২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

প্রচলিত নির্বাচন কতটুকু শরিয়াহসম্মত

প্রচলিত নির্বাচন কতটুকু শরিয়াহসম্মত - ফাইল ছবি

ইসলামী আদর্শে কল্যাণরাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে মজলিসে শূরা (জাতীয় সংসদ) গঠন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন একটি মৌলিক বিষয়। ইসলামী রাজনীতিতে প্রজাতন্ত্রের প্রধান অর্থাৎ খলিফা বা আমীর বা রাষ্ট্রপতি জনগণের আস্থাভাজন হওয়া অত্যাবশ্যক। মৌরসি রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, ডিক্টেটরশিপ ও বন্দুকের নলে ক্ষমতা দখলের কোনো অবকাশ ইসলামে নেই। ইতিহাসবিদ ইবনে সাদের মন্তব্য এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘ইসলামী হুকুমত হচ্ছে যা জনগণের রায় ও পরামর্শের ভিত্তিতে গঠন করা হয় আর রাজতন্ত্র হচ্ছে যা তরবারির জোরে হাসিল করা হয়।’ (ইবনে সাদ, তাবাকাত আল কুবরা, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১৩) মজলিসে শূরার সদস্য অথবা রাষ্ট্রপতি জনগণের নির্বাচিত, সমর্থিত ও পছন্দনীয় ব্যক্তি হওয়া একান্ত দরকার। রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনগণের রায়ে নির্বাচিত হতে পারেন অথবা মজলিসে শূরার সদস্যদের রায়ে নির্বাচিত হতে পারেন। সঙ্গত কারণে এ প্রশ্ন উঠতে পারে, নির্বাচনের পদ্ধতি কী হবে? পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের মাধ্যমে প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতি ইসলামী চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও পুরো সাংঘর্ষিক নয়। এক ব্যক্তি এক ভোট (One man one vote), প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারাধিকার (Adult Franchise) আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে স্বীকৃত ও সাংবিধানিক নিয়ম। 

ভোট ছাড়া কেবল মনোনয়নের মাধ্যমে মজলিসে শূরার তথা জাতীয় সংসদ গঠন জায়েজ হলেও বর্তমান যুগে এতে একনায়কতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্র চালু হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়। হজরত আবু বকর রা:, হজরত ওমর রা:, হজরত ওসমান রা: ও হজরত আলী রা:-এর মতো মুসলিম উম্মাহর শ্রদ্ধাভাজন শাসক মনোনীত ব্যক্তিকে নিজেদের প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নিতে তখনকার মুসলমানরা প্রস্তুত ছিলেন। আধুনিক যুগে এমন সর্বজন শ্রদ্ধেয় আস্থাভাজন শাসক পাওয়া রীতিমতো মুশকিল। পাওয়া গেলেও অন্য চিন্তাধারার আলেমরা তার বিরোধিতা করবেন, এমন মন্তব্য সহজে করা যায়। কারণ আলেমরা বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছেন এবং তাদের মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড মতবিরোধ। (মাওলানা গওহর রহমান, ইসলামী সিয়াসত, লাহোর, তৃতীয় সংস্করণ-১৯৮৭, পৃষ্ঠা-৩০৬) 

জনগণের সন্তুষ্টি ছাড়া মনোনীত ব্যক্তিরা ‘জনপ্রতিনিধি’ রূপে গণ্য হতে পারেন না (কাজী আবুল ইয়ালা, আহকাম আস-সোলতানিয়া, মিসর-১৯৬৬, পৃষ্ঠা-২৩) এবং তাদের সিদ্ধান্ত জনগণ বিনা দ্বিধায় মেনেও নিতে পারেন না। তাই এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ভোটাধিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও মজলিসে শূরা বা জাতীয় সংসদ গঠন অধিকতর যুক্তিযুক্ত। এতে জনগণ মনে করবে, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় তাদের মতামতের গ্রহণযোগ্যতা আছে। সরকার পরিচালনার অংশীদারিত্বের অনুভ‚তি ও জাতীয় ঐক্যের চেতনা তাদের দ্বারা সুদৃঢ় হবে। বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ। প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে এসব অনিয়ম দূর করা যেতে পারে। মনোনয়নের ক্ষতি এ যুগে তার উপকারিতার চেয়ে বেশি ও প্রয়োজনীয় শর্তাবলি আরোপপূর্বক সংশোধিত নির্বাচনপদ্ধতির উপকারিতা তার ক্ষতির চেয়ে অধিক (মাওলানা গওহর রহমান, ইসলামী সিয়াসত, লাহোর, তৃতীয় সংস্করণ-১৯৮৭, পৃষ্ঠা-৩০৬)। 

এ জন্য নিম্নোক্ত স্বীকৃত নীতিমালার ভিত্তিতে নির্বাচনের পথই কম বিপজ্জনক; ‘দু’টি মন্দ জিনিসের মধ্যে কম মন্দকে গ্রহণ করা নিরাপদ’। ‘লাভ অর্জনের আগে ক্ষতির উৎস বন্ধ করা দরকার;’ ‘ফ্যাসাদ ও মন্দের সব অবলম্বনকে প্রতিহত করা প্রয়োজন।’ (মুনির আল বালবাকি, আল মাওরিদ, লেবানন-১৯৮৬, পৃষ্ঠা-৭১)

যদি কোনো বৈধ (জায়েজ) অথবা প্রশংসিত (মুস্তাহসান) কাজ ফ্যাসাদ অথবা শরিয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েজ কাজের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন ওই কাজ অবৈধ ও বাতিলযোগ্য বিবেচিত হয়। এতে করে ক্ষতির পশ্চাৎদ্বার চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। ইবন কাইয়িম এ নীতিমালার ৯৯টি উদাহরণ পেশ করেন। ইমাম বোখারি এ নীতিমালার ব্যাখ্যা করেন এভাবে যে- ‘এ অধ্যায়ে ওই ব্যক্তির প্রমাণ পেশ করা হয়েছে যিনি অনেক ভালো জিনিসকে প্রত্যাখ্যান করেন এ উদ্দেশ্যে যে, কিছু লোক এর উপযুক্ততা অনুধাবন করতে পারবে না এবং এর চেয়ে অধিকতর ক্ষতির সম্মুখীন হবে।’ (সহিহ বোখারি, কিতাবুল ইলম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৪)

বর্তমান প্রচলিত নির্বাচনপদ্ধতি সাধারণ প্রথায় (উরফে আম) পরিণত হয়েছে এবং সাধারণ্যে প্রচলিত প্রথাই আইনের মর্যাদা লাভ করে। অর্থাৎ ‘রীতি ও প্রথা শরিয়তে গ্রহণযোগ্য এ কারণে যে, অনেক সময় এর ওপরই ফায়সালা নির্ভর করে।’ (ইবনে আবেদিন শামি, রাসাইল ইবনে আবেদিন, দ্বিতীয় রিসালাহ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৪)

পৃথিবীর বহু দেশের সংবিধান সাধারণ্যে প্রচলিত প্রথার ভিত্তিতে রচিত হয়েছে। ব্রিটেনের সংবিধান তার উজ্জ্বল প্রমাণ। শরিয়তের দৃষ্টিতে যেসব প্রথা, রীতি ও রেওয়াজ সরাসরি কুরআন-হাদিস ও মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যের (ইজমা) পরিপন্থী হবে না তা গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ ‘প্রথা ও রেওয়াজ নীতিগতভাবে অবৈধ নয় যদি না আল্লাহ কোনো ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করেন। (ইবনে তাইমিয়াহ, ইকতিদা আস সিরাত আল মুসতাকিম, মিসর-১৯৫০, পৃষ্ঠা-২৬৯)

এতে প্রমাণিত হয়, সব জিনিসই মূলত বৈধ ও আইনসম্মত যতক্ষণ না তা অবৈধ এবং হারাম হওয়ার ব্যাপারে শক্তিশালী দলিল উপস্থাপন করা হয়। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা:-এর কিছু হাদিসও রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহ কিছু কিছু ব্যাপারে সচেতনতার সাথে নীরব থেকেছেন। তোমরা ওইসব জিনিস বৈধ হওয়ার ব্যাপারে তর্কে লিপ্ত হয়ো না।’ (মিশকাত আল মাসাবিহ) উপর্যুক্ত হাদিসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মোল্লা আলী কারী হানাফি বলেন, ‘এ হাদিস প্রমাণ করে, আসলে সব জিনিসই বৈধ ও আইনসম্মত।’ (মোল্লা আলী কারী, মিরকাত, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬৩) আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইন বিশেষজ্ঞ ইবনে আবেদিন শামি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রথা ও রেওয়াজে বিশদভাবে প্রমাণিত বস্তু আল্লাহ ও রাসূলের বাণীর মতো গ্রহণযোগ্য।’ (ইবনে আবেদিন শামি, রাসাইল ইবনে আবেদিন, দ্বিতীয় রিসালাহ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১৫)

আধুনিক বিচারব্যবস্থায় পূর্বদৃষ্টান্ত ও নজির (Precedence) যেমন আইনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রচলিত প্রথা এবং রীতি বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের (Judicial judgment) মতো কার্যকর। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতি এ নীতিমালাকে সুদৃঢ় ও নিষ্পত্তিকারী বিষয়রূপে মর্যাদা দিয়েছেন। (আল আশবাহ ওয়ান নাজাইর-১৯৫৯, পৃষ্ঠা-৮৯) আল্লামা ইবনে কাইয়িমের মন্তব্য এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য, ‘যুগ, এলাকা, পরিবেশ ও প্রথার পরিবর্তনের ফলে ফতোয়ারও পরিবর্তন ঘটে।’ (ইবনে কাইয়িম, আলাম আল মুকিইন, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৫ ও ৬৪) স্মর্তব্য, প্রথা ও রীতি রেওয়াজ সম্পর্কিত নীতিমালা নিখাদ ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ এ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের ঘোষণা অতি স্পষ্ট- অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি আমার দ্বীনে নতুন কোনো তরিকা-পদ্ধতি আবিষ্কার করে যা ওই দ্বীনে নেই, তা বাতিলযোগ্য।’ (মাওলানা গওহর রহমান, ইসলামী সিয়াসত, লাহোর, তৃতীয় সংস্করণ-১৯৮৭, পৃষ্ঠা-৩০৪)

এরূপ তরিকাকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘বিদআত’ বলা হয়। সব বিদআতই হচ্ছে গোমরাহির পথ। কিন্তু ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোট প্রদান বা গ্রহণ শরিয়তের কোনো আহকামের অন্তর্ভুক্ত নয়। শরিয়তের হুকুম (শুরাইয়ত বা পরামর্শ) যা কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরাম দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু মজলিসে শূরা গঠন প্রণালী বৈধ ও সুবিবেচ্য কার্যাবলির (মুবাহাত ও মাসালিহ) অন্তর্ভুক্ত। শরিয়ত এ ব্যাপারে জনগণকে স্বাধীনতা দিয়েছে- যেকোনো গ্রহণযোগ্য ও উন্নততর পদ্ধতি বেছে নেয়ার। যেমন- আল্লাহর পথে সশস্ত্র যুদ্ধ (কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ) কিয়ামত পর্যন্ত শরিয়তের এক অলঙ্ঘনীয় হুকুম। এটি মুখ্য বিষয় কিন্তু তরবারি, বর্শা, তীর-ধনুক, মানজানিক (Ballista) নিয়ে চিরকাল যুদ্ধ করতে হবে এমন কোনো বিধান শরিয়তে নেই। যুগচাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অস্ত্রের ধরন ও কৌশল পাল্টে গেছে ও যাবে, এটিই স্বাভাবিক। আধুনিক যুগে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর জন্য উন্নততর ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাংকবিধ্বংসী কামান, জেট ফাইটার, সাবমেরিন, টর্পেডো ইত্যাদির ব্যবহার শরিয়তে বৈধ কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ সা: তথা খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে এসব অস্ত্র প্রচলিত ছিল না বলে বর্তমানে এর ব্যবহার হতে পারে না- এমন কথা অযৌক্তিক, অগ্রহণযোগ্য ও অবাস্তব। 

সূরা আনফালের ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘তাদের (সাথে যুদ্ধের) জন্য তোমরা যথাসাধ্য সাজ-সরঞ্জাম, শক্তি ও ঘোড়া প্রস্তুত রাখবে এবং এগুলো দিয়ে তোমরা আল্লাহর দুশমন ও তোমাদের দুশমনদের ভীতসন্ত্রস্ত করে দেবে।’ এ আয়াতে জিহাদের জন্য ঘোড়া পালনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শায়খ ইউসুফ কারযাভীর ভাষ্য হচ্ছে- তখন ঘোড়া ছিল সামরিক যান। এখন আর এটি প্রাসঙ্গিক নয়; বরং এখনকার যুদ্ধে ট্যাংক, সামরিক যান ও এ ধরনের উন্নত সব সমরাস্ত্র ব্যবহৃত হয়। এগুলোই বর্তমানকালের ঘোড়া। বর্তমানে যারা এসব যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারে, তারাই এ যুগের অশ্বারোহী।’

অনুরূপভাবে ব্যালট পেপার কেন্দ্রিক বর্তমানে প্রচলিত নির্বাচনপদ্ধতিও নাজায়েজ হতে পারে না ইসলামের প্রাথমিক যুগে (কুরুনে উলা) চালু ছিল না, এ অজুহাতে। নির্বাচন হচ্ছে আস্থা অর্জন ও রায় গ্রহণের একটি মাধ্যম মাত্র। যুগ পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে পদ্ধতির পরিবর্তন হতে পারে। আগামীতে হয়তো আস্থা অর্জনের বা রায় দেয়ার আরো উন্নততর পদ্ধতি আবিষ্কৃত হতে পারে। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় আমির, খলিফা বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বাইয়াত একটি মৌলিক শর্ত। বাইয়াতকে আনুগত্যের শপথ, রায় প্রদান, খলিফা নির্বাচন ও খলিফার ইখতিয়ার ইত্যাদি অভিধায় চিহ্নিত করা যায়। 

বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদরা অভিমত ব্যক্ত করেন যে- জনপ্রতিনিধিদের বাইয়াত ছাড়া খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। (কাজী আবুল ইয়ালা, আল আহকাম আল সোলতানিয়া, মিসর-১৯৬৬, পৃষ্ঠা-২৩; ইবনে কুদামাহ, আল মুঘনি, অষ্টম খণ্ড, মিসর-১৯৬৯, পৃষ্ঠা-৫২৬; মুহাম্মদ আল কুরতুবি, আল জামে লি আহকামিল কুরআন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬৮; ইবনে তাইমিয়া, মিনহাজ আস সুন্নাহ, প্রথম খণ্ড, মিসর-১৩২১ হি., পৃষ্ঠা-১৪০; ইবনে কাসির, তাফসির আল কুরআন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১২৫; শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী, ইজালাতুল খাফা, প্রথম অধ্যায়, লাহোর-১৯৭৬, পৃষ্ঠা-৫; ইবনে খালদুন, আল মোকাদ্দমাহ, পৃষ্ঠা-১৫২)

খলিফা বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সরাসরি জনগণের রায়ে নির্বাচিত হতে পারেন অথবা জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সদস্যদের দিয়েও তাকে নির্বাচন করা যায়। জাতীয় সংসদের সদস্যরা হচ্ছেন জনগণের আস্থাভাজন ও জনপ্রতিনিধি। (আহলুল হক ওয়াল আকদ) ইসলামের প্রাথমিক যুগে হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ করা হতো। এ হাত মেলানো ছিল নির্বাচন ও রায় গ্রহণের তৎকালীন পদ্ধতি। 

বাইয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের পক্ষ থেকে সাহায্য ও আনুগত্যের ওয়াদা আর শাসকের পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ, জনগণের কল্যাণকামিতা ও ন্যায় ইনসাফ সুনিশ্চিতকরণের ওয়াদা। (মাওলানা গওহর রহমান, ইসলামী সিয়াসত, লাহোর, তৃতীয় সংস্করণ-১৯৮৭, পৃষ্ঠা-৩২০) হাত মেলানো ছিল শাসক ও শাসিত এ দু’পক্ষের চুক্তির এক প্রতীকী বা বাহ্যিক রূপ। কেবল হাতে হাত মেলানোতে বিশেষ কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে- আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। যুগে যুগে এর পরিবর্তন হতে পারে প্রথাগতভাবে। বর্তমান যুগে বাইয়াতের পরিবর্তিত রূপ হচ্ছে ব্যালট পেপার। ব্যালট পেপারের মাধ্যমে একজন ভোটার তার রায়, আনুগত্য ও আস্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারেন। এটিও বাইয়াতের মতো প্রতীকী রূপ। নির্বাচিত ব্যক্তি শপথের মাধ্যমে আইনের প্রতি তার বাধ্যবাধকতা ও জনগণের প্রতি তার দায়িত্বাবলির ওয়াদা স্বীকার করে নেন। উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, প্রচলিত নির্বাচনপ্রক্রিয়া ও পদ্ধতিকে ইসলামী সংবিধান বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কিছুটা সংশোধনপূর্বক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অথবা প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে আরো কোনো উন্নততর পদ্ধতি-প্রক্রিয়া যদি উদ্ভাবন করা যায় এবং তা যদি সরাসরি কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মতের চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী না হয় তাহলে তাও সন্দেহাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসার্হ হতে পারে। 

প্রচলিত নির্বাচন ও ভোট প্রসঙ্গে উপমহাদেশের বিখ্যাত ফিকাহবিদ আল্লামা মুফতি মুহাম্মাদ শফী বলেন, ‘ইসলামের দৃষ্টিতে ভোট হচ্ছে তিনটি বিষয়ের সমষ্টি- ১. সাক্ষ্য প্রদান; ২. সুপারিশ ও ৩. প্রতিনিধিত্বের অথরিটি প্রদান। শরিয়তে উপরোক্ত তিনটি বিষয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা তৈরির ও রাষ্ট্র্ পরিচালনার জন্য প্রতিনিধিত্বের সনদ দেয়ার মানে হচ্ছে প্রতিনিধিত্ব দানকারী (ভোটার) তার ভবিষ্যৎ সব কার্যকলাপের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিচ্ছে। এমনিভাবে সুপারিশের বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য। কুরআনুল কারিমের ভাষায়- ‘যে ভালো সুপারিশ করবে সে তার নেকির ভাগী হবে। আর যে মন্দ সুপারিশ করবে সেও মন্দের হিস্যা পাবে।’ (সূরা নিসা, আয়াত-৮৫) ভোটের মধ্যে যে তিনটি (সাক্ষ্য প্রদান, সুপারিশ, প্রতিনিধিত্বের সনদ প্রদান) বিষয় রয়েছে এর মধ্যে ‘শাহাদত’ বা সাক্ষ্যের বিষয়টি মৌলিক। অর্থাৎ কাউকে ভোট দেয়ার অর্থ হলো- তার ব্যাপারে এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে, লোকটি ভালো ও যোগ্য। এখন যদি যথাযথ জায়গায় সিল দিয়ে এ সাক্ষ্য প্রদান করা হয়, তবে সে হবে সত্য সাক্ষী অন্যথায় হবে মিথ্যা সাক্ষী। আর মিথ্যা সাক্ষ্য যে কত বড় কবিরা গুনাহ ও হারাম কাজ তা কি কারো অজানা রয়েছে? মিথ্যা ও অবাস্তব সাক্ষ্যের ক্ষতি ও খেসারত বলে শেষ করার মতো নয়। হকদার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, অযোগ্য ও অপদার্থের উত্থান, দুর্নীতিবাজ ও শোষক শ্রেণীর লোকদের ক্ষমতায়ন- এ সবই মিথ্যা সাক্ষ্যের ক্ষতি।


উপর্যুক্ত আলোচনায় প্রশ্ন আসতে পারে, তা হলে তো বর্তমান সমাজে বেশির ভাগ আসনের লোকদের ভোট দেয়াই সম্ভব হবে না। কারণ, এমন লোক তো পাওয়া যাবে না, যার সপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করা যায় এবং এ কারণে অনেকে ভোট দেয়া থেকে বিরতও থাকেন, এমনকি বহু লোক ভোটার হতেও আগ্রহী হন না। সাধারণ বিবেচনায় এ চিন্তা যুক্তিযুক্ত মনে হলেও এ ক্ষেত্রে কিন্তু মুদ্রার ভিন্ন পিঠও রয়েছে। তা হচ্ছে- মন্দের ভালো বা তুলনামূলক কম ক্ষতিকে বেছে নেয়া এবং অধিক ক্ষতি থেকে বাঁচার চেষ্টা করা। 

বর্তমানে ভোটকে এ দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচনায় আনতে হবে এবং ভোটের মাধ্যমে অধিক ক্ষতি থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। কোনো আসনে একজন লোককেও যদি সাক্ষ্য ও ভোট দেয়ার উপযুক্ত মনে না হয় তবে তাদের মধ্যে যে জন নীতি-নৈতিকতা, চিন্তা-চেতনা ও কাজে-কর্মে অন্য প্রার্থীর তুলনায় কম খারাপ তাকেই ভোট দিতে হবে। কারো ব্যাপারে যদি খোদাদ্রোহিতা, ইসলাম-দুশমনী, রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থবিরোধী হওয়ার সুস্পষ্ট আলামত থাকে তবে ওই অসৎ ব্যক্তির বিজয় ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে ভোটারাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে। মোট কথা, গণতন্ত্র ও বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির যতই ত্রুটি থাকুক এর কারণে ভোটদানে বিরত থাকা সমীচীন হবে না; বরং বুদ্ধি-বিবেচনা খরচ করে, ভেবে-চিন্তে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হবে ভালো, মন্দের ভালো অথবা অন্তত কম মন্দের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে শরিয়তের দৃষ্টিতে কাউকে ভোটদানের অর্থ হবে- এ সাক্ষ্য দেয়া যে, লোকটি তার প্রতিদ্ব›দ্বীদের তুলনায় কিছুটা হলেও ভালো (জাওয়াহিরুল ফিকহ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩০০; মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, আল-কাউসার, ঢাকা, বর্ষ-৪, সংখ্যা-১১, ডিসেম্বর-২০০৮)

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement