২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মানসম্মত সেবামূলক হাসপাতাল পাবো কি

- ছবি : সংগৃহীত

পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আমাদের সংবিধানে স্বাস্থ্যসেবা তথা চিকিৎসাকে জীবন ধারণের অন্যতম মৌলিক উপকরণ বিবেচনায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব মর্মে অভিহিত করে এটিকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার দলিল-১৯৪৮, যেটি সার্বজনীন মানবাধিকার দলিল হিসেবে খ্যাত। এ দলিলটিতেও প্রত্যেক ব্যক্তি ও তার পরিবারের জীবন যাপনে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ও কল্যাণ প্রদান অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর ৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা শহর ও উপজেলায় সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। জেলা শহর ও উপজেলা হাসপাতালগুলোর জনবল ও সরঞ্জামাদির বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, জটিল অস্ত্রোপচার ব্যতীত অপর সব ধরনের চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধাদি প্রদানে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও যন্ত্রপাতির সংস্থান রয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও মৌলিক ওষুধ দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জেলায় চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোর কোনো কোনোটি সরকারি আবার কোনোটি বেসরকারি। ইউনিয়ন কমিউনিটি ক্লিনিক এবং উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে নিত্য চিকিৎসাসেবা গ্রহণের জন্য যাদের আগমন ঘটে এদের বেশির ভাগই হতদরিদ্র। রাজধানী বা বিভাগীয় শহরের খ্যাতনামা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে এদের চিকিৎসা গ্রহণের সামর্থ্য ও সুযোগ সীমিত।

আমাদের রাজধানী শহরে সরকারি-বেসরকারি যেসব হাসপাতাল রয়েছে সেগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সরঞ্জামাদির কোনো ধরনের অপ্রতুলতা নেই, কিন্তু তবুও দেখা যায় আমাদের রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীদের একটি বড় অংশের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা নেই। এদের অনেককেই প্রতি বছর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে যেতে দেখা যায়। সাধারণ ও জটিল অস্ত্রোপচারে এরা কোনোভাবেই দেশের স্বনামধন্য বলে কথিত হাসপাতালেও চিকিৎসা গ্রহণে আগ্রহী নন। এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত যাদের সামর্থ্য কম অথবা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত- এমন অনেক যারা দেশের হাসপাতালগুলোতে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা গ্রহণের পরও আরোগ্য লাভে ব্যর্থ হয়েছেন কেবল তারাই চিকিৎসা গ্রহণের জন্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে থাকেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ভারতে চিকিৎসা ব্যয় সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ৬০-৭০ শতাংশ কম।

আমাদের দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসক তাকে ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) দেয়ার সময় তার সাথে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে এমন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ওষুধের নামের দীর্ঘ তালিকা ও তার নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। একজন রোগী চিকিৎসকের চেম্বার থেকে বের হলে দেখা যায়, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা তাকে ঘিরে ধরেন এবং ব্যবস্থাপত্রে তার প্রতিষ্ঠানের ওষুধের নাম লেখা হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এর ছবি মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করেন। ছবি ধারণ পরবর্তী যদি দেখা যায়, ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও এর প্রতিনিধির সাথে সম্পর্কযুক্ত চিকিৎসক ভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ওষুধের নাম উল্লেখপূর্বক ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি চিকিৎসককে প্রশ্নেবাণে জর্জরিত করেন। এ সময় চিকিসৎকে ওষুধ কোম্পানি ও এর প্রতিনিধির কাছে বিভিন্ন দায়ে আবদ্ধ থাকার কারণে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে দেখা যায়। চিকিৎসকের দেয়া ব্যবস্থাপত্রে উল্লিখিত পরীক্ষা করতে গিয়ে সচরাচর যে পরিমাণ সময় ও অর্থ ব্যয় হয় তা চিকিৎসকের পরামর্শ দেয়ার সময়কাল ও ফি’র এক বা একাধিক গুণ বা তারও অধিক হয়ে থাকে।

এসব পরীক্ষার প্রতিবেদন (রিপোর্ট) যখন চিকিৎসকের কাছে উপস্থাপন করা হয় চিকিৎসক তা নামমাত্র সময় ব্যয় করে দেখেন। তাতে রোগীর হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিই-বা করার থাকে। অনেক রোগীকে আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়, রিপোর্ট সংশ্লেষে সময় ও অর্থ কি এতই তুচ্ছ যে, তিনি নিমিষের অবলোকনে রিপোর্টের আদ্যোপান্ত জেনে ফেললেন! আবার এমনও দেখা যায়, একজন রোগী একই বিষয়ে দ্বিতীয় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তিনি প্রথম চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে উল্লিখিত পরীক্ষার প্রতিবেদনগুলো গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে নতুনভাবে পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দিয়ে থাকেন। অনন্যোপায় হয়ে রোগীরা দ্বিতীয় দফায় পরীক্ষা করালেও এতে যে চিকিৎসকের কাছে পরীক্ষার প্রতিবেদনের চেয়ে কমিশন প্রাপ্তির বিষয়টি অধিক আকর্ষণীয়- এ সত্যটি আজ আর এ দেশের সচেতন জনমানুষের অজানা নয়। লক্ষণীয় যে, সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার ফি’র ব্যাপক ফারাক। এর পেছনে যে মূল কারণ চিকিৎসকের অবৈধ কমিশন বাণিজ্য- তা এখন আর গোপন কিছু নয়। তবে এ দেশে ভালো চিকিৎকের সংখ্যাও কম নয়।

পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মানবসেবার মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ। মানবসেবার মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য লাভে উদ্বুদ্ধ হয়ে স¤প্রতি ভারতের এক নারী ধর্মগুরু ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ১৩৩ একর ভ‚মির উপর এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, এ হাসপাতালে হতদরিদ্ররা বিনামূল্যে বিশ্বের অত্যাধুনিক মানের চিকিৎসাসেবা লাভ করবেন। ভারতের অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি উন্নত চিকিৎসা গ্রহণের জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের দ্বারস্থ হন, যদিও মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের অর্ধেক খরচে সমমানের চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ ভারতের বেশ কয়েকটি উন্নতমানের বিশেষায়িত হাসপাতালের রয়েছে। আক্ষেপের সাথে বলতে হয়, আমরা আমাদের দেশে এ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ বা ভারতের উন্নতমানের বিশেষায়িত হাসপাতালের সমমানের হাসপাতাল নির্মাণ করতে পারিনি। এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য, উভয় দেশের বিশেষায়িত চিকিৎসক ও হাসপাতালের সহায়ক কর্মীর কর্মদক্ষতা, সততা, আন্তরিকতা ও নৈতিকতার যে মান আমাদের দেশের হাতেগোনা দু’য়েকজন ছাড়া আর সবাই তার সঙ্গে তুলনীয় নয়।

আমাদের দেশের অনেক নামকরা মাজার রয়েছে যেগুলো সবসময় জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগত ব্যক্তি ও ভক্তদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। জিয়ারতকারী ও ভক্তদের দেয়া অর্থ থেকে এসব মাজারের আয় প্রচুর। প্রতিটি মাজারের ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। আবার মাজারে সমাহিত অলি বা পীর মাশায়েখের উত্তরাধিকারীরা বংশানুক্রমিকভাবে মাজারের খাদেমের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। মাজার থেকে যে আয় হয় তার একটি অংশ খাদেম ভোগ করেন এবং অবশিষ্টাংশ ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে মাজারের উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় হয়। আমাদের দেশের এমন অনেক পীর রয়েছেন যারা ধর্মীয় ওয়াজ করে থাকেন। এদের অনেকের আয় নেহাত কম নয়। ভারতের নারী ধর্মগুরুর মতো আমাদের মাজারের খাদেম বা ব্যবস্থাপনা কমিটি বা পীর বা ধর্মীয় বক্তাদের মধ্য থেকে মানবসেবা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কারো পক্ষে কি কখনো এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে? ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি রাষ্ট্রের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান কখনো অসুস্থ হলে বা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন দেখা দিলে তারা নিজ দেশের হাসপাতাল থেকেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও সেবা গ্রহণ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে আমরা এখনো ব্যতিক্রম।

আমাদের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা বা চিকিৎসাসেবা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়- তারা বিদেশের উন্নতমানের হাসপাতালের শরণাপন্ন হন। তাদের দেখাদেখি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, শীর্ষ রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক আমলা, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও প্রথিতযশা পেশাজীবী একই পথ অনুসরণ করেন। অথচ রাষ্ট্র ও সরকারের শীর্ষ নির্বাহী নিজ দেশে নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করলে আমাদের দেশের মানুষ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজ দেশে চিকিৎসা গ্রহণ করত যা প্রকারান্তরে দেশে উন্নতমানের হাসপাতাল ও বিশেষায়িত চিকিৎসক গড়তে সহায়ক হতো। আমাদের দেশের সরকারপ্রধানের একটি ত্রাণ তহবিল রয়েছে। দেশের হতদরিদ্র নিঃস্ব মানুষ ও ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী যারা জাকাত পাওয়ার জন্য উপযুক্ত এমন ব্যক্তি এ তহবিলের অর্থের হকদার। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বিভিন্ন সময়ে এ তহবিল থেকে অর্থ সাহায্য গ্রহণ করে যারা বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছেন এরা কেউই হতদরিদ্র বা নিঃস্ব নন বা জাকাত পাওয়ার হকদার নন।

আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ গরিব। তাদের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত। এরা সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার ওপর নির্ভরশীল হলেও এরা অনেকেই জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধির ক্ষেত্রে দেশের বিশেষায়িত হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা ও এর চিকিৎসকদের সেবা থেকে বঞ্চিত। লোভী, দুর্নীতিগ্রস্ত, আদর্শচ্যুত, নৈতিকতা ও নীতিজ্ঞানবিবর্জিত চিকিৎসক এবং হাসপাতালের সহায়ক কর্মীদের দৌরাত্ম্যে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ব্যবসায় আজ রমরমা। অন্য দিকে, নৈতিকতা ও নীতিজ্ঞানবিবর্জিত হওয়ায় একশ্রেণীর চরিত্রহীন রাজনীতিক, ঘুষখোর আমলা, অসাধু ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীর কাছে দেশের উন্নয়ন, দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের সেবার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজ সেবা ও নিজের ভাগ্যোন্নয়ন। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্রীড়নকরা যতদিন এ অবিনাশী দুর্বৃত্তায়নের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত না হবেন ততদিন আমাদের ভালোমানের সেবামূলক হাসপাতালের জন্য হা পিত্যেশ করতে হবে এমন ধারণা আদৌ অমূলক নয়।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement