২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সৌদি আরব সফর

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সৌদি আরব সফর। - ছবি : সংগৃহীত।

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী এমবিএস খ্যাত মোহাম্মদ বিন সালমান ও বাদশা সালমানের সাথে ১৫ জুলাই জেদ্দার আস-সালাম প্রাসাদে বিভিন্ন ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইসরাইলের তেল আবিব থেকে তিনজন ডাকসাইটে ইহুদি সাংবাদিকসহ সরাসরি ফ্লাইটে জেদ্দা আসেন। এদের একজন গিল তামারি নামের ইহুদি সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে হারাম এলাকায় এবং মক্কার পবিত্র স্থানের পাশ দিয়ে গাড়ি চালান, আরাফাত পর্বতে সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেন। এসব এলাকায় প্রবেশ অমুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ। তিনি ইসরাইলের চ্যানেল-১৩ এর সাংবাদিক। তাকে সহায়তাকারী সৌদি নাগরিককে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই সফরে উভয় পক্ষে ১৮টি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইসরাইল হয়ে সৌদি আরব যাওয়ার সাথে ইরানের বিরুদ্ধে একটি বার্তা রয়েছে। সফরে চীন ও রাশিয়া ছাড়াও ইরানকে শায়েস্তা করার একটি গোপন অ্যাজেন্ডা রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ২০১৬ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইসরাইল সফর করেছিলেন বাইডেন। অতীতে বাইডেন দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানের জন্য ইসরাইলকে সেটেলমেন্ট আর না বাড়ানোর আহ্বান করেছিলেন। বিশেষ করে পশ্চিম তীরে না এগোনার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু বর্তমান সফরে তিনি পশ্চিম তীরও সফর করেছেন। ট্রাম্পের বানানো জেরুসালেম রাজধানীতে তিনি সময় অতিবাহিত করেন। এবার ফিলিস্তিনের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা ও ইসরাইলের জন্য ইতিহাসের সর্ববৃহৎ চার বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্যাকেজের ব্যবস্থা করেছেন। ইসরাইল প্রসঙ্গে, সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল-সৌদ সৌদি-ইসরাইল সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়ে বাইডেনের দাবির বিরোধিতা করেছেন।

মার্কিন-ফিলিস্তিনি সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ হত্যার তদন্তে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া থেকে এখন পর্যন্ত বিরত থেকেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন নিজেও কোনো শোকবার্তা দেননি। অবশ্য সাংবাদিকের খুনের ঘটনায় জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে আহ্বান করেছেন। বিষয়টি আহ্বানের চক্করেই দিন কাটাচ্ছে।

জনাব বাইডেন এমন একসময় এই অঞ্চলে গেছেন যখন বিশ্ব ব্যাপক অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখোমুখি। ইউক্রেন ক্রাইসিস বিশ্ব খাদ্য ঘাটতি, জ্বালানি সঙ্কট, মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যশস্যের জন্য আরব দেশগুলোতে মানুষের মনে শান্তি নেই। ইউক্রেন ও রাশিয়ার শস্য আমদানির জন্য বিশ্ব যেন হাহাকার করছে। বিভিন্ন দেশ মন্দার শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, এমন এক বৈশ্বিক দুর্যোগে বিভিন্ন মোর্চা গঠন ও রাশিয়া ও চীনের বিরোধিতা নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মঞ্চ উত্তপ্ত করার মতো বিষয় কেউ স্বাভাবিক ও সহজভাবে নেয়নি। মানুষ আগে দুর্যোগ থেকে বাঁচতে চায়।

মিসর থেকে সৌদি আরবে দুটি ছোট ছোট দ্বীপের দীর্ঘ-সম্মত স্থানান্তরে বাইডেন ঘোষণা করেন যে, তিরান ও সানাফি দ্বীপের শান্তিরক্ষী বাহিনী তাদের অবস্থান ত্যাগ করবে, ফলে দ্বীপ দুটিতে বিনিয়োগ ও পর্যটন বাড়বে। হোয়াইট হাউজের এই প্রচেষ্টায় তারা খুব একটি খুশি হয়ে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানাবে, তেমনটি হয়নি আর দ্বীপের দামতো সৌদি আরবই চুকিয়েছে।

নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গিয়েও বাইডেন সৌদি যুবরাজ সালমানের সাথে দেখা করতে বা কথা বলতে অস্বীকার করেন। সৌদি যুবরাজ তার সাথে কথা বলতে কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সৌদি আরবের কাছে নতুন অস্ত্র বিক্রি স্থগিত করেন বাইডেন। বিবিসি বলছে, বাইডেন ‘১৮ মাসের মাথায় এসে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলেন।’ সম্ভবত ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতা বাইডেনকে এমন মত পরিবর্তনে বাধ্য করেছে। তাকে বলতে হয়েছে, ‘আমেরিকা যখন বিশ্বে তাদের প্রভাব ধরে রাখতে চীন ও রাশিয়ার সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত, সেখানে সৌদিদের অবজ্ঞা করলে আমেরিকার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে।’ গত ১৮ মাস ধরে হোয়াইট হাউজের সাথে সম্পর্ক শীতল হয়ে যাওয়ায় সৌদিরা চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। চীনের সাথে সৌদি আরবের ব্যবসা বেড়েছে আর পুতিনের সাথে যুবরাজ সালমানের সম্পর্ক বেশ উষ্ণ। যুবরাজকে ক্ষমতা থেকে সরানো এখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। সৌদি আরবের প্রিন্সহুড এক অন্যরকম ডকট্রিন। মানবাধিকার ও জনরোষ এখানে কাজ করার উর্বর ভূমি নয়। এই সফরের পরিণতিতে হয়তো বাইডেনকেও চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।

গত দেড় বছর ধরে হোয়াইট হাউজের কাছ থেকে অবজ্ঞায় খুবই নাখোশ ক্ষমতাধর সৌদি যুবরাজ। তাই ইউক্রেন সঙ্কটে পুতিনকে একঘরে করার আমেরিকান চেষ্টায় সাড়া দেননি। দি আটলান্টিকের সাথে এক সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে সৌদি যুবরাজ বলেছিলেন, ‘আমার তাতে বিন্দুমাত্র আসে যায় না।’ তিনি জানান, সৌদি আরবকে অবজ্ঞা করলে ‘আমেরিকার জন্য তা হবে দুর্ভাগ্য এবং চীনের জন্য সৌভাগ্য।’ গত এপ্রিলে এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান সফরে তারই সঠিক প্রতিধ্বনি হয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের এক গবেষণা নিবন্ধে ডেনিস রস লিখেছেন, ‘সৌদিরা অভিযোগ করেছে যে, আমেরিকা কিছু চাইলে সাথে সাথে ফোন করে আর আমরা কিছু চাইলে ফোনই ধরে না।’ বিন সালমান মনে করেন, সৌদি আরবকে অবজ্ঞা করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়।

কূটনীতিকদের মতে, মার্কিনিদের আরো আরো জ্বালানি তেল দরকার। বিশেষ করে ইউরোপ ও মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার বিরোধিতা করায় তেলের সঙ্কটে পড়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তখন এদেশগুলোকে তেলের নিশ্চয়তা দিয়েছিল, বর্তমানে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তেলের বাজার চড়া বিধায় আরো তেলের প্রয়োজন। ৩০ জুন, ওপেক, রাশিয়া ও অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর কর্মকর্তারা আগস্টে প্রতিদিন ৬৪৮,০০০ ব্যারেল উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলেছেন। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বলেন, ২০২৭ সালের মধ্যে অপরিশোধিত তেলের উৎপাদন প্রতিদিন ১০ মিলিয়ন ব্যারেল থেকে বাড়িয়ে ১৩ মিলিয়নে উন্নীত করা যাবে। এমবিএস আরো উল্লেখ করেছেন যে, বিশ্ব অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন এবং শক্তির উৎস সম্পর্কিত অবাস্তব নীতিগুলো মুদ্রাস্ফীতিকে আরো প্ররোচিত করতে পারে। সৌদি আরবের এককভাবে করার কিছু নেই। সৌদি আরব আরো জানায়, তেল উৎপাদন বৃদ্ধি সৌদি সিদ্ধান্ত নয়, বরং অর্গানাইজেশন অফ দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (ওপেক) প্লাসের সিদ্ধান্ত, যার মধ্যে রাশিয়াও রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাই ভাবুক না কেন ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সৌদি তার উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে। সরাসরি এমন সব বক্তব্য বাইডেনকে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে নতুন হিসাব নিকাশ করার দিকে নিয়ে যাবে বৈকি!

সৌদি আরবে আলাপকালে প্রেসিডেন্ট বাইডেন আন্তর্জাতিক জ্বালানিবিষয়ক, স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিশেষ দূত আমোস হোচস্টেইনকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। সৌদি পক্ষে ছিলেন, আব্দুল আজিজ, এমবিএসের সৎ ভাই এবং ২০১৯ সালে সৌদি জাতীয় তেল কোম্পানি আরামকোর আইপিও তত্ত্বাবধান করার জ্বালানিমন্ত্রী। তিনি ওপেকের সৌদি প্রতিনিধি ও বৈশ্বিক এনার্জির সবচেয়ে সিনিয়র এবং শক্তিশালী ব্যক্তিত্বদের একজন। টেবিলজুড়ে আমেরিকান প্রতিনিধি দলে তার সমতুল্য কোনো কর্মকর্তা ছিলেন না। এনার্জি সচিব জেনিফার গ্রানহোলম এদিকে ভ্রমণও করেননি, বিভিন্ন বিষয়ে টুইট করেন।

সমালোচকরা বলছেন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার সফরের সময় সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার বিষয়টি আরো একবার উত্থাপন করা ছাড়া আর কিছু করতে পারেননি। যদিও সৌদি আরব এই অপরাধের একটি বিস্তারিত তদন্ত করেছিল এবং আটজন অপরাধীর বিচার করেছিল। খাশোগির ছেলে সালাহ পরে ঘোষণা করেন যে, সৌদি বিচার বিভাগ তার পরিবারের প্রতি ন্যায্য ছিল এবং তাদের পরিবার ন্যায়বিচার পেয়েছে; তবে খাশোগির প্রেমিকা ও বাগদত্তা হাতিস চেনগিজ এখনো সোচ্চার। পর্দার আড়ালে অনেক কথা রয়েছে যেমন- সৌদি প্রতিনিধি দলের সামনে বাইডেন ক্রাউন প্রিন্সকে জামাল খাশোগির হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।’ সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবেইর বলেন, তিনি এটা শুনেছেন বলে মনে পড়ে না। যখন বাইডেনকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সত্য বলছেন কিনা, তখন তিনি না বলেছিলেন- যার অর্থ একজন গুরুত্বপূর্ণ সৌদি কর্মকর্তা মিথ্যাবাদী ছিলেন! এমনকি নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রশ্ন তুলেছে যে, বাইডেনের অ্যাকাউন্টটি সঠিক ছিল কিনা। পত্রিকা উল্লেখ করে যে, তার এমন ঘটনাগুলো বর্ণনা করার ইতিহাস রয়েছে যা অন্যান্য সভায় অংশগ্রহণকারীদের মনে পড়ে না!

এমবিএস বাইডেনকে কিছু বিষয় দেখিয়ে দিয়েছেন যেমন, রিয়াদ ভালোভাবেই জানে যে, খাশোগি ইস্যুটি ওয়াশিংটন রাজনীতিকরণ করেছে। বাইডেন প্রশাসনের অভিযোগের জবাবে এমবিএস ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে ইরাকে মার্কিন সামরিক বাহিনী ও সিআইএ কর্মীদের দ্বারা সঙ্ঘটিত, আবু ঘারিবে নির্যাতন এবং বন্দী নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে জোর দিয়ে বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারিতেও দুর্বৃত্তপনার ঘটনা ঘটেছে। রিয়াদ এই বিষয়টির প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে, খাশোগিকে যে বছর হত্যা করা হয়েছিল, সেই একই বছরে সারা বিশ্বে ২৪৮ জনেরও বেশি সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছিল এবং কেউ তাদের সম্পর্কে কোনো কথা বলেনি।’ সৌদি ক্রাউন প্রিন্সকে এই আলোচনায় বেশি রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব ও দক্ষ বলে মনে হয়েছিল।

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স তাদের বৈঠকের সময় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বলেছিলেন যে সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড ‘দুঃখজনক’ হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতও পরিষ্কার নয় এবং অন্য সাংবাদিকদের দায়মুক্তি দিয়ে হত্যা করা হয়। বিন সালমান বিশেষভাবে ইরাকের আবু ঘারিবে মার্কিন সামরিক কারাগারে নির্যাতন-কেলেঙ্কারির কথাও উল্লেখ করেন বলে জানা যায়। কোল লিখেছেন : মার্কিন সরকার ইসরাইলিদের শিরিন এবং আরো ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের অনেক বেআইনি হত্যাকাণ্ডে বিব্রত নয়; তদুপরি বছরে ৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তার জন্য এবং বৃহত্তর ইসরাইল স¤প্রসারণবাদের সমর্থনে পুরো আমেরিকানদের ওপর কর আরোপ করা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরত হয়নি। তাহলে কেন বাইডেন প্রশাসন একজন মাত্র সাংবাদিককে হত্যার ঘটনায় সৌদি আরবকে বয়কট করার কথা বলছেন!

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইরানের কাছে ইতোমধ্যেই অন্তত কয়েকটি বোমা তৈরির যথেষ্ট সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে। বাইডেন ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ইয়াইর লাপিদ আবারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের অনুমতি দেয়া হবে না। ইসরাইল মনে করে ‘তাদের থামানোর একমাত্র উপায় হলো, টেবিলে একটি বিশ্বাসযোগ্য সামরিক হুমকি রাখা।’ কিন্তু বাইডেন তা করেননি। ১৮ মাস ধরে তিনি তেহরানকে পারমাণবিক অস্ত্র পরিত্যাগ করার জন্য অনুরোধ করেছেন এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন, অবরোধের জোয়ার সৃষ্টি করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে কষ্টকর নজরদারি এবং সৌদি আরবের ওপর হুতি বিদ্রোহীদের হামলার সমর্থনে চোখ বন্ধ করে রেখেছেন। এখন তেহরানও উল্টো যুক্তরাষ্ট্রকে অবরোধ দেয়া শুরু করেছে। ট্রাম্প পরমাণু চুক্তি এককভাবে লঙ্ঘন করে পুরো বিশ্বকে পরমাণু দুনিয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। নতুবা বর্তমান ইরান পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। বাইডেন নির্বাচনের সময় বলেছিলেন, তিনি ইরান পরমাণু চুক্তিকে রিভাইভ করবেন এবং এমবিএসের বিচার করবেন।’ তার কোনোটিতে এক চুলও অগ্রগতি করতে পারেননি।

এবিসি-র দিস উইক অনুষ্ঠানে বার্নি স্যান্ডার্স ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার অবসান ঘটাতে আহ্বান জানিয়েছেন। কূটনীতির মাধ্যমে এবং মার্কিন অস্ত্র ও সামরিক সমর্থন বন্ধ করে ইয়েমেনের এই যুদ্ধ শেষ করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই কাজে কংগ্রেসের পূর্ববর্তী দ্বিপক্ষীয় প্রচেষ্টায় ভেটো দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কংগ্রেসের কাছে এখন একটি বাস্তবতা তৈরি করার সুযোগ রয়েছে।

কংগ্রেসের অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সাল থেকে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা এবং অস্ত্র সরবরাহ করে ইরান ও হুতিদের বিরুদ্ধে জোটকে ক্রমাগত সমর্থন করে আসছে। ইয়েমেনে আক্রমণাত্মক অভিযান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রত্যাহারের জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আগের প্রতিশ্রুতি এখন পর্যন্ত শূন্য।

সঙ্কলিত তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৫ হাজারেরও বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে, হামলায় প্রায় ৯০০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। গত মাসে (জুন-২০২২), ওয়াশিংটন পোস্ট ইয়েমেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দোষারোপের বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে এই ধরনের হামলা চালানোয় ব্যবহৃত মার্কিন-উৎপাদিত অস্ত্রের প্রমাণ উল্লেখ রয়েছে। মার্কিন সরকার ইয়েমেনে বেসামরিক ক্ষতির জন্য কতটা দায়ী, এই প্রতিবেদন কিছুটা আলোকপাত করেছে। ইয়েমেনে সৌদি আরবের সমুদ্র, স্থল ও বিমান অবরোধের ফলে দেশটি খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ থেকে বঞ্চিত হয়ে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায়, সেখানকার মানবিক সঙ্কট প্রকট, এই অবস্থা ১০০,০০০ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে।

ইয়েমেনের এক কোটি ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ আজ অনাহারের দ্বারপ্রান্তে। ইউক্রেনের যুদ্ধ দুর্ভিক্ষকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে, কেননা ইয়েমেনের ৩০ শতাংশ গম আমদানি হয় ইউক্রেন থেকে। খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি’ সতর্ক করে বলেছে, চলতি বছরের শেষের দিকে ইয়েমেনে তীব্র ক্ষুধার পরিমাণ পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। ইয়েমেনের শহর বন্দরগুলো সিরিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ বিধ্বস্ত শহরের মতোই, তবে প্রচার কম। ক‚টনীতির মাধ্যমে এবং মার্কিন অস্ত্র ও সামরিক সমর্থন বন্ধ করে ইয়েমেনের এই যুদ্ধ শেষ করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কংগ্রেসের প্রচেষ্টায় ভেটো দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রশাসন কংগ্রেসে এখন একটি বাস্তবতা তৈরি করার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন। বাইডেন নিজেই ২০১৯ সালে স্বীকার করেছিলেন, ইয়েমেন বা অন্য কোথাও হোক না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনোই ‘কেবল তেল কেনা বা অস্ত্র বিক্রি করার নীতি পরীক্ষার জন্য দরজা উন্মুক্ত করবে না।’

গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর নেতাদের বৈঠকগুলো সাধারণত সার্থক হয়, এমনকি কোনও তাৎক্ষণিক ফলাফল পাওয়া না গেলেও। কিন্তু ব্যতিক্রম তো আছেই; এর একটি ছিল নেভিল চেম্বারলেইনের হিটলারের সঙ্গে ১৯৩৮ সালে মিউনিখের বৈঠক। আরেকটি স¤প্রতি সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বৈঠক!

মার্কিন-সৌদি সহযোগিতা পুনর্নির্মাণের জন্য বাইডেনের ভালো প্রচেষ্টা ছিল কিন্তু এই সফরটি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নিরাপত্তা স্বার্থকে অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে; বিশ্বের ক‚টনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন যে, সৌদি আরব ও অন্য উপসাগরীয় দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যথেষ্ট বিশ্বাস করছে না। আরব নেতাদের উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, ‘চীন, রাশিয়া বা ইরান যে একটি শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, সেরকম আমরা সরে যাব না।’

সংক্ষেপে বলতে গেলে, প্রেসিডেন্ট কোনো অগ্রগতি ছাড়াই সফরের সমাপ্তি টেনেছেন। শুধু তেলের ক্ষেত্রেই নয়, ইয়েমেনের শান্তি, অস্ত্র বিক্রি ও অন্যান্য বিষয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি। হোয়াইট হাউজ যেভাবে এই সফরটি পরিচালনা করেছিল তা এই ব্যর্থতাকে আরো জটিল করে তুলেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement
থাইল্যান্ডের রাজা-রাণীর সাথেপ্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ গ্যাস বিতরণে সিস্টেম লস ২২ শতাংশ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে : নসরুল হামিদ গণকবরে প্রিয়জনদের খোঁজ কক্সবাজারে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, স্বজনদের হাসপাতাল ঘেরাও বঙ্গোপসাগরে ১২ নাবিকসহ কার্গো জাহাজডুবি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশকে ‘নেট সিকিউরিটি প্রোভাইডার’ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি রাজশাহীতে টানা তাপদাহ থেকে বাঁচতে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা শরীয়তপুরে তৃষ্ণার্ত মানুষের মাঝে পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ জামায়াতের এক শ্রেণিতে ৫৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী নয় : শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নজিরবিহীন দুর্নীতির মহারাজার আত্মকথা

সকল