১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ তকমা

সৃষ্টির-শ্রেষ্ঠ-তকমা - ফাইল ছবি

পেশায় আইনজীবী। আইনজীবীরা যখন যার পক্ষে থাকেন তখন তার পক্ষেই নির্বিচারে যুক্তিতর্ক করেন। নির্বিচার তর্কে কখনো লাউকে বেল আবার কখনো বেলকে লাউ বলতেও দেখা যায়। এ নিয়ে পরের কথা ছাড়াও ঘরের অনেক খোঁটা হজম করতে হয় আইনজীবীদের। যখন পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন (১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত) তখন মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম। মালয়েশিয়া এয়ারওয়েজে জীবনের প্রথম বিমান আরোহণ। পদে পদে বিপন্ন ও ভুল-বিচ্যুতি। হাস্যরসে ভরপুর ভুল-বিচ্যুতি নিয়েই আমার প্রথম ভ্রমণকাহিনী ‘টুইন টাওয়ারের দেশে’। ‘টুইন টাওয়ারের দেশে’ নিজের লেখা নিজে পড়ে মাঝে মধ্যে নিজে নিজেই হাসি। হাসির কারণ, বিমানে ওঠার শুরুতেই শুরু হয় বিচ্যুতি। ‘দুধ, চিনি ও লিকার’ পৃথক পৃথক থাকার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। মালয়ী বিমানবালা যখন কাছে এসে-
-Tea?
-Yes tea.
-Only tea?
-Yes only tea.

কথার পৃষ্ঠে কথা বলার পর গরম লিকার ঢেলে রেখে যায়। গরম লিকার মুখ দিয়েই শুরু হয় স্বভাব-সুলভ বন্দনা। বন্দনা করতে গিয়ে ‘Only tea’ শিরোনামের একটি রম্য প্রবন্ধে লিখেছিলাম, ‘দুধ-চিনিবিহীন কেমন যেন তিতা তিতা Only tea. ভাবছি এখানে এটিই নিয়ম। বিদেশ ভ্রমণ করতে গেলে সব ধরনের খাবার খাওয়া অভ্যাস করতে হয়। শৈশবে দাদাকে চিরতার পানি পান করতে দেখতাম। সকালে খালি পেটে চিরতার তিতা পানি পান করার সময় কাছে থাকলে আমাকেও ধরে গিলিয়ে দিতেন। দুধ-চিনিবিহীন পাতিমারা চায়ের তিতাপানি পান করা শৈশবে দাদার দেয়া চিরতার পানির চেয়ে বেশি তিতা হবে না।

আসলে এ রকম তিতা চা পান করাই ঠিক যাকে বলে খাঁটি চা। দুধ-চিনি মিশিয়ে আমরা চায়ের মৌলিকত্বই নষ্ট করে ফেলি। চায়ের নামে দুধ-চিনির গরম শরবত পান করি। দোকানে বসেই হুকুম করি, ‘দুধ-চিনি বেশি দিয়ে এক কাপ চা দাও’। দুধ-চিনি মিশ্রিত মিশ্রণটিকে এককাপ চা না বলে এক কাপ দুধ-চিনিও বলা চলে। আমার ধারণা, মিশ্রণ ও রূপান্তরে মানুষ বড়ই পটু। রূপান্তরের নব নব পদ্ধতির মধ্যেই মানুষ আধুনিক হচ্ছে। তাই অত্যাধুনিকতার লটবহরে মৌলিক বস্তু খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হয়।

মনুষ্য জগতের বাইরে, অন্যসব প্রাণী খাদ্যসহ আবশ্যকীয় বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ মৌলিক অবস্থায় প্রকৃতি থেকে সরাসরি গ্রহণ করে। মানুষের খাদ্য তালিকা থেকে মৌলিক বস্তু দিন দিনই লুপ্ত হচ্ছে। এ কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, মস্তিষ্কজাত কলাকৌশল ছাড়া অপরাপর ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে মানুষ অপেক্ষা অপরাপর প্রাণী অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল ও সামর্থ্যবান। যেমন- সবচেয়ে নিকৃষ্ট অসমর্থ প্রাণীর নবজাতক সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সামর্থ্য নিয়ে মাতৃজঠর থেকে বের হয়ে আসে, আর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সামর্থ্যরে মানবশিশুটি সবচেয়ে নিকৃষ্ট সামর্থ্যরে কারণে মাতৃজঠর থেকে বের করে (কখনো কখনো পেট কেটে) আনতে হয়। এ ছাড়া পরিপাকতন্ত্র, শীতাতপ ও প্রতিক‚ল পরিবেশে নিকৃষ্ট প্রাণীরাই উৎকৃষ্টদের চেয়ে বেশি ‘অভিযোজ্য, টেকসই ও পারঙ্গম’ (টুইন টাওয়ারের দেশে, পৃষ্ঠা ১১-১২)।

চাঁদে গিয়েছি। শুরু করেছি মঙ্গলে যাওয়ার পাঁয়তারাও। মিটার ও গজ-ফিতা নিয়ে, ‘মহাবিশ্বের বয়স এক হাজার ৪০০ কোটি বছর। তা হলে মহাবিশ্বের ভেতর দিয়ে আলো মাত্র এক হাজার ৪০০ কোটি বছর চলাচলের সুযোগ পেয়েছে। অতএব আমরা পৃথিবীতে বসে এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ যে দূরত্ব পর্যন্ত দেখতে পাই তা হলো, এক হাজার ৪০০ কোটি আলোকবর্ষ’ দূরের হিসাবটাও বের করে ফেলেছি।
বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের সময় ড. মুনীর উদ্দিন যখন বলেন, ‘জীবাণুগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে? রোগ-ব্যাধি সৃষ্টিকারক জীবাণুরা নিজেদের টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা নিজেরাই অর্জন করছে। অনেক জীবাণু এর মধ্যেই অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা রোধ বা ধ্বংস করে সফল চ্যালেঞ্জার হিসেবে টিকে থাকার দক্ষতা ও সক্ষমতা আর্জন করেছে’, তখন মানুষ হিসেবে নিজকে বড় অসহায় লাগে। অসহায় লাগার কারণ, এসব অদৃশ্য জীবাণু ছাড়াও দৃশ্য জগতে সর্দি-কাশির ব্যাক্টেরিয়াসহ পিঁপড়া, ইঁদুর, মশা-মাছি, তেলাপোকা, ছারপোকা, ঘুণপোকা, কেরিপোকা ও পামরিপোকা মানুষের প্রতিপক্ষ। মানুষ মশার সাথে যুদ্ধে হারতে শুরু করেছে সেই নমরুদের আমল থেকেই। এদের নির্মূল করা তো দূরের কথা, প্রতিরোধ করাও সম্ভব হচ্ছে না।

এক সকালে দেখা যাবে, চিচিঙ্গা গাছের একটি লতা দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে গেছে। উপরে উঠে গেছে কোনো প্রকার ডালপালায় ভর করা ছাড়াই। কাছে গিয়ে দৃষ্টিপাত করলেই দেখা যাবে, খাড়া দেয়ালে চুল পরিমাণ ফাঁক যেখানে পেয়েছে সেখানেই আঁকশির মাথা ঢুকিয়ে শার্শির মতো চেপে প্রিংয়ের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গাছটিকে চার তলায় নিয়ে গেছে।

জীবাশ্মের রেকর্ড থেকে জানা যায়, ১৫ কোটি বছর আগে অর্থাৎ জুরাসিক যুগের শেষ দিকেও পিঁপড়ার অস্তিত্ব্ ছিল। বাড়ি ও রাস্তার পাশে অচেনা ঝোপ-জঙ্গল, পুকুর, জমির আগাছা একদিক দিয়ে পরিষ্কার করতে না করতেই আরেক দিক দিয়ে গজিয়ে ওঠে। দূর্বাঘাসের বৈজ্ঞানিক নাম Cynodon dactylon. পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গেলেই পাওয়া যাবে, দূর্বাঘাস জুরাসিক যুগের আগেই ভূপৃষ্ঠ দখল করে বসে আছে।

কথিত আছে, অর্কিডসাদৃশ্য ফুলের সৌন্দর্যপ্রেমিক এক ব্রাজিলিয়ান পর্যটক অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এ দেশে কচুরিপানা নিয়ে আসেন। এরপর তা এতই দ্রুত বংশবিস্তার করতে থাকে যে, ১৯২০ সালের মধ্যে দেশের প্রায় প্রতিটি জলাশয় ভরে ওঠে। কয়েকবার বিষ প্রয়োগ করেও এদের মারা গেল না। বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ কচুরিপানা। এরা দ্রুত বংশবিস্তার করার জন্য প্রচুর পরিমাণ বীজ তৈরি করে, যা ৩০ বছর পরও অঙ্কুরোদগম ঘটাতে পারে। নদ-নদীতে চলাচল দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। পুকুর-ডোবা দখলসহ জমির ফসল ধ্বংস করতে শুরু করে।

বাধ্য হয়ে ১৯৩৬ সালে কচুরিপানা নির্বংশকরণ আইন জারি হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের প্রধান অঙ্গীকার ছিল কচুরিপানা ধ্বংস করা। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক নির্বাচনে বিজয় লাভ করে কচুরিপানা ধ্বংসে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ধ্বংস করা দূরের কথা, গত ৯০ বছরে কচুরিপানার টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেননি। অবহেলিত কীট-পতঙ্গ ও আগাছা। আমাদের মতো এদের কোনো স্কুল, কলেজ, সংঘ, সমিতি নেই। পুড়ে ফেললে কিংবা নির্বিচারে কাটাকুটি করলেও করে না কোনো প্রতিবাদ। বোবা প্রাণী ও আগাছারা পরাক্রমশালী মানুষকে চ্যালেঞ্জ করে টিকে রয়েছে লাখ লাখ বছর।

এসব নিন্দিত অবহেলিত প্রাণীর বিস্ময়কর সক্ষমতার মূল কোথায়? ধর্মের উত্তর, সব স্রষ্টার লীলাখেলা, বিজ্ঞানের উত্তর- Adaptability. Adaptability শব্দের অর্থ- অভিযোজ্যতা। অভিযোজ্যতার আভিধানিক অর্থ- ‘উদ্দেশ্য সাধনের উপযোগীকরণের ক্ষমতা বা প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্জিত শক্তি। বিজ্ঞানের ভাষায়, অপরাপর প্রাণীর মতো প্রকৃতির সন্তান ছিল মানুষও। আত্মরক্ষার জন্য পাথর ছিল প্রধান হাতিয়ার। শক্তির সাথে বুদ্ধি যুক্ত হওয়ায় পেছনে পড়ে থাকে অপরাপর প্রাণী। ‘সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ তকমা’ যুক্ত হয় মানুষের নামের পাশে।

মানুষের বুদ্ধি যত বাড়ছে তত কমছে শক্তি। বুদ্ধি আর শক্তি যেন পরস্পরের পরিপূরক। বুদ্ধির জোরে মানুষ সব শক্তির দায় চাপিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ওপর। কায়িক শক্তির সাথে ফুরিয়ে যাচ্ছে মানুষের ইন্দ্রিয় শক্তিও। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা ও জিহ্বা দিয়ে মানুষ যা উপলব্ধি করতে পারে- মশা, মাছি ও পিঁপড়া উপলব্ধি করতে পারে তার হাজারগুণ বেশি। এদের তুলনায় মানুষের কায়িক ও ইন্দ্রিয় শক্তি প্রায় শূন্যের কোঠায়। ইরানি বংশোদ্ভূত মার্কিন পরমাণু বিজ্ঞানী ড. মেহেরান খোশের মতে, ‘মহাভূমিকম্পের অশনি সঙ্কেত সুনামি হওয়ার আশঙ্কা। উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই মহাদেশ লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে, গুঁড়িয়ে যাবে আকাশচুম্বী অট্টালিকা, তলিয়ে যাবে বিশাল জনপদ, জলোচ্ছ্বাস ও ভূগর্ভে চাপা পড়ে মরবে চার কোটি মানুষ। মহাপ্রলয়ের সূত্রপাত হবে দক্ষিণ আমেরিকায়। ভূমিকম্পের পরিমাণ রিখটার স্কেলে ১০ থেকে ১৬। কখনো কখনো ছাড়িয়ে যেতে পারে ২৪-ও। বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙে পড়বে, মহাবিপর্যয়ে ডুববে মানবজাতি’ (দৈনিক যুগান্তর, ৫ ডিসেম্বর ২০১৫)। নূহ আ:-এর সময়ের মহাপ্রলয়ের মতো প্রলয় থেকে যারা বেঁচে যাবে তারা শূন্যের কোঠা শক্তি নিয়ে উল্লিখিত কীট-পতঙ্গ ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর বিরুদ্ধে কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে (ফেসবুক, কম ও সুখপাখির গল্প, পৃষ্ঠা : ১৩৪ থেকে ১৩৬)

মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি, আস্ফালন আর ক্ষমতার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়ে গেছে কোভিড-১৯। করোনাকালে পরাক্রমশালী মানুষকে জন্মান্ধ উইপোকার চেয়েও বেশি অসহায় মনে হয়েছিল। তখন লিখেছিলাম ‘মহামারীর নাম মুখে আনতেই সামনে চলে আসে প্লেগ। প্লেগের প্রথম ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যায় বিশ্বের আড়াই থেকে পাঁচ কোটি মানুষ। দ্বিতীয় ঢেউ আসে ১৩৪৭ সালে। এতে বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। প্লেগ পাল্টে দিয়েছিল বিশ্বের মানচিত্র। নিচের তলার সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ বেশি আক্রান্ত হওয়ায় ইউরোপে শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। পক্ষান্তরে, ১৭ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৩০ লাখ, মৃত্যুহার ১ থেকে ৪ দশমিক ৪। প্লেগের ঝড় শুরু হয়েছিল নিচের তলা থেকে আর করোনার ঢেউ শুরু হয় উপরতলা থেকে।

প্লেগকে মানুষ ভুলে গেছে- একদিন ভুলে যাবে করোনাকেও। ১২ মার্চ ২০২০ সাল থেকে এক বছরের মধ্যে নিজের ফেসবুক ওয়াল থেকে গোটা বিশেক প্রবন্ধ জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে- যার মধ্যে চারটি প্রবন্ধ কোভিড-১৯ সম্পর্কিত। কোভিড-১৯ প্লেগের চেয়েও ভয়াবহ হওয়ার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে রয়েছে অসংখ্য পোস্ট। ১২ মার্চ ২০২০, পোস্টে লিখেছিলাম- ‘হে জগতসমূহের পালনকর্তা, সর্ববিষয়ে মহাজ্ঞানী, পরম দয়ালু পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়, ক্ষমাপরায়ণ, পাপ মোচনকারী, শ্রেষ্ঠ রক্ষণাবেক্ষক, মহাঅনুগ্রহশীল, আ’লা কুল্লি শাইয়্যিন কাদির, মালিকুল মুলক, আ’লা কুল্লি শাইয়্যিন হাসিব, মহিমাময় মহানুভব, বিশ্বের বিজ্ঞান প্রযুক্তি অকার্যকর তোমার প্রেরিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটের কাছে। চরম আস্ফালনকারী বিশ্ব আজ শিশুর মতো বড়ই অসহায়। তোমার কীটাণুর কাছে বিশ্বের পরাশক্তি পরাজিত।

বিশ্বের এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ তুমি ছাড়া আর কেউ দেখাতে পারবে না। এমন এক মুসিবত যা থেকে কেউ কারো সাহায্যে এগিয়ে আসে না, এমনকি সুযোগ নেই পরিজনের কাছে থাকার। বিশ্ব জন্মের পর এত কঠিন সমস্যার মুখোমুখি আর কখনো হয়েছিল কি না তা আমাদের জানা নেই। শক্তিমান ও শাস্তিদানে কঠোর আ’লা কুল্লি শায়্যিন ওয়াকিল এ ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে অসহায় মানবজাতিকে মুক্তির পথ দেখাও। আমীন।

সুধীজন ও বিজ্ঞানের ভাষায় ‘মানুষ’ এখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোন স্তরে আছে? ‘আমি জানি না বিশ্বের কাছে আমি কীভাবে উপস্থাপিত হয়েছি, কিন্তু আমার কাছে নিজেকে মনে হয় এক ছোট্ট বালক, যে কেবল সমুদ্র তীরে খেলা করেছে এবং একটি ক্ষুদ্রতর ও খুব সাধারণ পাথর সন্ধান করেছে, অথচ সত্যের মহাসমুদ্র তার সামনে পড়ে রয়েছে যা অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে’ এই উক্তি বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, প্রাকৃতিক দার্শনিক, আলকেমিস্ট, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্যার আইজ্যাক নিউটনের।

৪০০ বছর আগের উপরে উল্লিখিত উক্তির সাথে মিল খুঁজে পাই, আধুনিক নিউরোসাইন্টিস্টরা যখন বলেন, ‘মানব মস্তিষ্ক সর্বাধুনিক কম্পিউটারের চেয়েও কমপক্ষে ১০ লাখ গুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। ...

আমরা মস্তিষ্কের মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ ক্ষমতা ব্যবহার করছি। প্রতিভাবান সফল ব্যক্তিরা মস্তিষ্কের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ব্যবহার করছেন।’ ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, Empty vessels make the most noise (খালি পাত্রে সবচেয়ে বেশি শব্দ হয়)। যাদের মধ্যে কম প্রতিভা তারা সাধারণত বেশি কথা বলেন- হইচইও তারাই বেশি করেন। নিউটন ও নিউরোসাইন্টিস্টের ভাষায় মস্তিষ্কের দিক দিয়ে মানুষ এখনো খালি পাত্র। তাই আস্ফালন উৎপাতও বেশি।

গত এপ্রিল ২০২২ সুইডেন ছিলাম। সুখ-শান্তির দেশ সুইডেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তন সুইডেন থেকেই শুরু হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণায়ও এগিয়ে রয়েছে সুইডেন। সুইডেন গিয়ে জ্ঞানের সন্ধান করতে গিয়ে প্রথমেই চলে আসে আলফ্রেড নোবেলের নাম। ইউরোপজুড়ে একসময় যার পরিচয় ছিল, ‘মৃত্যুর সওদাগর’। ‘মৃত্যুর সওদাগর’ থেকে সুখ-শান্তির প্রবর্তক! খোঁজ করতেই সামনে চলে আসে ভেক্টর ফ্রাংকেনস্টাইনের কথা। বিজ্ঞানী ভেক্টর ফ্রাংকেনস্টাইন মানুষকে কিভাবে অমরত্ব দেয়া যায়, নিজের সর্বস্ব দিয়ে জানার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। অনেক কষ্ট, পরিশ্রম ও ত্যাগে তিনি মানুষ সৃষ্টি করতে গেলেন। কিন্তু তা মানুষ না হয়ে, হয়ে গেল কুৎসিত, বিকৃত ও ভয়ঙ্কর এক দানব। লজ্জায়, ঘৃণায়, ভয়ে তিনি দানবকে সেখানেই ফেলে এলেন। কিন্তু দানব তার পিছু ছাড়ল না। তার সুন্দর সাজানো জীবনকে দুর্বিষহ নরকে পরিণত করে ছাড়ল।

তেমনি ইউরোপকে নরকে পরিণত করেছিল নোবেল পরিবার। দরিদ্র কৃষক পরিবারের ছেলে নোবেল, যার দাদা নাপিতের কাজ করত। নোবেলের বাবা ইমানুয়েলের ছিল বিস্ফোরক ও অস্ত্র তৈরির কারখানা। বিস্ফোরণে নোবেলের ভাই মারা যাওয়াসহ পুড়ে যায় কারখানা। একসময় সফল হন। তিনি উদ্ভাবন করলেন ডিনামাইট। বিশ্বের ২০টি দেশের ৯০টি শহরে নোবেলের কারখানা স্থাপিত হয়। নোবেল সাম্র্রাজ্য বিস্তৃত হতে থাকে। বাড়তে থাকে নতুন নতুন আবিষ্কার। ৩৫৫টি আবিষ্কারের প্যাটেন্ট পেয়েছিলেন আলফ্রেড নোবেল। আয় করেছিলেন লাখ লাখ ডলার। তার এই উদ্ভাবন লাখো কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। ফলে তাকে ডাকা হয় ‘মৃত্যুর সওদাগর’। বলা হতে থাকে- ‘মানুষ মারার উপায় উদ্ভাবন করে ধনী হয়েছেন নোবেল। তার নিজের নামের সাথে মানুষের ঘৃণা ও সমালোচনা মেনে নিতে পারেননি তিনি। ১৮৮৮ সালে তার ভাই লুডভিগ নোবেল ফ্রান্সের কান শহরে মৃত্যুবরণ করেন।

খবরটি ভুলভাবে পত্রিকায় মৃত্যু সংবাদের শিরোনামে লেখা হয়, ‘মৃত্যুর সওদাগর’ মারা গেছেন। খবরটি খুব বিচলিত করে তাকে। ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবের মতো হাজার হাজার মৃত আত্মা দুর্বিষহ করে তোলে। সব কিছু থেকে ধীরে ধীরে সরে দাঁড়ান আলফ্রেড নোবেল। এ সময় তিনি এমন কিছু করে যাওয়ার কথা ভাবেন, যার ফলে তার মৃত্যুর পর সবাই তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। আর এ জন্য তার সব সম্পদ দান করে করে একটি উইল করেন। উইলে লিখে যান, তিনি তার ৯৪ ভাগ সম্পদ পুরস্কার আকারে দান করতে চান। সে সময় তার সম্পদ ছিল ৩১০ কোটি সুইডিস ক্রোনা। আর ১৯০১ সাল থেকে তার নামানুসারে চালু হয় বিশ্বের অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার ‘নোবেল’। ধ্বংসের পরিবর্তে সৃজন করতে শুরু করে নোবেলের ডিনামাইট।

মানুষের অপরিণত মস্তিষ্কের কারণেই কি অস্থির ও অস্থিতিশীল বিশ্ব? মানুষের মস্তিষ্ক ৪-৫ শতাংশ থেকে যত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে তত স্থিতিশীল হবে বিশ্ব। এমআইটির নিউরোসাইন্টিস্ট প্রফেসর ফ্রান্সিস স্মিথের ভাষায়- ‘মানুষ যদি আবিষ্কার করতে পারে কেন সে অনন্য, তা হলে হয়তো সে নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে না। বরং এখনকার চেয়ে নিজকে বেশি শ্রদ্ধা করবে।’ মানুষ মানুষকে আবিষ্কার করতে পারলে বিশ্ব ধ্বংস না হয়ে স্বর্গ হবে। বিশ্বের প্রতি ইঞ্চি যেদিন ডিজিটাল প্রযুক্তির আওতায় চলে আসবে সেদিন অপরাধী অপরাধ ঢাকাসহ পালানোর ঠাঁই পাবে না, উঠে যাবে অপরাধও। অপরাধ কমে যাওয়ার সাথে সাথে কমে যাবে কোর্ট-কাচারিও।

মহাবিশ্ব যত বড়ই হোক, বল্গাহীন পাগলা ঘোড়া নয়। মস্তিষ্ক যত উর্বর হচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে, মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রক। ‘তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন তুলাদণ্ড (সূরা আর রাহমান, আয়াত-৭)। তুলাদণ্ডের আভিধানিক অর্থ- সূত্র ও নির্ভুল পরিমাপক যন্ত্র। এই উক্তির সমর্থন রয়েছে- ‘অভিকর্ষ গ্রহগুলোর গতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করে, কিন্তু এটি ব্যাখ্যা করতে পারে না, কে এগুলোকে গতিশীল হিসেবে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করে দিলো। বিধাতা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন এবং যা কিছু ঘটছে বা যা কিছু ঘটা সম্ভব, তার সবই তিনি জানেন’ (স্যার আইজ্যাক নিউটন)।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement