১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইউরোপীয় মুসলমানদের সঙ্কট

বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ছবিটি ২০১৪ সালের। - ছবি : এএফপি

ইউরোপের মুসলমানরা সুদীর্ঘ দিন ধরে নানা সঙ্কটে বসবাস করছেন। বর্তমানে দু’টি বিষয় ইউরোপীয় মুসলমানদের তাড়া করে ফিরছে, একটি ইসলামোফোবিয়া অপরটি টেররিজম বা ‘ইসলামী সন্ত্রাস’। এসব মাথায় নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ায় এবং বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ইসলামের সঠিক পরিচিত ও তার কার্যক্রম সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়ার কষ্টকর কার্যক্রম চালিয়ে আসছে সেখানকার কিছু মুসলমান। পশ্চিমা বিশ্বের বিশাল জনগোষ্ঠীর ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। মিডিয়া এমন করে তথ্য প্রবাহ সৃষ্টি করে যে পশ্চিমা বিশ্বের তাবৎ অকল্যাণ ওখানকার মুসলমানদের জন্য! ইসলামিক সোসাইটি গত ৩৫ বছর ধরে ইতালিতে এ ধারণার বিরুদ্ধে কাজ চালিয়ে আসছে, যদিও তা অপ্রতুল।

বর্ণিত চ্যালেঞ্জের জন্য পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে একটি নতুন ধরনের সহযোগিতার ক্ষেত্র খুঁজে বের করা উচিত, হতে পারে সেটি প্রজ্ঞা বা ‘হিকমা’, পাশ্চাত্যের মুসলমানরা ‘জিহাদ আল-আকল’ বা বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ নিয়েও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বিষয়টি সূক্ষ্ম। ইউরোপীয় নাগরিকদের অনেকে মুসলিম অভিবাসীদের কুসংস্কার এবং পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকাতে অভ্যস্ত। প্যারিস হামলাকে অনেক ইউরোপীয় ‘ইসলামী আগ্রাসন’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এর পেছনে যে মুসলমানদের প্রিয় নবীকে অবমাননাকর ছবি প্রকাশ করার কারণে, সে বিষয়ে কোনো কথা বলছেন না। এমনকি লেবাননে ম্যাক্রোঁর সফরের সময় বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এটি নিয়ে এভাবে খোলামেলা আলাপ করা ঠিক হবে না।’ মুসলমানরা বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করার পর পশ্চিমারা ইসলামোফোবিয়ার বিষয়ে ভালো মওকা পেয়ে যায়।

ইসলামোফোবিয়া বিশ্বের মুসলমানদের নানাভাবে প্রভাবিত করে। দুঃখজনকভাবে বিশ্ব এমন কিছু সন্ত্রাসীর দেখা পেয়েছে; যারা নারী ও শিশুসহ বেসামরিক নাগরিক এবং নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। ইসলামের নামে সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং সাম্প্রদায়িকতাকে সক্রিয় করে তুলছে, অথচ তারা প্রায়শই ধর্ম সম্পর্কে কিছু জানে না। অন্য দিকে, পশ্চিমা মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদরা, বিশেষ করে প্রভাবশালী শক্তিগুলো, নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে বিশ্বজুড়ে ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে দিতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে, বেশির ভাগে রয়েছে ফ্রান্স।
ইতালিসহ ইউরোপে ইসলামোফোবিয়ার চর্চার অনেক ঘটনা রয়েছে। সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলোতে দেখা যায়, শুধু ধর্মীয় কারণে মুসলমানদের চাকরির আবেদন এবং সাক্ষাৎকার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। শুধু হিজাব পরিধান করায় চাকরি ও বিদ্যালয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। লন্ডনের মতো স্থানে হিজাব পরিধান করার কারণে মিসরীয় নারীকে হত্যা করা হয়েছে।

নিউজিল্যান্ডের ঘটনায় মুসলিম সংগঠনগুলো হতাশা প্রকাশ করেছে। তাদের প্রশ্ন, ক্রাইস্টচার্চের সীমান্তে আলাদা আলাদা জেল সেল হিসেবে কথিত হত্যাকারী বসে আছেন। নিউজিল্যান্ডের অনেকে ভাবছেন, একজন উগ্র ডান চরমপন্থী সামরিক অভিযানের অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে কিভাবে এতদিন ধরে অচেনা রয়ে যায়। ক্রাইস্টচার্চের ঘটনায় অভিযুক্ত যুবক একজন শুটার ও স্থানীয় বন্দুক ক্লাবের সক্রিয় সদস্য। তিনি দক্ষিণ ডুনেডিন জিমে নিজের ওজন কমিয়েছেন। তিনি খুব শান্ত ও আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন। নিউজিল্যান্ডের মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন হতাশা প্রকাশ করেছে যে, গত পাঁচ বছরে জাতিগতভাবে বর্ণবাদ ও তাদের সম্প্রদায়ের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে উত্তর দ্বীপের মাওরি, প্যাসিফিকা ও এশিয়ান কমিউনিটির ব্যাপারেও সতর্ক করা হয়েছে।

ক্রাইস্টচার্চে বসবাসকারী কান্টারবারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞানী এবং অপরাধী বিচার ও গোষ্ঠীগত সন্ত্রাসবিষয়ক বিশেষজ্ঞ জারড গিলবার্ট বলেন, ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত ক্রাইস্টচার্চ ও বৃহত্তর দক্ষিণ দ্বীপে ‘অল্পবয়সী ন্যাড়া মাস্তান’ শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৯০ এর দশকে অতি উগ্র মতবাদ আজকের বিচ্ছিন্নতাবাদের চেয়ে অনেক বেশি দৃশ্যমান ছিল। তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে নানা বর্ণের মানুষকে অপমান ও উপহাস করত। যদিও অল্প বয়সী ন্যাড়া মাস্তানদের সংখ্যা কমেছে কিন্তু অতি উগ্রবাদের সংখ্যা ও সহিংসতা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিউজিল্যান্ডে অতি উগ্রবাদীদের ২৫০টিরও বেশি সক্রিয় গ্রুপ রয়েছে! গিলবার্ট বলেন, ক্রাইস্টচার্চে অভিযুক্ত ব্রেনটন ট্যারান্টের অপরাধ সম্পূর্ণ নতুন ঘটনা। রাতে রাস্তার কোণের মাস্তানদের গণনা করা সহজ। কিন্তু অনলাইন সম্প্রদায়গুলোর অনুমান করা ও হুমকির আকার নির্ধারণ করা অসম্ভব।
ক্রাইস্টচার্চের শুটারের ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন ছিল না। এটি স্থানীয় সমস্যাও ছিল না। বরং আন্তর্জাতিক ইউরোপীয় সমস্যা, কিন্তু ঘটেছে স্থানীয়ভাবে। নিউজিল্যান্ডের মেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উগ্র ডানপন্থী রাজনীতির বিশেষজ্ঞ পল স্পুনলির বিশ্বাস, নিউজিল্যান্ডে ঘৃণার বসতি রয়েছে। নিউজিল্যান্ড জাতীয় ফ্রন্ট, ডোমিনিয়ন মুভমেন্ট ও রাইট উইং রেসিসটেন্সসহ দেশে ২০০ থেকে ২৫০টি উগ্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। এরাই মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনলাইন ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে পুরো ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্বে ঘৃণা ছড়াচ্ছে ও নিরীহ মুসলিম নর-নারীদের আঘাত করে প্রাণহানির ঘটনা ঘটাচ্ছে।

অষ্টম থেকে ১১তম শতাব্দীতে ইউরোপ সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের যুগ হিসেবে পরিচিত অন্ধকার যুগ। ওই সময় কর্ডোবার গ্র্যান্ড মসজিদটি স্পেনে নির্মিত হয়েছিল, ৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে, অন্ধকার যুগের শুরুতে। এ অন্ধকার যুগের কেন্দ্রস্থলে, ইবনে আল হাইথাম নামে একজন মানুষ আলো খুঁজে পান। তিনি প্রথম পিনহোল ক্যামেরা তৈরি করেছিলেন। আলো এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর তার কাজ শত শত বছর পরে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু তার নাম কেউ নেয় না, অন্ধকারে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

ফাতিমা আল ফিহরি একটি মাদরাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা এখন পর্যন্ত প্রাচীনতম ধারাবাহিকভাবে চলমান বিশ্ববিদ্যালয়, পরে ইসলামী বিশ্বে চিন্তার অগ্রগতির একটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে। একজন নারী এটি খুলেছিলেন এবং এটি ছিল ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দ। যখন ইউরোপ গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল।

এসব বিষয় বাস্তবে দেখে ইসলামোফোবিয়ার ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে সহায়তা করতে হবে। অনেক অমুসলিম বৃদ্ধ বয়সে পরকালে শান্তিতে থাকার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। লেখালেখি করছেন। তারা উদগ্রীব হয়ে পড়েন ইসলামের অমীয় বাণী শুনতে। তাদের অন্তরে একত্ববাদ এখন কাজ করছে এটিই বড় কথা। বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্ব ও ইউরোপে আরো ব্যাপকভাবে তাদের মতো করে বুঝানোর প্রচেষ্টা চালানো উচিত। তাই ইসলামের প্রকৃত নীতিগুলো সম্পর্কে তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ম্যানিপুলেট করতে হবে, উলামার মূল ফাংশন পরিবর্তন করতে হবে, তাদের এমন রাজনীতিবিদে রূপান্তরিত করা, যাদের ইসলামের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান নেই।

অভিযোগ আছে, পশ্চিমা সমাজের অনেক মানবাধিকার সংস্থা ইসলামোফোবিয়ার মাধ্যমে মুসলমানদের ওপর জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্যের প্রতি অন্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আসছে। এটি অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দ্বৈত মানদণ্ডের প্রমাণ।

কিছু গোষ্ঠী ও ডানপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলন, ইসলামোফোবিয়াকে রাজনৈতিক শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তারা ইউরোপের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনে দায়ী। ইউরোপে কোনো ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করে এ সমস্যা মোকাবেলা করা সহজে সম্ভব হবে না, এ পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে প্রশমিত করবে বলে মনে হয় না। এ পদ্ধতি অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে; এর মধ্যে ইসলামোফোবিয়ার বদলে অন্য কোনো আজাব হয়তো চলে আসবে। এ বিষয়ে কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান প্রয়োগ করা যেতে পারে। যেমন প্রতিটি জেলা ও এলাকায় ইসলামের ভালো প্রতিনিধি গড়ে তুলতে অবশ্যই স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদিতে শিক্ষার ক্ষেত্রে কাজ করা এবং মসজিদভিত্তিক কাজ করা যা ইতোমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত মুসলমানরা ইসলাম ধর্মের বিধিবিধান মেনে চলার কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। অ্যামনেস্টি আরো বলেছে, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে মুসলমানরা বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, স্পেন এবং সুইজারল্যান্ডে বসবাসকারী মুসলমানদের পরিস্থিতির ওপর এ প্রতিবেদনে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে ইসলাম সম্পর্কে কল্পনাপ্রসূত, ভুল ও প্রতিকূল ধারণা দূর করতে ইউরোপীয় সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ইউরোপীয় দেশগুলোতে ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলো দূর করার কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে না বরং কিছু রাজনৈতিক দল ও কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তা ভোট পাওয়ার লোভে এসব আরো উসকে দিচ্ছেন।

ফ্রান্সসহ যেসব দেশ মুসলিম নারীদের নেকাব নিষিদ্ধ করেছে অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে সেসব দেশের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, হিজাব এক শালীন পোশাক।

এ নৈতিক শূন্যতার মাঝে, একটি বিরক্তিকর কণ্ঠস্বর দেখা যায়, মুসলমানদের নীরবতার কণ্ঠস্বর। তারা অনিরাপদ সংখ্যালঘুদের চলমান নৌকাকে আর ঝাঁকাতে আগ্রহী নয়; বরং তাদের মতামত নিজেদের কাছে রাখতে চায়। পশ্চিমা সভ্যতার নব নব অনৈতিক রূপান্তর চিন্তাশীলদেরও অস্থির ও দুর্বল করে তুলেছে।
গর্ভনিরোধ থেকে শুরু করে সমকামিতা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বিষয়ে ক্যাথলিক গির্জার মতামত বেশির ভাগের অজানা নয়। ক্যাথলিক দাতব্য সংস্থা ক্যাথলিক কেয়ার, সমকামীদের তাদের সন্তানদের দত্তক নিতে বাধা দেয়ার জন্য এক আবেদনে হেরে যায়। চ্যারিটি কমিশন বলেছিল যে সমকামী লোকেরা উপযুক্ত ‘বাবা-মা’ এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বৈষম্যকে ন্যায্যতা দেয় না। সম্প্রতি পোপের সফর এমনকি যারা তার প্রশংসা করে তাদের দ্বারাও মন্তব্য করা হয়েছিল যে তারা গর্ভপাত বা সমকামিতা সম্পর্কে তার মতামতের সাথে একমত নন। এক সময়, ব্রিটেনে সমকামিতা সামাজিক অবক্ষয় ও অপরাধ ছিল। আজ অবস্থা ভিন্ন। অস্কার ওয়াইল্ড ১৮৮৫ সালে যৌন বিচ্যুতির জন্য নিজেকে কারাগারের পিছনে খুঁজে পেয়েছিলেন। ব্রিটিশ মুসলিম কাউন্সিলের সাবেক প্রধান ইকবাল স্যাক্রানি, সমকামিতাকে ক্ষতিকারক বলে অভিহিত করায় তিরষ্কার হয়েছিলেন।

অবাধ যৌনাচারের পরিণতির অর্থ হলো, দম্পতিদের জন্য তাদের অংশীদারদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা এখন আদর্শ, তাদের স্বামী-স্ত্রীর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার বিপরীতে। ২০০৬ সালে, যুক্তরাজ্যের ৪০ শতাংশ শিশু বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করে, যা ১৯৮০ সালে ১২ শতাংশ ছিল। এ ধরনের বংশধরদের জন্য ইংরেজি ভাষায় একটি অবমাননাকর শব্দ রয়েছে, যা বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সাথে সম্পর্কিত ট্যাবুকে প্রতিফলিত করে। কিন্তু সময় বদলেছে, সমাজের অধিকার ও অন্যায়ও বদলেছে।

গতকাল যা ভুল ছিল তা আজ সঠিক। তখন যা অনৈতিক ছিল, তা এখন নৈতিক। তখন যা শাস্তিযোগ্য ছিল তা আজ প্রশংসনীয়। ইউরোপে নৈতিকতার জন্য কেউ কাঁদে না, কোনো নৈতিক ধ্রুবক নেই। একটাই ধ্রুবক, উদার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। ইসলামে সেখানে লাগাম দেয়া হয়েছে। জিহাদ-আল-নফসকে বলা হয়েছে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। আমার যা চাই তাই অর্জন করতে হবে সেটিই আইন সেটিই ধর্ম! খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের সাথে বিরোধ বাঁধে সাধারণের। পোপরা কতক্ষণ হাঁকডাক করবেন? লোকজন গির্জায় না গেলে তারা কিভাবে বাঁচবেন। বিষয়টি আঘাত করছে মুসলমান সংখ্যলঘুদের ওপরও। ১০০ বছর আগে, সোডোমি অপরাধ ছিল কিন্তু আজ তা নয়। আজ সমলিঙ্গে বিয়ে আইন সিদ্ধ। অথচ এ অপরাধে লুতের বংশধর বিলুপ্ত হয়, বিলুপ্ত হয় পম্পেই। আজ অসদাচরণ একটি অপরাধ। উদার ব্রিটেন এ প্রজন্মকে কি গ্যারান্টি দিতে পারে যে, আরো ১০০ বছরের মধ্যে এটি অপরাধ হবে না।

পশ্চিমাদের জনপ্রিয় রাজনৈতিক ও সংস্কৃতির এক আইটেম হলো ‘মুসলমানরা সন্ত্রাসী’। এটি তারা শুধু বলে নয়, বিশ্বাসও করে। জেহাদি চেতনাকে নির্মূল করতে ২০০৫ সালে পশ্চিমা শক্তি ‘ইসলামের বিরুদ্ধে ইসলাম’ নামে একটি কৌশল ও কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে। তখন জোর দিয়ে বলা হয়েছিল যে এটি অর্জনের জন্য পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক দিক থেকে কষ্টকর হলেও বড় অর্থ খরচের ঝুঁকি নিয়ে সামনে এগুবে।

পরিকল্পনাটি দক্ষিণ এশিয়া থেকে নাইজেরিয়া এবং সিরিয়া থেকে ইরাক পর্যন্ত পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এটি একটি জঘন্য কৌশল যা একজন মুসলিমকে মাথা নত করতে এবং নীরব থাকতে বাধ্য করে যখন একজন সাধারণ এবং নির্বোধ পশ্চিমা জিজ্ঞাসা করে ‘মুসলমানরা কি সবসময় একে অপরের সাথে দ্বন্দ্ব করে এবং রক্তপাত করে?’ ‘ইসলাম বনাম ইসলাম’ কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু নিঃসন্দেহে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব। মুসলমানরা এখনো সেই জটিল প্রক্রিয়ায় আবদ্ধ।

অনেক বছর ধরে দেখা যায় মুসলিম নেতারা একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অথচ ইউরোপীয় সমাজের ক্ষতিকর বিষয়গুলো নিয়ে মুখ খুলছেন না। তারা সমকামিতা, অশ্লীলতা, মদ্যপান, নাস্তিকতা, সমলিঙ্গে বিয়ে, উদারতাবাদ, সুখবাদ এবং অশালীনতার ক্ষেত্রে সত্য ঘোষণা এবং প্রেস রিলিজ প্রদান করাতে উৎসাহ পাচ্ছেন না। এরা কি জবাবদিহির ঊর্ধ্বে? কুরআনে যে বলা হয়েছে ‘তোমরা সর্বোত্তম জাতি’ সেটি কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পালন করা হবে?

এটি একটি সঙ্কটময় মুহূর্ত, কিন্তু এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে নিয়ে মানুষকে ইসলামের প্রকৃতি বোঝাতে আরো বেশি সুযোগ করে দিতে হবে। ইতালিতে অমুসলিমদের মসজিদে আমন্ত্রণ জানানোর বিশেষ প্রচেষ্টা খুব ভালোভাবে কাজ করছে। অমুসলিমরা মুসলমানদের সাথে মসজিদে দেখা করতে পারেন এবং ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারেন, নারী-পুরুষকে তাদের নিজস্ব পোশাকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয় এমনকি তারা পেছনে বসে সালাত আদায়ও দেখেন।

অপর একটি কৌশল হলো ইসলামী বিশ্বাসকে শেষ এবং সর্বোত্তম হিসেবে গ্রহণ করতে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ব্যাপকভাবে চালু করা। মুসলমান কর্মীরা ইতালি ও ইউরোপজুড়ে অনেক স্থানে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। ধর্মপ্রচার ইসলামের একটি অপরিহার্য অংশ। ধর্মীয় সংলাপে ইসলামী ইতিহাসকে সংযুক্ত করা, ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে অধ্যয়ন করা। ভেনিসে আন্তঃধর্ম আলোচনা হয়েছে, বিশেষ করে আব্রাহামিক সম্প্রদায় এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সাথে; কেননা এরা ভ্যাটিকানের প্রতিনিধিত্ব করে না। সে দেশে প্রকৃতিবিরোধী যেসব ফেতনা জনপ্রিয় হচ্ছে ইউরোপীয় মুসলমানদের তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে নতুবা সুখে থাকার দিন এক সময় ফুরিয়ে যাবে, যেকোনো সময় বসনিয়া ও স্পেনের মতো দুর্যোগ নেমে আসতে পারে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement