২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পানি ও বাস্তুতন্ত্র : পর্ব-২

ছবি : ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল বাস্তুতন্ত্র - সূত্র : ইন্টারনেট

ভূগর্ভস্থ পানি ও বাস্তুতন্ত্র (Ecosystems)
আগের পর্বে পানি, পানিচক্র, ভূগর্ভ ও ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মানুষের জীবন ধারণের জন্য বাস্তুতন্ত্র আবশ্যকীয়। পানি ছাড়া বাস্তুতন্ত্রের গঠন বা সৃষ্টি সম্ভব নয়। ভূগর্ভস্থ পানির সাথে জীবসত্তার বাসযোগ্য বাস্তুতন্ত্রের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। বাস্তুতন্ত্র পানির ওপর নির্ভরশীল, বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। মূলত ঝিরি, ঝরনা, প্রস্রবণ, গুহা ও গভীর শিকড়যুক্ত উদ্ভিদের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির সাথে এই সংযোগ ঘটে। নদী, খাল-বিল, জলাশয়, জলাভূমি ও হ্রদও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আর যেখানে ভূগর্ভস্থ পানি, ভূপৃষ্ঠের সাথে মিলিত হয়, সেখানে উদ্ভিদ ও প্রাণীর এক অনন্য যৌথ-সম্প্রদায় গড়ে উঠে ও বিকাশ ঘটে।

উদ্ভিদসহ প্রতিটি প্রাণীর জন্ম, জীবনের বিকাশ, জীবনধারণ বা জীবিত থাকা, বংশবৃদ্ধি এবং উত্তরোত্তর বিকাশ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে। বাস্তুতন্ত্রের জন্য তাই পানির উৎস অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ভূগর্ভস্থ পানিতে থাকা ক্ষুদ্র প্রাণীরা যেমন এর মধ্যে থাকা দূষিত পদার্থগুলোকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে, তেমনি ভূপৃষ্ঠের ওপরে অবস্থিত পানির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া অনেক প্রাণী-প্রজাতি নিজেদের আবাসস্থল রক্ষায় ভূগর্ভস্থ পানির নিঃসরণের ওপর নির্ভর করে। এভাবেই যেকোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের পরিবেশগত বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়। এসব প্রাণ-প্রজাতিই বাস্তুসংস্থান সংক্রান্ত বিচিত্রতা ও আঞ্চলিক পরিবেশের জৈবিক স্বাস্থ্যের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির সূচক হিসেবে কাজ করে।

বাস্তুতন্ত্র হলো জীবসত্তার বিকাশ ও জীবনধারণের জন্য একটি গোষ্ঠীগত ব্যবস্থা। বলা যায় যে, এটি হলো জীবসত্তা বেঁচে থাকার জন্য একটি পরিবেশ। জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সহায়ক পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। বাস্তুতন্ত্রে এমন এক সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়; যে পরিবেশে জীবসত্তা (living organism) ও অজীব (non-living) প্রেক্ষিতগুলো যেমন- বায়ু, মাটি, পানি, ভূগর্ভস্থ পানির মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো একটির সাথে আরেকটির যোগাযোগের মাধ্যমে জীবনের প্রেক্ষিত তৈরিতে ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। অন্যভাবে বলা যায়, বাস্তুতন্ত্র হলো এক জটিল প্রাকৃতিক ব্যবস্থা যা উদ্ভিদ, প্রাণী এবং অণুজীবদের সমন্বয়ে গঠিত। আর এই জটিল ব্যবস্থা যখন একটি নির্দিষ্ট স্থানের পরিবেশের মধ্যে স্থাপিত হয়, তখন সেখানে উপরোক্ত প্রত্যেকটি উপাদান একক কার্যকরী উপাদান হিসেবে পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়ে জীবনধারণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।

পরিবেশ টিকিয়ে রাখার জন্য ভূগর্ভস্থ পানির সাথে বাস্তুতন্ত্রের সংযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অতীব অত্যাবশ্যক। কোন জায়গায়, কোন বাস্তুতন্ত্র, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর কতটুকু নির্ভরশীল, তা একমাত্র অনুমান করা যায় সেখানকার উদ্ভিদের পানির ব্যবহার ও বৃদ্ধির মাধ্যমে। মানুষ বাস্তুতন্ত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারণ তাদের সুস্থতা এবং জীবিকা যেমন বাস্তুতন্ত্রের সাথে যুক্ত, তেমনি নির্ভরশীলও। অবশ্য এই সংযোগের ফলেই মানুষের ক্রিয়াকলাপ বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। কারণ মানুষ খাদ্য, পানীয়, জ্বালানি, তন্তু (fibre) ইত্যাদি বাস্তুতন্ত্র থেকেই সংগ্রহ করে।

প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মানুষের জীবনধারণ এমনভাবে সংযুক্ত যে, একটি সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার করতে গেলে, অন্য আরেকটি সম্পদের কার্যকর ব্যবহার ও স্থায়িত্বের সাথে আপস করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়; খাদ্যের জোগান বাড়াতে সেচের প্রয়োজন। সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার করতে হয়। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আবশ্যিকভাবেই বাস্তুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আবার চাষের জন্য জমি বাড়াতে হলে বন উজাড় করতে হবে। অতিমাত্রায় বন উজাড় করলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অথবা জীবনমান উন্নয়নে প্রয়োজন বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন তেল, গ্যাস ও কয়লার ব্যবহার। এসবই ভূগর্ভে থাকা খনিজ। এগুলোর উত্তোলনে ভূগর্ভস্থ পরিবেশ ও ভূপৃষ্ঠে ভূমির আকার-আকৃতিতে পরিবর্তন আসে। এগুলোর ব্যবহারে আকাশে কার্বন-ডাই অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যায়। তাতে জলবায়ুর পরিবর্তন অবধারিত। জলবায়ুর পরিবর্তনে হয়তো বৃষ্টি কমে যাবে অথবা বেশি হবে। তাতে পরিবেশের অবনতি ঘটবে। পরিবেশ খারাপ হলে বাস্তুতন্ত্রে বিভিন্ন আনুষঙ্গিক অজীব উপাদানের কার্যক্রম বিঘিœত হবে, যা আবার মানুষের জীবনমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে অবনতি ঘটাবে। এসবই যেমন মানুষের বেলায় প্রযোজ্য, তেমনি প্রত্যেক জীবের বেলায় এসব শর্ত একই।

এসবের মধ্যে পানি হলো এমন এক প্রাকৃতিক সম্পদ, যা প্রতিটি প্রাণীর জীবনধারণ, তথা গোটা বাস্তুতন্ত্রের জন্য মৌলিক ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের জীবনধারণ ও জীবনমান উন্নয়নে উৎপাদন কার্যক্রমের জন্যও পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। পানির নিরাপত্তা না থাকলে মানুষের জীবিকা নির্বাহ অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই বলা যায়, মানুষের জীবনের বিকাশ, জীবনধারণ বা জীবনমান এবং বাস্তুতন্ত্রের কার্যকর ক্রিয়াকলাপ নির্ভর করে পানিসম্পদের নিশ্চয়তা এবং নির্ভরযোগ্য সরবরাহের ওপর।

বাস্তুতন্ত্রের আকার ও ধরণ
পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। জলবায়ুর ধরন ও পরিস্থিতি নির্ধারণ করে কোন ধরনের বাস্তুতন্ত্র কোন নির্দিষ্ট স্থানের জন্য উপযুক্ত। বিভিন্ন জীবসত্তা বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্রে বাস করে। তারা সংশ্লিষ্ট পরিবেশগত অবস্থার সাথে খাপখাইয়ে নেয়। এতদসত্ত্বেও প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রের মৌলিক ভূমিকা একই। অর্থাৎ জীবসত্তার জন্য জীবনধারণের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী, প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রেই এমন কিছু জীব থাকতে হবে, যেগুলো সেখানে বসবাসকারী জীবসত্তার জন্য খাদ্য উৎপাদন করে; যেমন সাগরে শ্যাওলা, মাছ বা জমিতে গাছপালা, ভূপৃষ্ঠে গাছপালা, বিভিন্ন ধরনের প্রাণী ইত্যাদি। যেসব জীবসত্তা বাস্তুতন্ত্রের ভেতর খাদ্য উৎপাদন করে সেগুলো মানুষ ও অন্যসব জীবের জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং বাস্তুতন্ত্রকে জীবিত প্রাণীর জৈবিক সম্প্রদায় হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে, যা ভৌত পরিবেশ এবং অন্যান্য নির্জীব উপাদানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে ও ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় সদাসর্বদা লিপ্ত থাকে।

প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রের ধরন-আকার পৃথক। একটি দেহের ভেতর যেমন বহু ধরনের বাস্তুতন্ত্র তৈরি হয়, তেমনি বাইরে পুকুরের মতো ছোট জলাশয়ে সৃষ্ট বাস্তুতন্ত্র ও সমুদ্রের মতো বিশাল জলরাশিতে সৃষ্ট বাস্তুতন্ত্র এক নয়। বাস্তুতন্ত্রের দু’টি প্রধান উপাদান হলো- জৈব ও অজৈব উপাদান। বাস্তুতন্ত্রে জৈব বা জীবন্ত অংশ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে অজৈব উপাদান বা অজীবন্ত অংশ। জৈব উপাদানের মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদ, মানুষসহ অন্যান্য জীব। অজৈব উপাদানের মধ্যে রয়েছে- বায়ু, পানি, আলো, মাটি, শিলা, সার্বজনীন পুষ্টি উপাদান।

অন্য দিকে জৈব উপাদান হলো বাস্তুতন্ত্রে বসবাসকারী প্রতিটি উৎপাদক, ভোক্তা, পচনে সাহায্যকারী প্রাণ। জৈব-অজৈব প্রতিটি উপাদান (factor) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। যেমন- একটি বাস্তুতন্ত্রের তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করবে সেখানে কী ধরনের গাছপালা বেড়ে উঠবে ও বিকশিত হবে। জীবনধারণের জন্য এক এক প্রাণী এক এক ধরনের খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল। বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তনের কারণে যদি কোনো প্রাণীর প্রয়োজনীয় খাদ্যের নির্দিষ্ট উদ্ভিদ বা গাছপালা আর বেড়ে না ওঠে, তবে ওই প্রাণীদের অন্যত্র চলে যেতে হবে বা তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।

বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্ব
প্রকৃতিতে বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের আবাসস্থল প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন খাদ্য শৃঙ্খল এবং খাদ্য জাল নিয়ন্ত্রণ করে। একইসাথে, মানুষ বাস্তুতন্ত্র সংক্রান্ত প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে জীবনের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে। এটি পরিবেশের জৈব-অজৈব (জীব ও জীবন সম্পর্কিত) পুষ্টির উপাদানগুলোর পুনর্ব্যবহারেও জড়িত। এ ছাড়া এই প্রক্রিয়া একটি বাস্তুতন্ত্রে কার্বনচক্র, শক্তিচক্র, নাইট্রোজেন চক্র, অক্সিজেন চক্র এবং পানিচক্রসহ প্রাকৃতিক শক্তির স্বাভাবিক প্রবাহ (usual flow of energy) বজায় রাখতে সহায়তা করে। এসব চক্র জীবনের বিকাশ ও জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয়। সংক্ষেপে বলা যায় যে, বাস্তুতন্ত্র হলো এমন একটি ভৌগোলিক এলাকা যেখানে গাছপালা, প্রাণী ও অন্যান্য জীব এবং আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক ভূচিত্র প্রাকৃতিক নিয়মে একে-অপরের সাথে ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হয়ে জীবনের আকাশ-কুসুম (bubble) তৈরি করে।

আগেই বলা হয়েছে যে, একটি বাস্তুতন্ত্রের আকার যেমন অনেক ছোট, আবার অনেক বড়ও হতে পারে। গোটা পৃথিবীর উপরিভাগ এই ছোট বড়, সারি সারি বাস্তুতন্ত্রের সংযুক্তি। এ থেকে বলা যায় যে, বাস্তুতন্ত্র হলো উদ্ভিদ ও জীবসত্তার একটি দীর্ঘ যৌথ সমাজগোষ্ঠী। অন্যভাবে বলা যায় যে, বাস্তুতন্ত্র হলো প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রধান বাসস্থান। এ প্রক্রিয়া সাধারণত উদ্ভিদ এবং প্রাণীর ধরনের ওপর ভিত্তি করে সংগঠিত হয়। যেমন- একটি ছোট পুকুর, বন বা মরুভূমির মধ্যেও বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। এমনকি, একই ধরনের জায়গায় সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তুতন্ত্র থাকতে পারে। একটি বনের পরিবেশ যেমন অন্য বনের থেকে একেবারে আলাদা, তেমনি একটি মরুভূমির পরিবেশও অন্য মরুভূমির থেকে আলাদা।

সাহারা মরুভূমির মতো কঠিন পরিবেশেও বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। শুষ্ক জলবায়ু এবং গরম আবহাওয়া সাহারার বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। তবু সেখানে খেজুর গাছ, মিঠা পানি এবং প্রাণী রয়েছে। সাহারাতে বালুময় পাহাড়ের আলাদা বাস্তুতন্ত্রও আছে। তবে বাতাসের কারণে প্রতিনিয়ত এর রূপ পরিবর্তিত হয়। এসব বালুর পাহাড়েও সাপের মতো প্রাণী দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে সক্ষম। এমনকি সাহারা একটি মরুভূমি হলেও এর উত্তর-পশ্চিম উপকূলে সংযুক্ত আছে সামুদ্রিক পরিবেশ। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে হাওয়া এসে সেখানে এক ধরনের শীতল কুয়াশা তৈরি করে। ফলস্বরূপ সেখানে এক ধরনের লতা-গুল্মের জন্ম হয় যেগুলো খেয়ে অনেক ধরনের ছোট প্রাণী যেমন ছাগল জীবনধারণ করে। অন্য দিকে মঙ্গোলিয়া এবং চীনের গোবি মরুভূমিতে পরিবেশের ধরন আলাদা। তবে সেখানে ঘনমাত্রায় তুষারপাতের ফলে তাপমাত্রা নিচে নেমে যায় এবং বরফ জমে। এ জন্য একে শীতল মরুভূমিও বলা যায়। গোবি মরুভূমির পরিবেশ সাহারার মতো বালুময় নয়, বরং পাথুরে। এখানকার ঠাণ্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়াতে অনেক ধরনের ঘাস জন্মাতে পারে। সেগুলো ঘোড়ার বেশ পছন্দ। তাই এখানে বেশ বড় প্রাণী বাস করতে পারে ভালোভাবেই।

ভূগর্ভস্থ পানি এবং বাস্তুতন্ত্র
ভূগর্ভস্থ পানি এবং সংশ্লিষ্ট বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক বেশ জটিল। মূলত ভূগর্ভস্থ পানির নিষ্কাশন, স্তর এবং গুণগত মানের সাথে বাস্তুতন্ত্রের রয়েছে নির্ভরতার সম্পর্ক। ভূগর্ভস্থ পানির সাথে সংযুক্ত বাস্তুতন্ত্র যেমন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল, তেমনি এই বাস্তুতন্ত্রে বসবাসকারী জীবজন্তু ও উদ্ভিদ সবই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। এটি তাদের বেঁচে থাকা এবং অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মূল, বলা যায় মৌলিক উপাদান। আবার ভূপৃষ্ঠের অনেক বাস্তুতন্ত্রে বসবাসকারী প্রাণীরাও ঋতুভেদে বা কোনো কোনো মৌসুমে পর্যায়ক্রমিকভাবে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। তবে ওই সময়কালে পানির সরবরাহ নদী অথবা হ্রদ কিংবা জলাধার থেকেও পাওয়া যেতে পারে। অন্য দিকে আবার, নদী, হ্রদ, জলাভূমি এবং ঝরনাগুলোও সারা বছর বা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। নদীর মোহনা ও সমুদ্রের উপক‚লের কাছাকাছি সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রও ভূগর্ভস্থ পানির নিঃসরণ দ্বারা প্রভাবিত হয় (ক্লোভ অ্যাট অল)।

ইয়ান্নুস অ্যাট অল ভূগর্ভস্থ পানিনির্ভর বাস্তুতন্ত্রের তিনটি প্রধান শ্রেণী নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেগুলো; (ক) চুনাপাথর জাতীয় অঞ্চল বা কার্স্ট ভূমিরূপ; (খ) যে অঞ্চলে বসবাসকারী প্রাণীদের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির প্রয়োজন হয় (যেমন প্রস্রবণ, ঝরনা, জলাভূমি); (গ) যেসব অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির উপরি অংশের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে উদ্ভিদের শিকড়ের গভীরতা কতটুকু হবে (যেমন রিপারিয়ান বা নদীতীরস্থ বনভূমি)।

অতএব, বলা যায়, ভূগর্ভস্থ পানি পৃথিবীর মিঠা পানির প্রধান উৎস এবং প্রাণীর আবাসস্থলে জীবনধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের জন্য সচরাচর জীবনধারণ ছাড়াও কৃষি, শিল্প, খাদ্য এবং পুষ্টির জন্যও ভূগর্ভস্থ পানির গুরুত্ব অপরিসীম। গত কয়েক দশক ধরে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারে ও সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বিশ্বব্যাপী ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন কমে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির অতিমাত্রায় নিষ্কাশন একটি ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কোনো কোনো অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গেছে বা যাবে। একই সাথে উষ্ণায়নের ফলে বাষ্পীভবন বা বাষ্পাকারে নির্গমন বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের অনেক অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াটা সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। মনে হচ্ছে, দিনে দিনে এই পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে।

ভূগর্ভস্থ পানি মৌলিকভাবেই বাস্তুতন্ত্রের স্থায়িত্ব বা অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শুধু মানবগোষ্ঠীর জন্যই নয়, বরঞ্চ সব জাতি-প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভূগর্ভস্থ পানির সাথে বাস্তুতন্ত্রের সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন হলে, তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে বহুমুখী। বিশেষ করে বাস্তুতন্ত্র গঠনকারী উপাদান যেমন- বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, বাষ্পীভবন, মানুষের ব্যবহারের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন, কৃষি, সেচ, স্যানিটেশন ব্যবস্থায় এর প্রভাব পড়বে। যদি বাস্তুতন্ত্রে হঠাৎ কোনো উপাদান বেড়ে যায় বা সীমা অতিক্রম করে তাহলে অন্যান্য উপাদানগুলোর গঠন বা মিশ্রণেও পরিবর্তন আসবে। অতএব, ভবিষ্যতে একটি বিশ্ব ব্যবস্থাপনার আওতায়, বাস্তুতন্ত্র এবং মানবস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ করা জরুরি এবং সেটি মেনে চলা মানুষের জন্য আবশ্যকীয়।

বাস্তুতন্ত্র, আবহাওয়ার ধরন এবং ভূগর্ভস্থ পানি
এটা স্বীকৃত যে, ভূগর্ভস্থ পানি মানুষের জীবন টিকিয়ে রাখার একটি প্রধান উৎস। আবহাওয়ার স্বল্পমেয়াদি পরিবর্তনেও ভূপৃষ্ঠে পানির সঙ্কট সৃষ্টি হয়। ওই সঙ্কটকালে ভূগর্ভস্থ পানি মানুষের জন্য সংরক্ষণাগার হিসেবেও কাজ করে। এভাবে কালে কালে ভূগর্ভস্থ পানি মানুষের জীবনধারণে একটি স্থিতিশীল এবং নির্ভরযোগ্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভূগর্ভস্থ পানির নিষ্কাশন বা উত্তোলন বহুমাত্রায় বেড়ে গেছে। ১৯৬০ এর দশকে প্রতি বছর ৩১২ ঘন কিলোমিটার (শস৩) থেকে ২০০০ সালে বেড়ে ৭৪৩ ঘন কিলোমিটারে (শস৩) গিয়ে দাঁড়িয়েছে (ওয়াদা অ্যাট অল ২০১০)। এর প্রধান কারণ হলো বিদ্যুতায়ন ও বাজারে শক্তিশালী পাম্পের আবির্ভাব। উত্তোলিত পানির ৭০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় কৃষিতে। এ ছাড়াও বিশ্বব্যাপী শহর এলাকায়, মানুষের ঘরবাড়িতে ব্যবহৃত পানির অর্ধেকই ভূগর্ভের পানি থেকে (জিওর্দানো ২০০৯) আসে। সুতরাং বলা যায়, ভূগর্ভ এবং ভূপৃষ্ঠের পানি এবং মানুষ ও বাস্তুতন্ত্র, এ সবই একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত ও পরস্পর নির্ভরশীল।

ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন বিশ্বের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যদিও ‘অতি উত্তোলনের’ সংজ্ঞা এখনো চূডান্ত পর্যায়ে নির্ধারিত করা হয়নি। কেননা স্থান, সময়, বৃষ্টির পরিমাণ, পর্বতমালা ও হিমবাহ থেকে বরফগলিত পানির প্রবাহ ইত্যাদি মিলে এ সংজ্ঞার পরিবর্তন হয়। প্রথম দিকে রিচার্জের মাধ্যমে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন ও পুনঃপূরণের মধ্যে ভারসাম্য আনতে একটি পদ্ধতির চিন্তা-চেতনা ছিল। তবে তখন বাস্তুতন্ত্রের ওপর এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়নি। বর্তমানে টেকসই উত্তোলনের ধারণাটি মূলত বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। কেননা ভূগর্ভস্থ পানির টেকসই উত্তোলন ও ব্যবহারের বিষয়টি এখন মৌলিক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই একটি সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির টেকসই উত্তোলন ও ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা সবাই উপলব্ধি করছে।

ভূগর্ভস্থ পানির বাস্তুতন্ত্রের সেবাসমূহ
সহস্রাব্দ বাস্তুসংস্থানের মূল্যায়ন ও শ্রেণীকরণ (এমএ ২০০৫) অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানিতে বাস্তুতন্ত্রের সেবা এবং তাতে থাকা উপাদানগুলোকে চার ভাগে বিভক্ত করা যায়; (ক) সহযোগিতা সেবা; (খ) ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ ও সেবা; (গ) নিয়ামক নিয়ন্ত্রণকারী সেবা; (ঘ) সাংস্কৃতিক সেবা। ভূগর্ভস্থ পানির বাস্তুতন্ত্রের সংশ্লিষ্ট সেবাসমূহের কথা বলতে গেলে উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়েই বেশি কথাবার্তা, তর্ক-বিতর্ক ও প্রশ্ন ওঠে। বাস্তুসংস্থানের জন্য এই প্রতিটি পরিষেবা, সেখানকার পানির সাথে সম্পর্কিত। যদিও ভূগর্ভে পানির উপস্থিতি নিজেই একটি সহায়ক পরিষেবা হিসেবে কাজ করে। কারণ বেশির ভাগ স্থলজ এবং জলজ বাস্তুসংস্থান নির্ভর করে এই পানির প্রাপ্যতার ওপর। ভূগর্ভস্থ এই বাস্তুসংস্থানের নিয়ন্ত্রক পরিষেবাগুলোর মধ্য রয়েছে; ক্ষতিকর অণুজীব ও ভাইরাস দূর করা এবং এগুলোর সাথে সম্পর্কিত রোগ নিয়ন্ত্রণে পানিকে পরিশোধন করা। অন্য দিকে, সাংস্কৃতিক পরিষেবার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বিনোদনের মতো বিষয়।

ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভের পানির মধ্যে সংযোগ
এমনকি শতাব্দী পূর্বেও পানি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টি নিবন্ধ থাকত শুধু ভূপৃষ্ঠে থাকা পানির ব্যবস্থাপনার ওপর। অথচ ভূপৃষ্ঠের বেশির ভাগ জলাশয়ের সাথে ভূগর্ভস্থ পানি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাই এখন মানবসমাজ ভূগর্ভস্থ পানির দিকেও দৃষ্টি ফিরিয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, বৃষ্টিপাত বা তুষার গলিত পানি বিভিন্ন পথ অনুসরণ করে নিচের দিকে নেমে আসে। এর কিয়দংশ নদী, জলাধার ও সমতল ভূমিতে পড়ে। আবার এই পানির কিয়দংশ মাটিতে ছিদ্রের মধ্য দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পুনরায় ভূগর্ভে চলে যায়। আবার ভূগর্ভে পানির স্তর বেড়ে গেলে, তা নদী ও জলাধারে ফিরে আসে। ভূপৃষ্ঠের অগভীরে অবস্থিত পানি জলাভূমি ও নদীর তীরস্থ গাছপালাকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। তাই বলা যায় যে, পৃথিবীর প্রতিটি পুকুর, জলাভূমি, জলাশয়, নদী, হ্রদ ও ঝরনা, সবই ভূগর্ভস্থ পানির সাথে ওতোপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত, যা বিশ্বজুড়ে মিঠা পানির বাস্তুতন্ত্রের অংশ। তবে অবিরত মানব হস্তক্ষেপের কারণে বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্র অনবরত বৈচিত্র্য হারাচ্ছে। এসবই পানি চক্রের জন্য বিপজ্জনক হুমকি তৈরি করছে।

আগেই বলা হয়েছে যে, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের মাত্র এক শতাংশজুড়ে আছে মিঠা পানি। অন্য দিকে ৭১ শতাংশ আচ্ছাদিত করে রেখেছে মহাসাগর। অথচ জীবিত প্রাণীর জাতি-প্রজাতির মাত্র ৭ শতাংশ বাস করে সাগরে। পক্ষান্তরে ১২ শতাংশের বসবাস মিঠা পানিতে। কেউ কেউ অনুমান করেন, নদীর মোট প্রাণিজ বৈচিত্র্য, সাগরের তুলনায় ৬৫ গুণ বেশি। দুর্ভাগ্যবশত মিঠা পানিতে বসবাসকারী অনেক প্রাণীর প্রজাতি বিলীন হয়ে গেছে ও যাচ্ছে। এর প্রধানতম কারণ হলো, বাস্তুতন্ত্রে পরিবর্তন যার অন্যতম কারণ হলো সীমিত পানির অতিমাত্রায় চাহিদা এবং অবিবেচকের মতো কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন, যা কোনোভাবেই টেকসই (Sustainable) নয়। তদুপরি বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পানির প্রাপ্যতাকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলেছে। তাই টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কার্যক্রমের সাথে টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, যাতে করে পানিচক্র ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা যায়। পরবর্তী অধ্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

লেখক : এমএসসি, কৃষি অর্থনীতিবিদ
প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশন
সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই


আরো সংবাদ



premium cement