১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সুইডেন বালিকা থুনবার্গ

লেখক : জয়নুল আবেদীন - ফাইল ছবি

গভীর রাতে ঘুম ভাঙে। অসময়ে ঘুম ভাঙার কারণ, লোডশেডিং। কোনো এক সময় লোডশেডিংয়ের কারণে বন্ধ হয়ে পড়েছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রক। শরীর ঘেমে যখন মশার কামড় শুরু হয় তখনই ঘুম ভাঙে। পাশে শায়িত আট বছরের নাতিটাও উঠে বসে আছে। ছেলে আর ছেলেবউ জেগে উঠার শব্দও কানে আসে। ঘামে ভেজা গেঞ্জি খুলে বাইরে গিয়ে দেখি, তিন বছরের নাতনিটাও উদাম গায়ে কান্নাসহ হাঁটাহাঁটি করছে। সবাই দক্ষিণের খোলা বারান্দায় যাই। বাইরে ঝিরঝিরে বাতাস। মশার উৎপাত কম থাকলে ঘরের চেয়ে বাইরেই ভালো ছিল। ঘণ্টা দুয়েক পর বিদ্যুৎ চলে আসতেই ঘরে আসি। চোখে ঘুম আসার আগেই কানে আসে আজানের ধ্বনি। এভাবেই দিনের শুরু।

মামলার সাক্ষী। জেরার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগেই চেম্বারে লোডশেডিং। শরীর ভিজতে শুরু করে। চেম্বার ছেড়ে বাইরে আসি। বিদ্যুৎ যখন আসে তখন কোর্ট বসার সময়। ভেজা শরীর শুকানোর আগেই পরতে শুরু করি কোট-গাউন। টাইট করে নেকটাই বেঁধে মুখে মাস্ক পরে আদালতের উদ্দেশে ছুট। মক্কেল-উকিল ঠেলাঠেলি করে তড়িঘড়ি সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় ওঠার পর দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আদালত কক্ষের আয়তনের তুলনায় ফ্যানের সংখ্যা অপ্রতুল। আমার মতো অনেক আইনজীবী আদালত কক্ষেও ঘামতে শুরু করেন। গেঞ্জি, জামা ভিজে যখন গায়ের কালো কোট ভিজতে শুরু করে তখন ভয় জাগে। ভয় জাগে, ঘামের সাথে শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া পানির ঘাটতি পূরণ করতে না পারলে রক্তচাপ কমে যায়। রক্তচাপ কমে গেলেই মাথা ঝিমঝিম শুরু হয়। আমারও যেন মাথা ঝিমঝিম শুরু হয়েছে। এই অবস্থা দেখে এক জুনিয়র আইনজীবী,

-স্যার, বিশ্বজুড়ে বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। মানছি চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় বিদ্যুতের লোডশেডিং। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও লোডশেডিংয়ের সাথে ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া কোট-গাউন পরিধান করার বাধতামূলক আইনটা গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো শিথিল করলে চলে না? এই বিষয়েও লেখালেখি করুন।

-লেখালেখি আগেই তো বন্ধ করা হয়েছিল ড্রেসকোড। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশের হাইকোর্টে বিচারপতি এবং আইনজীবীদের কালো কোট ও গাউন পরার বাধ্যতাবাধকতার বিষয়টি আদালত শিথিল করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিস থেকে এই মর্মে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলা হয়েছিল, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত পরিস্থিতিতে বিচারপতি এবং আইনজীবীরা টার্নড-আপ সাদা কলার এবং সাদা ব্যান্ডসহ সাদা শার্ট ও প্যান্ট/শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ পরিধান করবেন।’

করোনার প্রকোপ কমতে না কমতেই আবার ফিরে আসতে হয় সাড়ে তিন শ’ বছর আগের পুরনো ড্রেসকোডে। সাড়ে তিন শ’ বলছি এ কারণে যে, ১৬৮৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস মারা যাওয়ার পর শোক প্রকাশের জন্য আদালতের আইনজীবী এবং বিচারপতিরা কালো কোট ও গাউন পরা শুরু করেন। চার্লসের শোক পালন শুরু হয় ব্রিটিশ শাসিত পাক-ভারতেও। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কালো কোট ও গাউন পরার রেওয়াজ রয়ে গেছে। এক পক্ষ বলেন, এই প্রথা ব্রিটেন তাদের উপনিবেশগুলোর উপর চাপিয়ে দিয়েছে,কালো রঙের সাথে ন্যায়বিচারের কোনো সম্পর্ক নেই।

অপর পক্ষ বলেন, আদালতের গুরুগম্ভীর পরিবেশসহ মক্কেল, বিচারপতি এবং আইনজীবীদের পৃথক করার জন্য এই পরিচ্ছদই দরকার।

আইনজীবীদের বাইরে সুধীজনের বক্তব্য, ‘বিজ্ঞ বিচারক ও আইনজীবীদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জন্য স্বতন্ত্র শত প্রকারের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন পরিচ্ছদ রয়েছে- কিংবা ডিজাইনার দিয়ে বের করা সম্ভব। তার পরেও উষ্ণ মণ্ডলের গরমের দেশে শীতের দেশের ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া শোক পরিচ্ছদ কেন? বুদ্ধি ব্যবসায়ীর ভালো ভালো সব বুদ্ধি বাইরে বিক্রি করে নিজের বেলায় চিন্তা করার সুযোগ থাকে না।’ এই হলো বৈশ্বিক উষ্ণতার পরিণামে মফস্বল শহর নারায়ণগঞ্জের ৭২ ঘণ্টার চিত্র।

যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বদলাতে শুরু করেছে বিশ্বের চিত্রও। কয়েকদিন আগে জাতীয় দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘রোদে ডিম ভাজা’। লন্ডনের বিমানবন্দর হিথ্রো এলাকার খবর। গত মে মাসের শেষদিকে হিথ্রো সংলগ্ন ডিয়ার পার্কে বসে বিমান গণনা করছিলাম। বিশ্বের ব্যস্ততম বিমানবন্দর হিথ্রো। ডিয়ার পার্ক এলাকা দিয়েই নামে বিমানগুলো। পার্কের রোদে বসে নাশতাকরাসহ প্রতি মিনিটে কয়টি বিমান অবতরণ করে এই নিয়ে গণনা। শীত থেকে বাঁচার জন্য যে দেশে প্রবেশ করতে হয় ভাস্কো দা গামার পরিচ্ছদ পরে সে দেশে আগুন ছাড়া রোদের উত্তাপে ডিম ভাজা করা অবিশ্বাস্য। বড় মেয়ে হেনার কাছে ফোন করেছিলাম। উত্তরে,

-আব্বা, লন্ডনের আবহাওয়া বদলে গেছে। এখন বাংলাদেশের মতো গরম। সপরিবারে মেজোমামা এসেছেন। তারা গরম সহ্য করতে পারেন না। এসি খুঁজতে গিয়েছিলাম। তিন রুমের জন্য তিনটা টেবিল ফ্যান নিয়ে এসেছি। এখানে রুম গরম করার জন্য যত সহজে হিটার পাওয়া যায় ঠাণ্ডা করার জন্য তত সহজে এসি পাওয়া যায় না।

বৈশ্বিক উষ্ণতা হঠাৎ শুরু হয়নি। অজগর যেভাবে হরিণ শাবককে আস্তে আস্তে গলাধঃকরণ করে ঠিক সেভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতাও আস্তে আস্তে আমাদের এই অসহায় বিশ্বকে গলাধঃকরণ করতে শুরু করেছে। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম লন্ডন যাই। তখনই লিখেছিলাম, ‘লন্ডন শহরটি দেশের (ইংল্যান্ডের) পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলে, আর উত্তরাঞ্চলে স্কটল্যান্ড। স্কটল্যান্ড এলাকায় অনেক আগে থেকেই বরফ পড়তে শুরু করেছে। একসময় লন্ডন এলাকায়ও এ সময় তুষারপাত হতো। এখন এ এলাকায় তুষারপাত বিরল ব্যাপার। এর কারণ হিসেবে কৃত্রিম প্রণালীতে বহুমাত্রায় তাপ উৎপাদনকেই দায়ী করা হয়েছে। এখনকার দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যানবাহন, অফিস-আদালত, বাসা-বাড়ি সবখানেই হিটার। একমাত্র খোলা আকাশের তলা ছাড়া হিটারবিহীন স্থান নেই বললেই চলে। শুধু তুষারপাত বন্ধ হয়নি, গ্রীষ্মকালে উষ্ণতা বেড়েছে অনেক গুণ বেশি।

গত জুন মাসে তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছিল। কারণ এ দেশে এয়ারকুলার ও ফ্যানের ব্যবহার নেই বললেই চলে। গত জুনে অনেকে সারা শহর খোঁজাখুঁজি করেও বৈদ্যুতিক পাখা কিনতে পায়নি। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিবেশ বিপর্যয়সহ তাদের হাজার বছরের অবকাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, যা তারা চায় না।.. শ শ বছর আগে নির্মিত বিশেষ মডেলের বাড়িঘর। একচিলতে ভ‚মির উপর বিশেষভাবে নির্মিত বাড়ি। নিচতলায় রাস্তার দিকে ড্রয়িংরুম, ড্রয়িংরুমের সামনে ছোট্ট একটি গার্ডেন। পেছনে ডাইনিংয়ের পরে কিচেন ও তৎসংলগ্ন একটি সবজি বাগান। মনের মতো সাজানো-গোছানো দূরের কথা এক সাথে পাঁচ/সাতজন মেহমান এলে তাদের শুতেই দেওয়া যাবে না। একটার বেশি দুটো ফার্নিচার ঢুকানো যাবে না, বৈঠকখানা জলসাঘর তো দূরের কথা লোকসংখ্যা সীমিত পরিমাণ ছাড়িয়ে গেলে বসাই যায় না।’ (বিলেতের পথে পথে পৃষ্ঠা ৮৭ ও ৮৯)।

খবরে প্রকাশ, ‘ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল গিরোনদ থেকে গত ক’দিনে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। স্পেন ও পর্তুগালে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর। বেশ কয়েকটি এলাকায় দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। এই দুই দেশে গত ক’দিনে দাবদাহে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে।’

বিষয়টির সত্যতা জানতে চেয়ে ফোন করেছিলাম ফ্রান্সবাসী মেজো মেয়ে টগরের কাছে। উত্তরে,
-আব্বা, আমরা এক যুগের বেশি বছর ধরে দেশে যাই না। দেশের অবস্থা কেমন, জানি না। এখানকার অবস্থা আমাদের দেশের গ্রীষ্ম কালের মতো। ক’দিন খুবই খারাপ ছিল। সন্তানদের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে দুইটা ফ্যান কিনেছি। এই দেশের ঘরবাড়িতে সিলিং ফ্যান লাগানোর সিস্টেম নেই। তাই, একটা টেবিল ফ্যান আর একটা স্ট্যান্ড ফ্যান।

ছোট মেয়ে মল্লিকা থাকে সুইডেন। মাস দুয়েক আগে সুইডেন থেকে এসেছি। শীতের কাপড় ছাড়া বাইরে বের হতে পারতাম না। সুইডেনের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলেই বলে,

-গরমের তীব্রতা বেড়েছে। আমাদের সুইডিশ মালিক বলেছিলেন, বছর বিশেক আগে সুইডেনে বৈদ্যুতিক পাখা কিনতে পাওয়া যেত না। এখন পাওয়া যায়, বিক্রিও হয় প্রচুর। আমাদের বাসার সামনের যে জঙ্গলে আমরা ঘুরাঘুরি করতাম সে জঙ্গলের মোড়ে মোড়ে ছিল বার বি কিউ প্লেস। অনেক জঙ্গলেই এ রকম বার বি কিউ প্লেস রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগার সংবাদে জঙ্গলে বার বি কিউ করা বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এক সময় শীতকালে হ্রদের পানি বরফ হয়ে যেত। এখন আর তেমন বরফ হয় না।

‘পৃথিবীতে ভয়াবহ প্লাবনের ঘটনা ঘটেছিল হজরত নূহ (আ:)-এর আমলে। কুরআনুল কারিমের একাধিক স্থানে এই প্লাবনের বর্ণনা রয়েছে। পূর্ববর্তী অপরাপর আসমানি কিতাবেও গুরুত্বের সাথে এই মহা প্লাবনের ইতিহাস বিবৃত আছে। পথভ্রষ্ট মানুষকে হজরত নূহ (আ:) সঠিক পথে আসার আহ্বানসহ বারবার সতর্ক করেছিলেন। মানুষ কান দেয়নি- বরং কানে আঙুল দিয়ে ঘুমাচ্ছিল। নবী-রাসূলদের কাল শেষ হজরত মুহাম্মদ (সা:)-এর সময় থেকেই। এটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বৈজ্ঞানিকের সতর্কবার্তায় কেউ কান দিচ্ছে না। নেপালের ভ‚মিকম্পের আগেও সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছিল। যারা সতর্ক বার্তা দিয়েছিল তারাই এখন সতর্কবার্তা দিয়ে বলছেন, ‘পৃথিবীর উষ্ণতা এতটাই বেড়ে চলেছে যে, আগামী এক দশকে তাপমাত্রা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলতে পারে। বিশ্ব নেতারা তা প্রতিরোধের উপায় খুঁজছেন।’

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিবেশ গবেষণা কেন্দ্রের লিন্ডা মেয়ারন্স মনে করেন ‘এটা নিশ্চিত যে, অবস্থা আরো খারাপ হবে। যাওয়ার কোনো স্থান নেই, পালিয়ে বাঁচার উপায় নেই। ২৩৪ জন বিজ্ঞানীর করা তিন হাজার পৃষ্ঠার বেশি দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উষ্ণতার কারণে ইতোমধ্যেই সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বন্যা, খরা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও তপ্ত বায়ু প্রবাহসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। শক্তিশালী ও ভয়াবহ হচ্ছে ক্রান্তীয় ঝড়, গলে যাচ্ছে আর্কটিকের বরফ ও কমছে ভূগর্ভস্থ মজুদ। সবকিছুই আরো খারাপের দিকে যাবে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।

রিপোর্টের আরেক লেখক রাটগারস বিশ্ববিদ্যালয়ের বব কব বলেন, এই শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১৩ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার (৬ থেকে ১২ ইঞ্চি) বৃদ্ধি পর্যন্ত সইতে পারবে আমাদের ধরণী। জাতিসঙ্ঘের পরিবেশ কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ইন্সার অ্যান্ডারসন বলেন, বিজ্ঞানীরা হয়তো তিন দশক ধরে এই কথাটাই বলে আসছেন। কিন্তু বিশ্ব তাতে কর্ণপাত করেনি।

দক্ষিণ মেরুর বরফ গলার পরিণাম; দক্ষিণ মেরুর বরফ খণ্ড প্রায় দুই কিলোমিটার পুরু। গ্রিনল্যান্ডের প্রায় সাতগুণ বেশি জমাটবাঁধা বরফ সম্পূর্ণ গলে গেলে হয়তো সাগরতলের উচ্চতা মোট ৬৫ মিটার বা প্রায় ২১৩ ফুট বাড়বে।

প্রথম আলো গত ৩ এপ্রিল ২০২২ প্রকশিত ‘উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর বরফ গলার ফলাফল কতটা ভয়ঙ্কর’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরের একাংশে বলা হয়েছে, ‘মাইকেল ব্রস লিখেছেন, বিজ্ঞানীদের ধারণা, শুধু গ্রিনল্যান্ডের হিমবাহের সব বরফ গলে গেলে মহাসাগরের পানির উচ্চতা প্রায় সাড়ে সাত মিটার বেড়ে যাবে। আর যদি দক্ষিণ মেরুর সব বরফ গলে যায় তা হলে আরো ৫৮ মিটার উচ্চতা বাড়বে।... দুই মেরুর জমাট বরফ সম্পূর্ণ গলে গেলে হয়তো সাগর তলার উচ্চতা মোট ৬৫ মিটার বা প্রায় ২১৩ ফুট বাড়বে। হয়তো এ অবস্থায় যেতে অনেক সময় লাগবে।’

সবাই যখন কানে আঙুল দিয়ে ঘুমাচ্ছিল তখন ঘুম ভাঙার গান গাওয়া শুরু করে সুইডেন বালিকা থুনবার্গ। বছর শুরুতে আমরা সুউডেনের ছোট্ট শহর ভক্সজো লিনিয়াস বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। জনমানবহীন সুইডেন। প্রধান শহর স্টকহোম, গথেনবার্গ ও মালমা। বাংলাদেশ থেকে তিন গুণ বেশি আয়তন সুইডেন, লোকসংখ্যা মাত্র এক কোটি। মোট লোকসংখ্যার ৮৫ শতাংশ শহরে বাস করে। ভক্সজো উপশহর। ভক্সজোর পাশেই টেলিবর্গ এলাকায় আমাদের বাসা। অবসরে চার তলার বারান্দায় বসে টেলিবর্গ জঙ্গল ও রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিছুক্ষণ পরপর যাত্রীশূন্য বাস, চলমান সাইকেল, পোষা কুকুরসহ দু’য়েকজন নারী/পুরুষ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ত না। তা দেখে মল্লিকাকে বলতাম,

-ব্রিটিশ শাসিত উপনিবেশ থেকে রাষ্ট্রদ্রোহীদের দ্বীপান্তর দিত জনমানবহীন কালাপানির আন্দামান। জনমানবহীন কষ্টকর জীবন ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যেত। ফাঁসির দণ্ড থেকেও কষ্টকর ছিল পরিজনহীন ধুঁকে ধুঁকে জীবন শেষ হওয়া। ব্রিটিশরা বোকা, বিরোধী ভারতীয়দের আন্দামান দ্বীপে নির্বাসনে না দিয়ে সুইডেন দ্বীপে নিয়ে এলেই পারত। তোমরা কী করে থাকবে? আমার কাছে সুইডেন জনমানবহীন দ্বীপে নির্বাসনের মতোই লাগে।

-আব্বা, মানুষের ভিড়ে দমবন্ধ হয়ে সুইডেন এসেছেন। দুই দিন যেতে না যেতেই আপনার দমবন্ধ হয়ে আসছে মানুষ দেখার জন্য!

এর পরের দিন-ই (১লা মে) উপশহর ভক্সজোর লিনিয়াস বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কার্ল লিনিয়াসের ভাস্কর্যের কাছে আমরা। একজন দু’জন সাইকেল আরোহীর ছবি তুলছিলাম। এমন সময় কানে আসে বাদ্য-বাজনার শব্দ। হাজার মানুষের মিছিলসহ বাদ্যবাজনা। সামনে বাদ্য-বাজনা, পেছনে নিঃশব্দ মিছিল। হাতে ব্যানার। ব্যানারে লেখা, ইয়ুথ ফর ক্লাইমেট, ক্লাইমেট ফর স্ট্রাইক (জলবায়ুর জন্য ধর্মঘট), স্টপ ক্রিগ রিসলান্দ (রাশিয়ার যুদ্ধ বন্ধ কর), সোভেরিয়ে কান বেতরে (সুইডেন আরো ভালো করতে পারবে), ভ্যাক্সজো কান বেতরে (ভক্সজো আরো ভালো করতে পারবে), রেত ফর কাবিন্নোর (নারীর জন্য অধিকার), রেত ফর ফোলক (জনগণের জন্য অধিকার) এবং রেত ফর ম্যোনিহা (মানুষের জন্য অধিকার)।

সহস্র মানুষের মিছিল দেখে জানতে চেয়েছিলাম, এরা কারা? কী চায়? শান্তির দেশে কী অশান্তি তাদের? প্রশ্নের উত্তরে জেনেছিলাম, ‘জলবায়ু কন্যা থুনবার্গের মিছিল। ‘জলবায়ু কন্যা থুনবার্গ’! দেখাও করতে চেয়েছিলাম, বিশ্বের বিস্ময় বালিকা থুনবার্গকে। সম্ভব হয়নি। কী করে সম্ভব হবে? বিশ্বের পরাশক্তি যখন যুদ্ধের চিন্তায় ব্যস্ত তখন টুনটুনি মেয়েটি পরিবেশ সংরক্ষণের আন্দোলন করে কাঁপিয়ে তুলেছে বিশ্বকে। টুনটুনির পূর্ণ নাম, ‘গ্রেটা টিনটিন ইলেওনোরা এর্নম্যান থুনবার্গ’, জন্ম ৩ জানুয়ারি ২০০৩, স্টকহোম সুইডেন। থুনবার্গ জলবায়ুর জন্য স্কুলছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। স্কুল থেকে পার্লামেন্ট ভবনের সামনে রাজনৈতিক নেতাদের জাগিয়ে দিয়ে পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।

আগস্ট ২০১৮ সালে সুইডিশ সংসদের বাইরে একটি প্রতিবাদ করেন, যেখানে লেখা ছিল ‘জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট’। এই প্রতিবাদ ১৫ মার্চ ২০১৯ ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। সাড়া দিয়ে ধর্মঘটের আয়োজন করে ১২৫টি দেশ। ১২৫টি দেশের ২২০০টি ধর্মঘটে লোক সংখ্যা ছিল এক মিলিয়নেরও বেশি। সম্ভবত বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জলবায়ু ধর্মঘট এটি। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ধর্মঘটে প্রায় ৪ মিলিয়ন বিক্ষোভকারী জড়ো হয়েছিল, বেশির ভাগই ছিল স্কুলছাত্রী। তাদের মধ্যে জার্মানিরই ছিল ১.৪ মিলিয়ন। এর মধ্যেই থুনবার্গ ‘ফ্রিট অর্ডার পুরস্কার’, ‘রাহেল কারসন পুরস্কার’, ‘রাইট লাইভলিভির পুরস্কার’সহ ২০১৯ টাইম বর্ষসেরা পুরস্কারে ভ‚ষিত হয়েছেন। রয়েছে এ বছর নোবেলপ্রাপ্তির সম্ভাবনাও।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement