২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সুরোভিচিন, ইউক্রেনের জন্য কসাই

-

ইন্টিগ্রেটেড গ্রুপ অব ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল সার্গেই সুরোভিচিন মিডিয়ায় বলেছেন, রাশিয়ান সৈন্যরা ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানে অবিরাম শত্রুবাহিনীকে গ্রাস করছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কৌশল ভিন্ন। ক্রমাগতভাবে অগ্রসরমান শত্রুকে আমরা পিষে দিচ্ছি।’

সুরোভিচিন জানান, রাশিয়ান যুদ্ধবিমান ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানে ৩৪ হাজারের বেশি অভিযান পরিচালনা করেছে, সাত হাজারের বেশি নির্দেশিত যুদ্ধাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। সু-৫৭ পঞ্চম-প্রজন্মের ফাইটার জেট প্রতিটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। বায়ুচালিত কিনজল হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটি শত্রুর যেকোনো বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা লঙ্ঘন করতে সক্ষম। ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানে রাশিয়ার ড্রোনগুলো ৬০০টিরও বেশি ইউক্রেনীয় সামরিক লক্ষ্যবস্তু নিশ্চিহ্ন করেছে। সুরোভিচিন আরো বলেন, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী প্রতিদিন ৬০০ থেকে এক হাজার সৈন্য হারাচ্ছে। রাশিয়া চায় ইউক্রেন পশ্চিমা ও ন্যাটো থেকে স্বাধীন হোক এবং রাশিয়ার জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হোক।

বিগত দুই সপ্তাহে রাশিয়ান সামরিক বাহিনী ইউক্রেনজুড়ে শহর এবং শহরতলিতে আর্টিলারি এবং রকেট ফায়ার করছে, চালাচ্ছে ড্রোন ও বিমান হামলা। শুধু সামরিক লক্ষ্যবস্তুই নয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা, ব্রিজ, দোকান এবং এমনকি পাবলিক পার্কগুলোতেও আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। কিয়েভ থেকে বলা হয়েছে, শত শত রকেট হামলা হয়েছে। জেলেনস্কি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও আকাশ প্রতিরক্ষা ইউনিট চেয়ে পাঠিয়েছেন। কেননা এভাবে বিগত দশ মাসের যুদ্ধে মানবিক সুবিধার উৎসে আগে হামলা করা হয়নি। যুদ্ধ যে মানুষকে অসহায় করে সেটি ইউক্রেনের লোকজন বুঝতে পারছে।

চলতি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের সময়, সুরোভিচিন প্রাথমিকভাবে রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর আর্মি গ্রুপ ‘দক্ষিণ’-এর কমান্ডার ছিলেন। ২০২২ সালের ৮ অক্টোবর, তিনি ইউক্রেন অভিযানের সব রাশিয়ান বাহিনীর কমান্ডার হন।

ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে, সুরোভিচিনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় যুক্ত করা হয়েছিল, নিষেধাজ্ঞার মন্তব্যে উল্লেখ ছিল ‘সক্রিয়ভাবে সমর্থন এবং বাস্তবায়নের জন্য দায়ী পদক্ষেপ এবং নীতিগুলো যা ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতার পাশাপাশি ইউক্রেনের স্থিতিশীলতা বা নিরাপত্তাকে বিনষ্ট করে ও হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।’

সুরোভিচিন তিনবার ‘অর্ডার অব দ্য রেড স্টার’, ‘দ্য অর্ডার অব মিলিটারি মেরিট’ এবং ‘দ্য অর্ডার অব কারেজ’ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৭ সালে তিনি ‘হিরো অব রাশিয়ান ফেডারেশন’ উপাধি লাভ করেন। তিনি বিবাহিত, চার সন্তান রয়েছে। তিনি গোড়া খ্রিষ্টান।

২০২২ সালের জুনে জানা যায়, তিনি দক্ষিণ ইউক্রেন অভিযানে রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর আর্মি গ্রুপ দক্ষিণের কমান্ডার হয়েছেন। ৮ অক্টোবর তাকে ইউক্রেনে যুদ্ধরত সব রাশিয়ান বাহিনীর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। তিনি কর্নেল জেনারেল গেনাডি ঝিদকোর স্থলাভিষিক্ত হন। ১৮ অক্টোবর রাশিয়ার গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিপক্ষ একটি অপরাধী সরকার।’

ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করা একটি সেতুর ক্ষতির প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া এবার ভয়ানক আক্রমণ শুরু করেছে। পুতিন বলেছেন, ‘ইউক্রেন নিজেই এমন পরিণতি ডেকে এনেছে।’

ক’দিন আগে রাতে বেশ কয়েকটি অঞ্চলজুড়ে আবারও বিমান হামলার সাইরেন বাজানো হয়েছিল যেন এই বিষয়টির ওপর জোর দেয়ার জন্য যে আরো নিষ্ঠুরতা আসছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার আগ্রাসী বাহিনীর প্রধান হিসাবে বেসামরিক লোকজনের ওপর আক্রমণের জন্য কুখ্যাত মাস্টার জেনারেল সার্গেই সুরোভিচিনকে নিযুক্ত করেছেন। যাকে অনেক পৌরাণিক কুখ্যাত নায়কের সাথে তুলনা করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন নামে ডাকা হচ্ছে।

পুতিনের অনেক দোষের মধ্যে তার নেতৃত্বের অনেক গুণাবলিও লুকিয়ে আছে। পুতিন একাই অন্তত ত্রিশজন রাষ্ট্রনেতার সাথে খেলছেন।

তিনি এখন হামলা জোরদার করার পথ বেছে নিয়েছেন। যদিও গোলাবারুদ এবং সামরিক সরবরাহের ঘাটতির মুখোমুখি হওয়ার সময়। তিনি একটি সরাসরি এবং সবচেয়ে জঘন্য পথ গ্রহণ করেছিলেন। তার নতুন কমান্ডার ইউক্রেনীয়দের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য শহুরে কেন্দ্রগুলোতে রকেটের বন্যা বইয়ে দিতে পারেন, যেকোনো মুহূর্তে।

পুতিন ইউক্রেনের পশ্চিমা সমর্থক ও অস্ত্র সরবরাহকারীদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়াচ্ছেন, বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞার পুরনো খেলায় বাইডেন নিজে ও পশ্চিমারা হেরে গেছে। পুতিনকে যত বোকা ও অসহায় ভেবেছিল কার্যত তা উল্টো হয়ে গেছে। পুতিনকে যতই মানবতাবিরোধী বলে ডাকা হোক না কেন তাদের হাতও অনেক আগে থেকে রক্তাক্ত। তিনি সৌদি আরবের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছেন, যা পেট্রোলিয়াম রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন (ওপেক+) এর প্রধান হিসাবে তেল সরবরাহ হ্রাসের আয়োজন করেছিল এবং এর ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বেড়েছিল।

এই সব কিছু যুদ্ধক্ষেত্রের বিপর্যয়কে বিপরীত করতে পারে কি না তা এখনো দেখার বিষয়, হিসাব-নিকাশের বিষয়। ইউক্রেনীয়রা উত্তর-পূর্ব ফ্রন্টে অগ্রসর হচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অগ্রগতি ধীর। গত ১১ অক্টোবর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তার মার্কিন ও ইউরোপীয় মিত্রদের কাছ থেকে আরো অস্ত্র চেয়েছেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অবশ্য তিনি প্রতি সপ্তাহেই দু-একবার অস্ত্র, গোলাবারুদ, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও অর্থ সহায়তা চেয়ে বিবৃতি দেন। কেন তিনি বলতে পারেন। আফগানিস্তান, ইরাক ও ন্যাটোর যুদ্ধে তিনি হাজার হাজার চৌকস সেনা দিয়ে সহায়তা করেছেন। আর সবখানেই ন্যাটো চরম নাকানি খেয়েছে। জেলেনস্কি এখন তার প্রতিদান দাবি করতেই পারেন।

এদিকে ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, পুতিনের হিসাব অনুসারে দ্রুত বিজয়ের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এর অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো পোল্যান্ড সীমান্ত দিয়ে জলের স্রোতের মতো অস্ত্র ঢুকে পড়া। সময়ের মধ্যে অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় পুতিন কমপক্ষে ছয়জন শীর্ষ কমান্ডারকে বরখাস্ত করেন।

রাশিয়ার চেচনিয়া প্রদেশ এবং সিরিয়ার যুদ্ধের একজন প্রবীণ নেতা ডরনিকভকে আবার পশ্চিমা গণমাধ্যম ‘সিরিয়ার কসাই’ বলে ডাকে। যদিও কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে তার আক্রমণগুলো রাশিয়ান অনুশীলনের সীমার মধ্যে ছিল।

ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি থিংক ট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়্যার লিখেছে ‘রাশিয়ান বাহিনী সিরিয়ার বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করেছে, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোও ধ্বংস করেছে।’ তবে কথা হলো, সিরিয়ায় বিভিন্ন দেশ যুদ্ধে জড়িত এবং সবার হাতেই বেসামরিক লোকজন হতাহত হয়েছে, খোদ বাশার আল আসাদের হাতেও অসংখ্য সিরিয়ান নিগৃহীত হয়েছে।

ডরনিকভও সক্রিয় ছিলেন না। জুনের শেষের দিকে তার স্থলাভিষিক্ত হন রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক জেলার সাবেক কমান্ডার ও দেশটির উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী গেনাডি ঝিদকো। রহস্যজনক পরিস্থিতিতে, ঝিডকোকে শিগগিরই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল এবং ৭ অক্টোবর পর্যন্ত এটি বলা মুশকিল ছিল যে মূলত কে দায়িত্বে ছিল, পরে জানা যায়, সুরোভিচিন অভিযানের মূল কর্তাব্যক্তি। যদি কেউ ‘কসাই’-এর বিশেষণটি প্রাপ্য হয়, তবে তার উপযুক্ত সুরোভিচিন।

১৯৯১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভকে উৎখাত করার জন্য পরিকল্পিত অভ্যুত্থানের চেষ্টার সময় তিনি প্রথম কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি একটি মোটরচালিত ইউনিটকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যা মস্কো নদীর কাছে নোভি আরবাট বুলেভার্ডের ডুমা আইন সভা অফিসের কাছে গর্বাচেভপন্থী তিনজন বিক্ষোভকারীকে হত্যা করেছিল। তাকে ছয় মাসের জন্য কারাগারে পাঠানো হলেও পরে মুক্তি দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি। চেচনিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে, দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধে সুরোভিচিন এক সাঁজোয়া বিভাগের নেতৃত্ব দেন।

সুরোভিচিন চেচেন সন্ত্রাসীদের দোষারোপ করতেন এবং প্রত্যেক মৃত রাশিয়ানের জন্য তিনজনকে হত্যা করার অঙ্গীকার করেন। পরে তিনি জানান যে, আসলে এটি একটি সেনাপতিদের কথার কথা। এটি নিয়ে বিতর্ক করার দরকার নেই। টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তাকে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন, ‘সাধারণভাবে, আপনি নানা কথা বলতে পারেন যেকোনোটি সঠিক করা হয়েছিল এবং কী করার প্রয়োজন ছিল না।’ ‘একজন সেনাধ্যক্ষ যুদ্ধের আগে কোনো গতিবিধির কথা প্রকাশ করেন না।’ অর্থাৎ এ ধরনের কথাবার্তাই বলেন।

চেচেন বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়; প্রথমে পরাজিত হয় ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহীরা এবং পরে ইসলামী শক্তি। এরপর সুরোভিচিন মস্কো চলে যান। পরে সিরিয়ায় নিয়োগ পান। বিমানবাহিনীর অভিজ্ঞতা না থাকলেও সুরোভিচিনকে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ার শহরগুলোতে ব্যাপক বোমা হামলার দায়িত্বে রাখা হয়েছিল। ইরানি বাহিনী এবং লেবাননের শিয়া মুসলিম মিলিশিয়া হিজবুল্লাহ আসাদকে স্থলভাগে সাহায্য করেছিল। সিরিয়া যুদ্ধের হাত ধরেই কিছুদিন আগে ইরান-রাশিয়া অক্ষ গড়ে ওঠে। ফলে সিরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ইউরোপে বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার অবস্থান দৃঢ়তর হতে থাকে।

এই জোট আসাদকে ক্ষমতায় রেখেছিল। এর মধ্যে রয়েছে আলেপ্পোতে ধ্বংসাত্মক বিমান বোমা হামলা, যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, সেই সাথে অন্যান্য শহরও।

২০২০ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়ার কৌশলগুলো কয়েক ডজন বেসামরিক বস্তু ও অবকাঠামোর ওপর হামলাকে কেন্দ্র করে তৈরি করা। সুরোভিচিন-কমান্ডের অধীনে রাশিয়ান বাহিনী সিরিয়ার ‘বাড়িঘর, স্কুল, স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা এবং হাটবাজার-যেখানে লোকেরা বাস করে, কাজ করে এবং পড়াশোনা করে এমন জায়গাগুলোতে’ আঘাত হানে। ইউক্রেনে হামলা করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার জন্য কোনো সেনা কমান্ডারের পক্ষে সম্ভব না হলেও সুরোভিচিন এ কাজ করে ওস্তাদি দেখাতে পারবেন।

ইউক্রেনে এখন তার চেয়েও জঘন্য ঘটনা ঘটছে। পুতিনের বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের কঠিন পর্ব শুরু হয়েছে। বিশ্বকে যারা খাদ্য জোগায়, তাদের ঘরে এখন খাবার নেই, পানীয়জল নেই, বিদ্যুৎ নেই। কিয়েভ থেকে লোকজন পালাচ্ছে। জেনারেল সার্গেই সুরোভিচিন মনে করেন, রাশিয়াকে রক্ষা করতে হলে ইউক্রেন ধ্বংস করতে হবে এবং তিনিই এই কাজের যোগ্য মানুষ। সুরোভিচিনের কাজ সবে শুরু। প্রতিদিনের যুদ্ধ পরিস্থিতি প্রমাণ করছে তিনি কত ভয়াবহ। স্পষ্টতই, পুতিনকে ইউক্রেন থেকে দূরে রাখতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement

সকল