২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মুদ্রায় ডলারের একাধিপত্য

- ছবি : সংগৃহীত

সঙ্গত কারণে প্রশ্ন জাগে, ডলার কিভাবে বিশ্বের প্রায় সব দেশের মুদ্রা খাচ্ছে? সহজ কথায় বলতে গেলে, ধরুন, বাংলাদেশে মাত্র ছয় মাস আগে এক ডলার সমান ছিল বাংলাদেশী ৮৬ টাকা। সেই এক ডলার মাত্র ছয় মাস পরে এখন ১১০ টাকা; শতকরা ২৭ ভাগ মান কম। তার মানে ছয় মাসে ডলার বাংলাদেশী টাকার ২৭ ভাগ খেয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ কোনো অপরাধ না করে, কোনো ব্যর্থতা না থাকার পরও বাংলাদেশের টাকার মান শুধু ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে কমে গেল এবং সাথে পণ্যের দাম ২৭ ভাগ বেড়ে গেল। একইভাবে বিশ্বের প্রায় সব দেশের মুদ্রাকে ডলার খেয়ে ফেলেছে গত কয় মাসে অনেকাংশে। আবার প্রশ্ন হলো- খেতে দিচ্ছে কেন বিশ্ব? এক কথায় বলতে হয়, পছন্দ করেন কি নাই করেন, ডলার এখন বিশ্ব মুদ্রা বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা। কিভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হলো সে কথা আগের অনেক প্রবন্ধে বলেছি। আলোচনার স্বার্থে আবারো সংক্ষেপে বলছি। ডলার অন্যসব দেশের কারেন্সির মতোই একটি ফিয়াট কারেন্সি যা কাগজের নোটের মাধ্যমে ব্যবহৃত এবং এই নোটের সাথে কোনো মূল্যবান স্বর্ণ-রৌপ্য ধাতুর বাস্তবে সম্পর্ক নেই। এ ক্ষেত্রে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক তাদের চাহিদামতো ডলার নামে এই ফিয়াট কারেন্সি ছাপিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

উল্লেখ্য, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় মূলত ইউরোপে। ফলে ইউরোপের দেশগুলো যুদ্ধের খরচ মেটানোর জন্য তাদের স্বর্ণের মজুদের ভিত্তিতে যে পরিমাণ নোটের মুদ্রা ছাপানো সম্ভব ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ছাপিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে নিজেকে না জড়িয়ে কেবল ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে অস্ত্র ও যুদ্ধের রসদ বিক্রি করে মূলত স্বর্ণের বিনিময়ে। ফলে আমেরিকার অর্থনীতি যেমন সমৃদ্ধ হয় তেমনি বিশ্বের স্বর্ণের উল্লেøখযোগ্য অংশ আমেরিকায় জমা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্বর্ণের ঘাটতির কারণে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ তাদের স্বর্ণমান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের মুদ্রা ফিয়াট কারেন্সিতে রূপান্তরিত হয়। তবে মার্কিন ডলার তখনো ফিয়াট কারেন্সিতে পরিণত হয়নি। ফলে ডলার স্বর্ণমান বা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ধরে রাখায় আস্থা অর্জন করে এবং বিভিন্ন দেশ তাদের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবেও ডলার সঞ্চয় করতে থাকে। একপর্যায়ে ডলার গ্লোবাল কারেন্সি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। যুক্তরাষ্ট্র তখন তাদের রফতানি করার জিনিসপত্রের বিনিময়ে স্বর্ণ ছাড়া অন্য কোনো কিছু গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণের মজুদ বাড়তে থাকে, বিপরীতে অন্য রাষ্ট্রগুলোর স্বর্ণের মজুদ কমতে থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। যুদ্ধ হয় ইউরোপে, যুক্তরাষ্ট্রে নয়। শেষের দিকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের তেমন ক্ষতি হয়নি। অধিকন্তু তারা ইউরোপের কাছে অস্ত্র বিক্রয় করে স্বর্ণের বিনিময়ে। এই সময় যুক্তরাষ্ট্র তার রফতানিকৃত পণ্যের বিনিময়ে স্বর্ণ ছাড়া অন্য কোনো কিছু গ্রহণ করেনি। এই নীতির কারণে ১৯৪৭ সালে বিশ্বের মোট মজুদকৃত স্বর্ণের ৭০ শতাংশই ছিল আমেরিকার হাতে। যুদ্ধপরবর্তী অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখার জন্য ১৯৪৪ সালে মিত্রপক্ষের ৪৪টি সদস্য রাষ্ট্রের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ব্রেটন উডস চুক্তি করে এবং এই চুক্তির মাধ্যমেই স্বর্ণকে পাশ কাটিয়ে মার্কিন ডলারকে আনুষ্ঠানিকভাবে রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন ঘোষণা করেন, মার্কিন ডলারের সাথে স্বর্ণের কোনো সংযোগ থাকবে না, যা নিক্সন-শক নামে পরিচিত। তিনি আরো ঘোষণা করেন, এখন থেকে আর কোনো দেশ চাইলেই নির্দিষ্ট মূল্যে মার্কিন ডলারের বিনিময়ে স্বর্ণ কিনতে পারবে না। তার মানে মার্কিন ডলারও তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুদ্রাগুলোর মতো ফিয়াট কারেন্সিতে পরিণত হয়। অধিকন্তু, বিশ্বজুড়ে আমেরিকান ডলারের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে ও চাহিদা বাড়ানোর জন্য ১৯৭৪ সালে সৌদি আরবের বাদশা ফয়সালও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে একটি চুক্তি করেন, পেট্রল কেবল ডলারের বিনিময়ে ক্রয় করতে হবে। পরে ওপেকও এই নিয়ম মানতে বাধ্য হয়। বিশ্ব বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণকারী একক মুদ্রা হিসেবে ডলারকে প্রতিষ্ঠিত করার ও টিকিয়ে রাখার মহৌষধ ছিল ডলারকে পেট্রোডলারে রূপ দিতে পারা। এরপর যত দেশ ডলার থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেছে তত দেশকেই বল প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র ডলারে থাকতে বাধ্য করছে; এভাবেই একটি দেশের ফিয়াট কারেন্সি এখন বিশ্বমুদ্রা।
সঙ্গত কারণে আবার প্রশ্ন জাগে, ডলার একা কিভাবে সারা বিশ্বের মুদ্রা খাচ্ছে? আগের সেকশনে বলেছি ডলারের ক্যারিশমার কথা। আর ওই শক্তির সাথে ডলার বিশ্বকে শোষণ করার জন্য অনেক কারুকার্য করে যার কিছুটা বর্ণনা এখানে দেয়া হলো।

এ কথা সত্যি, ডলার তো আর শূন্যের মধ্যে শক্তিশালী হয় না, তাকে তো কোনো না কোনো কিছুর সাপেক্ষে শক্তিশালী হতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এটিই অর্থনীতির চিরাচরিত ধারণা। কিন্তু কপি বুক বোধ হয় সবসময় অন্ধের মতো অনুসরণ করা যায় না। বাস্তবতা বুঝে করতে হয়। বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে লড়াই করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নীতি সুদহার বৃদ্ধির হিড়িকের পরিপ্রেক্ষিতে যে মন্দার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এমন কথা বলছেন বিশ্লেষকরা। বিষয়টি হলো- পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনীতির, ততোধিক প্রভাবশালী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে তার প্রভাব শুধু সে দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সেই প্রভাব গড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের প্রায় সর্বত্র। ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড) ব্যাংক অনুসরণে অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে এবং অনিয়ন্ত্রিত ডলারের প্রভাবে অন্যান্য দেশের মুদ্রার অবনমন এখন বাস্তবতা। ফলে অনেকেই বলছেন, এখন যে বিশ্বজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, তা মূলত ডলারবাহিত মূল্যস্ফীতি। ফেডের সুদের হার বৃদ্ধির প্রভাব অন্যান্য দেশেও পড়ছে। কারণ, ওই সব দেশ মনে করে, তারা যদি ফেডের পেছনে পড়ে যায়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা তাদের দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে পারে, আর তাতে মহাবিপদ। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন ডলার সে দেশেই জমা রাখা লাভজনক ও নিরাপদ। ফলে ভারতের মতো বিশ্বের অনেক দেশের বাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নেয়ার ঢল পড়েছে। ফেডের অনুসরণে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, নরওয়ে, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাইওয়ান, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন, ভারত ও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারসহ এ বছর সব মিলিয়ে তিনবার নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেছে।

ফেডারেল রিজার্ভের এ নীতি সুদহার বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় সুফল হলো, ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া। প্রভাবশালী মুদ্রাগুলোর মধ্যে ডলারের বিনিময় মূল্য এখন গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এতে মার্কিন নাগরিকদের সুবিধা হলেও অনেক দেশের অবস্থা বিপজ্জনক। আমদানি মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ অনেক উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশ বিপাকে পড়েছে।

আগেই বলেছি, ডলার তো আর শূন্যের মধ্যে শক্তিশালী হয় না, তাকে তো কোনো না কোনো কিছুর সাপেক্ষে শক্তিশালী হতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল রিজার্ভের কারুকার্য অন্যান্য দেশের জন্য রীতিমতো শাস্তিমূলক হয়ে উঠেছে। ফেডের এ নীতি সুদ বৃদ্ধির হিড়িকে জাপানের মতো দেশও স¤প্রতি ইয়েনের দর বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছে যা গত ২৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। উল্লেøখ্য, জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশ্বের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল, তারা এত দিন নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেনি। অথচ তারাও শেষমেশ তা করতে বাধ্য হলো।

এ পরিস্থিতিকে অনেক অর্থনীতিবিদ বিনা অপরাধে শাস্তির কথা বলেছেন এবং আরো বলছেন- এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য যথাযথ নীতি প্রয়োজন, কোনো ধরনের ব্যত্যয় হলে তার জন্য শাস্তি পেতে হবে। ডলারের এই কাণ্ডকীর্তি শুরু হয় ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই। করোনা মহামারী মোকাবেলায় আমেরিকান সরকার সে দেশের জনগণকে বিপুল প্রণোদনা দিয়েছে। এ অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে তারা যেমন একদিকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তেমনি সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ বিপুল মুদ্রা ছেপেছে। আর সেই ডলারের হাত ধরে মূল্যস্ফীতি দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্লোবাল টাইমসের মতে, এবারের বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি মূলত ডলারবাহিত মূল্যস্ফীতি। ডলারের কারুকার্য বলতে মূলত ডলারের অতি মুদ্রণ প্রথমত দায়ী। অর্থাৎ ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র তার আগের কয়েক দশকের তুলনায় অনেকগুণ বেশি ডলার ছেপেছে। সূত্র মতে, ১৮ ট্রিলিয়ন বা ১৮ লাখ কোটি ডলার করোনার প্রভাব মোকাবেলার জন্য ছাপিয়েছে। এই অতিরিক্ত ডলারের কারণে সারা পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, বিশ্বে অস্ত্রের যুদ্ধ যতটা না ভয়ানক তার চেয়ে ভয়ানক মুদ্রার যুদ্ধ। এমনকি অস্ত্রের যুদ্ধও বাধে অথবা বাধায় মূলত মুদ্রার মান রক্ষা তথা অর্থনৈতিক কারণে। অভিযোগ রয়েছে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধও আমেরিকার পরিকল্পিতভাবে বাধানো। এই যুদ্ধ বাধিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্যস্ফীতি বিদেশে রফতানি করেছে। কোভিড অতিমারীর বিপর্যয় যুক্তরাষ্ট্রকে এই সুযোগ করে দিয়েছে। মন্দার কারণে গরিব দেশগুলোর রফতানি আয়, রেমিট্যান্স কমে গিয়ে তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের চাহিদা সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি আমদানি প্রবাহ ঠিক রয়েছে; এমনকি একভাবে বেড়েছে মূলত পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে। ফলে রিজার্ভে ঘাটতি দেখা দিয়ে শ্রীলঙ্কা, লেবানন এখন দেউলিয়া; পাকিস্তান ও বাংলাদেশও একই পথে হাঁটছে।

বর্তমান সুদের হার কমানোর মতো, ২০০৭-০৮ সালের আর্থিক সঙ্কটের আগেও যুক্তরাষ্ট্র সুদহার কমানোর নীতি গ্রহণ করেছিল। তার পরিণতিতে বন্ধকি ঋণের সঙ্কটে পড়ে তারা। কিন্তু সে দেশের নীতিপ্রণেতারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেননি বলেই অভিযোগ করছেন বিশ্লেষকরা। একইভাবে এবারো কোভিড-১৯ মহামারীর ধকল কাটিয়ে উঠতে নীতি সুদহার কম রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন। শুধু তা-ই নয়, ফেডারেল রিজার্ভ ট্রেজারি বন্ডসহ অন্যান্য সিকিউরিটিজ-সমর্থিত সম্পদ কিনেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা বাজারে বিপুল নগদ অর্থ সরবরাহ করেছে।

মুদ্রাস্ফীতি কমানোর একটি বিশ্বব্যাপী বহুল প্রচলিত টেকনিক ছিল, সুদের হার বাড়ানো। তবে বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে ধারণা এতদিন বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ছিল, তা ইতোমধ্যে ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। নীতি সুদের হার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সামান্যতম সাফল্য মিলছে না; বরং এতে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিবিদদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকও একই সুরে কথা বলেছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেভাবে একযোগে সুদের হার বাড়াচ্ছে, তা গত পাঁচ দশকে আর দেখা যায়নি। এ প্রবণতা আগামী বছরও থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে; বরং সরবরাহব্যবস্থা গতিশীল করা এবং ভ‚রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব নিরসনেই বেশি গুরুত্ব দেয়ার পক্ষপাতী তারা। বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করবে, যা ২০০১ সালের গড় হারের দ্বিগুণের বেশি।

উল্লেখ্য, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর টেকনিক সাময়িকভাবে ফলপ্রসূ হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে সুদের হার বাড়ানোর প্রভাবে অর্থনীতিতে মন্দা অবশ্যম্ভাবী। কারণ সুদের হার বাড়ালে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা না করে বেশি হারে সুদ পাওয়ার জন্য টাকা ব্যাংকে রেখে দেবে। ফলে, শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়, উৎপাদন কমে এবং কর্মের সুযোগ কমে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে গিয়ে মহামন্দা দেখা দেয়।

তাহলে প্রশ্ন হলো- এর সমাধান কী, অর্থাৎ কিভাবে পৃথিবীকে মন্দায় ফেলে না দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি কমানো যাবে? এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ১৯৮০-এর দশকেও ডলারের এমন উল্লম্ফন দেখা গিয়েছিল। তার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তখনকার জি-ফাইভভুক্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য সমন্বিতভাবে মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ করে, যাকে বলে প্লাজা অ্যাকর্ড। উল্লেখ্য, প্লাজা অ্যাকর্ড ছিল একটি যৌথ-চুক্তি যা ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫ সালে নিউ ইয়র্ক সিটির প্লাজা হোটেলে তখনকার জি-ফাইভ দেশ, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এটি ছিল মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ করে ফ্রেঞ্চ ফ্রাঙ্ক, জার্মান ডয়েচে মার্ক, জাপানিজ ইয়েন ও ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিংয়ের সাথে সম্পর্কিত মার্কিন ডলারের অবমূল্যায়ন। এই চুক্তির কারণে চুক্তির সময় থেকে ১৯৮৭ সালে লুভর অ্যাকর্ড দ্বারা প্রতিস্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত মার্কিন ডলারের উল্লেখযোগ্যভাবে অবমূল্যায়ন হয়েছে। কিছু মন্তব্যকারী বিশ্বাস করেন, প্লাজা অ্যাকর্ড ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে জাপানি সম্পদ মূল্যের বুদবুদ সৃষ্টিতে অবদান রেখেছিল।

ডলারের চলমান এই তাণ্ডবের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এখন অ্যাকর্ড চুক্তির মতো আরো একটি চুক্তির সময় এসেছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন চুক্তিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সুতরাং তেমন উদ্যোগের সম্ভাবনা খুবই কম কারণ দেশটির জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের পরিচালক বলেছেন, ‘আমি মনে করি না, তেমন কোনো ঐকমত্যের দিকে আমরা এগোচ্ছি।’ তার এই বক্তব্য খুবই স্বাভাবিক, কারণ ডলারের বর্তমান অতিমূল্যায়ন তাদের নিজস্ব কারুকার্যের ফসল। যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতির হারও ভয়াবহ। তথ্য মতে, গত চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি। বর্তমানে তা ৭ শতাংশে ঠেকেছে বলে সতর্ক করেছে দেশটির সর্বোচ্চ ব্যাংক। তবে এত মুদ্রাস্ফীতি এমনকি অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কার পরও যুক্তরাষ্ট্র সুদের হার কমিয়ে ডলারের অবমূল্যায়ন করার উদ্যোগ নিতে চাচ্ছে না মূলত ডলার তার দাপট হারানোর সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, এই জন্য। সুতরাং নিজেদের মুদ্রা ডলারকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেদের দেশের সাময়িক সমস্যা মেনে নিয়েও তারা সুদের হার বাড়িয়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশের মুদ্রাকে বিপদে ফেলছে; এমনকি এর পরিণতিতে বিশ্বে মহামন্দা আসার সম্ভাবনাকেও তারা আমলে নিচ্ছে না।

উল্লেখ্য, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এখন এক নম্বর সমস্যা মূল্যস্ফীতি। এই মূল্যস্ফীতি যতটা না রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে, তার চেয়ে বেশি ডলার অতিমূল্যায়নের কারণে। বিশ্বব্যাপী সব ধরনের অর্থনৈতিক নীতি নেয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে। অথচ কাজ হচ্ছে না, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ মূল্যস্ফীতি কমাতে আগ্রাসীভাবে নীতি সুদের হার বাড়াচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে মন্দাকে পর্যন্ত ডেকে আনতেও তোয়াক্কা করছে না। এ নিয়ে এখন বিশ্বব্যাপী চলছে প্রবল বিতর্ক। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, সবাই যদি সমন্বিতভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি না করে, তাহলে মন্দার চেয়েও খারাপ অবস্থা হতে পারে। দেখা দিতে পারে স্ট্যাগফ্লেশন। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি আদৌ কমল না, অথচ প্রবৃদ্ধি কমে গেল ভয়াবহভাবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ যাদের ওপর সবচেয়ে বেশি, তাদের রক্ষা করা না গেলে বিশ্বের দেশে দেশে মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে।’

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল গত ফেব্রুয়ারি থেকেই। গত জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে তা ৬ শতাংশ অতিক্রম করে। এরপর মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়ে বর্তমানে কাগজ-কলমেই প্রায় ১০ শতাংশ; বাস্তবে হয়তো আরো বেশি। এর কারণ, নিয়ন্ত্রণহীন বাজারের অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। অথচ জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির সাথে সমানভাবে আয় বাড়ছে না, ফলে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এ রকম এক পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কিছু পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়েই দায় সারছে। অথচ বিশ্বব্যাপীই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে মুদ্রানীতির প্রয়োগ, মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস। আমানতের সুদের হারে কিছুটা তারতম্য করলেও ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ ঠিক রাখছে। একদিকে মানুষ ব্যাংক থেকে জমা টাকা তুলে খাচ্ছে, অন্য দিকে সুদের হার কম থাকার কারণে জমার হার কম। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির কারণে জমা টাকার প্রকৃত পরিমাণ ভল্টে বসেই কমছে। ফলে ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট দেখা দেয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।

এক কথায় বলতে গেলে, অর্থনীতির এ অব্যবস্থা মূলত সুদভিত্তিক অর্থনীতির কারণে। লাভ-লোকসান, ক্রয়-বিক্রয় ও ইজারাভিত্তিক অর্থব্যবস্থা বা ব্যাংকব্যবস্থা বহাল থাকলে আমেরিকা ডলারের সুদের হার বাড়িয়ে বিশ্বের মুদ্রাবাজারকে এমন বিপদে ফেলতে পারত না। ফিয়াট কারেন্সি নামক কোনো কারেন্সির অস্তিত্ব থাকত না। এই সত্যটি ২০০৭-০৮ সালের ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার সময় প্রমাণিত হয়েছে। উত্তর আমেরিকার থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমাবিশ্বের বড় বড় ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলো যখন অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছিল তখন বিশ্বের ছোট ছোট শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক এবং ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলোরও প্রত্যক্ষভাবে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি; তবে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা হলে পরোক্ষ ক্ষতি তো হতেই পারে। কারণ, শরিয়াহভিত্তিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম অ্যাসেট ব্যাকড; ফলে, দেউলিয়া হওয়ার সুযোগ কম। লাভ-লোকসান ও ক্রয়-বিক্রয়ভিত্তিক; ফলে পণ্য উৎপাদন করতে হবে; কর্মও বহাল থাকবে। বাজারে যত পরিমাণ পণ্য থাকবে সেই অনুপাতে মুদ্রা থাকবে, ফলে মূল্যস্ফীতি থাকবে না। সুতরাং ধীরে ধীরে সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম থেকে সরে এসে লাভ-লোকসান, ক্রয়-বিক্রয় ও ইজারাভিত্তিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমই মূলত মূল্যস্ফীতি তথা মন্দা মুক্তির একমাত্র উপায়।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : mizan12bd@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement