২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দেশে কাঠামোগত সরকারের অভাব

মইনুল হোসেন - ফাইল ছবি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এবং অন্য থিংক-ট্যাংক ও বেসরকারি সংস্থাগুলো বর্তমান সরকারের অধীনে অর্থনীতিতে জাদুকরী পরিবর্তন অর্জিত হওয়ার কথা বলার সময় চাতুর্যের সাথে বলেন, নীতিগত বিষয়ে এখানে সেখানে কিছু পরিবর্তন আনা হলে অর্থনীতি সঠিক অবস্থানে চলে আসবে।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলেছেন। তার কাঠামোগত সংস্কারের কথা আমাদের পছন্দ হয়েছে। তিনিও বলেছেন, অর্থনীতি সঙ্কটে নয়, চাপের মধ্যে আছে। কাক্সিক্ষত সংস্কার কিভাবে করা হবে; তরুণ প্রজন্ম শেখার জন্য তা জানবে কাদের কাছে? আমরা ৫০ বছরেও তা করতে ব্যর্থ হয়েছি বলেই মনে হয়।

প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন; আমরা বিষয়টি বুঝতে পেরেছি এমন দাবি করব না। তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় একটি কাঠামোগত ব্যবস্থার দরকার হয়, এ ধারণাটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমরা সবসময় সরকারের কাঠামোগত ব্যবস্থাপনায় জোর দিয়ে এসেছি। দেশ পরিচালনায় ব্যক্তিসর্বস্ব ব্যবস্থাপনাকে সরকারের কাঠামোগত ব্যবস্থা বলা যায় না। সেই সাথে সরকারও বলা যায় না। প্রকৃতপক্ষে নিজের বা অন্যের শক্তিতে ক্ষমতা দখল সরকার নয়।

থিংক-ট্যাংক হিসেবে পরিচিত প্রতিষ্ঠানে আমাদের বিজ্ঞজনরা অর্থনীতি সম্পর্কে বেশ বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু সরকার ব্যবস্থাপনা ভিন্ন, সঠিক অর্থনীতি যে গুরুত্ব পায় না সে কথা শোনা যায় না। যে সরকারের ভিত্তি দুর্নীতি ও নির্বাচনী প্রতারণা; সে সরকার কতটা দায়িত্বশীল হতে পারে তা সহজে অনুমেয়। চাটুকারদের ভিড় দেখে বোঝা যায় সরকার কাদের খুশি রাখছে।

কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রভাবনায় সরকারের কাঠামোগত কোনো ব্যবস্থাপনা থাকে না। শুধু থাকে ব্যক্তিবিশেষের খেয়াল-খুশি অথবা নিজের ক্ষমতার তীব্র স্পৃহা। জনগণের ওপর অবাধ ক্ষমতা প্রয়োগ, ঠিক যেমনটি দেখা যায় রাজতন্ত্রে বা জমিদারি ব্যবস্থায়। যেখানে একতরফা শাসনের দৌরাত্ম্য। সরকারের অঙ্গগুলোর নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব বা বক্তব্য থাকে না। বিচার বিভাগ হয়তো নামমাত্র থাকে। কারো কোনো ভ‚মিকা বলতে কিছু থাকে না। ক্ষমতাধররা যা বলেন তাই আইন, সেটিই বিচার। জনগণের স্বার্থরক্ষার আইন বা জনগণকে নিরাপত্তা দেয়ার আইনের চিন্তা-ভাবনা তাদের বিশ্লেষণে থাকে না। অন্য সব কিছুর মতো নির্বাচনও জাতীয়করণের আওতাধীন। জনগণের নিজস্ব অধিকার বলতে কিছু থাকে না। তাই সরকারের ব্যবস্থাগত কোনো বাধা-নিষেধ মানতে হয় না। এ জাতীয় সরকার পরিচালনাকে একনায়কত্ব বলা হয়- সরকার নয়। সরকার জনগণের জন্য কাজ করছে তাই নাগরিকদের কিছু বলতে হবে কেন? পুলিশ ও বিভিন্ন ধরনের গোয়েন্দা বিভাগ সরকারের শক্তি। হত্যা, গুম, নির্যাতন, জেল-জুলুম সব জনস্বার্থে করা হয়। তাই প্রতিবাদ করার অর্থ রাষ্ট্রবিরোধী হওয়া।

বাংলাদেশী হিসাবে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় আমরা পার করে এসেছি; তবুও আমাদের থিংক-ট্যাংকগুলো এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানগুলোর ভারসাম্যপূর্ণ শাসন পরিচালনার কাঠামোগত প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব দিতে দেখিনি। আমাদের জনগণের সব সংগ্রামের মূলে ছিল নাগরিকের ভোটে জনগণের গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কর্তৃত্ব যে জনগণের বিষয় নয় তা কমিউনিস্ট দেশগুলোর দিকে তাকালে পরিষ্কার হবে। ওই সব দেশে মেগা প্রজেক্ট দেখিয়ে উন্নয়নের সাফল্য দাবি করা হয়। জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে সামরিক শক্তির প্রতিযোগিতায় তারাও পরাশক্তিগুলোর মধ্যে নিজেদের শক্তির স্থান পেতে বিশাল সামরিক বাহিনী গড়ে তোলেন। সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তাদের প্রতিযোগিতার কথা ছিল জনগণের জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে। কমিউনিস্ট দেশগুলোতে জনগণ সবচেয়ে অসহায় ও অবহেলিত।

আমাদের থিংক-ট্যাংকগুলো সরকারের কাঠামোগত দিকের প্রতি গুরুত্ব না দেয়ায় বাংলাদেশ জন্মলাভের অব্যবহিত পরে সুশাসন হাওয়া হয়ে যায়। জনগণ প্রদত্ত গণতান্ত্রিক সরকার-ব্যবস্থার শাসনতন্ত্র জাদুঘরে স্থান পেলো। ক্ষমতাসীনদের কাছে সুশাসনের অর্থ ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতায়ন, ব্যক্তিবিশেষকে নিয়ে চাটুকারদের সীমাহীন প্রশংসা। সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার তীব্র বাসনা।

দেশে যে লুটপাটের দৌরাত্ম্য চলেছে; তা থিংক-ট্যাংকগুলো স্বীকার করছে। দেশটি যে দুর্নীতিতে ডুবে আছে তাও কবুল করতে অসুবিধা হচ্ছে না। দায়বদ্ধতাহীন সরকারের কাছ থেকে কতটা সাফল্য আশা করা যায় তা তারা বুঝেও না বোঝার ভান করে আছেন। তারা মানুষকে বাদ দিয়ে অর্থনীতির চর্চা করে যাচ্ছেন।

বড় গলায় যত সাফল্যের দাবি করুক, সরকার কখনো অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্মত হবে না, বরং পুলিশি শক্তির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। এমন বাস্তবতায় দেশাত্মবোধ ও জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধে অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজের শিক্ষিত অংশ যদি সামনে এগিয়ে না আসে; তবে শুধু রক্তপাতই হবে, কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসবে না। শুধু ব্যক্তিবিশেষের সুবিধা হবে।

সুস্থ সরকারি ব্যবস্থা পাওয়া যাবে না। ক্ষমতা দখল আর রাজনীতি এক নয়। রাজনীতি শিক্ষিত লোকজনের ব্যাপার। সরকার কী তা জানতে হবে। রাস্তার রাজনীতি আমরা অনেক দেখেছি। জনগণ কী পেয়েছে? সবাই মিলে মান-মর্যাদা নিয়ে জীবন-যাপনের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। সব সময় থাকতে হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতায়।

সাধারণ মানুষ রক্ত দেবেন, জীবন দেবেন আর শিক্ষিতজনরা নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ কিভাবে করা যায়; তা দেখতে অপেক্ষা করবেন- এমনটি আর গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সৎ ও বিবেচনাবোধসম্পন্ন শিক্ষিত লোকদের ভ‚মিকা না থাকায় জাতি হিসেবে আমরা যে শুধু চরম দুর্ভোগ ও অসহায় অবস্থায় আছি শুধু তা নয়, জাতি হিসেবে আমাদের ভাবমর্যাদাও অত্যন্ত লজ্জাকর। দেশে না আছে আইন, না আছে সত্যিকার বিচার। পুলিশ গ্রেফতার করলেই হলো। জেল তার জন্য অনিবার্য। বিচারে দোষী প্রমাণ করার ব্যাপারে তাড়া নেই।

প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অংশে মারমুখী জনগণ সংঘবদ্ধভাবে রাস্তায় বেরিয়ে এসে তাদের ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছে। পুলিশের হাতে অনেককে জীবন হারাতে হচ্ছে। মামলা হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে। গ্রেফতার এড়াতে তাদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। পুলিশকে অবশ্যই দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলব, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। পুলিশ যে বাধা দিচ্ছে তা-ই যথেষ্ট হওয়া উচিত। জনগণ রাস্তায় নেমে ক্ষোভ প্রকাশ করছে, তা পুলিশের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়েও করা সম্ভব।

বিএনপিকর্মীরাই কেবল পুলিশের সাথে সঙ্ঘাত মোকাবেলা করছে এমনটি ধারণা করলে বড় ভুল হবে। বিশাল বিক্ষোভে সমাজের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষও তাতে শামিল হচ্ছে। তারা আর ধৈর্য রাখতে পারছে না, ভোগান্তি আর সইতে পারছে না। দেশের বিভিন্ন এলকায় শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছে। সরকারের পদত্যাগ দাবি নিয়ে দেশে তীব্র অস্থিরতা বিরাজ করছে। উভয়পক্ষ রাস্তায় শক্তির মহড়া দেখাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

দুশ্চিন্তার কথা হলো- কোনো সভ্য সরকার রাস্তার সঙ্ঘাত বেছে নিতে পারে না। ইংল্যান্ডে জনমতের চাপে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে হলো সংসদে অসত্য বলার দায়ে। আমাদের দেশে মিথ্যা ও অসততাই রাজনীতি। পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় এটি সুবিধা যে নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তন সম্ভব। অবশ্য আমাদের সরকারকে কিছু মানতে হয় না। আসলে তারা রাজনীতিবিদই নন। আইন আছে, আইনের শাসন নেই। সংসদ আছে, তবে নির্বাচন নেই।

সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা থাকায় জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। তাদের ভোগান্তির শেষ নেই। তারা বেঁচে থাকার তাড়নায় রাস্তায় নামতে শুরু করেছে পুলিশের ভয় অগ্রাহ্য করে। আইন অর্থহীন, সরকারের ইচ্ছা কার্যকর করতে পুলিশি ক্ষমতাই যথেষ্ট। শাসনতন্ত্র আছে কিন্তু শাসনতন্ত্র অবজ্ঞা করে সরকার ক্ষমতায় আছে। নির্বাচন জাতীয়করণ হয়েছে। অর্থাৎ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত। প্রশ্নবিদ্ধ পার্লামেন্টে সরকারের তীব্র সমালোচনা করা বিরোধী দলের নামে তাদের কাছে লজ্জার কিছু নয়। তাদের সহযোগিতায় সরকার বিপুল ভোটে বিজয় দাবি করতে পারছে।

জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনের সদিচ্ছা থাকলে বিরোধী দলের সদস্যরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করে দেখান যে, দেশে রাজনৈতিক সততা বলতে এখনো কিছু আছে। পরিবর্তন অবধারিত। প্রশ্ন হচ্ছে- কখন আমাদের উদাসীন শিক্ষিতজন নিজেদের সেই পরিবর্তনের সাথে সম্পৃক্ত করার তাগিদ অনুভব করবেন; যাতে তা রক্তপাত ও নৈরাজ্য ছাড়াই সংঘটিত হতে পারে।

লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement
ক্রিকেট খেলতে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে দেওয়ানগঞ্জের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী শিহাব কিশোরগঞ্জে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ সাতক্ষীরা বৈদ্যুতিক খুটিতে ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেলআরোহী নিহত বার্সেলোনাতেই থাকছেন জাভি চতুর্থ দফা ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি : এবারের তাপদাহ শেষেই বৃষ্টিপাতের আশা ফরিদপুরে বৃষ্টির জন্য নামাজে হাজারো মুসুল্লির কান্না পোরশার নোচনাহারে আগুনে ৩টি দোকান পুড়ে গেছে খুলনা বিভাগ ও ৬ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ ‘১ টাকার কাজ ১০০ টাকায়, ৯৯ যায় মুজিব কোটে’ রাত পোহাতেই রুদ্ধদ্বার অনুশীলন শুরু বাংলাদেশের সাটুরিয়ায় প্রশান্তির বৃষ্টি চেয়ে সালাতুল ইসতিসকা আদায়

সকল