১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বেফাঁস কথা কাল হলো মোমেনের

- ছবি : সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সফরে এই মুহূর্তে ভারতে আছেন। গত সোমবার তিনি বেশ বড়সড় একটি দল নিয়ে এই সফরে যান। কিন্তু বিদেশ সফরে সবচেয়ে আগে যার প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হবার কথা সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীই তার সঙ্গীদের মধ্যে নেই। তিনি বাদ পড়েছেন। কী কারণে তিনি বাদ পড়লেন তা-ও জানানো হয়নি। এ নিয়ে কেউ মুখ খোলেননি। তবে নানা সূত্রে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে তার একটিই মর্ম। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে এ মোমেনের অপেশাদার নানা মন্তব্য, বিশেষ করে সম্প্রতি ভারত প্রসঙ্গে দেয়া একটি বক্তব্যের কারণেই তাকে বাদ দিতে হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নিজ দায়িত্বে জনাব মোমেনকে বাদ দিয়েছেন নাকি কারো পরামর্শে, সে বিষয়েও কোথাও কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। তবে শুরু থেকেই আলটপকা মন্তব্য করা এ কে মোমেনের স্বভাবসিদ্ধ। সম্ভবত কথা বলতে তিনি খুব পছন্দ করেন। আর এটা তো সত্য যে, বেশি কথা বললে তাতে অতিরঞ্জন এবং অসত্য আপনাআপনিই মিশে যাবার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে যে কূটনীতিকসুলভ ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, কুশলী আচরণ প্রত্যাশিত সেটি তার কথায় বা আচরণে কমই প্রকাশ পেয়েছে। বরং প্রগলভতাই যেন তার ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি জানা যাচ্ছে, ভারতের মিডিয়া তাকে (Garrulous) ‘বাক্যবাগীশ’ বা বাচাল বলে উল্লেখ করেছে। চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমী উৎসবের এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানানোর কথা বলেন। তার ভাষায়, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।’ এরপর তিনি ভারতের জন্য শেখ হাসিনার সরকার কী কী অবদান রেখেছেন এবং তাতে ভারতের কী কী ‘মঙ্গল’ হচ্ছে তার কিছু ফিরিস্তি তুলে ধরেন। এসব মন্তব্যের কোনোটিই অসত্য বা অতিরঞ্জিত বলে এ দেশে অনেকেই মনে করেন না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কারো (ভারত বা বাংলাদেশ) এমন কিছু করা উচিত হবে না, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এমন কোনো উসকানি দেয়া ঠিক হবে না, যাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রতিবেশী দেশে কয়েকটি মসজিদ পোড়ানো হয়েছে। সেটি দেশে প্রচার করতে দেয়া হয়নি। এর কারণ হচ্ছে, কিছু দুষ্ট লোক আছে, কিছু জঙ্গি লোক আছে, যারা এটার বাহানায় আরো অপকর্ম করবে। তিনি বলেন, ‘অনেকে আমাকে ভারতের দালাল বলে, কারণ অনেক কিছুই হয়, আমি স্ট্রং কোনো স্টেটমেন্ট দিই না।’ ভারতের উদ্দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কিছু দিন আগে একজন ভদ্রমহিলা (মহানবী রাসূল সা.কে নিয়ে বিজেপির নেত্রী) একটি কথা বলেছিলেন, আমরা একটি কথাও বলিনি।... বিভিন্ন দেশ কথা বলেছে, ... আমরা একটি কথাও বলিনি। এ ধরনের প্রটেকশনও আমরা আপনাদের দিয়ে যাচ্ছি। সেটা আপনাদের মঙ্গলের জন্য, আমাদের মঙ্গলের জন্য।’ এখানেই থামেননি তিনি। বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আছেন বলেই ভারতের যথেষ্ট মঙ্গল হচ্ছে। ভারতে বর্ডারে এক্সট্রা খরচ করতে হয় না। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে বছরে ২৮ লাখ মানুষ ভারতে বেড়াতে যায়। কয়েক লাখ ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করে।’

এসব কথা কতটা সত্য বা কতটা অসত্য বাংলাদেশের মানুষের অজানা নয়। কিন্তু সব কথা বা সব সত্য কথাই কি প্রকাশ্যে বলা যায়? নাকি বলা উচিত? আর মন্তব্যকারী যদি হন স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রী! তার কি বোঝার কথা নয়, একটি স্বাধীন দেশ তার সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য অন্য একটি দেশের সাহায্য চাইতে পারে কি না। স্বাভাবিকভাবেই তার এসব মন্তব্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে গেছে। এ নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। তার বিরুদ্ধে কালো পতাকা মিছিল হয়েছে, পদত্যাগের দাবি উঠেছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করার দাবি জানিয়ে উকিল নোটিশও তিনি পেয়েছেন। আর দুই দেশেরই সরকার বিব্রত ও বিহ্বল হয়েছে। বিশেষ করে, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকের আগে এসব বক্তব্য কর্মকর্তাদের অস্বস্তিতে ফেলে। এরই জেরে তিনি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর থেকে বাদ পড়েছেন বলে নানা সূত্রে ধারণা ব্যক্ত করা হয়। এতকিছুর পরও তার ভাষায়, ‘বিশ্বের নেত্রী’ শেখ হাসিনা কিন্তু তাকে মন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেননি। হয়তো অদূরভবিষ্যতেও দেবেন না। তবে শেষ নিট ফল হলো এই যে, তিনি আর ভারতগামী বিমানে উঠতে পারলেন না। এয়ারপোর্টে যাবার জন্য স্যুট-টুট পরে টাইয়ের নট বাঁধতে বাঁধতেই ফোনে খবর পেলেন তার যাওয়া বাতিল।

বেফাঁস মন্তব্য কিভাবে একটি দেশকে বিপদে ফেলে এসব তারই উদাহরণ। এমন বহু উদাহরণ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন তৈরি করেছেন নানা সময়ে। বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও অবাধ হয় এমন একটি আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্টদূত। দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গেও কিছু কথা বলেছিলেন। তার জবাব পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে দিয়েছেন তাকে কূটনৈতিক আচারের কোনো সংজ্ঞায় ফেলা যায় কি না জানা নেই। তিনি প্রতিক্রিয়া জানান ইউরোপ সফরের সময়। মন্ত্রীর বরাত দিয়ে তার জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রেস রিলিজ আকারে ঢাকার সংবাদপত্রে সেই বার্তা পাঠান। তাতে বলা হয়, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা এবং আসন্ন নির্বাচন নিয়ে রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে ক্ষুব্ধ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা কি মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে এই প্রশ্নগুলো করবেন যে, কেন তারা তাদের দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করতে পারে না? পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি, প্রতি বছর প্রায় এক লাখ মার্কিন নাগরিক নিখোঁজ হয়, এমনকি মার্কিন শিশুদের তাদের হিস্পানিক বা স্পেনিশ পিতা-মাতার সঙ্গে মিলিত হতে দেওয়া হয় না।’

মন্ত্রী আরো বলেন, ‘প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র যদি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চায়, তবে কেন রাশিয়ার আরটি টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে? দ্বিতীয়ত, তারা যদি জবাবদিহি চায়, তাহলে কেন প্রতি বছর হাজারো মার্কিন নাগরিক হত্যার জন্য নিজেদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো বা পুলিশের জবাবদিহি ও শাস্তি নিশ্চিত করা হয় না? হত্যা হওয়া বেশির ভাগ কালো ও হিস্পানিক নাগরিক। আপনারা কেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে এ প্রশ্নগুলো করেন না?’

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এসব মন্তব্য ও অতিকথন কার্যত দেশের স্বার্থের বিপক্ষেই গেছে। র‌্যাব ও পুলিশের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পেছনে এ কে এ মোমেনের ওইসব মন্তব্যের ভূমিকা নেই এমনটা বোধ হয় বলা যায় না। এই নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক বিশে^ বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা কতটা ক্ষুণ্ণ করেছে সেটা সম্ভবত আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।

সম্প্রতি আরো একটি ব্লান্ডার করেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সেটি ছিল সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতের একটি মন্তব্য প্রসঙ্গে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে ক‚টনৈতিক রিপোর্টারদের এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড বলেছিলেন, বিভিন্ন সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বেশির ভাগই অবৈধ উপায়ে উপার্জিত বলে অভিযোগ আছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত সুইস ব্যাংক বা কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য চায়নি। রাষ্ট্রদূতের ওই বক্তব্যকে সরাসরি ‘মিথ্যা’ বলে অভিহিত করেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। একজন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে সরাসরি মিথ্যা বলতে পারে কেউ? রাষ্ট্রদূত দূরের কথা, কোনো সাধারণ মানুষকেও কি এভাবে কেউ মিথ্যাবাদী বলতে পারে? সাধারণ ভব্যতা বা সামাজিক সৌজন্য বলেও তো একটা বিষয় আছে! কিন্তু এই অসম্ভব কাজটিও তিনি করেছেন।

বর্তমান ক্ষমতাসীনদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো অকপটে চমকপ্রদ মন্তব্য করা। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত সবারই অভিন্ন বৈশিষ্ট্য। একটু হুমকি ধমকি গোছের মন্তব্য করতে তাদের পারঙ্গমতা কিংবদন্তিতুল্য, এটা স্বীকার না করে উপায় নেই। মন্ত্রী, এমপি, জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ নেতাকর্মীদের মন্তব্য বা বক্তৃতা বিবৃতি একটু মনোযোগ দিয়ে অনুসরণ করলেই তা যে কারো কাছে স্পষ্ট হবে। এটি এক অর্থে ভালোই। মনে হয়, এদের মনে সম্ভবত কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই, যা সত্য মনে করেন তা-ই বলে ফেলেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে একটু সংযম, একটু কৌশল এবং ওজন বুঝে, ওজন রেখে কথা বলার বোধহয় প্রয়োজন থাকে। বিশেষ করে মন্ত্রীদের বক্তব্যে এই জিনিসটি সবচেয়ে বেশি দরকারি। কারণ, তাদের বক্তব্য কেবল ব্যক্তিবিশেষের বক্তব্য বলে কেউই গ্রহণ করে না। বরং সেটি সরকারের এবং ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রের বক্তব্য অথবা অবস্থান হিসেবেই গণ্য হয়।


সহযোগী দৈনিকের মতামত কলামে সিনিয়র সাংবাদিক কামাল আহমেদ লিখেছেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ভারতের সাহায্য চাওয়ার কথা প্রকাশ্যে বলায় দুই দেশেই যে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তার খুব নির্মম উপসংহার টেনেছে ভারতের পুরোনো পত্রিকা দ্য স্টেটসম্যান। পত্রিকাটি বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃত করে বলেছে, এই মন্তব্যে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে যে ইঙ্গিত গেছে তা হলো, পররাষ্ট্রনীতি ও দর্শন নির্ধারণে বাংলাদেশের পেশাদার ক‚টনীতিকদের সামর্থ্য মানসম্মত নয়।’ (‘বেশি দিচ্ছি, কম পাচ্ছি নয়- সম্পর্ক হোক সুষম’ কামাল আহমেদ, প্রথম আলো, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২) বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা অথবা আমেরিকায় বসে ‘আমরা গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৩ বছর ধরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে’- এমন বাগাড়ম্বর থেকে নীতি, দর্শন নির্ধারণে মন্ত্রীর সামর্থ্য সম্ভবত অনেকটাই পরিষ্কার হয়।

মাত্র ক’দিন আগে ‘আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেহেশতে আছি’ এমন মন্তব্য করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরে বলেন, ‘আমি তো ট্রু সেন্সে বেহেশতের কথা বলিনি। কথার কথা বলেছি। কিন্তু আপনারা সবাই আমারে খায়া ফেললেন।’ কিন্তু তখনো তিনি জানেন না, বেফাঁস মন্তব্যের বিষাক্ত তীর আসলে তার নিজেরই ক্যারিয়ার ফুঁড়ে দিয়েছে। জিহ্বায় ঝড় তুলে দুটি দেশের হার্দিক সম্পর্কে কালো মেঘ ঘনিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেই নিজেরে ‘খায়া ফেলছেন’।

mujta42@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement