২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভেটো পাওয়ার : বিশ্বশান্তির বাধা হয়ে যাচ্ছে

-

রোহিঙ্গা সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করেছে। গত ২৯ অক্টোবর পত্রিকায় প্রকাশিত পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এটিই প্রতীয়মান হয়, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগের কোনো অগ্রগতি হয়নি এবং গোটা বিশ্ব বাংলাদেশকে বাস্তবসম্মত ও কার্যকর কোনো প্রকার সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেনি। এ মর্মে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিম্নবর্ণিত বক্তব্য থেকে রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সহজেই অনুমান করা যায়।

বিশ্ব রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে মোটেও কিছু করেনি বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। সম্প্রতি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিমন্ত্রী আলম বলেছেন, ‘রাজনৈতিক এবং প্রত্যাবাসন সমাধানে বিশ্ব একেবারে কিছুই করছে না। তারা এখনো তাদের সব শক্তি প্রয়োগ করেনি। সাম্প্রতিককালেও তারা মিয়ানমারে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ছিল।’ তিনি আরো বলেন, ‘মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্ব মোটেও কিছু করেনি। বাংলাদেশ বৈশ্বিক সহায়তা ছাড়াই ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে।’ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রতি বছর হ্রাস পাচ্ছে এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে সাত লাখের বেশি মানুষ বাংলাদেশে আসার পর থেকে বিগত পাঁচ বছরে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে কোনো বাস্তব অগ্রগতি হয়নি।’

প্রতিবেদনে প্রতিমন্ত্রীর উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘মিয়ানমারের সামরিকজান্তার ওপর যথেষ্ট চাপ দেয়া হয়নি।’ তিনি জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যা মামলা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে জোরপূর্বক দেশ ছাড়তে বাধ্য করা সংক্রান্ত মামলায় ব্যাপকতর আন্তর্জাতিক সমর্থনের আহ্বান জানিয়েছেন। মিয়ানমারের সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাদের ভ্রমণ ও অর্থের ওপর প্রস্তাবিত নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে শাহরিয়ার আলম বলেন, এসব ব্যক্তি খুব কমই ভ্রমণ করে থাকে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য জাতিসঙ্ঘের মানবিক আবেদনে এ বছর প্রয়োজনীয় অর্থের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পেয়েছে।’ বিশ্বব্যাপী ব্যয় বৃদ্ধির কারণে আগামী বছর আরো কম অর্থ দেয়া হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।

প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কিছু লোককে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের ওপর বোঝা উল্লেøখযোগ্যভাবে লাঘব করার জন্য আরো কয়েকটি দেশের অনুরূপ প্রস্তাব দিতে হবে।’ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য অনেক কিছুর ইঙ্গিত বহন করে। এতে বোঝা যায়, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পুনর্বাসনের কার্যকর কোনো উদ্যোগ জাতিসঙ্ঘ গ্রহণ করেনি, এমনকি সাহায্য-সহযোগিতার পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে। রিফিউজিদের সমস্যা সমাধান করা জাতিসঙ্ঘের অন্যতম দায়িত্ব। এ কারণে জাতিসঙ্ঘে UNHCR অর্থাৎ United Nation High Commission for Refugee নামে আলাদা দফতর স্থাপন করা হয়েছে। এ দফতরের একমাত্র কাজ রোহিঙ্গাদের মতো রিফিউজিদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন নিয়ে। জাতিসঙ্ঘ একটি শক্তিশালী ক্ষমতাসম্পন্ন সংগঠন, আমার দৃষ্টিতে এটি একটি অরাজনৈতিক রাজনৈতিক সংগঠন। কারণ এ সংগঠনটি রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত। জাতিসঙ্ঘের একটি সাধারণ পরিষদ রয়েছে, সদস্যভুক্ত সব রাষ্ট্রই সাধারণ পরিষদের আওতাভুক্ত। কিন্তু নিরাপত্তার প্রশ্নে সিকিউরিটি কাউন্সিলের সম্মতি ব্যতীত জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনো প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণে অপারগ। কারণ নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো পাওয়ার। এই ভেটো পাওয়ারই এখন সর্বজনীন বিশ্ব শান্তির জন্য একটি বিষফোঁড়া, যার বিষক্রিয়া শান্তি স্থাপনে জাতিসঙ্ঘকে অকার্যকর করে রেখেছে। ফলে জাতিসঙ্ঘ শুধু রিলিফের জন্য ভূমিকা রাখছে, বিশ্বশান্তির জন্য নয়।

নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি বৃহৎ রাষ্ট্রের ভেটো পাওয়ার রয়েছে। রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে- আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্স। এ পাঁচটি রাষ্ট্রের যেকোনো একটি রাষ্ট্র ভেটো দিলে সিকিউরিটি কাউন্সিল কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে। ফলে এ মর্মে সিকিউরিটি কাউন্সিল মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য Peace Keeping Force নিয়োগ করতে পারছে না।

রিফিউজিদের প্রতি জাতিসঙ্ঘের দায়িত্ব 
জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী-বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) শরণার্থী সংক্রান্ত জাতিসঙ্ঘের প্রধান সংস্থা হিসেবে আইআরো-এর স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন ঘটনাবলি যেমনÑ মানবাধিকার সর্বজনীন ঘোষণার ১৪(১) নং অধ্যায়, নিপীড়নের সাথে ‘আশ্রয়’-এর সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক আশ্রয়ের প্রভাব বিবেচনায় এনে এর ক্ষমতার ক্ষেত্র এবং ব্যাপ্তি নিয়ে সম্পূর্ণরূপে বিবেচনা করা হয়েছে। এভাবে শরণার্থীর আন্তর্জাতিক আইনি ধারণার ভিত্তি চুক্তি, জাতীয় ও জাতিসঙ্ঘের রীতি এবং ইউএনএইচসিআর-এর সংবিধানে দেখা যায়।

জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী-বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) সংবিধান :
শরণার্থীদেরকে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা ও শরণার্থী সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ ইউএনএইচসিআর প্রতিষ্ঠা করে। ইউএনএইচসিআর-এর সংবিধান অনুযায়ী এর কর্মকাণ্ড হবে সম্পূর্ণরূপে অরাজনৈতিক, মানবিক ও সামাজিক। এর কর্মকাণ্ড শরণার্থী-সংশ্লিষ্ট হবে।

সংবিধান মোতাবেক আগে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তি ও কর্মসূচির আওতায় শরণার্থীরা প্রথমে ইউএনএইচসিআর-এর ক্ষমতার মধ্যে আসবে। ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারির আগে যেসব লোক তাদের নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল এবং নিপীড়িত হওয়ার ভয়ে তারা দেশে যেতে পারে না কিংবা ইচ্ছুক নয়, তাদেরকে ইউএনএইচসিআর-এ সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যে সব লোক তার নিজ দেশ কিংবা কোনো দেশের অভ্যাসগত বাসিন্দা হলে যদি সে দেশ থেকে বিতাড়িত হয় এবং তারা যদি নিপীড়িত হওয়ার ভয়ে সে দেশে যেতে ইচ্ছুক না হয় তাহলে তারা ইউএনএইচসিআর-এর সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হবে।

উপরোক্ত বিবরণী সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য হবে। এতে কোনো সাময়িক কিংবা ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা থাকবে না। শরণার্থীদের ক্ষেত্রে বাস্তব কিংবা ভাবাদর্শগত মাপকাঠী তাৎপর্যপূর্ণ সীমাবদ্ধতা। বর্ণিত কারণের মধ্যে নির্যাতনের ভয় রয়েছে তা শরণার্থীদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কারা জাতিসঙ্ঘের সুরক্ষা ও সহযোগিতা পাবে তা নির্ধারণের জন্য শরণার্থীর সংজ্ঞায় একটি সমালোচনামূলক বিষয় রয়েছে। এটি তাদের সরকার প্রদত্ত সুরক্ষা অভাবের জন্য। সরকার সাধারণ বিদেশী ও শরণার্থীদের মধ্যে পার্থক্য করে। এই অভাব পূরণের জন্য উপযুক্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার লক্ষ্য হবে জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকারসহ শরণার্থীদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করা।

একই সাথে ‘সুরক্ষা কর্মকাণ্ড’ কেবল শরণার্থীর বিশেষ ইস্যুকেন্দ্রিক হবে। উদাহরণস্বরূপ এটি নিশ্চিত করতে হবে, যে দেশে বিপদগ্রস্ত সে দেশে শরণার্থীকে জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো যাবে না। এটিও নিশ্চিত করতে হবে, শরণার্থীর একটি জ্ঞাত প্রক্রিয়ায় প্রবেশাধিকার থাকবে এবং প্রত্যেক শরণার্থী স্বীকার করবে, আশ্রয় মঞ্জুর করা হয়েছে, বিতাড়ন রোধ করা হয়েছে এবং ভ্রমণ ও পরিচয়-সংক্রান্ত কাগজপত্র ইস্যু করা হয়েছে। সরকারের হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু অধিক্ষেত্র ভিত্তি থাকতে হবে, বিশেষ করে যখন রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে করা হয় যা আশ্রয়ের নিরোধী কিংবা যে আইন, বিধি কিংবা রীতি-নীতি সংক্ষিপ্ত খারিজ-ভিত্তিক হতে পারে।

চীনের উইঘুরে মুসলমানদের ওপর চীন সরকারের অমানুষিক নির্যাতন ও রোহিঙ্গাদের দেশান্তরী হওয়ার কাহিনী একই সূত্রে গাঁথা। কারণ তারা মুসলমান। ইসলাম একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনীতে কোনো সাম্প্রদায়িক উক্তি বা ঘটনা পরিলক্ষিত হয় না। তারপরও শুধু মুসলমানদেরই জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক বানানোর জন্য বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যার পেছনে ব্যয় হচ্ছে তাদের মোটা অঙ্কের অর্থ। গৃহযুদ্ধ বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরোধ করার প্রশ্নেও জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ Peace Keeping Force নিয়োগ করতে পারে। কিন্তু যেখানে মুসলমান নির্যাতিত সেখানে জাতিসঙ্ঘ নীরব। সৌদি আরব যেখানে বিশ্ব মুসলিমদের নেতৃত্ব দেয়ার কথা- হালে তারাও হাঁটছে ভিন্নপথে।

সৌদি যুবরাজ সালমান পশ্চিমা সংস্কৃতিকে বিভিন্ন পন্থায় সৌদিতে প্রবেশ করাচ্ছেন। অথচ এ পবিত্র শহরের পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব যাদের হাতে বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের প্রশ্নে তাদের ভূমিকাই প্রশ্নবিদ্ধ। নিরাপত্তা পরিষদে যে পাঁচটি রাষ্ট্রের ভেটো পাওয়ার রয়েছে তাদের মধ্যে একটিও মুসলিম রাষ্ট্র নয়। অথচ পৃথিবীতে ৫৬টি মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে। ফলে বিশ্বশান্তিতে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে (Security Council) মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিনিধি থাকা দরকার যার ‘ভেটো পাওয়ার’ থাকতে হবে। মুসলিম সমাজের উপলব্ধি হওয়া দরকার, মুসলমানরাই বহুজাতিক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement