১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঘুমিয়ে থাকার সময় এখন নয়

ঘুমিয়ে থাকার সময় এখন নয় - ফাইল ছবি

সব ব্যাপারে অসত্য শুনিয়ে জনগণকে তা বিশ্বাস করতে বাধ্য করিয়ে বাংলাদেশ নিজের মতো শান্তিতে থাকতে পারবে, এমন আশা করা একেবারেই ঠিক হবে না। আমরা শ্রীলঙ্কার মতো ভয়ঙ্কর এক গণ-অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি কি না তা নিয়ে তর্ক না করে, সেখানকার সরকারবিরোধী গণবিক্ষোভ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে কি না তা নিয়ে বিশ্লেষণ করাই হবে বাস্তবভিত্তিক।

অসত্য প্রচারণা যতই করা হোক না কেন, সত্যকে মিথ্যা বা মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করা যায়নি। সত্য সত্যের জায়গায় রয়েছে। মিথ্যা মিথ্যার জায়গায়।

শ্রীলঙ্কায় স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এমন বিক্ষুব্ধ জনজাগরণ দেখা দিয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দুর্নীতি ও সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতার কারণে পরিবার-পরিজনসহ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। তার জন্য সৌভাগ্যের বিষয় হলো- জীবনে বেঁচে গেছেন তিনি। তার আপন দুই ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ও সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে।

তারা দেশে গণতন্ত্রের স্থলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাজতন্ত্রের আদলে রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে সবাইকে সুযোগ দিয়েছিলেন দুর্নীতি করে লাভবান হতে। ফলে দেশটির অর্থনীতিতে এমন অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি হয় যে, শেষ রক্ষার মতো কিছু আর অবশিষ্ট ছিল না।

এখন শ্রীলঙ্কায় কোনো সরকারের কর্তৃত্ব বলতে কিছু নেই। একই সাথে অর্থনৈতিকভাবে দেশটি দেউলিয়া হয়ে গেছে। সামরিক বাহিনীর সহায়তায় সরকার গঠনের চেষ্টা চলছে নৈরাজ্য থেকে দেশকে রক্ষায়। এই দেউলিয়া অবস্থা থেকে দেশটিকে উদ্ধার করতে প্রয়োজন হবে বাইরের আর্থিক সহায়তা এবং তা পেতে হলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক ও অন্যরা শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইবে। কিন্তু যে রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দিয়েছে এর মধ্যে এই স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দেয়া কারো পক্ষে সহজ কাজ হবে না। কোন ধরনের সরকার হবে তা নিয়ে সঙ্কটে আছে। সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবও অনিশ্চিত। একনায়কত্বের বিরুদ্ধে জনজাগরণ ঘটলে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনার মতো নেতৃত্বের অস্তিত্ব থাকে না। শ্রীলঙ্কার গণ-অভুত্থান কোনো রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছাড়াই হয়েছে। তাই সঙ্কট সামাল দেয়ার মতো রাজনৈতিক নেতা সেখানে আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

শ্রীলঙ্কায় আস্থাভাজন সংসদ থাকায় সামরিক শাসনের ঘোষণা দেয়ার প্রয়োজন হয়নি। সংসদের মাধ্যমে স্বল্পকালীন সরকার গঠন করা যাচ্ছে। সামরিক শাসন নিয়মতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার বিকল্প নয়। সামরিক কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক না কেন রাষ্ট্র পরিচালনার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ তাদের থাকে না। সামরিক বাহিনী কিছু সময়ের জন্য দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যাতে সরকার পরিচালনার রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি সম্ভব হয়। জাতির সঙ্কটকালে সামরিক বাহিনীর এরূপ দূরদর্শী ভূমিকাই কাম্য।

ব্রিটিশ কলামিস্ট এমএস রাইয়ান ‘ক্রিপলড : অসটারিটি অ্যান্ড দি ডিমোনাইজেশন অব ডিজঅ্যাবল্ড পিউপল’ শীর্ষক বইতে ব্রিটেনে কনজারভেটিভ পার্টিতে সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব গঠনের প্রতিফলন ঘটা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি এ কথা এমন সময় বলেন যখন দলটি রাজনৈতিকভাবে মুমূর্ষু অবস্থার কাছাকাছি অবস্থান করছিল। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘যখন কেউ মৃত্যুকালে উপস্থিত হয়; তখন তার চোখের সামনে যাপিত জীবন উদভাসিত হয়, তার ভাবনায় ধরা পড়ে তিনি কি তার সময়কাল বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যয় করেছেন, না অপচয় করেছেন? ভালো কাজ করেছেন, না ক্ষতিকর কাজ করেছেন? এর সাথে রাজনৈতিক মৃত্যুরও কোনো পার্থক্য নেই।’ তিনি অবশ্যই বিদায়ী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের রাজনৈতিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে সমগ্র কনজারভেটিভ পার্টির করণীয় সম্পর্কে সচেতন থাকতে বলেছেন।

বাংলাদেশেও আমরা ক্রমেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের মরণদশা দেখে আসছি। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফসল হিসেবে জন্ম নেয়া বাংলাদেশে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কেন বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বে পরিচালিত গণতন্ত্রের ব্যর্থতায় জনগণের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংগ্রামের মৃত্যু দেখতে হয়েছিল। বাংলাদেশ সৃষ্টির ভুল-ভ্রান্তি এমনই ছিল যে, আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানি একনায়কত্ববাদী শাসনের শোষণ, বৈষম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তাদের চিন্তায় ও কার্যক্রমে প্রতিফলিত করতে ব্যর্থ হন। তাদের এ ব্যর্থতাই গণতন্ত্রহীন একদলীয় শাসনের বাম রাজনীতির চিন্তাভাবনা দেশকে দুঃশাসনের আবর্তে ফেলে। জনগণের অধিকারে অবিশ্বাসী বাম রাজনীতি যা আমাদের জনগণের কাছ একেবারেই গ্রহণীয় নয়। সরকারও গণতান্ত্রিক মৃত্যু ঘটিয়ে নিজেদের বেঁচে থাকার শেষপ্রান্তে এসেছে।

আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তভাবে নিজেরা দেশ পরিচালনার সাহস ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। অন্যদের ওপর নির্ভরশীলতায় তারা স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা নিয়ে দেশ শাসনে অক্ষমতা দেখান। নেতৃত্বের এই দুর্বলতা জনগণের প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষার গুরুত্ব অনুভব করতে পারেননি। ক্ষমতা পেয়েই খুশিতে মাতোয়ারা হলেন।

শেষ বিচারে জনগণই যে সব ক্ষমতার উৎস তা ভুলে যাওয়া হয়। শ্রীলঙ্কায় জনগণের বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে জনগণের সার্বভৌম শক্তির বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। সরকার জনসমর্থনের ওপর নির্ভরশীল নয়, তাই জনজীবনের দুর্ভোগ ও অসহায়ত্ব সরকারের কাছে গুরুত্ব পায়নি সেখানে। সরকার পরিচালনার কারিগরদের মিথ্যাই সত্য বলে গৃহীত হয়েছিল সেখানে এতদিন।

স্বচ্ছ নির্বাচন না দিয়ে এবং জবাবদিহি ছাড়া শাসন চালাতে বাম ধারার কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রচিন্তা সুবিধাজনক বিবেচিত হওয়ায় আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতারা অবাধ নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে পারছেন না। সরকার পরিচালনায় চরমভাবে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও সরকার শান্তিপূর্ণ পথে বিদায় নেয়ার কথাও ভাবতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে গণবিক্ষোভের আশঙ্কা থাকতেই পারে। এখনই এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে তা বলছি না। তবে সরকারকে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে চিন্তা করতে নিশ্চয়ই বলব।

আন্তর্জাতিকমানের মুক্ত নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক মহলের চাপ বাড়ছে। তার পরও কিন্তু মনে হচ্ছে সরকার এখনো আগের মতো নির্বাচন চালিয়ে যাওয়ার চিন্তায় অটল। কারণ তাদের জনসমর্থনহীন ক্ষমতার ভিত্তি আগের মতোই অটুট আছে বলে তারা বিশ্বাস করেন। দুর্নীতির শক্তি তাদের কাছে অপরাজেয় মনে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সরকারের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের শান্তিপূর্ণ পথকে স্বাগত না জানানোর ব্যাপারটি মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। আমরা তাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ পথে পরিবর্তন সম্ভব করার মতো বিদ্যাবুদ্ধির এখনো সন্ধান পাচ্ছি না। দেশে সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার দল নেই বলেই মনে হয়। সরকার নির্বাচনে কারচুপি করতে পারলে কেনা-বেচার মাধ্যমে সবাইকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে পারবে- এই বিশ্বাস এখনো সহজ মনে করা হচ্ছে। সরকার যে ভেঙে পড়ছে, ঝুঁকি নেয়ার পরিস্থিতি যে আর নেই; সেই শুভবুদ্ধির সুযোগ থাকলে সরকার নিজেই বুঝত।

সরকারের সাফল্যের গল্প-কাহিনী জনগণের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে কাজে আসছে না। চাঁদাবাজি আর লুটপাটের কর্মকাণ্ড এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। গ্রাম-গঞ্জে শ্রদ্ধাভাজন মুরুব্বিদের কোনো ভূমিকা নেই। মাস্তানি রাজনীতির ভয়ভীতির মধ্যে সবাইকে থাকতে হচ্ছে।

হত্যা বা গুমের রাজনীতির অবসান হচ্ছে না। সম্প্রতি এক দিনের ব্যবধানে খোদ রাজধানীতে পুলিশ পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করেছে। জামিনের ব্যাপারে কড়াকড়ি থাকায় পুলিশ যাকেই গ্রেফতার করছে তাকেই জেল খাটতে হচ্ছে। জামিন পাওয়া ব্যক্তি যে আদালতের নিয়ন্ত্রণে থাকেন, সে কথা গুরুত্ব পাচ্ছে না। বিনা বিচারে জেলে বন্দী রাখা সম্ভব বলেই মিথ্যা মামলার বোঝা বেড়ে চলছে। মনে হচ্ছে অপরাধীরা বাইরে থেকে যাচ্ছে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমছে না। দুঃখী জনসমষ্টিকে অবহেলা করতে বা অন্যায়কারী ও দুর্নীতিপরায়ণদের মদদ দিতে দেশ স্বাধীন হয় না।

বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নির্ভরশীল থাকলে কিছু হবে না। আঁতাতের রাজনীতিতে অভ্যস্ত হওয়া বিরোধী রাজনীতিবিদদের দিয়ে কেউ পরিবর্তন আশা করেন না। রাজনীতির পারিবারিকীকরণ গণতান্ত্রিক নয়, এমন রাজনীতি দুর্নীতি ও দুঃশাসনের জন্য দায়ী। গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করে পারিবারিকীকরণের রাজনীতি থেকে মুক্তি পেতে হবে। নির্বাচনে কারা যোগ্য বিবেচিত হবেন, কাদের নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। নির্বাচন হবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে।

নির্বাচনের আশায় বসে থাকলে সঙ্কটের তীব্রতা বাড়তেই থাকবে। ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনীতিতে শূন্যতা সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক সঙ্কটের গণতান্ত্রিক সমাধান দিতে জানে না। তাই পরিবর্তন যে জরুরি সেকথা অস্বীকার করা যাচ্ছে না।

শ্রীলঙ্কার ঘটনাপ্রবাহ আমাদের সবাইকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। আমরা নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারি এবং দেশকে হিংসা-প্রতিহিংসার নৈরাজ্য থেকে রক্ষা করতে পারি, এটিই এখন মুখ্য কর্তব্য হওয়া উচিত। বিদেশীরা তো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমাদের সাহায্য করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু পরিবর্তন আনতে আমাদেরও সুচিন্তিত উদ্যোগ থাকতে হবে।

লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিসিডিপি গঠন করা হবে : পরিবেশমন্ত্রী অননুমোদিত জমি ভরাট কার্যক্রমের সন্ধান পেলে দ্রুত ব্যবস্থার নির্দেশ ভূমিমন্ত্রীর ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক ব্যক্তিকে গলা কেটে হত্যা ইসরাইলকে পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাতের ব্যাপারে সতর্ক করলো আইআরজিসি সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ১২৮তম প্রয়াণ দিবসে স্মরণ সভা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের শূন্য পদ দ্রুত পূরণের নির্দেশ ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে ঝুলন্ত নারীর লাশ উদ্ধার মধুর প্রতিশোধে সিটিকে বিদায় করে সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদ রাজশাহীতে ভুয়া তিন সেনা সদস্য গ্রেফতার ডেঙ্গুতে আরো একজনের মৃত্যু, আক্রান্ত ২৩

সকল