২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এম আর খান: একজন সামাজিক চিকিৎসকের প্রতিকৃতি

এম আর খান: একজন সামাজিক চিকিৎসকের প্রতিকৃতি - ফাইল ছবি

জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফি খান (১৯২৮-২০১৬), যিনি এম আর খান হিসেবে ছিলেন অতি পরিচিত। বাংলাদেশে ফাদার অব পেডিয়াট্রিকস হিসেবে খ্যাত অধ্যাপক খান ছিলেন একজন অনুকরণীয় ও প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। শিশু চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রবাদপুরুষ, শিশুবন্ধু, সমাজহিতৈষী, শিক্ষাবিদ, দক্ষ চিকিৎসা প্রশাসক ও সফল শিল্প উদ্যোক্তা যিনি সমাজসেবায় একাধারে একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। নির্লোভ, প্রচারবিমুখ, সদাহাস্য মানুষটি তার বিভিন্ন জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে সমাজে অসংখ্য মানুষকে সেবা দিয়ে গেছেন।

শিশুবন্ধু এম আর খানের জীবন দর্শন ছিল- কর্মচাঞ্চল্য আর মহৎ ভাবনার সরোবরে সাঁতার দিয়ে মানব কল্যাণে নিবেদিত চিত্ততা। নিবেদিতা মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট আর অগণিত শিশু চিকিৎসা সদন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার সেই স্বপ্নেরা ডানা মেলে ফিরেছে সাফল্যের আকাশে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিশু, নারী ও অসহায়জনের নতশির, মূক ও ম্লান মুখে হাসি ফুটিয়ে সাফল্যের তারকারা ঝিলিমিলি করে ফিরত তার ললাটে, তার মুখে-তার সানন্দ তৃপ্তির নিলয়ে।

সুদক্ষ পরিচালনায়, সাংগঠনিক দক্ষতায়, পৃষ্ঠপোষকতায়, নৈপুণ্যে, নিবেদনে স্বাস্থ্য ও সমাজসেবা খাতে অর্থবহ অবকাঠামো নির্মাণ ছিল তার ব্রত। এ সবের মাঝে চির ভাস্বর হয়ে রইবে তার স্মৃতি। ‘উপকার করো এবং উপকৃত হও’ এ মহাজন বাক্য তার জীবন ও কর্মে, মনন ও মেধায় পথ চলা ও জীবন সাধনায় স্বতঃসিদ্ধের মতো অর্থবহ হয়ে উঠেছিল। আর এসবের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় শিশুদের মতো সারল্যে, সহজিয়া কড়চায়, বন্ধু বাৎসল্যে, স্নেহাস্পদনায়, মুরুব্বিয়ানার মাধুর্যে ছিল তার ব্যক্তি ও চরিত্র উদ্ভাসিত।

জাতীয় অধ্যাপক ডা: এম আর খান মনে করতেন রোগীও একজন মানুষ। আর রোগীটি সামাজে আমাদের কারো না কারো আত্মীয়স্বজন, এমনকি আপনজন। রোগী যখন ডাক্তারের কাছে আসেন; তখন সাহায্য প্রার্থী, কখনো কখনো অসহায় বটে। আর রোগীটি যদি শিশু হয় তা হলে কথাই নেই। ডাক্তারের কর্তব্য হবে রোগীর কষ্ট গভীর মনোযোগের সাথে ধৈর্যসহকারে শোনা, রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। রোগীকে সুস্থ করে তুলতে সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা যেমন প্রয়োজন; তেমনি রোগীর অভিভাবকের প্রতি ডাক্তারের সহমর্মিতা প্রদর্শন ও আশ্বস্ত করাও প্রয়োজন। সব রোগী তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে এমনটিও ঠিক নয়। কারো কারো সুস্থ হতে সময় লাগতে পারে। মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে তিনি বলতেন, হায়াত ও মউতের মালিক যেমন আল্লাহ; তেমনি রোগ থেকে মুক্তিদাতাও তিনি। তবে রোগীর আপনজনরা এমন যেন বলতে না পারেন, ডাক্তার আন্তরিক ছিলেন না, ডাক্তারের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

মৃত্যুর আগে বেশ কয়েক মাস তিনি তার প্রতিষ্ঠিত সেন্ট্রাল হাসপাতালে পরিচর্যাধীন ছিলেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে ৯ সেপ্টেম্বর (২০১৬) ‘দুটি কথা’ শীর্ষক শেষ লেখায় তিনি বলেন- ‘মানুষ বাঁচে আশায়, দেশ বাঁচে ভালোবাসায়। আপনি আশা করেন এটা-ওটা করবেন। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আছে, কিন্তু আল্লাহ জানেন আপনি কত দিন এ দুনিয়ায় আছেন। সুতরাং আপনি যেটা ভালো মনে করেন এখুনি বা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করবেন। এ সুযোগ আর নাও আসতে পারে। ‘শুভষ্য শীঘ্রম’- রাম রাবণের একটা গল্প শুনাতে চাই। রাবণ বললেন আমি স্বর্গের সিঁড়ি বানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার সময় শেষ। সে জন্য আমি তোমাকে একটা উপদেশ দেবো, যদি তুমি কোনো ভালো কাজ করতে চাও স্টার্ট নাউ ডোন্ট ওয়েট ফর টুমোরো’।

এ প্রসঙ্গে তিনি তার জীবনের দু’টি ঘটনা তুলে ধরেন- প্রথমত, শিশুদের জন্য পথকলি নামে এক সংস্থায় কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হতো বর্তমান শেরাটন হোটেলের উত্তর দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাড়িতে। আমি তৎকালীন সরকারপ্রধানের কাছে তাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে একটা জায়গা চেয়েছিলাম। সেটি হলো মিরপুরের এশিয়া সিনেমা হলের উল্টো দিকে। এক বিঘা জমিতে একটি টিনের ঘর করে সেখানে আউট ডোর শুরু করা যেত। তখন পথকলি ট্রাস্ট গঠনের লক্ষ্যে অনেক টাকা উঠেছে; সেই টাকা দিয়ে ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে একটা প্রতিষ্ঠান চালানোর উদ্যোগ নেয়া যেত।

হাসপাতাল ও মসজিদ সবাই চান কেউ এর বিনাশ চান না। সরকারপ্রধান বললেন পরে হবে। এ বাড়িটা তো কেউ নিচ্ছে না, এখানে কাজ চলতে থাকুক। আমি স্থায়ী জায়গার জন্য আবেদন জানাই। তিনি বললেন দেখা যাক পরে হবে। কিছু দিনের মধ্যে পটপরিবর্তন হলো। পথকলি ট্রাস্ট বন্ধ হয়ে গেল। সব শেষ। অসচ্ছল শিশুদের সেবা সুযোগ মিলিয়ে গেল।

দ্বিতীয়ত, তৎকালীন আইপিজি এমআর বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে একটি জায়গা ছিল। আমি ও প্রফেসর নূরুল ইসলাম সাহেব (১৯২৮-২০১৩) এ হাসপাতাল বর্ধিত করার লক্ষ্যে ওই জায়গাটি হাসপাতালের নামে বরাদ্দের জন্য ভূমিমন্ত্রী আবদুল হক সাহেবের সাথে দেখা করি। কয়েক দিন যাতায়াতের পর সেখানে দেখলাম খুবই হইচই। আমি মন্ত্রী মহোদয়কে অনুরোধ জানালাম, স্যার কাজটা ভালো মনে করলে আজকে করে দেন। আপনার এখানে যে অবস্থা না জানি আপনি ক’দিন এ দায়িত্বে থাকবেন? মন্ত্রী মহোদয় বললেন আজ তো অফিস প্রায় শেষ কালকে আসেন।

আমি বললাম কালকে আপনি এ পদে নাও থাকতে পারেন। সবাই আমার কথায় অবাক। বললাম আজকে সম্ভব হলে করে দেন। সন্ধ্যায় আমাদের পিএ-কে টাইপ মেশিনসহ তার কাছে পাঠালাম, রাতের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে গেল। ভাগ্যের পরিহাস পরের দিন তার মন্ত্রিত্ব চলে গেল। সুতরাং শুভষ্য শীঘ্রম কত উপকারী। আমার এই দু’টি ঘটনা বলার উদ্দেশ্য- প্রথমটি পরে করবেন বলে রেখে দিলেন কিন্তু আর করতে পারলেন না। আর দ্বিতীয়টি তিনি যদি ওই দিন রাতে না করতেন তা হলে হয়তো এটিও হতো না।

‘দেশ বাঁচে ভালোবাসায়’ শিরোনামে তিনি আরো লিখেছেন- ‘আপনি টাকার ২.৫ শতাংশ জাকাত দেন। সময়ের জাকাত যদি ২.৫ শতাংশ ধরি তবে সপ্তাহে প্রায় ৪.৫ ঘণ্টা হয়। সপ্তাহে ২ দিন ২.১৫ মি., ২.১৫ মি. ঘণ্টা সময় দিতে পারেন। এতে অনেক ভালো ভালো কাজ করতে পারবেন। আপনারা সবাই ব্যস্ত আপনাদের সময় অনেক মূল্যবান। তবু সবার জন্য ২৪ ঘণ্টা সমান। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামারও ২৪ ঘণ্টা, আপনাদেরও ২৪ ঘণ্টা, আমারও ২৪ ঘণ্টা। ব্যাপার হলো এই ২৪ ঘণ্টা আমরা কে কিভাবে ব্যবহার করি। সেটিই ভবিষ্যতের সফলতা। যদি আপনি আপনার গ্রামের বা ইউনিয়নের বা উপজেলার বা জেলার একজন লোককে যদি ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন তা হলে তিনি তার পরিবারের, তার গ্রামের একজন আদর্শ মানুষ হতে পারেন। যার দ্বারা সমাজ ও দেশ উপকৃত হবে। তবে এর নেগেটিভ আসপেক্ট আছে, তিনি যদি লাঞ্ছিত, বাধাপ্রাপ্ত বা নির্যাতিত হন, তবে এ কাজ আর করবেন না। এমনকি তার আত্মীয়রা তাকে অন্যভাবে নিবৃত রাখার চেষ্টা করবেন।

এখানে আমি সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ থেকে একটি ঘটনা তুলে ধরব। নবকুমার ও তার সঙ্গীরা নৌকাতে করে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে রান্নার জন্য কাঠের প্রয়োজন হলো। তখন নবকুমারকে কাঠ সংগ্রহে একটা দ্বীপে নামিয়ে দেয়া হলো। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল, নদীতে জোয়ার এলো, কিন্তু নবকুমার আর ফিরে এলো না। তখন তার সঙ্গীরা মনস্থির করলেন, কতক্ষণ আর অপেক্ষা করব? তখন নবকুমারকে রেখে সঙ্গীরা চলে গেলেন। নবকুমারের ভাগ্যে আসলে কী ঘটেছিল আমরা কিন্তু জানি না। তাই সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘নবকুমারের কাষ্ঠ হরণের বিপর্যয় দেখিয়া যদি কেহ পর উপকারে ব্রতী না হন তাহলে তিনি মহা ভুল করবেন’। অর্থাৎ ভালো কাজে প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে কিন্তু আপনার যদি নিয়ত ঠিক থাকে, ধৈর্য, সাহস ও নিষ্ঠা থাকে তবে সফলতা আসতে বাধ্য।

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরএর সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement