপ্রিয়তা হারায়, তাহলে পরবর্তী নির্বাচনে তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা প্রায় দুঃসাধ্য। তবে কখনো কখনো যে তার ব্যত্যয় হয় না, তা নয়। সেটা হয় তখনই যখন ক্ষমতাসীন দল বোঝে তাদের কর্মকাণ্ড সরকারি স্তরে কোন কোন বিষয়ে খারাপ করেছে, যা ভোটার ও সর্বস্তরের জনগণ পছন্দ করছে না। সেসব ভ্রান্তি সংশোধন করার চেষ্টা করেন সেই দলের প্রেসিডেন্ট, যাতে চার বছর পরের জাতীয় নির্বাচনে সুফল পাওয়া যায়। আর যদি তা করতে ব্যর্থ হন কোনো কারণে, তাহলে সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো অবস্থা হয়। দ্বিতীয়বার আর নির্বাচিত হবার সুযোগ তিনি বা তার দল পায় না। ট্রাম্প হেরেছিলেন তার রাজনৈতিক বর্ণবাদ উসকে দিয়ে দেশের শাদা অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ জনগণের মনে এক ধরনের রাজনৈতিক অহঙ্কার প্রতিষ্ঠার চেষ্টার কারণে। তার পরই ছিল তার অভিবাসনবিরোধী অবস্থান। হোয়াইট জনগোষ্ঠীর রিপাবলিকান লাখ লাখ মানুষ জানে, তারাও মূলত অভিবাসী জনগোষ্ঠী। এ কারণে তারা ট্রাম্পের ওই তুরুপের তাসটি নেয়নি।

আগামী সপ্তাহে নাকি ট্রাম্প ২০২৪ এর নির্বাচনে তার প্রার্থিতার কথা ঘোষণা করবেন। আর ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন করার আশা পোষণ করছেন। আসলে সব কিছুই নির্ভর করছে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ফলাফলের ওপর। এর মধ্যেই পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বলছে, ট্রাম্প যে ‘লাল ঢেউ’ তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা উপকূলে পৌঁছাতে পারেনি। তার বিশিষ্ট প্রার্থীগণের দু’একজন জয়ী হলেও বাকিরা হেরে গেছেন। তবে তাদের জন্য খুশির খবর হচ্ছে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে (হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস) তাদের দল গরিষ্ঠতা পাচ্ছে, এটা এখন স্পষ্ট। আর উচ্চকক্ষ সিনেটে ডেমোক্র্যাটরা গরিষ্ঠতার মুখে। সিনেট দখলে রাখতে পারলেও হাউজ যদি নিয়ন্ত্রণ করে রিপাবলিকানরা তাহলে আগামী দুই বছরে বাইডেন প্রশাসন তেমন কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্যই পূরণ করতে পারবে না। সেসব আইন বা বিল যদি বৃহত্তর জনগণের দীর্ঘমেয়াদি লাভেরও হয়, তারপরও ছাড় দেবে না রিপাবলিকানরা। এ ধরনের রাজনৈতিক বিরোধিতায় আমেরিকার সাধারণ মানুষের ইচ্ছা ও আশা অনেকখানিই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এবার বোঝাই যাচ্ছে, জো বাইডেনের কপালে দুর্বিপাক লেখা হয়ে গেল। তিনি আর তেমনভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র চালাতে তার ও দলের লক্ষ্যে কাজ করতে পারবেন না। এই না পারার দায় বাইডেনের কাঁধে চাপবে, তার কাঁঠালটি ভেঙে খাবে রিপাবলিকানরা।

রাজনীতিকরা পরিকল্পনা করেন অনেক ইতিবাচক বিষয়ে, তবে তা বাস্তবায়ন করতে পারেন না রাজনৈতিক বিরোধীদের জন্য। যৌক্তিক হোক বা জনগণের জন্য কল্যাণকর হোক, তারও চেয়ে বড় স্বার্থ হচ্ছে তাদের দল কি পাচ্ছে বা কি পাবে না। এই ইক্যুয়েশনের কবলে এশবার পড়লে, দল আর জনগণের দল থাকে না, হয়ে ওঠে আপনাদের স্বার্থ উদ্ধারের রাজনৈতিক সংঘ মাত্র। গোটা পৃথিবীতে আজ রাজনৈতিক সঙ্ঘবদ্ধতাই গণমানুষের জন্য ভয়ের। কারণ, দলের স্বার্থকেই তারা দেশের উন্নয়নের রূপ হিসেবে দেখে এবং দেখাতে চায়। উপমহাদেশের প্রায় সব দেশের জনগণই এই সত্যটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেন।

২.
মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের বিভিন্ন ইসু্যু আছে। সেই সব ইস্যু নিয়েই দলীয় প্রার্থীগণ ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ভোটার জনগণ বিবেচনা করে ভোট দেন।

এবার দ্রব্যমূল্য, গর্ভপাত, অস্ত্রবিষয়ক ইস্যু ছাড়াও ছিল বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আঞ্চলিক ইস্যু। সেগুলো নিয়েই প্রার্থীরা ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন।

রয়টার্স একটি জরিপ করেছে বুথস্পট থেকে, যারা ভোট দিয়ে ফিরেছেন বা যারা যাবেন, তাদের মতো সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে।

‘যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে সাধারণত ক্ষমতাসীন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ভালো ফল করে না। তার ওপর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জন্য এবার পরিবেশ ছিল আরো প্রতিকূল। এর পরও মধ্যবর্তী নির্বাচনে ‘লাল ঢেউয়ের’ যে স্বপ্ন দেখেছিলেন রিপাবলিকানরা, বাস্তবে তেমনটা হয়নি। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় কাজ করেছে বলে রয়টার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে।

মধ্যবর্তী নির্বাচনে জর্জিয়ায় ভোট দেন মিশেল ও ম্যাথিউ নিলসেন। ভোটে প্রার্থী বাছাইয়ে অর্থনৈতিক উদ্বেগ তাদের প্রভাবিত করেনি। তারা গর্ভপাত অধিকারের সুরক্ষা চেয়েছেন। থামাতে চেয়েছেন রিপাবলিকান সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুগত প্রার্থীদের।

আলফারেটায় ভোট কেন্দ্রের বাইরে ৩৩ বছর বয়সী ম্যাথিউ নিলসেন বলেন, ‘কেউ যদি চান আমি রিপাবলিকানদের ভোট দিই, তাতে আপত্তি নেই। তবে তারা যেন সম্ভব হলে গর্ভপাত এবং ট্রাম্পের কথা বলে ভোট না চান।’

গর্ভপাত অধিকারের সাংবিধানিক সুরক্ষা-সংক্রান্ত আইন বাতিলের পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায় ভোটার জনগণ।
সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাত অধিকারের সাংবিধানিক সুরক্ষাসংক্রান্ত আইন বাতিলের পর অনেক মানুষ রাজপথে নামে। আমাদের দেশে তো কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্নই তোলা যায় না। সেখানে আমেরিকায় এতবড় একটি ইস্যুর বিরুদ্ধে, পুরুষ ও মহিলারা মিলে যে প্রতিবাদ জানায়, তা অনেকটাই বৃহত্তর নারীসমাজের সমর্থন ও প্রশ্রয়ে হয়েছে। এই ইস্যুটি ভোটারদের অনেকটাই প্রভাবিত করেছে। ডেমোক্র্যাটরা গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে, কিন্তু কোর্ট স্বাধীন বলে আমাদের দেশের মতো প্রভাবিত করতে পারে না।

ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া লাখো ভোটারের উদ্বেগই ম্যাথিউ নিলসেন ও মিশেল-এর কথায় উঠে এসেছে।

‘এই সমর্থকদের সংখ্যা বিস্মিত হওয়ার মতো। নির্বাচনে রিপাবলিকানরা কথিত ‘লাল ঢেউয়ের’ যে প্রত্যাশা করেছিলেন, তা ঠেকিয়ে দিয়েছেন এসব ভোটাররাই।

গত বুধবার ফলাফল আসার পর থেকেই সেই ঢেউ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। তবে রিপাবলিকানরা প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পথেই রয়েছেন। আগে থেকেই এমনটি ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যবধান হবে ধারণার চেয়ে আরো কম। কারা সিনেটের নিয়ন্ত্রণ পাবেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এজন্য সম্ভবত জর্জিয়ায় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের ভোটাভুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। (প্রথম আলো/১০ নভেম্বর, ২২)

৩.
মার্কিন নির্বাচন কি আমাদের দেশে কোনো রকম প্রভাব ফেলবে? দৃশ্যত নয়। কারণ, আমাদের দেশের নির্বাচনে যে কটি দল অংশগ্রহণ করে, তাদের অধিকাংশেরই নির্বাচন কমিশনের সততা, সামর্থ্য ও নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ আছে এবং তারা সেটা জানিয়েও এসেছে কমিশনের সঙ্গে তাদের সংলাপের সময়। কিন্তু আমেরিকায় এমনটা নেই। এখন ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায়, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ক্যাডার নেই। এমনকি ট্রাম্প যে শাদাদের হোয়াইট সুপ্রিমদের উসকে দিয়েছিলেন, তারাও ভোটকেন্দ্র দখল করে সিল মেরে বিজয় অর্জনের চেষ্টা করেনি। আমাদের কাছে তা অনেকটাই বিস্ময়কর। কেননা, আমরা ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি গত ৫০ বছরে যে, মারামারি, কাটাকাটি, রক্তাক্ত অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত কোনো জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতেই পারে না। নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, সন্ত্রাসমুক্ত হতে হলে দলনিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের দরকার হয়। এমন ভাবনা-চিন্তার কোনো পরিবর্তন হয়নি, আর কখনো হবে এমনটাও মনে হয় না। নির্বাচন এলেই কিছু মানুষের প্রাণহানির শঙ্কায় থাকে দেশের সাধারণ মানুষ। ভোটার তার ভোটটা দিতে পারবে কিনা তাও সে জানে না। তার আগেই ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারগণ সিল মেরে ভোটের উৎসব সেরে ফেলেন।

আমেরিকায় নির্বাচনে ভোটারদের অনুরোধ করে আনতে হয়। এবার যেমন জর্জিয়ায় কোনো প্রার্থীই শতকরা ৫০ শতাংশ ভোট পাননি। ফলে ওই অঙ্গরাজ্যে আবারো ভোট হবে আগামী ৮ ডিসেম্বর। অঙ্গরাজ্যটির সেক্রেটারি অব স্টেট ভোটার জনগণের উদ্দেশে অনুরোধ জানিয়েছেন, ভোট দেয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে আসুন, প্লিজ। জয় পরাজয় নির্ধারণ করে দিন। অঙ্গরাজ্যের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার এই আবেদনের মানে আমাদের বুঝতে হবে। যেন তিনিই অসহায় আজ। প্রার্থী বা রাজনৈতিক দলগুলোর দায় তো আছেই। তারাও ভোটারদের বাড়িতে বাড়িতে যান, অনুরোধ করেন। আমাদের দেশে নির্বাচন ওই পর্যায়ে যাবে কবে, তা আল্লাহ জানেন।

৪.
আজ আমাদের দেশে অনেক মিডিয়া হাউজ। কিন্তু এসব হাউজ কি প্রাক-নির্বাচনি পোল বা জনমত যাচাইয়ের কাজটি করেন? আমার জানা নেই। আমার মনে হয়, এই এখন থেকেই ভোটার জনগণের মনের অবস্থা কী তা জানতে নানান বিষয়ে জনমত যাচাইয়ের সমীক্ষা হওয়া জরুরি। কারণ বহু থাকলেও, বেছে নেয়া যেতে পারে দ্রব্যমূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, রাষ্ট্রযন্ত্রের অকার্যকরতা, আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা ও রাজনীতিক ও আমলাদের দুর্বৃত্তায়ন, ব্যবসায়ীদের ব্যাংকের অর্থ ফেরত না দেয়ার প্রবণতা, শাসকদের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে সহায়তা, রাজনৈতিক মিথ্যাচার, মিথ্যা আশ্বাস, মিথ্যা তথ্যপ্রবাহ, হত্যা ও গুমের রাজনীতি, দোষারোপের রাজনীতি, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর নোংরামি, সঙ্ঘবদ্ধ দলীয় লুটেরাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের মতো ইস্যুগুলো। এ ছাড়াও আরো অনেক ইস্যু যুক্ত করা যেতে পারে।

কেউ কি আছেন এমন কাজ করার!


আরো সংবাদ



premium cement