মুসলমানরাই সাম্প্রদায়িকতার শিকার
- তৈমূর আলম খন্দকার
- ১১ নভেম্বর ২০২২, ২০:২১
‘সাম্প্রদায়িকতা’ নামক একটি মহামারী রোগের নির্মম শিকার হচ্ছেন মুসলমানরা। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান। বিশ্বের ৫৬টি দেশে মুসলিমরা প্রধান জনগোষ্ঠী। বৌদ্ধদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী ‘জীব হত্যা মহাপাপ’। অথচ মুসলমান হত্যা করা বৌদ্ধদের একটা অংশের জন্য কোনো পাপ নয়, যার প্রমাণ আমরা মিয়ানমারে দেখতে পাই।
ভারত কাগজ-কলমে সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। অথচ মুসলমানদের বাড়িঘর ধ্বংস করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নির্দেশে। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে কৌশ প্রকাশ করা হচ্ছে- কিভাবে মুসলমানদের ভারত থেকে বিতাড়িত করা যায়। এ ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মুসলমান ব্যক্তির চেয়ে গরুর মূল্য তাদের কাছে অনেক বেশি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা গরুকে দেবতা মনে করে, এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলমানদের জন্য তো গরুর গোশত খাওয়া নিষেধ নেই, তবে কেন এই ধর্মীয় বিরোধ। গালভরা বুলি নিয়ে বলা হয়, ধর্ম যার যার তবে রাষ্ট্র সবার। যদি তাই হয় তবে পার্শ্ববর্তী বন্ধুরাষ্ট্রে মুসলমানদের ওপর এত নির্দয় নির্যাতন কেন? কথাটি বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত যে, ইসলাম একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম এবং হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকানি দেয়ার মতো ঘটনা দেখা যায় না; বরং বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না, এ কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।’
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বাংলা (আবশ্যিক) প্রথমপত্রে ১১ নম্বর ক্রমিকে নাটক সিরাজউদ্দৌলার সৃজনশীল প্রশ্নে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করা হয়েছে। হিন্দু ও মুসলমানদের জীবনাচরণের কিছু চিত্র তুলে ধরে এই প্রশ্নের উদ্দীপকের প্রশ্নে কিছু বিষয়ে মুসলিমদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তবে প্রশ্নপত্র তৈরিতে কেন ও কিভাবে এই প্রশ্নে সাম্প্রদায়িকতার ইঙ্গিতপূর্ণ উদ্দীপক তুলে দেয়া হলো তা নিয়েও রীতিমতো অনুসন্ধান শুরু করেছে বলে সরকার থেকে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্ন নিয়ে দেশজুড়ে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য সাম্প্রদায়িকতার উসকানি দেয়া হয়েছে। প্রশ্নগুলো হচ্ছে- ক. মীর জাফর কোন দেশ থেকে ভারতে আসেন? খ. ঘরের লোক অবিশ্বাসী হলে বাইরের লোকের পক্ষে সবই সম্ভব ব্যাখ্যা কর? গ. উদ্দীপকের নেপাল চরিত্রের সাথে সিরাজউদ্দৌলা নাটকের মীর জাফর চরিত্রের তুলনা কর?
ঘ. খাল কেটে কুমির আনা প্রবাদটি উদ্দীপক ও সিরাজউদদৌলা নাটক উভয় ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য- উক্তিটির সার্থকতা নিরূপণ কর।’ ওই প্রশ্নপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আবদুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে। আবদুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এ ঘটনায় নেপালের মন ভেঙে যায়। কিছু দিন পর কাউকে কিছু না বলে জায়গাজমি ফেলে সপরিবারে ভারত চলে যায় সে।’
চলতি এইচএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নে ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয় উল্লেøখ করে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার সৃষ্টি করা হয়েছে। ফেসবুকে অনুরূপ উন্মাদনা প্রায়ই দেয়া হয়ে থাকে। তদন্তে দেখা গেছে- কিছু ক্ষেত্রে এসবের জন্য হিন্দু ধর্মের বিপথগামী কিছু ধর্মান্ধ এগুলো করছে। সরকারের ছত্রছায়ায় এদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি একটি জাতির ঐতিহ্য ও পরিচয়। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সমীক্ষামূলক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দফতরে গুরু দায়িত্বে আনুপাতিক হারে হিন্দুদের সংখ্যা অনেক বেশি। এটা একেবারে ভারসাম্যহীন অবস্থায় রয়েছে। বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু। অথচ সেখানে মুসলমানরা এহেন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে প্রায় শতভাগ বঞ্চিত। বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ অধিবাসী মুসলমান। অথচ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের মুসলমানদের হেয়প্রতিপন্ন করে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এক প্রকার সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়েছে।
একই কারণে মুসলিম মনীষীদের লেখা ও জীবন-চরিত্র পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। সংবিধান থেকে ‘বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ উঠিয়ে দেয়ার জন্য সময়ের অপেক্ষায় আছেন মর্মে আইনমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। আইনমন্ত্রী ধর্মকর্ম কতটুকু করেন তা জানি না, তবে তিনি মুসলমানের একজন সন্তান হয়ে বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহিম-এর প্রতি তার এত অনীহা কেন? এগুলো কিসের আলামত? মুসলমানদের মধ্যেও একটি শ্রেণী রয়েছে যারা নাস্তিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে বড় মাপের ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল সাজতে চায়। তাদের আচার-আচরণ সবসময়ই ইসলামবিদ্বেষী। শুধু ভোটের রাজ্যে ভাগ বসানোর জন্য পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত হয়ে, গায়ে সুগন্ধি লাগিয়ে ঈদগাহ ময়দানের বড় জামাতে লোকদেখানো ঈদের নামাজ আদায় করে। তারাও ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে কথা বলে অত্যাধুনিক মানবপ্রেমী সাজতে চায়।
চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুরদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ৫০টি দেশ। উইঘুরদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বিবৃতিতে সই করা দেশগুলো একে ‘ক্রাইম অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি’ (Crime Against Humanity) অর্থাৎ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে শিরোনাম করেছে এবং চীনকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে। পশ্চিমা বেশির ভাগ দেশ এই বিবৃতিতে সই করেছে। সেখানে বলা হয়েছে- আমরা চীনের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত। বিশেষ করে সংখ্যালঘু মুসলিম উইঘুরদের বিরুদ্ধে যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, তা উদ্বেগজনক। ৫০ দেশের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ইসরাইল, তুরস্ক, গুয়াতেমালা ও সোমালিয়াও রয়েছে।
এই সমালোচনাও মূলত প্রতীকী। কারণ, এর আগে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদের উইঘুর নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তা ভোটাভুটিতে পাস হয়নি, কারণ তারা মুসলমান। জাতিসঙ্ঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলির মানবাধিকার কমিটিতে এই বিবৃতিটি পড়ে শোনান জাতিসঙ্ঘে কানাডার দূত। ৫০টি দেশের সই করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে- চীন যেন জাতিসঙ্ঘের রিপোর্টের সুপারিশ মেনে নেয় এবং যাদের যথেচ্ছভাবে আটকে রাখা হয়েছে, তাদের মুক্তি দেয়। কার্যত এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি, অমুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে জাতিসঙ্ঘ ও এর সিকিউরিটি কাউন্সিল। ফলে উইঘুর মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য Peace Keeping Force আদৌ পাঠাতে পারবে না। চীন সরকারের নির্মম অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডের ফলে দুই কোটি উইঘুরের সংখ্যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ। বন্দিশালায় মুসলমানদের মদ ও শূকরের মাংস খেতে দেয়া হয়। মুসলমান সন্তানদের নাস্তিক বানানোর জন্য শিশুকাল থেকেই শিক্ষা দেয়ার নামে বন্দিশালায় রাখা হয়। সৌদি যুবরাজ সালমান চীন সফরে গেলেও উইঘুরদের নিরাপত্তার জন্য কোনো কথা বলেনি। বাংলাদেশ থেকে কোনো প্রতিবাদ জানানো হয়নি।
মুসলমানরা আজ চরম ষড়যন্ত্রের শিকার। সৌদি যুবরাজ সালমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরই ভিন্নধর্মীদের সাথে হাত মিলিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতি যা ইসলাম সমর্থন করে না, তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। সম্প্রতি পশ্চিমা স্টাইলে হোলোয়িন মিছিল হয়েছে যা সৌদি আরবের ইতিহাসে ইতঃপূর্বে ঘটেনি। মুসলমানদের মধ্যে অনেক নাস্তিক রয়েছে যারা ইসলাম ধর্মের বেশি সমালোচনা করে নিজেদের প্রগতিশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার’ স্লোগান নিয়েও একটি শ্রেণী সমালোচনা করতে চাইছে। আমি মনে করি, ওই স্লোগানটি প্রতিটি মুসলমানের জন্য আকর্ষণীয় ও সম্মানজনক। মুসলমানদের মধ্যে একতা নেই বলে আজ চরম দুর্দিনের মধ্যে পড়েছে প্রকৃত ইসলামপ্রিয় জনগোষ্ঠী। পীর মাশায়েখদের নেতৃত্বে বাংলাদেশেও অনেক শক্তিশালী ইসলামিক রাজনৈতিক দল আছে। কিন্তু তারা ঐক্যবদ্ধ নয়। একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে কঠিন সমালোচনা করে।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : taimuralamkhandaker@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা