২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পথশিশুদের কথকতা

পথশিশুদের কথকতা - ছবি : সংগৃহীত

দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের একটি বিষফল হচ্ছে ‘পথশিশু’। এসব শিশু, কিশোর ও তরুণরা অভিভাবকহীন। এদের আশ্রয়, ঘুমানোর ও খাবারের জায়গাও পথ। নির্দিষ্ট কোনো থাকার ও খাবারের জায়গা নেই, ঘুমানোর ব্যবস্থা নেই। এরা পথে পথে ঘোরে, যেখানেই সুযোগ পায় ফুটপাথের উপরে, দোকানের আড়ালে, ফুটওভারব্রিজে এরা ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ পিতৃ-মাতৃহীন। ঘরের পিছুটান নেই এদের। এই ধরনের শিশুদের সংখ্যা নিয়ে মতবিরোধ আছে। ইউনিসেফের হিসাবে ছয় লাখ ৭০ হাজার, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের হিসাবে ১৬ লাখ। দেশে এদের ৭৫ শতাংশ হলো ঢাকা শহরে। কোনো দেশের সামাজিক দারিদ্র্যের চরম বহিঃপ্রকাশ দারিদ্র্যপীড়িত শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত, অভাবী শিশুদের সংখ্যা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা একদিকে দাবি করছি আমাদের দারিদ্র্যের হার কমেছে; কিন্তু একই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পথশিশুদের সংখ্যা। এ শিশুরা তাদের জীবন ধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না। এরা অপুষ্টিতে ভোগে, ভোগে বিভিন্ন রোগে। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের সাথে অনেকে জড়িয়ে যায়। এদের ভেতরে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অন্ধকারে হারিয়ে যায়, অপরাধ জগতের দিকে পা বাড়ায়। এদের নিয়ে তৈরি হয় কিশোর গ্যাং এবং এই কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত ও অসহনীয় দৌরাত্ম্য নিয়ে কমবেশি সবাই ভুক্তভোগী। সবাই এদের ভয় পায়। এরা একটি অদৃশ্য জনগোষ্ঠী। জনশুমারিতে এদের কোনো জায়গা নেই। তারা বেড়ে উঠে সুবিধাবঞ্চিত হয়ে। সরকার, আইনি কর্তৃপক্ষ ও প্রভাবশালীরা এদের ব্যাপারে খুব একটা সজাগ নন। এদের ব্যাপারে যেন কারুই গরজের বালাই নেই। এরা যেন সমাজে অপাঙ্ক্তেয়। এসব পথশিশুদের ব্যাপারে মনোযোগী নয় শিশু মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর এবং শিশু নিয়ে যেসব দেশী ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে, তারা। এই সুযোগে এদের বিভ্রান্ত করার একটি পরিবেশ তৈরি হয় এবং অপরাধ জগতের হোতারা এই সুযোগটি গ্রহণ করে।

বাংলাদেশে সরকারিভাবে ৭৩টি এতিমখানা রয়েছে। এই ৭৩টি এতিমখানায় সাড়ে ৯ হাজার শিশুর বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা রয়েছে। এই বেড়ে ওঠা খুব যে একটা শিশুবান্ধব পরিবেশে, তা বলা যায় না। এখানে তারা থাকে ন্যূনতম খাবারের সাশ্রয়ে। এদের নেই কোনো কারিগরি শিক্ষার সুযোগ, কমবেশি সবাই মাদরাসা সিলেবাসে পড়াশোনা করে। অপর দিকে, কারিগরি শিক্ষা বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় মাদরাসার পরিসরে এর সুযোগ নিতান্তই সীমিত। অনেক ক্ষেত্রেই রুদ্ধ। রাস্তা-ঘাটে, ফুটপাথে, ট্রাফিক সিগন্যালে এদের কেউ কেউ বিভিন্ন রকম টুকটাক জিনিসপত্র বিক্রি করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। এটি সবসময়ই অনিশ্চিত। আজ যে শিশুটি ফুল বিক্রি করছে, কালকে হয়তো দেখা গেল, ভিন্ন একটা কিছু হাতে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। কোনোটিতেই তারা স্থিত নয়। এদের প্রতি দৃষ্টি দেয়া দরকার। এরা যেন বিপথগামী না হয়। এরা যেন নিগ্রহ, অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার না হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আইনি কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সাহায্যের পরিবর্তে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শারীরিক অত্যাচারের পথ বেছে নেয়।

কারণে-অকারণে তাদের গ্রেফতার করা হয়। জেলে পাঠানো হয়। একবার জেলের ভেতরে গেলে এদের ছাড়ানোর কেউ থাকে না। এরা এখানেই ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে অপরাধীদের সাথে। অপরাধীদের মনন ও মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে। অথচ তারা এই সমাজেরই অংশ। তাদের লেখাপড়ার সুযোগসহ চিকিৎসা ও খাদ্যের নিরবচ্ছিন্ন ব্যবস্থা করা আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। আমাদের সামাজিক সচেতনতা ও দায়বোধের অভাবের জন্য এ অবস্থার সৃষ্টি। এটি অস্বীকার করা যায় না। একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন সমাজের প্রতিটি অংশকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা।

নৈতিকতাসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি হওয়া। পথশিশুদের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় লক্ষ করার মতো। আমাদের শিশুদের মতো বড় হওয়ার অবারিত সুযোগ তাদের মৌলিক অধিকার পুঁজিবাদী সমাজে যা অকল্পনীয়। বিপরীতে ইসলামী সমাজব্যবস্থায় এতিমরা প্রাধিকারপ্রাপ্ত। সেখানে অসহায়দের অধিকারের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। দায়বোধ আরোপ করা হয়েছে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিত্তবানদের ওপর যেন তারা অন্ধকার পথে পা না বাড়ায়। ইসলাম এটি নিশ্চিত করেছে। আমাদের দেশে আইন আছে, কিন্তু দেখা যায় এই আইন রক্ষার পরিবর্তে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পথশিশুদের ক্ষেত্রে। এভাবেই তারা একটি ভিন্ন মানসিকতায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় হয়।

তারা দেখে, তাদেরই পাশ দিয়ে ঝকঝকে গাড়িতে একটি পরিপাটি শিশু স্কুলে যাচ্ছে; কিছুক্ষণের জন্য হলেও তাদের মনে বঞ্চনার অনুভূতি জাগ্রত হয়। তারও তো স্কুলের যাওয়ার অধিকার ছিল, সুযোগ ছিল; কিন্তু সুযোগ পায়নি। এই হাহাকার তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এই অনুভূতি থেকে এরা পা বাড়ায় অন্ধকারের পথে। প্রথমে ছোটখাটো চুরি, এরপর দলবদ্ধ হয়ে ছিনতাই ও মাদকের সাথে একাকার। এরা অনেক ক্ষেত্রেই যৌন নিগ্রহের শিকারে পরিণত হয় ও ধীরে ধীরে অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যায়।

এদেরকে দেখভাল করার জন্য ইউনিসেফের দায় রয়েছে, দায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শিশু সংগঠনের। এ ক্ষেত্রে শিশু মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের রয়েছে অগ্রণী ভ‚মিকা। কিন্তু কাউকে এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে দেখা যায় না। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক শিশু দিবস পালিত হয় সাড়ম্বরে, জমকালো অনুষ্ঠান দিয়ে, পুরস্কৃত হয় অসংখ্য শিশু। কিন্তু তাদের সারিতে এদের কাউকে দেখা যায় না। এ যেন তাদের অসহায়ত্বের প্রতীক। এ অবস্থা আর কতদিন চলবে।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement