২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জনতার মঞ্চের প্রেতাত্মার তাণ্ডব

- ছবি : সংগৃহীত

২০০১ সালের ঘটনা। আওয়ামী লীগ তখন সবে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে এবং বিএনপি তখনো আওয়ামী লীগের ওপর প্রথাগত মামলা-হামলা শুরু করেনি। ঠিক সেই সময়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। ১৯৯৬-২০০১ সাল অবধি তারা যে সরকার চালিয়েছিল সেখানে টাউটারি, বাটপাড়ি করে যারা অবৈধ পয়সা আয় করেছিল তাদের প্রায় সবাই ছিল বহিরাগত অথবা ভিন্ন দলের মানুষ। সে সব ধড়িবাজ মাত্র কয়েক লাখ টাকা নগদ অথবা সামান্য কিছু উপহার দিয়ে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতার কাছ থেকে শত শত কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিত।
উল্লিখিত অবস্থার কারণে ২০০১ সালের ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামী লীগ অর্থনৈতিকভাবে ভারী বিপদে পড়ে। পরবর্তীকালে বিএনপির হাওয়া ভবনের বদনামি ও ২০০১-২০১৭ সালের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অনিয়ম, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ঘুষ, কমিশন, টাকা পাচার ইত্যাদি কর্ম আওয়ামী লীগকে এতটা প্রভাবিত করে যে, বড় বড় নেতারা বলতে থাকেন, আগামীতে ক্ষমতায় এলে আর অতীতের মতো ভুল করা হবে না। টাকা রোজগার করার জন্য নেতাকর্মীদের যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হবে এবং সবাই যাতে অতি অল্প সময়ের মধ্যে কোটিপতি হতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হবে।

২০০১-০৬ সালের আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক হতাশার পরিপ্রেক্ষিতে অনাগত দিনে তাদের যে মাস্টারপ্ল্যান ছিল তা ২০২২ সালে এসে কতটা সফলতার মুখ দেখেছে তা বাংলাদেশের বোবা প্রাণীগুলোও নির্ঘাত হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করতে পারে। ২০০১-০৬ সালের বিএনপি জমানার কিছু কর্ম, যেমন- আওয়ামী লীগ তাদের আরাধ্য বানিয়ে ফেলেছিল তদ্রুপ ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী শাসনের কিছু নমুনা নিজেদের জন্য অবশ্য কর্তব্যরূপে বিএনপি গ্রহণ করেছিল নিজেদের ২০০১-০৬ সালের শাসনামলে- আর তা হলো প্রশাসনে দলীয়করণ যা ম্যালথাসের ক্রমবর্ধমান সূত্রের প্রভাবে বর্তমান জমানায় এতটা সর্বগ্রাসী বিধ্বংসী অবস্থায় পৌঁছে গেছে যা সাধারণ জনগণ কল্পনাও করতে পারবে না। কেবল আমলাতন্ত্রের ভুক্তভোগীরাই প্রশাসনের দলতন্ত্রের করাল গ্রাস ও রাক্ষুসী থাবার ভয়াবহতা অনুভব করে। আমলাতন্ত্রসহ বাংলাদেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় প্রভাব, দলতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, জয় বাংলার প্রভাব প্রতিপত্তি হিমালয়ের উচ্চতা ছাড়িয়ে গেছে এবং বিকৃতি, রহস্য ও ভয়াবহতায় আমাজনের জঙ্গল, সাইবেরিয়ার বরফঢাকা মৃত্যুপুরী অথবা সাহারা-গোবি প্রভৃতি দুর্ভেদ্য ও দুর্গম মরুভূমির জটিলতাকেও ছাড়িয়েগেছে। ওসব ভয়াবহ অঞ্চলে মানুষের শাসন- সভ্যতার অনুশাসন, সাহিত্য-সংস্কৃতির রস অথবা বেহড়-বাগী-বন্দুকের সূত্র না চললেও প্রকৃতির আইন শতভাগ কার্যকর। হরিণেরা বাঘ-সিংহকে ভয় পায়- আর বাঘ-সিংহ ইন্দুর-বান্দরের সাথে গণ্ডগোল করে না। কিন্তু বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের এমনই ভয়াবহতা যে, এখানে কোনো প্রকৃতির আইন চলে না। বড় মাছ ছোট মাছকে খায় না; বরং পুঁটি-ঢেলা-মলা-কাচকিরা বড় বড় রুই-কাতলা পাঙ্গাশকে গিলে খেয়ে ফেলে।

প্রকৃতির আইনবিরুদ্ধ বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের কী দশা হয়েছে তা যদি বুঝতে চান তবে কোনো অফিসের পিয়ন-ড্রাইভার-আরদালির খোঁজ করুন এবং তারা যদি টুঙ্গিপাড়ার বাসিন্দা হয় তবে তাদের একটু আলাদা করে রাখুন। এরপর আপনি অন্য কোনো বড় কর্তার খোঁজ করুন যার বাড়ি বগুড়া অথবা যার গায়ে জামায়াত-শিবির অথবা বিএনপি-ছাত্রদলের গন্ধ আছে। এরপর আপনি টুঙ্গিপাড়ার পিয়ন-ড্রাইভার-আরদালির সামনে উল্লিখিত বড় কর্তাদেরকে একটু দাঁড় করালেই খুব সহজে বুঝতে পারবেন, মলা-ঢেলা-কাচকি মাছ কিভাবে রুই-কাতলা-বোয়াল, পাঙ্গাশ গিলে খেতে পারে- অথবা বিড়ালের ভয়ে বাঘেরা কিভাবে ঘড়ঘড় করে কাঁপতে পারে। আমার উল্লিখিত বক্তব্য শুনে যাদের খুব আনন্দ অনুভব হচ্ছে তাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি- বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের হালনাগাদ হালহকিকত শুরু হয়েছিল একটি প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে। সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য মনশেভিক-বলশেভিক বিপ্লব, ট্রটস্কির উত্থান-পতন-নির্বাসন যেমন গুরুত্বপূর্ণ অথবা ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থা গণতন্ত্র-আইনের শাসনের জন্য বিখ্যাত ম্যাগনা কার্টার দলিল যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি আজকের বাংলাদেশের দুনিয়া কাঁপানো আমলাতন্ত্রের জন্য জনতার মঞ্চ একই নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জনতার মঞ্চের সাথে আপনি যদি ঐতিহাসিক পানিপথের প্রথম, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় যুদ্ধের তুলনা করেন অথবা প্রাচীন দুনিয়ার দ্য ব্যাটেল অব গাওগেমেলা, দ্য ব্যাটেল ম্যারাথন কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর দ্য ব্যাটেল অব পিরামিডের তুলনা করেন তবে দেখতে পাবেন যে, ওইসব মহাযুদ্ধের চেয়েও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জনতার মঞ্চের পূর্বাপর প্রভাব অনেক অনেকগুণ বেশি। কারণ ওইসব যুদ্ধের ফলে কোনো অশরীরী প্রেতাত্মা জমিনে পয়দা হয়নি- অথচ জনতার মঞ্চের রসায়নে বাংলার জমিনে যেসব ভয়ঙ্কর প্রেতাত্মার সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মির প্রাণকে ক্রমাগত ওষ্ঠাগত করে তুলছে।

আজকের নিবন্ধের শিরোনাম ও ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে আমার মনে হঠাৎ জনতার মঞ্চের রসায়ন কেন এলো তা বলার আগে জনতার মঞ্চ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোচনা আবশ্যক। বাংলাদেশের রাজনীতিসচেতন লোকজন কমবেশি এই মঞ্চ সম্পর্কে জানেন- তবুও আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার লোভ সামলাতে পারছি না। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের দলবাজির যে বীজ আওয়ামী লীগ বপন করেছিল তা মহীরুহ আকার ধারণ করে তা প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রে কিভাবে ফুলে-ফলে শোভিত হয়েছিল তা ক্ষমতাধর বিএনপি সরকার যখন টের পেয়েছিল তখন আর তাদের করার কিছুই ছিল না। আওয়ামী লীগের বলবীর্যে বলীয়ান এবং আওয়ামী টনিকে মগজ ধোলাই হয়ে সচিবালয়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী যেভাবে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কর্মস্থল ত্যাগ করে রাজপথে নেমে এসে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মঞ্চে যোগদান করেছিল- তা-ই ঐতিহাসিক জনতার মঞ্চ হিসেবে পরিচিত! জনতার মঞ্চের কুশীলবরা পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারে নিদারুণ শক্তিশালী হয়ে পড়েছিল। পদ-পদবি, ক্ষমতা-অর্থ-বিত্ত, যশ-মদ-মাৎসল্য ইত্যাদি সব কিছুতে তারা যেভাবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন তা বিশ্বের যেকোনো যুদ্ধজয় বা রাজনৈতিক বিজয়ের ফলে বিজয়ীরা যেভাবে পেয়ে থাকেন তার চেয়ে শত-সহস্রগুণ বেশি ছিল। দ্বিতীয়ত, জনতার মঞ্চের আমলাদের দাপটে সত্যিকার রাজনীতিবিদরা রাজনীতির ময়দান থেকে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং অনেকে মনের দুঃখে স্বেচ্ছায় বনবাসে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাজনীতি যাদের নেশা-পেশা ও রুটি রুজির অবলম্বন ছিল তারা জনতার মঞ্চের নায়কদের তাণ্ডবে পথের ভিখারিতে পরিণত হয়েছিলেন।

আওয়ামী জনতার মঞ্চের আকাশচুম্বী সফলতা ঊর্ধ্বগামী হতে হতে প্রথম আকাশ ভেদ করে অনন্তলোকের পানে কেবলই ধেয়ে চলছে এবং মঞ্চের নায়ক-নায়িকাদের মিলনজাত বাই প্রডাক্টগুলো বংশ বৃদ্ধি করতে করতে এতটা বিস্তার লাভ করেছে যে, এগুলোর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, উচ্চতা মাপার মতো যন্ত্র পৃথিবীতে নেই। ফলে জনতার মঞ্চের বস্তুজাত-অবস্তুজাত, বায়বীয় ও অশরীরী উপসর্গ এখন সর্ব মহলে সীমাহীন আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।

আলোচনার শুরুতে বলেছিলাম, বিএনপির মন্দ দিকগুলো অনুসরণের জন্য আওয়ামী লীগ যেভাবে এ যাবৎকালে প্রতিযোগিতা করেছে ঠিক একইভাবে বিএনপি যদি আওয়ামী জনতার মঞ্চের অনুকরণে নতুন জনতার মঞ্চ তৈরি করে সেই আতঙ্কে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার যে কতটা বেহাল ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আমরা তার একটি নমুনা দেখতে পেলাম সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ঘটনার মধ্য দিয়ে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব মিয়ার চাকরির মেয়াদ ছিল মাত্র এক বছর। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমান সাহেবের সাথে দেখা করেছেন এবং মাঝেমধ্যে পল্টন বিএনপি অফিসের উল্টা দিকে জনৈক বিএনপি নেতার অফিসে গিয়ে আড্ডা মেরেছেন।

তো সরকারের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের একজনকে আমি সচিব সাহেব না বলে সচিব মিয়া সম্বোধন করলাম এ কারণে যে, তাকে বহিষ্কার করার পরও তার চাকরিপ্রীতি বা আওয়ামীপ্রীতি কমেনি; বরং আত্মমর্যাদা-আত্মসম্মানবোধ কবরচাপা দিয়ে তিনি যেভাবে নিজেকে সাবেক ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছিলেন তা শুনে বিশ্ববেহায়াদেরও লজ্জায় চোখ-মুখ লাল হয়ে যাওয়ার কথা। সচিব মিয়া তার ওপর অন্যায় করা হয়েছে নাকি হয়নি, কিংবা তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে কড়া প্রতিবাদ না করে যেভাবে বলেছেন যে, জনাব তারেক রহমানকে তিনি জীবনে দেখেননি- তাতে স্পষ্ট প্রমাণ হয়, বর্তমান প্রশাসন দলবাজির কাছে সমর্পিত হওয়ার জন্য তিন পায়ে খাড়িয়ে যেতে কীভাবে কতটা উদগ্রীব। উল্লিখিত সচিব মিয়ার মতো একই ভাগ্য বরণ করেছেন আরো তিন এসপি মিয়া ও একই কায়দায় আরো কয়েকজন মিয়া বা মিয়ার ব্যাটাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হবে বলে জোর প্রচারণা চলছে। সুতরাং জনতার মঞ্চের প্রেতাত্মাদের ভয় ক্ষমতার ভিত্তিমূলে কিভাবে কম্পন সৃষ্টি করেছে এবং ক্ষমতাধরদের চিত্তে কি মারাত্মক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

 


আরো সংবাদ



premium cement