২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভে ঢাকা যোগ দিলে কী হবে?

লেখক : মাসুম খলিলী - ফাইল ছবি

অতিগুরুত্বপূর্ণ চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ান ই’র ঢাকা সফর নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। এ সফরে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনের গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভে যোগ দিতে ঢাকার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এম এ মোমেন জানিয়েছেন, চীনা প্রতিপক্ষ গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে যোগ দিতে বলেছেন। অন্য দিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, বৈঠকে চীন গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভের ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন এবং তাতে যোগ দিতে বলেছেন। বাংলাদেশ এ প্রস্তাব গ্রহণ করেছে কি না তা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো মন্ত্রী মন্তব্য করেননি। চীনের গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ, সেটি ডেভেলপমেন্ট বা সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ, যা-ই হোক না কেন তা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল।

চীনের গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের ধারণাটি আসে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা ‘বিশ্ব ন্যাটো’ ধরনের জোট গঠনের উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তাবের পর। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকা মিজ লিজ ট্রাস চীন-রাশিয়াকে ঠেকাতে ‘গ্লোবাল ন্যাটো’ গঠনের উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তাব করেন। এখনকার ন্যাটো মূলত আটলান্টিক মহাসাগরকেন্দ্রিক। এর বাইরের অঞ্চলের কোনো দেশের পক্ষে এর সদস্য হওয়ার সুযোগ নেই। লিজ ট্রাস সেটিকে সম্প্রসারণ করে সব দেশের জোগদানের জন্য ন্যাটোকে উন্মুক্ত করার প্রস্তাব করেছিলেন। বর্তমান ন্যাটোর সীমাবদ্ধতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়াশিংটনের মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্য এশিয়া বা আফ্রিকায় ন্যাটোর সহযোগী সামরিক বা অর্থনৈতিক জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু এর নাম ন্যাটো বলেননি। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস প্রথমবারের মতো গ্লোবাল ন্যাটো গঠনের ধারণা সামনে নিয়ে এসেছেন।

গ্লোবাল ন্যাটো ও গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভের পাল্টাপাল্টি উদ্যোগ নতুন বৈশ্বিক উত্তেজনার পূর্বাভাস বলে ধারণা করা যায়। এ উত্তেজনা কতটা প্রলয়ঙ্করী হবে সেটি ভবিষ্যতেই হয়তো নিশ্চিতভাবে বলা যাবে। তবে রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হতে না হতে আরো একাধিক পয়েন্টে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। সার্বিয়ার কসোভো প্রজাতন্ত্র আক্রমণে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন সরাসরি সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যেকোনো সময় বলকানের এ অঞ্চল উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।

আমেরিকান প্রতিনিধি সভার স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর ঘিরে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাথে। এর রেশ কাটতে না কাটতে ভারতের লাদাখ সীমান্তের অদূরে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র যৌথ সামরিক মহড়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অন্য দিকে, মধ্য এশিয়ায় আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে নাগরনো কারাবাখকে ঘিরে একদফা সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হয়ে গেছে। সিরিয়ায় বাফার জোন গঠন নিয়ে চলছে তুরস্কের সাথে ইরান-রাশিয়ার উত্তেজনা। এর মধ্যে বারবার ঘুরেফিরে উঠে আসছে ‘আরব ন্যাটো’ গঠনের বিষয়টি।

এসব উত্তেজনাকর ঘটনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা প্রধান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পাল্টা ব্যবস্থা তৈরির উদ্যোগ এগিয়ে নেয়া হয়েছে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে। দ্বিপক্ষীয় মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করার একের পর এক চুক্তি করে যাচ্ছে চীন-রাশিয়া ও এর মিত্র দেশগুলো। একই ধরনের প্রস্তাব রাশিয়া ও ভারত বাংলাদেশকে দিয়েছে। বেইজিংয়ের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে যোগদানের অর্থ হবে এই ব্যবস্থায় ঢাকারও যোগ দেয়া। একই সাথে বৈশ্বিক বাণিজ্যে একটি আন্তর্জাতিক ডিজিটাল মুদ্রা তৈরি ও সুইফটের বিকল্প আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তথ্য পরিষেবা প্রতিষ্ঠান তৈরির যে চেষ্টা চীন-রাশিয়া চালাচ্ছে তার অংশ হওয়া।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশকে চীনা গ্লোবাল ইনিশিটিয়েভে যোগ দেয়ার আহ্বান ঢাকার জন্য কৌশলগত সুনামিতে প্রবেশের আমন্ত্রণতুল্য হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত বা নিরাপত্তা ইস্যুতে চীননির্ভরতা যেমন রয়েছে; তেমনিভাবে রয়েছে ব্যাপক পরিসরের পাশ্চাত্য নির্ভরতাও। চীন থেকে বাংলাদেশ প্রায় ৭০ শতাংশ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনে থাকে। ৯ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার পণ্য আমদানি করে। বিপরীতে চীনে রফতানি এর বিশ ভাগের এক ভাগ। চীন থেকে রেমিট্যান্স আসার অঙ্ক একেবারে অনুল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি চীন সম্প্রতি বাংলাদেশের অনেক অবকাঠামো প্রকল্পে বাণিজ্যিক শর্তে বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর সময় থেকে এ পর্যন্ত যে বৈদেশিক দায়দেনা রয়েছে তার ৮ শতাংশের মতো চীন থেকে আসা।

এর বিপরীতে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে উন্নয়ন সহায়তা এসেছে; তার ৮০ শতাংশের বেশি পাশ্চাত্য নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাংক, আইডিবি ও আইএমএফের মতো বহুপক্ষীয় সংস্থা ও পশ্চিমা দেশ থেকে। বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ৮০ শতাংশের বেশি গন্তব্য হলো এসব দেশ। রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ ইউরোপ আমেরিকা থেকে আসে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের পাশাপাশি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও সুইফটের মতো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় যেকোনো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা অবরোধের মতো পরিস্থিতি এলে বাংলাদেশের জন্য গুরুতর বিপদ নেমে আসতে পারে।

এ কারণে চীন-রাশিয়া বনাম ইউরোপ-আমেরিকা কোনো এক পক্ষকে বেছে নেয়ার মতো বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য নজিরবিহীন কৌশলগত সঙ্কট ডেকে আনতে পারে। সম্ভবত ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এ ধরনের ডিলেমায় বাংলাদেশ আর পড়েনি। স্বাধীনতার পর বিশ্বে যে স্নায়ুযুদ্ধের পরিবেশ ছিল তাতে জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে দুই পক্ষের সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক রক্ষা করেছিল ঢাকা। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মধ্যে একদলীয় ব্যবস্থায় গিয়ে সোভিয়েত বলয়ে পুরোপুরি ঢুকে পড়ার পর এখানে বড় ধরনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। এখনকার পরিস্থিতি দেখে অনেক বিশ্লেষক সে সময়ের সাথে তুলনা করতে চান।

তবে বাংলাদেশ ও বৈশ্বিকভাবে এখনকার বাস্তবতা হলো বিশ্ব পুরনো স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার দুই মেরুতে পুরোপুরি বিভাজিত যেমন নেই; তেমনিভাবে সোভিয়েত পতনের পর এক মেরু ব্যবস্থার মধ্যেও নেই। পশ্চিমা আধিপত্যকে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক দুই ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ করছে চীন-রাশিয়া যৌথভাবে। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে একান্ত বলয় বাছাই করতে হলে সেই ক্ষেত্রে ঢাকাকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত সরকারের ভাগ্যকে প্রভাবিত করবে শুধু তাই নয়, একই সাথে রাষ্ট্রের মধ্যেও নাজুক পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement