১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিক্ষার সঙ্কট

শিক্ষার সঙ্কট - ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর কিছু বক্তব্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ঘষেমেজে-পাস না করে শিক্ষার্থীদের দক্ষ হয়ে ওঠা প্রয়োজন; বলেছেন অনেকে শুধু কোনো রকম ঘষেমেজে বিএ,এমএ পাস করেই চাকরির পেছনে ছুটে বেড়ায়। শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য পড়াশোনা না করে নিজেকে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ করে গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন। মাননীয় তথ্যমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন- মানবিক সমাজ গড়ার জন্য যে ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনশক্তির প্রয়োজন তা আমাদের দেশে হচ্ছে না। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন- আজকাল হতাশা থেকে বিভ্রান্ত হয়ে তরুণরা আত্মহননের মতো জঘন্যতম পথ বেছে নিচ্ছে। এ তিনটি বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা দেশের উপযোগী নাগরিক তৈরিতে খুব একটা সক্ষম হচ্ছে না। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত, নৈতিকতায় সমৃদ্ধ পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতাসম্পন্ন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, গড়ে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। এর আগেও ২০১৬-১৭ সালে ভর্তি পরীক্ষায় ক,খ,গ,ঘ ইউনিটে গড় পাসের হার ছিল ১০ ভাগ। অর্থাৎ ওই বছর ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হতে পারেনি। অথচ অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীর অনেকেই এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় জিপিএ ৫ প্রাপ্ত ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য থেকে একটাই সত্য বেরিয়ে আসে তা হলো, আমাদের পাঠ্যক্রম ও শিক্ষার সার্বিক অবস্থা দেশের ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক নয়! দেশের বর্তমান জাতীয় প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে যোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ নয়। ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ তো অনেক দূরের কথা। বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত না হয় বাদ দিলাম।

এ অবস্থা এক দিনে তৈরি হয়নি। এটা মূলত সৃষ্টি হয়েছিল যখন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়। এই শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময় ১০ জন দেশ বরেণ্য শিক্ষক পরামর্শ দিয়েছিলেন শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতিকে উৎসাহিত না করা। কিন্তু সে পরামর্শ উপেক্ষিত হয়েছে। এখন দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশিশক্তির মহড়া প্রায়ই দেখা যায় ছাত্ররাজনীতির নামে। মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন একজন নাগরিক তৈরির স্বার্থে জাতীয় শিক্ষানীতিতে যে বিষয়গুলো সন্নিবেশিত থাকার প্রয়োজন ছিল তার অনেকাংশই পাঠ্যক্রমে অনুপস্থিত। এ ছাড়া নৈতিক শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা উপেক্ষিত হয়েছে। পরিনতির কথা মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী নিজেরাই উল্লেখ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে যেসব ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সবচাইতে ভালো ফল করে তারাই পরীক্ষা দিয়ে ১০ শতাংশের বেশি কৃতকার্য হয় না; এ ব্যাপারে দেশের গুণীজন এবং বোদ্ধা অনেক কথা বলেছেন। তবে এ ব্যাপারে সবাই মোটামুটি একমত, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বস্তরের সার্বিক সমন্বয়ের অভাব রয়েছে যে কারণে উচ্চশিক্ষার ভর্তি পরীক্ষায় এই ফলাফল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করেন তাদের পাঠ্যক্রমে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কোনো প্রতিফলন নেই। আমাদের জীবনধারার সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যারা পাস করে বের হন- তাদের বেশির ভাগই জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে হতাশায় ভোগেন এবং অনেকসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। অবশ্য সব প্রতিষ্ঠানই যে এমন তা ঠিক নয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সবচেয়ে মেধাবীরাই শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন। আমাদের দেশে তার ব্যতিক্রম। এখানে মেধা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত। এখানে মেধার কোনো গুরুত্ব নেই। রাজনৈতিক প্রভাব, বিশেষ গোষ্ঠীর আনুগত্য এখানে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। এভাবে যারা শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন, তারা বিভিন্ন অপর্কমের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন। নৈতিকতা-আদর্শ, শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য তাদের কাছে গৌণ। মানবিক সমাজ, মানবিকতা মূল্যহীন। তারা কোচিং বাণিজ্যের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে শ্রেণিকক্ষের পাঠদান হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। শিক্ষাকে পরিপূর্ণভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করায় গ্রামের হতদরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে শিক্ষার ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা বিত্তবান- সমাজের উঁচুস্তরে বাস করেন তারা তো তাদের ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই তারা কোথায় যাবে? যে তারুণ্যের কথা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা, প্রধানমন্ত্রী উচ্চারণ করেছেন, তা এভাবে তৈরি হবার দুরাশা বৈধ নয়। তরুণদেরকে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শিক্ষিত করার জন্য সরকারও চেষ্টা করে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর এই ইচ্ছার প্রতিফলন ‘দিল্লি দূর অস্ত’-এর মতোই।

মেধার মর্যাদা দিয়ে শিক্ষার পরিবেশকে ফিরিয়ে আনা না গেলে, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করা না হলে, পাঠ্যক্রমে ইতিহাস, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, নৈতিকতাবোধ ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন না থাকলে ভবিষ্যতের কল্যাণমুখী সমাজ গড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। মোটাদাগে, আমাদের দেশে শিক্ষার যে সঙ্কট, এটা পাঠ্যক্রমে নৈতিকতার অনুপস্থিতির কারণে। নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন গঠনমূলক শিক্ষার আলোকেই কেবল ভবিষ্যতে কল্যাণমুখী সমাজ গড়া সম্ভব। এর কোনো বিকল্প নেই।

এ ছাড়া শিক্ষা পেশায় উৎসাহী, মেধাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের অন্যতম প্রধান শর্ত যারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাবেন; এগিয়ে নিয়ে যাবেন সফলতার অভিযাত্রায়। যারা নিজেরাই স্বপ্ন দেখেন না, দেখার যোগ্যতাই যাদের নেই; তারা কিভাবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে প্রজন্মকে প্রেরণা জোগাবেন? অস্ত্রের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট রুম কালচারের বিলুপ্তি ঘটানো প্রয়োজন। নইলে আবরার ফাহাদের মতো মেধাবী ছাত্ররা অকালেই ঝরে পড়বে, জাতি হারাবে সম্ভাবনার একেকটি নক্ষত্রকে। যারা আজ শিক্ষা ও শৃঙ্খলার আদর্শের পরিবর্তে পেশিশক্তির ভূমিকায় বিশ্বাসী, অনুগত; তারা কর্মজীবনে গিয়ে কখনো আদর্শ এবং নৈতিকতার ধারক এবং বাহক হতে পারবেন না, এ কথা অনস্বীকার্য। এটা বুঝতে হবে। এ ক্ষেত্রে যদি অতিদ্রুত পদক্ষেপ নেয়া না হয়, সংশোধন করা না হয়, তাহলে আমাদের এই দুঃখ, এই বেদনা ও কষ্ট বহুদিন বহন করতে হবে। জাতি শিক্ষার আলোর পরির্বতে অন্ধকারের অতলান্তে হারিয়ে যাবে।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement