২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নির্বাচন নিয়ে রাজনীতি ও সংলাপ

নির্বাচন নিয়ে রাজনীতি ও সংলাপ - ফাইল ছবি

বেশ কিছু দিন ধরেই আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো কোন সরকার চায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এই সংলাপের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভঙ্গি এবং তাদের প্রত্যাশা। সেই সাথে নির্বাচন কমিশনের সাংগঠনিক শক্তি ও দলীয় সরকারের চাপ ও চাহিদা এবং একগুঁয়েমি ইত্যাদিও প্রকাশ পেয়েছে। একইভাবে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বড় স্টেকহোল্ডার বিএনপিসহ ৯টি দল সংলাপ বর্জনের কারণেও ইসির এই সংলাপ যে ব্যর্থ হচ্ছে তা পরিষ্কার ছিল। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে তারা নির্বাচনকালে দলনিরপেক্ষ সরকার চায় যাতে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে। সেই সাথে ইসি পুনর্গঠন করে নির্বাচনী ফিল্ড লেভেলপ্লেয়িং করারও দাবি জানিয়ে আসছে।

তারা বিদ্যমান আওয়ামী লীগ সরকারকে বৈধ মনে করে না। কারণ হিসেবে তারা বলেন যে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই সরকার নির্বাচনের আগের রাতেই রিগিং করেছে অন্তত ১০০টি আসনে। সেই আসনগুলোতে কোনো ভোটারকে আসতে দেয়নি তারা। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ, পুলিশ, প্রশাসনের কিছু ব্যক্তি মিলে উৎসব করে রাতের বেলা ব্যালট পেপারে সিল মেরে ভোট করেছে, যা জাতীয় সব মিডিয়াসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও প্রদর্শিত হয়েছে। কিন্তু সে সময় ইসি ওই রিগিং আমলে না নিয়ে তাদের বিজয়ী বলে ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ ওই নির্বাচনে ইসিও ছিল সরকারদলীয় কার্যক্রমের অংশীদার। ইসি ও সরকারের মধ্যকার গোপন যোগসাজশেই এই অবৈধ সরকার ক্ষমতায় বসেছে। তাই এই সরকারের বৈধতা নেই। তারা ভোট ডাকাতি করেছে আর ইসি সেই ডাকাতির বৈধতা দিয়েছে। এ কারণেই আওয়ামী লীগ আজো ক্ষমতায়। বিএনপিসহ ৯টি দল বলেছে, নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে হবে, না হলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না।

অন্য দিকে, ২০১১ সালে আওয়ামী সরকার নির্বাচনকালীন অনির্বাচিত সরকার যাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা হতো এবং হচ্ছে, যা সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল সংশোধনের মাধ্যমে, তা বাতিল করে দেয়। আওয়ামী লীগ চায় দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হতে হবে। তারা এ ব্যাপারে অনড় ও অটল। মূলত দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটটি এখানেই আটকে আছে। একপক্ষ চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অন্যপক্ষ চায় তাদের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে, যা বর্তমান সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে। সরকারি দলের যুক্তি, কোনো অনির্বাচিত সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন তারা মেনে নেবে না। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ ২০০৮-এর নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতায় যায় তাদের ভাষায় অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই। ফলে তাদের মুখে এটা মানায় না যে কোনো অনির্বাচিত সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। উভয়পক্ষই নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থানে, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অনড় ও অটল।

মূলত বাংলাদেশের রাজনীতি এখানেই এসে পৌঁছেছে। এই রাজনৈতিক অবস্থানের সমাধান করা কি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত? আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই এই সঙ্কট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে না। কারণ তার সেই সাংবিধানিক ক্ষমতা নেই। আর তার দায়ও নেই। তার দায় কেবল সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার। তবে সেই দায়িত্ব পালন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলো এখন দুই ভাগে বিভক্ত।

তবে অধিকাংশ দলই চায় নির্বাচন যেন সুষ্ঠুভাবে লেভেলপ্লেয়িং পরিবেশ তৈরি করে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ চায় তাদের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। তাদের অধীনে নির্বাচন কেমন হয়েছে তা জাতি দেখেছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে। তারা ওই দুটি নির্বাচনে প্রমাণ করেছে তারা রিগিং-উস্তাদই কেবল নয়, কোনো ভোটারকেও তারা কেন্দ্রে যেতে দেয়নি। এমনকি তাদের প্রার্থীকেও তারা ফেরত পাঠিয়েছে। শতভাগ ভোটই কেবল কাস্ট হয়নি, অনেক কেন্দ্রে তার চেয়েও বেশি ভোট পড়েছে। আওয়ামী লীগ যতই বলুক না কেন, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন হতে দেবে, সেটা এ দেশের বাতাসও বিশ্বাস করে না।
২.
অন্তত তিনটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ওই তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একবার ক্ষমতায় গেছে, দু’বার বিএনপি। তার পরও আওয়ামী লীগ সেই ব্যবস্থা বাতিল করেছে। কারণ তাদের দুরভিসন্ধি সুদীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় থাকা। তাদের প্রজেক্ট ২০৪১ সাল তারই একটি। কিভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার ও লুটপাটের দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে তা জাতি দেখতে পাচ্ছে। এ কারণেই বিরোধী রাজনীতিকরা আবারো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানাচ্ছে, যাতে নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও রিগিংমুক্ত হতে পারে। ভোটার জনগণ যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে। যারা নির্বাচনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চাইছে, তারা চায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যাতে হতে পারে, সেই আশায়। আর ক্ষমতাসীন সরকার আবারো ক্ষমতায় থাকতে পারে সে কারণে নিজেদের অধীনে নির্বাচন করতে চায়। নির্বাচনে জিতুক বা না জিতুক, ক্ষমতায় থাকাটাই হলো আসল। ভোটের রাজনীতি যখন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে তখন সেখানে প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকে না।
৩.
আমরা কি লক্ষ করিনি, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাংগঠনিকভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিন্দুমাত্র স্পর্শ নেই। প্রত্যেকটি দল রাজনৈতিকভাবে স্বৈর-মানসিকতার। আর তাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোতে দলীয় নেতার নামে, তাদেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশে নেতা নির্বাচিত হয়। কোনোরকম ভোটাভুটির উৎসবই তারা করতে রাজি নয়। দলে যেমন গণতন্ত্র নেই তেমনি রাজনৈতিক নেতারাও গণতন্ত্রের সামান্যই তোয়াক্কা করেন। সেটা তাদের কথাবার্তায়, আচরণে, শারীরী ভাষায় স্পষ্ট। সরকারে তো গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে অনেক আগেই। এক ধরনের অ্যারোগ্যান্ট স্বভাব তারা আয়ত্ত করেছেন, যা তাদের নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তা ও অনুসারীদের মধ্যেও দেখা যায়। দলীয় প্রধান বা সেক্রেটারি যদি বলেন, আমরা আমাদের অধীনে নির্বাচন করব, তাহলে তৃণমূলের কর্মীও সেই একই কথা বলবে। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিবেক ও বোধেরও জন্ম হয় না।

রাজনৈতিকভাবে গণতন্ত্রেরও জন্মনিরুদ্ধ হয়ে যায়। কারণ তারা গণতন্ত্র বলতে বোঝে দলীয় নেতাদের নির্দেশ, তাদের রাজনৈতিক আচরণ, তাদের মিথ্যাচার করতে দেখে তারাও সেই পথেই হাঁটে।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক সঙ্কট এতটাই প্রকট যে, সেখানে স্বৈরাচারিতাই প্রধান, গণমানসিকতার রেশ সেখানে মিলবে না। আর ক্ষমতাসীন দল সবসময় বিরোধীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দাঁড় করায়। যখনই যে দল ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বিরোধীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দাঁড় করে থাকে।

এবার ক্ষমতাসীন দল বলতে চায় বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, ইত্যাদি। সেই অভিযোগ সত্য হলে তার জন্য দায়ী রাজনৈতিক স্টেকহোল্ডারদের অরাজনৈতিক আচরণ ও দলে গণতন্ত্রহীনতা। দলে গণতন্ত্র থাকলে নেতৃত্ব অদল-বদল হতো, দলের ভেতরের সঙ্কট ভেতর থেকেই সমাধানে পৌঁছে যেত। তখন আর ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দাঁড় করিয়ে ফায়দা লোটা যেত না। নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে এই যে সঙ্কট এর জন্য প্রধানত দায়ী আওয়ামী লীগ। কারণ একটি ভালো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে তারা বাতিল করেছে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার মানসে। দলে গণতন্ত্র থাকলে দলীয় ফোরামে বিষয়টি আলোচিত হতো এবং দলীয় সংগঠনের ভোটারগণ তাদের মতামত দিয়ে দলকে সহযোগিতা করতে পারত। কিন্তু সেই পথে নেই দেশের রাজনীতি।
৪.
সবকিছুর আগে নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে সব রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করে দেয়া। তাদের এটাই বলা উচিত যে সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক দলের সাংগঠনিক ভিত্তি গণতান্ত্রিক হতে হবে। আগে দলে গণতান্ত্রিক ধারা কায়েম করুন। নির্বাচিত নেতা হয়ে আসুন। তারপর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাবেন। এই পথে যারা হাঁটবেন না, তারা অবশ্যই নিবন্ধন পাবেন না। দলের ভেতরের আবর্জনা পরিষ্কার না করলে রাজনৈতিক সরকারের ভেতরে যে স্বৈরাচারী মনোভাব আছে, যে অ্যারোগ্যান্সি কাজ করছে, তা দূর করা যাবে না। আর রাজনীতি হচ্ছে বুদ্ধির খেলা। সেখানে যুক্তি ও কুযুক্তির বিরোধ থাকবেই। ভোটার জনগণ যুক্তিকে গ্রহণ করবে, কুযুক্তিকে নেবে না, বাতিল করবে। তাদের সহযোগিতা পেতে হলে অবশ্যই নিজেদের সংশোধন করতে হবে।

নিজেদের ব্যর্থতার দিকে তাকান প্রিয় রাজনীতিকগণ এবং তা সংশোধন করুন। এ ছাড়া রাজনৈতিক ফিল্ড লেভেলপ্লেয়িং করা সম্ভব নয়। কারণ ভোটের মাঠটি উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হলে সৎ ও যোগ্য লোকদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। নেতৃত্বে থাকতে হবে নেতৃত্বের গুণাবলি। বক্রোক্তি, শ্লেষ ও অবহেলা করে কথা বলার দিন আর নেই। সেটা সুদূর অতীতে ছিল বা ছিল না। কিন্তু আজ আমাদের প্রয়োজন প্রজ্ঞাবান, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, মানবিক গুণের অধিকারী নয়া প্রজন্মের নেতৃত্ব। যারা প্রকৃত অর্থেই দেশ ও জাতির মানস প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবন করতে সক্ষম।

দলের ভেতরে ভোটাভুটি করুন নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে। দলের নিবন্ধিত ভোটার সদস্যদের অবাধে ভোট করতে দিন, তাদের মতামত নিয়ে দলীয় মতামত হাজির করুন জাতীয় পর্যায়ে। সেটাই হবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অবারিত পথ।


আরো সংবাদ



premium cement