২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পানি-জীবের অস্তিত্বের জন্য এক দৈব বস্তু- পর্ব-১

পানি-জীবের অস্তিত্বের জন্য এক দৈব বস্তু- পর্ব-১ - ছবি : সংগৃহীত

সূচনা
দৈব, অদ্ভুত ও বিচিত্রতা হলো পানির অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের গ্রহের বিবর্তনের মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। পানির ভৌত এবং রাসায়নিক প্রকৃতি, আকৃতি, আচরণ ও চরিত্র এবং এর বহুমুখী ব্যবহার আমাদের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। তাই পানি, প্রাণের জন্ম ও বিকাশ এবং বাস্তুতন্ত্রের (Ecosystems) জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ। অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের কারণেই প্রাণের সাথে পানির একটি মিথোজীবী (Symbiotic) সম্পর্ক আছে। প্রতিটি জীবের প্রতিটি জীবন্ত কোষের (Cell) অন্ত:স্থলের কাজ থেকে শুরু করে, গোটা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র সৃষ্টি ও টিকিয়ে রাখা, এ সবই পানির ওপর নির্ভরশীল। জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, মহাবিশ্বের সাধারণ দু’টি উপাদান যেমন; হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মিলে পানির সৃষ্টি। পানি এক অনন্য, অসাধারণ ও নিখুঁত পদার্থ, যা আমাদের জীবনকে টিকিয়ে রাখে।

পানির বৈশিষ্ট্য
পানির বৈশিষ্ট্য একেবারেই অনন্য। এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্য অন্য সব পদার্থ থেকে একেবারেই আলাদা। এই বৈশিষ্ট্যগুলো পানিকে তরল অবস্থা থেকে বরফের কঠিন অবস্থা; বরফ থেকে তরলে পরিণত; আবার তরল থেকে বাষ্পে পরিণত করতে পারে। তারপর আবার বাষ্প থেকে তরল অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। আর এই তরল পানি হলো; আমাদের পৃথিবীর সব জীবের প্রাণের কেন্দ্রবিন্দু। মূলত এই “একক, অসাধারণ ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের শক্তিগুণে” একদিকে যেমন পানির প্রতিটি অণু (Molecule) এককভাবে কাজ করতে পারে, আবার একইসাথে অন্য পদার্থের অণুর সাথে ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হয়ে একত্রে কাজ করার ক্ষমতা রাখে। পানির এই অনন্য বৈশিষ্ট্য অন্য যেকোনো পদার্থ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র। পানির অণুর আকার ও এক অণুর সাথে অন্য অণুর আচরণ এবং অন্যান্য পদার্থের অণুর সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করার ক্ষমতাই হলো পৃথিবীতে জীবন টিকিয়ে রাখার অপরিহার্য উপাদান।

পানিসহ সব রাসায়নিক পদার্থের অণু, অন্যান্য উপাদানের পরমাণু (Atom) দিয়ে গঠিত। এ ক্ষেত্রে অণুর ভর হিসেবে কাজ করে দু’টি পরমাণু। যদি একটি অণুতে একাধিক উপাদানের পরমাণু থাকে তবে সেটি স্বতন্ত্র একটি যৌগিক বা মিশ্র পদার্থ হিসেবে পরিচিতি পায়। অণুর মাঝে এই পরমাণুগুলো, একে অপরের সাথে শক্তভাবে যুক্ত থাকে এবং একে অপরের জিম্মাদার ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করে। যে রীতি-নীতি বা নিয়মের ওপর ভিত্তি করে এটি বিন্যাসিত, সেটা হলো; “এই পরমাণুগুলো একদিকে তার বিপরীত চার্জগুলিকে আকর্ষণ (Attract) করে; আবার অন্য দিকে অভিন্ন চার্জগুলোকে বিকর্ষণ (Repel) করে। কিভাবে এবং কেন পরমাণুগুলো একে অপরের সাথে একত্রিত থাকে, আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে বা এগুলো কিভাবে যোগাযোগ স্থাপন করে, সেটি রসায়ন বিদ্যার বিষয়।

তবে এটুকু জানা অতীব গুরুত্বপূর্ণ যে, পানির অণু গঠনের দু’টি যৌগিক হলো; হাইড্রোজেনের দু’টি ও অক্সিজেনের একটি পরমাণু। তাই পানির রাসায়নিক সূত্র হলো; এইচ২ও (H2O)। মাত্র দু’টি সাধারণ যৌগিক দেখে মনে হয়, পানি খুবই সাধারণ বা মামুলি একটা কিছু। বাস্তবে এটি একটি অত্যন্ত অসাধারণ জটিল পদার্থ। পানি সহজাত (Natural) রূপে বা মজ্জাগতভাবে গতিশীল। তবে পানি একদিকে যেমন জমে থাকতে পারে, অন্যদিকে আবার শক্তির (energy) সাথে পাল্লা দিয়ে সাড়া দিতে পারে। একইভাবে এটি তাপমাত্রার পরিবর্তনের সাথে সাথে যেমন আমূল পরিবর্তিত হতে পারে, তেমনি নতুন পরিবেশে তাৎক্ষণিক সাড়া দিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। জলীয় দ্রবণে পরিবেষ্টিত পানির অণুগুলো পারিপার্শ্বিকতার ভিত্তিতে অন্যান্য জীবসত্তার ক্ষুদ্র অণুগুলোর গঠনপ্রণালী এবং তাদের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার নমনীয়তায় সহায়তা করে।

পানির আরেকটি ব্যতিক্রমী, কিন্তু প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হলো; পানির ঘনত্বের বৈসাদৃশ্য বা অসঙ্গতি। এই অস্বাভাবিকতা সম্ভবত জীবনকে বিকশিত হতে সাহায্য করে। তাই বলা যায় যে, পানির এই অনন্য বৈশিষ্ট্য পৃথিবীতে সৃষ্ট প্রতিটি প্রাণের বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে। এই চক্র পৃথিবীর প্রাকৃতিক চক্রেরই একটি অংশ। এটা প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিক চক্রগুলো পৃথিবীতে একে অপরের সাথে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ও প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে গঠিত। এক কথায়, পৃথিবীর গোটা পরিবেশ ব্যবস্থার কার্যক্ষমতা এবং এর সাথে যুক্ত প্রাকৃতিক চক্রগুলোই জীবনের উত্থানের ভিত্তি তৈরি করেছে। একই সাথে এ চক্র শুধু জীবনের উত্থান নয়, বরং পৃথিবীতে জীবনের বিকাশ ও অস্তিত্ব রক্ষার পূর্বশর্ত হিসেবেও কাজ করছে। এভাবে একটি কার্যকরী পরিবেশ চক্র এই পৃথিবীতে জীবনের উত্থান, গঠন, জীবন রক্ষা বা বজায় রাখতে সহায়তা ও সামর্থ্য জোগাচ্ছে। এ প্রাকৃতিক চক্রই সম্ভবত জীবনরক্ষায় তাপমাত্রাকে একটি গ্রহণযোগ্য সীমার মধ্যে রেখে জলবায়ুও নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে পানি উদ্ভিদের জন্য কার্বনডাইঅক্সাইড সরবরাহ নিশ্চিত করে। অন্য দিকে এবং একই সাথে পৃথিবীতে সৃষ্ট সব প্রাণীর জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে। পবিত্র কুরআন শরিফের সূরা বাকারার রুকু ২০ এর ১৬৪ নাম্বারের আয়াতে বলা হয়েছে; “... আকাশ থেকে আল্লাহর বর্ষিত বৃষ্টিতে, যা দিয়ে তিনি রুক্ষ জমিনকে আবাদ করেন ও প্রাণের বিকাশ ঘটান, মৌসুমি বায়ুপ্রবাহে, আকাশ ও জমিনের মধ্যে মেঘমালার সুনিয়ন্ত্রিত ভ্রমণচক্রে জ্ঞানীদের জন্য অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে।”

মানবদেহে পানির পরিমাণ
মানুষের শরীরে গড় পানির পরিমাণ ৬০ শতাংশ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরে পানির পরিমাণ কিছু কমে আসে। তবে মানুষের স্বাস্থ্য এবং শরীরের কার্যকারিতা রক্ষার জন্য গড়ে ৬০ শতাংশ পানি অপরিহার্য। কেননা পানিই শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং দেহে কোষের গঠন, কার্যক্রম ও কর্তব্যপালনে সক্রিয় সহায়তা করে।

বাচ্চাদের শরীরে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে পানির পরিমাণ কমতে থাকে। যেমন; (ক) জন্ম থেকে ৬ মাস পর্যন্ত - ৭৪ শতাংশ; (খ) ৬ মাস থেকে ১২ বছর পর্যন্ত - ৬০ শতাংশ; (গ) ১২ বছর থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত - ৫৯ শতাংশ; (ঘ) ৫১ বছর থেকে উপরের বয়সে - ৫৬ শতাংশ।

শরীরের সমস্ত জায়গায় পানি বিস্তৃত। তবে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সমান নয়। যেমন; দেহের কোষে ৬০ শতাংশ; মস্তিষ্ক ও কিডনিতে ৮০-৮৫ শতাংশ; হার্ট ও ফুসফুসে ৭৫-৮০ শতাংশ; পেশি, লিভার ও ত্বকে ৭০-৭৫ শতাংশ; রক্তে ৫০ শতাংশ; হাড়ে ২০-২৫ শতাংশ এবং দাঁতে ৮-১০ শতাংশ। এ থেকে বোঝা যায় যে পানি মানুষের জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে পানি পৃথিবীর সব জীবন্ত প্রাণীর জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।

পানিচক্র - উপরে নিচে; সর্বদাই গতিশীল ও চলন্ত
পৃথিবীতে থাকা ১৩৮ কোটি ঘনকিলোমিটার (km3) পানির প্রায় ৯৭ শতাংশই মহাসাগরের নোনা পানি। সাগর-মহাসাগরগুলো রয়েছে পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রায় ৭১ শতাংশ জুড়ে। এই বিশাল জলরাশি পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল সব প্রাণীর জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করে। নিত্যনিয়ত প্রতিদিন পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রচুর পরিমাণ তরল পানি বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসের সাথে আকাশে উড়ে যায়। তারপর বৃষ্টি রূপে সমপরিমাণ পানি পুনরায় ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। যতই অদ্ভুত হোক না কেন, পানির এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ও আচরণ, অন্য যেকোনো পদার্থের থেকে একেবারেই আলাদা ও স্বতন্ত্র। আর এই পানিই বাসযোগ্য করে তুলেছে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠকে।

যেভাবে পানির এই চক্র আবর্তিত হয়; প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পানি বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমণ্ডলে উড়ে যায়। উপরে উঠার সময়কালে প্রথমে এটি উষ্ণ ও আর্দ্র বাতাসের সাথে মিশে জলীয়বাষ্পের (Water vapor) আকার ধারণ করে। পরবর্তীতে যতই উপরে উঠে ততই এই বাষ্প ঠাণ্ডা ও ঘনীভূত হয়ে তরল জলের ফোঁটায় পরিণত হয়। আকাশে আমরা যে মেঘ দেখি তা আসলে জলীয়বাষ্প। মেঘ বেশি উপরে উঠলে পানির ফোঁটাগুলো ঠাণ্ডায় জমে যায় ও তুষারে পরিণত হয়। পানি কঠিন বা তরল যাই হোক না কেন, এটা বাতাসের সাথে প্রবাহিত হতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত তাপমাত্রা এবং বায়ুর চাপ মিলে একটা যথাযথ প্রাকৃতিক ক্ষেত্র তৈরি করে এবং পানির ফোঁটাগুলোকে একত্রিত হতে সহায়তা করে। এরপরেই এটি বৃষ্টি বা তুষার হিসাবে সমুদ্রে বা মাটিতে ঝরে পড়ে। এই বৃষ্টি বা তুষারের ১৩৮ কোটি ঘনকিলোমিটার (শস৩) পড়ে সমুদ্রে। মাত্র ৫ লাখ ঘন কিলোমিটার পড়ে সমুদ্রের বাইরের ভূপৃষ্ঠে। অর্থাৎ ওপর থেকে আসা মোট পানির মাত্র ০.০৪ শতাংশ ভূপৃষ্ঠে পড়ে।

ভূপৃষ্ঠে ঝরে পড়া পানির মধ্যে প্রায় ১ লাখ ঘনকিলোমিটার (km3) নদীতে চলে যায় এবং ১.৫ লাখ ঘন কিলোমিটার বাষ্পীভূত হয়ে পুনরায় আকাশে চলে যায়। বাকি ২.৫ লাখ ঘনকিলোমিটার (km3) প্রাকৃতিক ভারসাম্যে তারতম্যের কারণে বাষ্পীভূত হতে দেরি হয়। যে পানি থেকে যায়, সেগুলোর কিছু অংশ বরফ বা পাথরে এবং মাটিতে মিশে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব পানি বাষ্পীভূত হয়ে আবার আকাশে ফিরে যায় ও বৃষ্টি হয়ে ফিরে আসে। সূর্যতাপ প্রথমে পানিকে শীতল বায়ুমণ্ডলে টেনে আনে এবং পরে চোলাই (distill) করে ভূপৃষ্ঠে ফিরিয়ে দেয়। সূরা ফুরকানের ৪৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে যে, “তিনি (আল্লাহ) তাঁর রহমতে আগে সুসংবাদবাহী বায়ু প্রেরণ করেন। অতঃপর আসমান থেকে বিশুদ্ধ পানি প্রেরণ করেন।” বলতেই হয় যে, এটা একটি দৈব বা অদ্ভুত চক্র। এর সোজাসাপটা অর্থ হলো; পৃথিবীতে আসলে পানির পরিমাণ একই; শুধু এটি নিজেকে কখনও তরল থেকে বাষ্পে রূপান্তরিত করে আকাশে উড়ে যায়। তারপর আবার তরল রূপ ধারণ করে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। অর্থাৎ পরিমাণ ঠিক রেখে ও নিজেকে সচল রেখে পানির এই চক্র শুধু ওপরে ও নিচে আসা যাওয়া করে।

ভূপৃষ্ঠের নদীতে, মাটিতে অথবা ভূগর্ভে থাকা পানির বাকি অংশের (যে পরিমাণ এখনও বাষ্পীভূত হয়নি) কার্যক্রম ও ক্রিয়া-প্রক্রিয়া বোঝার জন্য, আমাদের অবশ্যই শিলা-প্রস্তর, পাহাড় পর্বতসহ ভূপৃষ্ঠে ও ভূগর্ভের বিভিন্ন ধরন, প্রকৃতি, ক্ষেত্র, অবস্থা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় আনতে হবে। সাধারণত শিলা-প্রস্তর যে খনিজপদার্থ দিয়ে গঠিত তার অণুতে থাকে পানি। এছাড়া পৃথিবীর উপরের ভূ-ত্বকে প্রচুর পরিমাণে পানি, বিভিন্ন খনিজপদার্থ, স্ফটিক (Crystal) রূপে সঞ্চিত থাকে। এই পানি গতিশীল এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বা একদিক থেকে অন্য দিকে চলাচল করে। তবে সুযোগমতো নিচের দিকে চলে যায়। ভূ-অভ্যন্তর বিশাল বিশাল পট্টিকা (Plate) দ্বারা গঠিত। এইসব পট্টিকা কখনো কখনো কিলোমিটার পর্যন্ত পুরু, মোটা বা লম্বা। এই পট্টিকার উপরাংশ শীতল হলেও, এগুলোর অভ্যন্তর ভাগ উত্তপ্ত এবং ভাসমান থাকে। এই ভাসমান পট্টিকাগুলো খুব ধীরগতিতে ভূ-অভ্যন্তরে নড়াচড়া করে। তাপ ও চাপের কারণে এই পট্টিকাগুলোর উপরিভাগ নিচের দিকে চাপ দেয়। ভূ-ত্বকে (crust) যখন চাপ সৃষ্টি করে তখন খনিজবস্তুগুলো তাদের মধ্যে আবদ্ধ থাকা বা সঞ্চিত পানি মুক্ত করে দেয়। সূরা বাকারা-আয়াত ৭৪; “কোনো কোনো পাথর থেকে ঝরনা বা নালা প্রবাহিত হয়, কতক পাথর ফেটে গেলে তার ভেতর থেকে পানি বেরিয়ে আসে।”

আর এই পট্টিকাগুলো নড়াচড়া করার ফলে একে অপরের সাথে সংঘর্ষ বা ধাক্কা লাগে। এই সংঘর্ষের ফলেই সৃষ্টি হয় ভূকম্পন। ভূ-অভ্যন্তরে পট্টিকাগুলোর ধাক্কাধাক্কির ফলে তৈরি হয় অসংখ্য ফাটল। এ ছাড়া পট্টিকাগুলো যখন নড়াচড়া করে তখন একটি আরেকটির ওপর চাপ সৃষ্টি করার কারণে ধীরে ধীরে এসব ফাটল আরো প্রশস্ত হয়। এভাবে পট্টিকা বা প্লেটগুলো একটি আরেকটির ওপর অনবরত চাপ সৃষ্টি করে। এ প্রক্রিয়া; স্থলে বা সমুদ্রে যেখানেই ঘটুক না কেন, এর ফলে ভূ-অভ্যন্তরের অনেক নিচে থাকা জলীয় খনিজগুলোতে থাকা ফুটন্ত পানি ভূগর্ভ থেকে বড় কোনো ফাটলের মাধ্যমে বের হয়ে আসে। আর এটিই আমাদের কাছে আগ্নেয়গিরি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আগ্নেয়গিরি থেকে উদগীরিত এই ফুটন্ত পদার্থ যা বায়ুমণ্ডলে থাকা পানির সাথে পুনরায় মিলিত হয় এবং আবার তরল পানি হিসেবে পৃথিবীতে ফিরে আসে; বৃষ্টি, তুষারপাত বা শিলাবৃষ্টি আকারে।

অতএব পানি-চক্রের মৌলিক অর্থ হলো “পানি এমন এক চক্রভ্রমণকারী প্রাকৃতিক সম্পদ যা ক্রমাগত আকার পরিবর্তনের মাধ্যমে ওপরে এবং নিচে চলাচল করে।” যেসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানিচক্র (hydrological cycle) সচল থাকে সেগুলো হলো; (ক) বৃষ্টিপাত; যেমন - বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, তুষারপাত। (খ) মিঠা পানির চলাচল ব্যবস্থা; যেমন- নদী, হ্রদ, ভূপৃষ্ঠের জলাধার, মাটিতে ও ভূগর্ভস্থ জলাধারে জমাকৃত পানি। (গ) পানির ব্যবহার; যেমন পানীয়, খাদ্য ও শিল্পোৎপাদন (ঘ) প্রাকৃতিকভাবে সঞ্চিত; যেমন- ভূমিতে ও ভূগর্ভস্থ জলাধারে অবস্থিত। (ঙ) বাষ্পীভূত; যেমন- ভূপৃষ্ঠ বা স্থলে থাকা যেটুকু পানি বাষ্প হয়ে বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায় এবং গাছপালা, বিভিন্ন উদ্ভিদ বা লতা পাতার মাধ্যমে বাষ্পাকারে আকাশে নির্গমন করে;
আদিত্য আভা সিং, অরবিন্দ কে সিং, ওয়াটার কনজারভেশন এই দ্য এরা অব গ্লোবাল ক্লাইমেট চেঞ্জ, ২০২১

উপরোক্ত হাইড্রোলজিক্যাল সাইকেল বা পানির চক্রানুযায়ী; পানি হলো মাটির উপরে, নিচে ও আকারে পরিবর্তিত, বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে, ভূপৃষ্ঠে, ভূগর্ভে এবং বায়ুমণ্ডলে সঞ্চায়িত পানির একত্রিত সমাহার। অতএব বলা যায়, পানি কখনো বিনষ্ট, ক্ষয়, নিলীন-বিলীন কিছুই হয় না। বরং এটি বাষ্পীভূত হয় বা তরল থেকে গ্যাসে পরিবর্তিত হয়। আবার একসময় পুনরায় ঘনীভূত হয়ে তরল হিসাবেই ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। এমনকি সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis) কালে উদ্ভিদ যে পানি চুষে নেয়, সেটাও গাছপালার মধ্যে সঞ্চিত কার্বোহাইড্রেটের একটি অংশ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত পচনের মাধ্যমে ওই পানি আবারো পানি চক্রে ফিরে আসে। পানির এই চক্রের সাথে প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট উভয় প্রক্রিয়া জড়িত।

ভূগর্ভস্থ পানি
পৃথিবীর সমস্ত বাস্তুতন্ত্রের জীবন ধারণের জন্য পানির উৎস হলো; বৃষ্টি ও তুষার। এই পানি ঝরনা, জলাশয়, জলাধার, হ্রদ, নদী, হিমবাহ হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। তারপর আবার বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। তবে কিছু পরিমাণ বৃষ্টির পানি ভূপৃষ্ঠের মাটিতে থেকে যায়। এই পানি ধীরগতিতে চুইয়ে চুইয়ে খুব ভূগর্ভে চলে যায়। একেই ভূগর্ভস্থ পানি ধরে নেয়া হয়। এই ভূগর্ভস্থ পানিই হলো; আমাদের জলীয় খনিজগুলোর চূড়ান্ত উৎস। একইসাথে সৃষ্টি হয় জীবমণ্ডলের জন্য পানির বড় ভাণ্ডার। ধারণা করা হয়, ভূপৃষ্ঠের মাটি এবং পাথরের অভ্যন্তরে প্রায় ১০.০৬ মিলিয়ন বা ১ কোটি ছয় লাখ ঘন কিলোমিটার (km3) তরল পানি রয়েছে, যা পৃথিবীর বৃহদাংশ মিঠা পানির ভাণ্ডার বা আধার।

ভূগর্ভস্থ পানি হলো পৃথিবীতে মিঠা পানির দ্বিতীয় বৃহত্তম আধার। কারণ ভূপৃষ্ঠে থেকে যাওয়া পানির একটি বড় অংশই জমা থাকে মেরু অঞ্চলে বরফ হিসেবে (polar ice), মহাদেশীয় বরফের পাত (continental ice sheet) এবং হিমবাহে (Glaciers)। নদী এবং হ্রদের মতো আধারে থাকা ভূপৃষ্ঠের পানি বিশ্বের মোট মিঠা পানির মাত্র এক শতাংশেরও কম যেখানে ভূগর্ভস্থ পানি বিশ্বের মোট মিঠা পানির ৩০ শতাংশ।

বৈশ্বিক পানি বণ্টন
উপরোক্ত সারণি থেকে দেখা যায় যে, বিশ্বে মোট পানির পরিমাণ প্রায় ১৩৮৬ মিলিয়ন ঘন কিলোমিটার (km3)। যার মধ্যে ৯৭.৫ শতাংশই লবণাক্ত। আর মিঠা ও অন্যান্য পানি হলো মাত্র ২.৫ শতাংশ। অন্য দিকে আবার এই ২.৫ শতাংশের ৬৯ শতাংশই জমা হয়ে আছে বরফ ও হিমবাহে। মাত্র ৩০ শতাংশ মিঠা পানি ভূপৃষ্ঠে। নদী ও হ্রদের মতো জলাশয়গুলোয় থাকা মিঠা পানির পরিমাণ পৃথিবীর মোট মিঠা পানির এক শতাংশ।

ভূগর্ভস্থ পানি হলো, যে পানি চুইয়ে চুইয়ে ভূগর্ভে নেমে যায় এবং মাটির ছিদ্রস্থানে ও পাথরের ফাটলের মধ্যে ছিদ্রে, ভগ্নাংশে বা ফাঁকে ফাঁকে থাকে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভূগর্ভে পানির যে ভাণ্ডার সৃষ্টি হয়, সেটাকে বলা হয় অ্যাকুইফার (aquifers) বা ভূগর্ভস্থ পানির ভাণ্ডার। এটাই হলো ভূগর্ভস্থ পানির অন্যতম উৎস।

ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থা
ভূগর্ভস্থ পানি বলতে সুসিক্ত বা পরিপৃক্ত মণ্ডলে (saturated zone) জমাকৃত পানি। তবে এই পানির সাথে মৃত্তিকা (soil) ও অন্তমৃত্তিকায় (sub-soil) থেকে যাওয়া পানির সরাসরি যোগাযোগ আছে। এইসব পানিকে ভূগর্ভস্থ পানি বলে ধরে নেয়া হয়। পরিপৃক্ত মণ্ডল (Saturated Zone) হলো ভূপৃষ্ঠের নিচে এমন সব জায়গা যেখানে শিলাস্তরের সব ফাটল, ছিদ্র এবং শিলার বা মাটির মধ্যে ফাঁকা জায়গা, সেখানে পানি তার নিজ জায়গা করে নেয়। আর জলাধারের পানির স্তরের উপর যদি কোনো অংশ খালি থাকে বা মাটি ও পট্টিকার ছিদ্রের স্থানগুলো, যেখানে পানি ও বাতাস উভয়ই থাকে, ঐ স্থানকে বলা হয় অপরিপৃক্ত মণ্ডল (unsaturated zone)। এই ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করে এবং পাথরের ফাটলে ও ফাঁকে ফাঁকে জমায়িত হয়। তবে মাধ্যাকর্ষণ (gravitational pull) ও পানির নিজস্ব ওজনের প্রভাবে, এই পানি ওপর এবং নিচ উভয় দিকেই চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপের ফলে ভূগর্ভস্থ পানি এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় প্রবাহিত হয়। যেসব পথ বা এলাকা দিয়ে পানি অ্যাকুইফারে (ভূগর্ভস্থ জলভাণ্ডারে) প্রবেশ করে, সেই এলাকা রিচার্জ (recharge) জোন হিসেবে পরিচিত। আর যে এলাকায় পানি ঢোকে ও অবস্থান নেয়, সেটা ডিসচার্জ জোন হিসেবে পরিচিত।

পট্টিকার মাঝে ফাঁক-ফোকর, ঢাল বা উঁচু-নিচু এলাকা ইত্যাদি ভূগর্ভস্থ পানিকে ক্রমশ একদিক থেকে অন্য দিকে প্রবাহের পথনির্দেশনা দেয়। পানির এই নড়াচড়া ঘটে খুব ধীরগতিতে। শিলাস্তরের মধ্য দিয়ে নড়াচড়া বা প্রবাহের সময়কালে পানি পরিশোধিত (distil) হয়। এই প্রাকৃতিক পরিশোধনের মাধ্যমেই ভূগর্ভস্থ পানি থেকে প্রচুর অপ্রয়োজনীয় এবং দূষিত বস্তু অপসারিত হয়ে যায়। সে জন্যই ভূপৃষ্ঠের উপরের পানির চেয়ে ভূগর্ভস্থ পানি অনেক বেশি পরিষ্কার ও কম দূষিত। এই পানি, মিঠা পানি (fresh water) হিসেবে পরিচিত ও সহজেই ব্যবহার্য। অতএব, পানি প্রাকৃতিক নিয়মেই অন্তত দুইবার পরিশুদ্ধ হয়, একবার বাষ্পীয়রূপে আকাশে যাওয়া-আসার সময় এবং একবার ভূগর্ভে অবস্থানকালে নড়াচড়ার (movement) সময়।

জলাধার (aquifers)
জলাধার হলো কঠিন শিলা অথবা পলির যে অংশে ভূগর্ভস্থ পানি জমা হয়। এই জলাধার অ্যাকুইফার (aquifers) হিসেবে পরিচিত। অ্যাকুইফার ভূজলতল (Water Table) দ্বারা পরিবেষ্টিত। তবে ভূপৃষ্ঠ থেকে দেখা যায় এমন অংশকে অসীমাবদ্ধ বা অসমর্থিত জলাধার বলা যায়। এসব জলাধার ভূজলতলের অনুশাসনে আবদ্ধ থাকে এবং এগুলো ভূপৃষ্ঠের টপোগ্রাফিক বা ভূউপরিস্থানের অনুকরণে গঠিত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। সীমাবদ্ধ অ্যাকুইফার বা জলাধারের উদাহরণ হতে পারে; যেমন কম ব্যাপ্তিযোগ্যতার (low permeability) কারণে অ্যাকুইফারের পানি উপরের স্তরে সীমাবদ্ধ থাকে। একই সাথে আবার উপরের স্তরের পানির চাপের কারণে ভূগর্ভের পানির অবস্থান নিশ্চিত হয়। যখন ওপরের পানির চাপে ভূগর্ভস্থ পানির মধ্যেও চাপ সৃষ্টি হয়, তখন এটি বোরহোল বা ছিদ্র দিয়ে অ্যাকুইফারের ওপরে উঠে আসে।

উপসংহার
যেকোনো আঙ্গিকে পর্যালোচনা করা হোক না কেন এটা সহজেই বলা যায় যে; পানি অন্যসব প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে আলাদা। বহুমুখী ব্যবহৃত পানিসম্পদের কার্যকর ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ করা বা গুণমান ধরে রাখা খুবই কঠিন কাজ। এমনকি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার আওতায় আনাটাও খুবই কঠিন। প্রথমত; পানি দৈনন্দিন জীবনযাপন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া পানিকে একদিকে যেমন বলা যায় এটা লোকহিতকর ও সর্বসাধারণের ভোগ্য পণ্য (public goods), তেমনি পানিকে ব্যক্তিগত (private) পণ্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও দেখা যায়। একটি পণ্য যখন সার্বজনীন এবং ব্যক্তিগত, উভয় দিক থেকে বিবেচিত হয়, তখন গুরুতর প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দেয়। এতদসত্তে¡ও আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত কারণে বর্তমানে পানিসম্পদের ওপর সরকারি ও ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ এবং পানির ব্যবহার ও উন্নয়নে বিধিবিধান ও বিনিয়োগের যথাযথ মিশ্রণ, প্রতিটি সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

পানির আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এর গতিশীলতা। পানি কোনো সীমানা মানে না। পানি অনায়াসে প্রবাহিত হয় এবং এক সীমানা ছাড়িয়ে অন্য সীমানায় বা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে, এমনকি এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে পারে। সমস্যা হলো, পানি যখন সীমানা অতিক্রম করে, সেটা দেশের অভ্যন্তর হোক বা বিদেশের সীমানা হোক, তখন এর কর্তৃত্ব নিয়ে পরস্পরবিরোধী মতামত দেখা দেয়। তাই বাস্তুতন্ত্রের জন্য পানি ব্যবস্থাপনায় এমন এক সমন্বিত ব্যবস্থা প্রয়োজন, যা সব অনিশ্চয়তাকে সফল ও টেকসইভাবে মোকাবেলা করতে পারে। পানির সাথে বাস্তুতন্ত্রের সম্পর্ক এবং বাস্তুতন্ত্রের গঠন ও জীবনধারণে এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে পরের অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে।

লেখক : এমএসসি, কৃষি অর্থনীতিবিদ
প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশন
সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই


আরো সংবাদ



premium cement
মধুখালীর ঘটনায় সঠিক তদন্ত দাবি হেফাজতের ফর্মে ফিরলেন শান্ত জামায়াতের ৫ নেতাকর্মীকে পুলিশে সোপর্দ যুবলীগ কর্মীদের, নিন্দা গোলাম পরওয়ারের চায়ের সাথে চেতনানাশক খাইয়ে স্বর্ণালঙ্কার চুরি ঈশ্বরগঞ্জে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ব্যারিস্টার ফারজানাকে সংবর্ধনা যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে‘ভিত্তিহীন' তথ্য ব্যবহারের অভিযোগ বাংলাদেশ সরকারের মোদির মুসলিমবিরোধী মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় সংখ্যালঘু নেতাকে বহিষ্কার ফ্লোরিডায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের নতুন কনসাল জেনারেল সেহেলী সাবরীন চান্দিনায় পানিতে ডুবে একই পরিবারের দুই শিশু মৃত্যু কেএনএফ সম্পৃক্ততা : গ্রেফতার ছাত্রলীগ নেতা সম্পর্কে যা জানা গেছে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ

সকল