২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রোহিঙ্গা সমস্যা : জাতিসঙ্ঘের ব্যর্থতা

রোহিঙ্গা সমস্যা : জাতিসঙ্ঘের ব্যর্থতা - ছবি : সংগৃহীত

জাতিসঙ্ঘ পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান যার মূল উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীকে সঙ্ঘাতমুক্ত রেখে শান্তি স্থাপন করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত হয়েছিল League of Nation. ওই সংগঠন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই সংগঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবী চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিশ্বনেতারা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পুনরায় একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যার ফলে ১৯৪৫ সালের ২৬ জুন সান ফ্রান্সিসকোতে একটি চার্টার স্বাক্ষরের মাধ্যমে গঠিত হয় United Nations বাংলায় যা জাতিসঙ্ঘ নামে ব্যাপক পরিচিত। পৃথিবীতে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রের সঙ্ঘাত ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে একটি শ্রেণী কর্তৃক অন্য শ্রেণী বা একটি গোষ্ঠী কর্তৃক অন্য একটি গোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজমান সমস্যা অথবা গৃহযুদ্ধ জাতিসঙ্ঘ কতটুকু সমাধান করতে পেরেছে সেটিই পর্যালোচনার বিষয়।

জাতিসঙ্ঘের প্রশাসনিক কার্যক্রম মূলত তিনটি স্তরে বিভক্ত যথা- ১. জেনারেল অ্যাসেম্বলি-সাধারণ পরিষদ; ২. সিকিউরিটি কাউন্সিল-নিরাপত্তা পরিষদ; ৩. সেক্রেটারি জেনারেলের নেতৃত্বাধীন- ক. প্রশাসনিক দফতর; খ. বাজেট; গ. প্রশাসনিক ও বাজেট পরিচালনায় উপদেষ্টা কমিটি; ঘ. শান্তিরক্ষা মিশন; ঙ. সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নসহ জন্মগত ও মৌলিক অধিকার রক্ষা করা।

বৃহত্তর গোষ্ঠী কর্তৃক ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠী বা সংখ্যাগুরু কর্তৃক সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা, গৃহযুদ্ধ প্রভৃতি বন্ধ করা জাতিসঙ্ঘের একেকটি দায়িত্ব ও কর্তব্য। জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদে রাষ্ট্রের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী হবে এবং সংখ্যাগুরু কর্তৃক সংখ্যালঘুদের প্রতি দায়িত্ব কী হবে এবং কার কী অধিকার, তা ছাড়া মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি দায়িত্ব কী এবং জনগণের প্রতি সরকারের দায়িত্ব কী হবে এগুলো বিস্তারিত পর্যালোচনা করে জাতিসঙ্ঘ গৃহীত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদ বা দলিলে (International Instrument) বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে যা সদস্য রাষ্ট্রগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করার বাধ্যবাধকতা আছে। তবুও কোনো শক্তির বলে সবল মানুষ দুর্বলের ওপর নির্যাতন করা বা দেশ ত্যাগে বাধ্য করা কি বন্ধ হয়েছে? নাকি বৃদ্ধি পেয়েছে? এগুলোই আজকের নিবন্ধের পর্যালোচনার বিষয়। আন্তর্জাতিক দলিলে উল্লেখ রয়েছে- ১. জাতিগোষ্ঠীগত মতানৈক্য; ২. রাজনৈতিক মতাদর্শ; ৩. জাতীয়তা; ৪. কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ বা সমর্থন; ৫. ধর্মীয় মতাদর্শ প্রভৃতি কারণে কোনো রাষ্ট্র বা শাসকগোষ্ঠী দুর্বল গোষ্ঠীকে রাষ্ট্র থেকে উচ্ছেদ বা বিতাড়িত করতে পারবে না।

রোহিঙ্গারা হাজার বছর ধরে বংশানুক্রমে মিয়ানমারে বসবাস করার পর বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী অস্ত্রের মুখে জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। রোহিঙ্গাদের হত্যা করেছে, বাড়িঘর জ্বালিয়েছে, গণধর্ষণ অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘ শুধু উদ্বেগ প্রকাশ ও ত্রাণ বিতরণ ছাড়া তাদের জন্মভূমিতে ফিরিয়ে নেয়ার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। জাতিসঙ্ঘের অকার্যকর ভূমিকা ও নীরবতার কারণেই রোহিঙ্গাদের ভোগান্তি দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের শান্তিরক্ষার জন্য জাতিসঙ্ঘ ১৯৯২ সালে Department of Peace keeping কার্যক্রম শুরু করে। এ কার্যক্রম আরো জোরদার করার জন্য ২০০৫ সালে পুনর্গঠন করে। ২০১০ সাল থেকে Peace Keeping Operation-2010 পুরোদমে চালু করে। বর্তমানে ১১৪টি রাষ্ট্র থেকে পাঠানো শান্তিরক্ষীবাহিনীর সদস্য সংখ্যা এক লাখ ১৩ হাজার ৭৬৬ জন। আগে বিভিন্ন রাষ্ট্রের পাঠানো, শুধু সেনাবাহিনী থেকে সংগৃহীত সদস্যদের সমন্বয়েই পিসকিপিং (Peace keeping) কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে পুলিশ বাহিনী ও সাধারণ নাগরিকদের সংযুক্ত করা হয়। ওই বাহিনীকে নিম্নবর্ণিত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, যথা- ১. Peace Agreement, ২. Peace Building, ৩. Peace Keeping, ৪. Peace Enforcement.

বিভিন্ন রাষ্ট্রের শান্তিরক্ষার জন্য Department of Peace Keeping Operation-কে (সংক্ষেপে DPKO) দায়িত্ব দেয়া হলেও মিয়ানমারে গণহত্যা ও রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করার প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না কেন? কারণ জাতিসঙ্ঘের আড়ালে আবডালে পাঁচটি বৃহৎ রাষ্ট্র পৃথিবীকে শাসন শোষণ করে। কিভাবে পাঁচটি রাষ্ট্র পৃথিবীকে শাসন ও জাতিসঙ্ঘের নীতিমালা নির্ধারণ করে তার বিস্তারিত বিবরণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

DPKO (শান্তিরক্ষী মিশন) জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা (সিকিউরিটি কাউন্সিল) পরিষদ আওতাধীন ও অনুমোদনসাপেক্ষে অপারেশন পরিচালনা করে। নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচটি রাষ্ট্রে ভেটো পাওয়ার (আপত্তি জানানোর ক্ষমতা) রয়েছে। রাষ্ট্রগুলো হলো- আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন। এ পাঁচটি রাষ্ট্রের যেকোনো একটি রাষ্ট্র কোনো বিষয়ে ভেটো দিলে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গা বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে উঠানোর চেষ্টা করা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তাসহ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক ভিত্তিতে ভারত সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। রোহিঙ্গা পুনর্বাসন প্রশ্নে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে ভোট না দিয়ে নীরবতা পালন করে, পক্ষান্তরে মিয়ানমারের সামরিকজান্তাকে সমর্থন দিয়েছে।

তিনটি স্তরে বিভিন্ন রাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধ সংগঠন তৈরি করে পারস্পরিক সমস্যার সমাধান করে। যথা- জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক। আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে বিভিন্ন সম্মেলনে ভবিষ্যৎ পথচলা ও অধিকার আদায় সম্পর্কিত সনদ (INSTRUMENT) প্রস্তুত করা হয়। আঞ্চলিক সমস্যার সমাধানের জন্য ইউরোপ, ইন্টার-আমেরিকা, আফ্রিকা মহাদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সমন্বয়ে আঞ্চলিক ফোরাম গঠিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য গঠিত হয়েছে ‘সার্ক’। কিন্তু ভারতের অসহযোগিতার জন্য ‘সার্ক’ শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। অন্যান্য মহাদেশে আঞ্চলিক ফোরাম গঠনের মাধ্যমে তাদের মানবাধিকার-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান হচ্ছে। সেখানে মানবাধিকার আদালত রয়েছে। সেই আদালতে রাষ্ট্র কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় এবং মানবাধিকার রক্ষায় ওই আদালতগুলো ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ‘সার্ক’ যদি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করা যেত তবে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি আরো সুগম হতো।

উল্লেখ্য, এশিয়া মহাদেশের আঞ্চলিক শান্তি ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য ১৯৬৭ সালে The Asean নামে রাষ্ট্রপ্রধানদের একটি সংগঠন গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এশিয়া মহাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সেই সংগঠনটি কার্যকর ভ‚মিকা রাখতে পারেনি। ২০০৯ সালে The Asean Intergovernmental Commission on Human Rights (AICHR) গঠিত হয়। কিন্তু মানবাধিকার রক্ষার ওই সংগঠনটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এমনকি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে AICHR নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। কারণ বড় রাষ্ট্রগুলোর বৈরী মনোভাবের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।

এর পেছনের মূল কারণ, রোহিঙ্গারা মুসলমান। রোহিঙ্গারা মুসলমান হওয়ার কারণেই চীন ও ভারত তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভেটো পাওয়ার থাকার কারণে শান্তিরক্ষা মিশন পাঠানোর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দেয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ যখনই এ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো থেকে বলা হয়- এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য গঠিত হয়েছিল World Islamic Council (WIC). পৃথিবীতে ৫৬টি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র রয়েছে, অর্থনৈতিক দিক থেকে যারা অনেক শক্তিশালী। ধর্মীয় কারণে হলেও বিশ্বের ইসলামিক রাষ্ট্রগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য এগিয়ে এলে তারা হয়তো আলোর মুখ দেখতে পাবে। জাতিসঙ্ঘ কার্যত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা করতে পারবে বলে মনে হয় না। একটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করা দরকার, গোটা বিশ্ব এখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে। পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম মুসলমানদের জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদের বাজেট অনেক বড় করছে। লক্ষণীয় যে, হিন্দুরা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে বলে না, ইহুদিরা খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে বলে না, সবার অভিযোগ শুধু মুসলিম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। সময়ে সময়ে ঐক্যবদ্ধভাবে বিধর্মীরা মহানবী সা:-এর পূতপবিত্র চরিত্রের ওপর কালিমা লেপন করে মুসলমানদের ভাবমর্যাদা নষ্ট করার চেষ্টা করে। নিরাপত্তা ও ভাবমর্যাদা রক্ষার স্বার্থে বিশ্ব মুসলিমদের ইস্পাতকঠিন ঐক্য প্রয়োজন।

১৯৭১ সালে পাকহানাদার বাহিনীর পৈশাচিক আক্রমণের কারণে আমাদের এক কোটি নর-নারী ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। তখন ভারত সরকার শরণার্থীদের শুধু ত্রাণ না দিয়ে কূটনৈতিক সাহায্য ছাড়াও সামরিক সাহায্য করেছিল বিধায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়। মিয়ানমার থেকে অস্ত্রের মুখে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের স্বদেশে নিরাপদে ফিরে যাওয়ার জন্য এখন প্রয়োজন কূটনৈতিক ও সামরিক সাহায্য। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য তাদের প্রয়োজন একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ড, নতুবা রোহিঙ্গাদের দুর্দিন-দুর্দশা কোনো দিন শেষ হবে না। ফলে বিষয়টি বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে রচিত হবে। মানবতা ও মানবাধিকার লিপিবদ্ধ থাকবে শুধু জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন সনদে (Instrument), তবে আলোর মুখ দেখবে না।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement