২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নারীর অধিকার : আন্তর্জাতিক সনদ ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা

নারীর অধিকার : আন্তর্জাতিক সনদ ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মহিলা। এ জনশক্তিকে অবহেলিত রেখে গোটা বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় পরিচালনের ক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণের জন্য রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম আদি ও প্রথাগত পেশা পতিতাবৃত্তি যা নারী সমাজের জন্য অসম্মানজনক, তা নিরোধ করার নিমিত্তে সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে নির্দেশনা রয়েছে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়া খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯(৩) এ বলা হয়েছে, ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক নারী-পুরুষের জন্য আইন সমভাবে প্রয়োগ হবে এবং আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। এ মর্মে সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ তা ছাড়াও নারীর সাথে সব প্রকার বৈষম্য দূর করার জন্য সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে, তা নিম্নরূপ-

‘১. কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। ২. রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন। ৩. কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না। ৪. নারী বা শিশুদের অনুক‚লে কিংবা নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’

সরকারি নিয়োগ লাভের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সুযোগের নিশ্চয়তা সংবিধান দিয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯(২)-তে বলা হয়েছে- ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’

আমাদের সমাজব্যবস্থায় এমন এক সময় ছিল যখন মহিলাদের ভোগের সামগ্রী বা সন্তান উৎপাদনের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে পুরুষের একটি সম্পদ বলে মনে করা হয়। স্বামীর মতামতকে উপেক্ষা করে নির্বাচনে নিজ পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দেয়ার কারণে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ঘটনা স্বাধীনতার পরও ঘটেছে। মোটা অঙ্কের যৌতুক ছাড়া কন্যাসন্তানদের বিয়ে দিতে না পারার একটি সংস্কৃতির গোড়াপত্তন হয়েছে খুবই জোরালোভাবে। কুসংস্কারের এ গতিরোধ করার জন্য যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০ প্রণয়ন করে যৌতুক দেয়া-নেয়াকে আইনগত অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

পরবর্তীতে আইনকে আরো যুগোপযোগী করার জন্য যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ প্রণয়ন করা হয়। নারীদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করার জন্য প্রণীত হয়েছে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধনী ২০০৩)’। আন্তর্জাতিক বিশ্ব নারীদের অধিকার রক্ষা ও বৈষম্য দূর করার জন্য জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৯ “Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women” নামে একটি সনদ প্রণয়ন করা হয় যার সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সম্মতিক্রমে ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ থেকে গোটা বিশ্বে কার্যকারিতা শুরু হয়। ওই সনদ ছাড়াও জাতিসঙ্ঘ সময়ে সময়ে বিভিন্ন সার্কুলার জারি করে নারীর সাথে সব প্রকার বৈষম্য দূর করার জন্য দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। নারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ‘দিবস’ পালন করা হচ্ছে। গণসচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য জাতিসঙ্ঘ এ পদক্ষেপ নিয়েছে।

নারীর প্রতি সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা বন্ধ করার জন্য ১৯৯৩ সালে জাতিসঙ্ঘ আরো একটি সনদ ঘোষণা করে যা “Declaration on the Elimination of Violence Against Women’ 1993” নামে পরিচিত। ওই সনদের ২ নং ধারা মোতাবেক, নিষ্ঠুরতা বলতে শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়। ওই সনদে বলা হয়েছে- “The form of violence specifically mentioned in the document include battery, dowry related violence, sexual abuse of children, marital rape, rape, female genital mutilation, sexual harassment, trafficking, forced postitution & others.”

আপন জন (স্বামী বা প্রাক্তন স্বামী বা Intimate Friend বা একই পরিবারভুক্ত কোনো ব্যক্তি) কর্তৃক নারীরা নির্যাতিত হয় যা Domestric Violence নামে অবহিত। ১৯৯৯ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যেও Domestric Violence-এর কোনো Legal Definition ছিল না। ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে Inspectorate of Constabulary নিম্ন বর্ণিত সংজ্ঞা প্রদান করে-

“The term domestic violence shall be understood to mean any violence by current or former parteners in an intimate relationship, wherever and whenever the violence occurs” নারীবাদী নেতারা Domestric Violence-এর ওই সংজ্ঞাকে নিম্নমানের (Narrow) মনে করে তা প্রত্যাখ্যান করে। তারপর Domestric Violence-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- “Domestric Violence should be broadened to include verbal abuse, intimidation, physical harassment, homicide, sexual assult and rape.’’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা violence-কে তিনভাবে ভাগ করেছে, যথা- ১. Self directorate violence, ২. Interpersonal violence ও ৩. Collective violence.

নারী ছাড়া পৃথিবীতে সভ্যতার সৃষ্টি ও প্রসার হতো না। অথচ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক, পারিবারিক ও প্রথাগত দিক দিয়ে নারীরা নির্যাতিত ও অবহেলিত। এমন এক সময় ছিল যখন হিন্দু সমাজের নারীদের স্বামীর শবদেহে অগ্নিসংযোগ করার সময় জ্বলন্ত চিতায় স্বেচ্ছায় পুড়ে মরতে হতো, এ প্রথাটি সতীদাহ প্রথা হিসেবে পরিচিত ছিল। এখনো হিন্দু সমাজে স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে মাছ-মাংস খেতে দেয়া হয় না।

প্রথাগতভাবেই নারীসমাজ অবহেলিত। এ প্রথা একটি কুসংস্কার। রাজা রায় মোহন রায় এবং ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এ কুসংস্কারগুলো বন্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শিক্ষা লাভের জন্য একসময় মুসলমান মেয়েদের স্কুল-কলেজে যেতে দেয়া হতো না। এ কুসংস্কারের শিকার বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। কিন্তু তিনি সে কুসংস্কার পায়ে ঠেলে নারীদের শিক্ষার জন্য অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন।

কুসংস্কার ভাঙার জন্য সুশিক্ষার প্রয়োজন। তবে আশার কথা এই যে, বাংলাদেশে মহিলাসমাজ লেখাপড়ায় অনেক এগিয়ে এসেছে। ফলে নারীসমাজ আত্মনির্ভরশীল হতে যাচ্ছে। এ আত্মনির্ভরশীলতাই নারীসমাজকে সম্মানের সাথে প্রতিষ্ঠিত করবে। একমাত্র শিক্ষাই সব প্রকার কুসংস্কার দূরীভূত করে নারীসমাজকে আত্মনির্ভরশীল ও আত্মমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পারে।

আমাদের রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতাসহ অনেক উচ্চ পদে মহিলাদের অবস্থান রয়েছে। কেউ উত্তরাধিকার সূত্রে রাষ্ট্রীয় পদ এবং কোথাও পারফরম্যান্সের মাধ্যমে পদোন্নতি পেয়ে সরকারের আমলাতান্ত্রিক গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশের নারীসমাজ অবহেলা বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেয়েছে। অভিজাত মহলে নারীসমাজ বাহ্যিক দিক থেকে হয়তো ভালো রয়েছে, কিন্তু সার্বিকভাবে দেশের নারীসমাজের উন্নয়ন বলতে যা বোঝায় সে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে পারেনি। তবে অনেক ক্ষেত্রে নারীরা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টায় রয়েছে, কোথাও কোথাও সফলতা পেয়েছে, কিন্তু তার তুলনামূলক সংখ্যা অনেক নগণ্য।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement