২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভারত সফরে প্রাপ্তি কোন পথে

- ছবি : সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে এখন ভারতে রয়েছেন। ৬ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার দিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে তার শীর্ষ বৈঠক। দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্রে এ সফর সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে তা হচ্ছে, দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠক শেষে পাঁচ থেকে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহারে একটা সমঝোতা স্বাক্ষর এবং বাংলাদেশ রেলের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বাড়ানোর সহযোগিতা। শীর্ষ বৈঠকে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি তোলা হবে, এতটুকুই। তিস্তা বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাল্টি মিডিয়া নিউজ এজেন্সি-এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনালকে (এএনআই) এক সাক্ষাৎকারে জানিয়ে দিয়েছেন, তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান মূলত ভারতের ওপর নির্ভর করছে।
ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশের অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ীর একটি প্রতিনিধিদলও রয়েছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সাথে দু’দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি সেমিনারেরও আয়োজন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সেখানে বক্তব্য রাখবেন। দেশে ফিরে আসার আগে প্রধানমন্ত্রী আজমীর শরিফ যাবেন খাজা বাবার মাজার জিয়ারতে।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক দফা ভারত সফর করেছেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালে তিনি ভারতে গিয়েছিলেন। তবে এবার তার ভারত সফর নিয়ে তেমন হইচই নেই। দেশের মানুষ একে একটি রুটিন সফর হিসেবেই দেখছেন। এ সফরে ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিগত অর্জন হলেও দেশের জন্য তেমন কোনো অর্জন যে হবে না তা প্রায় সবারই উপলব্ধি। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর ইতোমধ্যে বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তির আশা কম।

কিছু দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন চট্টগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার, ভারত যেন তা করে সে জন্য তিনি ভারতের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন।’ এ বক্তব্য দেয়ার দু’সপ্তাহ পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে গেলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে সব মহলেই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। খোদ আওয়ামী লীগেও এ নিয়ে হইচই হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন দলের কেউ নন, এটা তার ব্যক্তিগত বক্তব্য ইত্যাদি ইত্যাদি বলেছেন দলের নেতারা। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে কিছু বলেছেন কোথাও শোনা যায়নি।

বাস্তবতা হচ্ছে কোনো গুরুত্বপূর্ণমন্ত্রী কোনো দেশে সফরে যাওয়ার আগে সরকারপ্রধানের সাথে কথা বলে যান, তার বার্তা নিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রীর কোনো বার্তা বা ইঙ্গিত ছাড়া ভারত সফরে গিয়ে সেখানকার শীর্ষ নেতৃত্বকে এমন অনুরোধ জানাবেন- এটা বিশ্বাস হয় না। তাও তিনি যেনতেন মন্ত্রী নন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কূটনৈতিক দিক থেকে এমন কাজ তাকে দিয়েই করানোর কথা। যাক চাপে পড়ে তিনি তার ওই বক্তব্যই অস্বীকার করেন। মিডিয়ায় বলেন, এমন কোনো বক্তব্যই নাকি তিনি দেননি। তবে সাধারণ মানুষের যা ধারণা হওয়ার তা হয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে অর্জন না নিয়ে কি ফিরবেন? দেশের না হলেও তা তার নিজের কিংবা দলের ব্যক্তিগত অর্জনও তো হতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার ও প্রকাশ পেয়েছিল। সেটি হচ্ছে, তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন সেটি দিল্লি কখনো ভুলবে না। তার এ বক্তব্যটি খুবই সঠিক। কারণ বাংলাদেশ থেকে নেয়ার মতো ভারতের আর কিছু বাকি নেই। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরসহ বাংলাদেশের সম্পূর্ণ সড়ক ও নৌ যোগাযোগব্যবস্থা ভারতের করিডোর হিসেবে ব্যবহারের জন্য একতরফা চুক্তির পর ভারত সেই সুবিধা ভোগ করে চলেছে। ভারতীয় পণ্যের জন্য বাংলাদেশের বাজার উন্মুক্ত। অথচ বাংলাদেশী পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশের সুযোগ খুব নেই। এ ক্ষেত্রে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা পাহাড়সম। সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশের বাজারে যে পরিমাণ ভারতীয় পণ্য আমদানি হয়, সে তুলনায় ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের বাজারে বাংলাদেশের খুব নগণ্য সংখ্যক পণ্যই প্রবেশের সুযোগ পায়।

পাটসহ কয়েকটি পণ্যের ওপর তো অ্যান্টি-ডাম্পিং বাধা আছেই। বাংলাদেশে কয়েক লাখ ভারতীয় চাকরি করেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক’জন লোক ভারতে চাকরির সুযোগ পেয়েছেন? দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বিরাট ঘাটতি। ভারতের সাথে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি ২৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। পি কে হালদারের মতো লোকেরা অনায়াসে ভারতে মুদ্রাপাচার করে যাচ্ছে। নেপালের সাথে সীমান্তে সামান্য কয়েক কিলোমিটার ভারতের পড়েছে। আজ পর্যন্ত সেটার সমাধান করেনি ভারত। অথচ এই সুযোগটুকু পেলে বাংলাদেশ-নেপাল ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্প্রসারণ হতো। ওই একটিই স্বার্থ নেপালের সীমান্ত খুলে গেলে নেপালে ভারতের ব্যবসা কমে যাবে, বাংলাদেশী পণ্যের কদর বেড়ে যাবে।

দীর্ঘ দিন ধরেই বাংলাদেশের একটি দাবি হচ্ছে বহুমুখী ট্রানজিট সুবিধা চাই। ২০১৬ সালে এ নিয়ে বাংলাদেশ লিখিত প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ভারতের কাছে বহুমুখী নয়, একমুখী কিংবা একতরফা ট্রানজিটই অগ্রাধিকার।

অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়ে গড়িমসি একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গঙ্গার পানির বিষয়ে চুক্তি হলেও বাংলাদেশ কখনোই চুক্তি অনুযায়ী ন্যায্য হিস্যা পায়নি। ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেয়ার কথা থাকলেও গঙ্গায় কোনো কোনো বছরে দেড় হাজার কিউসেক পানি পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি তো অধরাই রয়ে গেছে। ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ভেতর দিয়ে তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তিস্তা অববাহিকায় পাঁচ হাজার ৪২৭টি গ্রামের লাখ লাখ মানুষ এ নদীর ওপর নির্ভরশীল। কৃষি ও মৎস্যই তাদের জীবিকা। কিন্তু পানির অভাবে এসব মানুষের জীবিকা ধ্বংস হয়ে গেছে।

২০১১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে আমরা আশা পেয়েছিলাম যে, তিস্তা চুক্তি চ‚ড়ান্ত হয়েছে। ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং সফরে এসে চুক্তিটি স্বাক্ষর করবেন। ড. মনমোহন সিং ঠিকই এলেন, কিন্তু তিস্তা সমস্যা যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে যায়। চুক্তি স্বাক্ষর হলো না। বলা হলো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বাধা দেয়ার চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসা-যাওয়া হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির সরকারে দু’মেয়াদও শেষ হতে চলেছে। কিন্তু চুক্তির ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো সাড়াশব্দ নেই। কিছু দিন আগে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহার বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকের খসড়া গ্রহণ করা হয়। তিস্তা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। জেআরসির এই বৈঠকটিও হয়েছে দীর্ঘ ১২ বছর পর।

তিস্তার পানির জন্য অববাহিকা অঞ্চলের মানুষের আহাজারি করেই চলেছেন। কিছু দিন আগে তিস্তার পানির দাবিতে ২৩০ কিলোমিটারব্যাপী এক মানববন্ধন করেছেন ভুক্তভোগীরা। তারা তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা চান। কিন্তু কে শোনে কার কথা? বিশেষজ্ঞদের মতে, তিস্তার বয়স ২৩৪ বছর হলেও আজ পর্যন্ত এ নদীর ব্যাপারে যৌথ কোনো সমীক্ষা হয়নি। নদীটি পানির অভাবে ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে।

দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকে তিস্তার বিষয়টি তোলা হবে বলা হচ্ছে। যদি প্রাপ্তির কোনো আশা না-ই থাকে তাহলে বিষয়টি তোলার দরকার কী? নাকি দেশে ফিরে এটা বলার জন্য যে, আমরা তিস্তার বিষয়ে আলোচনা করেছি। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার দরকার কী? তিস্তার মতো মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বণ্টনের রূপরেখা নিয়েও নাকি আলোচনা হবে। একই কথা বলতে চাই- কার্যকর আলোচনা ছাড়া এসব বিষয় উঠিয়ে লাভ নেই। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এমন ধারণাই জন্মেছে যে, ভারতকে বেশি দিচ্ছি, পাচ্ছি না কিছুই।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
Email: abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement