২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কুসংস্কার নামক শৈবালে

কুসংস্কার নামক শৈবালে - ফাইল ছবি

‘যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে/ সহস্র শৈবাল দাম বাঁধে আসি তারে’ যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়/ পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।’

কবিগুরু তার ‘দুই উপমা’ কবিতায় দেশ ও জাতি স্থবির হয়ে পড়ার জন্য জীর্ণ লোকাচারকে দায়ী করেছেন। জীর্ণ লোকাচারের চেয়েও ভয়ঙ্কর হলো, কুসংস্কার। শুধু দেশ আর জাতি নয়, কখনো কখনো দুর্বল জ্ঞানও আটকে যায় কুসংস্কার নামক শৈবালে। এই নিবন্ধে জীবন থেকে নেয়া তেমনই কিছু ঘটনা শেয়ার করছি।

স্কুলজীবনে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। যে স্কুলের শিক্ষার্থী সে স্কুলে বিজ্ঞান শাখা ছিল না। তাই নবম শ্রেণীতে ওঠার পর আমরা ক’জন চলে গিয়েছিলাম অন্য স্কুলে। প্রধান শিক্ষক আমাদের ধরে রাখতে তড়িঘড়ি বিজ্ঞান বিভাগ খোলেন। বৈদ্যেরবাজার এনএএম উচ্চবিদ্যালয়ে (বর্তমান পাইলট) আমরাই বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম ছাত্র। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে সবসময় বিজ্ঞানচিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করত।

পীরবাড়ির মেয়ে সালমা। তার দাদা বুজুর্গ আকবর শা রহ:-এর মাজারে এখনো সাড়ম্ভর ওরস পালিত হয়। সালমা ছিল ঠিক আমার বিপরীত। পানিপড়া, তাবিজ-তুমার, কবিরাজ এমনকি ভূত-পেতনিসহ জাদুটোনায়ও বিশ্বাস করত। যার মাথায় সর্বদা বিজ্ঞানচিন্তা গিজগিজ করে তার ঘরনী কুসংস্কার বিশ্বাসী হয় কী করে! সালমা একবার প্রচণ্ড দাঁতব্যথা নিয়ে কবিরাজবাড়ি গিয়েছিল। জানতে পারি, কবিরাজ আক্রান্ত দাঁত থেকে অনেক পোকা বের করেছে। কবিরাজ বাড়ি যাওয়াসহ দাঁত থেকে পোকা বের করার কথা শুনেই আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়। জানতে চাই-

-কবিরাজ বাড়ি গেছ কার অনুমতি নিয়ে? কবিরাজ বাড়ি গিয়ে যখন দাঁতের পোকাই বের করেছ তখন আবার গালে হাত দিয়ে ঢঙ করছ কেন?

-(উত্তেজিত হয়ে) কী, আমি ঢঙ করছি! ব্যথা বাড়ছে বলে গালে হাত দিয়ে চেপে রেখেছি। পোকার বাসায় নাড়া পড়েছে, ক্ষেপে গিয়ে সমানে কামড় শুরু করেছে। তাই ব্যথা বাড়ছে।

-বাহ চমৎকার যুক্তি। মুখ্যসুখ্য-বউ বিয়ে করে জীবনের শুরুতেই শুরু হয়েছে জ্বালা। এ জ্বালায় সারাজীবন জ্বলতে হবে।

-(‘মুখ্যসুখ্য’ শব্দটি মুখ দিয়ে বের করতে না করতেই গোখরা সাপের মতো ফোঁস করে ফণা তুলে) কে কইছে, কে কইছে আপনাকে মুখ্যসুখ্য বউ বিয়ে করতে? এই মুখ্যসুখ্য বউ বিয়ে করার জন্যই একদিন কেউ কেউ আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল, পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল। যারা শিক্ষিত তারা একটা শিক্ষিত বউ নিয়ে আসলেই পারত। এখনো পারবে, আরো তিন জন বিয়ে করতে পারবে। না করবে কে? দেশের মোড়ল-মাতবর অনেকেরই তো একাধিক বউ, আপনিও তো মোড়ল মাতবর হতে যাচ্ছেন। সংসারও বড়। আপনার আবার এক বউ থাকবে কেন? করবেন তো আপনিও, আজ হোক, কাল হোক- বিয়ে করবেনই।

-বাপ-দাদাদের সময় দেশে আইন ছিল না, এখন আইন হয়েছে। এক বউ থাকতে বউয়ের অনুমতি ছাড়া যদি আরো একটি বিয়ে করে, তাহলে তাকে বর্তমান স্ত্রীর দেনমোহরের সব টাকা পরিশোধসহ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। আমাদের বিয়ের কাবিন ৫০০ টাকা। চাকরি করে যে টাকা বেতন পাই, কাবিনের ৫০০ টাকাসহ জরিমানার পাঁচ হাজার টাকা পরিশোধও করতে পারব না, জেল থেকে রেহাইও পাব না।

-ওহ, এর মধ্যে দ্বিতীয় বিয়ের খোঁজ-খবরও নেয়া শুরু হয়ে গেছে। আমার শাশুড়ির কপালে যা আমার কপালে তো তাই হবে। আইনের ডর নেই। এখন নিয়ে আসেন কাগজ, লেখেন যা মন চায়, দিয়ে দিই বিয়ের অনুমতি। আমি এখনই চলে যাচ্ছি, বড়বাড়ির বউ হওয়ার সাধ শেষ।

-(বলেই শায়িত অবস্থা থেকে উঠতে যায়। জোর করে শুইয়ে দিয়ে) বিয়ের আগে ‘আগুনে ঝাঁপ, পানিতে ঝাঁপ’ কার জন্য দিয়েছি। তোমার জন্য। এ নিয়ে তুমিই যদি খোঁটা দাও তখন ‘যার জন্য করলাম চুরি, সে-ই বলে চোর’-এর মতোই কষ্ট পাই।

-কষ্ট আমিও পাই। অনেকদিন থেকে দাঁতের ব্যথায় ভুগছি। এ বিষয়ে ভালো-মন্দ সান্ত¡না না দিয়ে চোখ রাঙিয়ে মুখ্যসুখ্য বউ বলে খোঁটা দিতে শুরু করেন।

-ভুল হয়েছে, সরি সরি। আমার রাগটা ‘দাঁতে পোকা হয়’ এ কুসংস্কার বিশ্বাস করার জন্য। দাঁত থেকে পোকা বের করা কুসংস্কার। এটি এক ধরনের বাটপাড়ি।

-হয় হয়, একশবার পোকা হয়। বুঝলাম, পাশের গাঁয়ের কবিরাজ বাটপাড়, আপনার আপন চাচা তো বাটপাড় না!

-কোন চাচা?
-আপনার আপন চাচা কয়জন? মাস ছয়েক আগে চাচাও দাঁত থেকে পোকা বের করেছেন। আমি তো প্রথম চাচার কাছেই গিয়েছিলাম। চাচা এখন আর দাঁতের পোকা বের করার কবিরাজি করেন না বলে জানান।

-তোমার দোষ দিয়ে লাভ নেই। চাচাও একদিন বিশ্বাস করতেন, দাঁতে পোকা হয়। দাঁত থেকে পোকা নামাতে লোকজন আসত অন্য গাঁ থেকেও। চাচা আদা, রসুন, এলাচি, তেজপাতা ও ফেনকচুর ডাঁটা পানিতে মিশাতেন। মিশ্রণটি চুলায় তুলে সিদ্ধ করলে তীব্র গন্ধ বের হয়। তীব্র গন্ধের গরম মিশ্রণটি নলওয়ালা কোনো পাত্রে (বদনিতে) রেখে, মুখ দিয়ে যে বাষ্প বের হয় সে বাষ্প মুখে নিতে হয়। কষ্টকর কাজটি করার সময় মিশ্রণের তীব্র গন্ধে দাঁতের পোকা বের হয়ে আসে। কাজ শেষে মিশ্রণটি কুলা বা এরকম পাত্রে ঢেলে খুঁজলেই পোকা পাওয়া যায়। মুখ থেকে গরম মিশ্রণে টপাটপ করে পড়া মৃত অসংখ্য পোকা আমি নিজেও দেখেছি। আমার চিরায়ত বিশ্বাসের সাথে মিল না পাওয়ায় শুরু করি অনুসন্ধান। উত্তর পেয়ে যাই অল্পক্ষণেই। যেসব উপাদান নিয়ে মিশ্রণটি তৈরি করা হয় সেসব উপাদানের মধ্যে সন্দিগ্ধ ফেনকচুর ডাঁটা। কারণ, গাছের যে ডাঁটাটি পচা, মিশ্রণের জন্য সেটিই নেয়া হয়। চাচার পরীক্ষায় দাঁতের কীট প্রাপ্তির পরপর খুঁজে বের করি সেই ফেনকচু যে ফেনকচুর ডাঁটা এনেছিলেন চাচা। একটি পচা ডাঁটা ফাঁক করতে গিয়ে দেখতে পাই ডাঁটার ভাঁজে ভাঁজে কিলবিল করছে কীট। চাচাকে কীট দেখানোর পর থেকেই কবিরাজি ছেড়ে দিয়েছেন চাচা।

-কালকের কবিরাজ বেটার পোকা বের করাটা সত্য, একেবারে চোখের সামনে। আমরা যাওয়ার পর লোকটি ওষুধের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে যায়, আসে ঘণ্টাখানেক পর। হাতে একটি শিকড়ের মতো নিয়ে। হা করার পর শিকড়টা মুখের ভেতর দাঁতের কাছে নিয়ে যায়। মুখ থেকে বের করে শিকড়ে টোকা দিলেই দু’তিনটি করে পোকা পড়ে।

-কবিরাজ এই ঘণ্টাখানেকের মাঝেই খুঁজে বের করেছে পোকাটা। বেদের মেয়েরা তো এ পোকা তুলার ভেতরেই গুঁজে রাখে। স্কুলে একবার দাঁতে পোকা থাকা না থাকা নিয়ে তর্ক হয়েছিল। সব শিক্ষক একদিকে আর আমি একদিকে। স্কুলের শিক্ষকরাও বিশ্বাস করতেন, দাঁতে পোকা হয়। স্কুলের কাছেই ছিল বেদের বহর। তর্কের নিষ্পত্তির জন্য দাঁত ব্যথার অভিনয় করে বেদের বহরের কাছে যাই। পয়সার লোভ দেখালে এক বেদেনী পোকা বের করতে সম্মত হয়। বেদেনী হাতের তুলা অদলবদল করে মুখে রাখে, আবার মুখ থেকে বের করে। ৩০ মিনিটের মধ্যে মুখ থেকে বের করে আনা শেষ তুলা থেকে পোকা বের করে দেখায়। একেবারে তাজা জ্যান্ত পোকা। এর পরও শিক্ষকদের মন থেকে দ্বিধাদ্ব›দ্ব দূর হয়নি।

-আপনি কি ভূত-পেত্নী, এ সবও বিশ্বাস করেন না?
-না, করি না। আমার বাবাও বিশ্বাস করতেন না। একবার নায়েব আলী চাচার ঘর থেকে মাদুলির ছড়া খোয়া যায়। চাচা তেতৈতলা থেকে শালুভ‚ষণধারী এক ফকির নিয়ে আসেন। রাতে আসর বসিয়ে জিন হাজির করবেন। জিন সবার সামনে চোরের নাম বলে দেবে। জিন নামানোর প্রথম শর্ত, ঘর থেকে কেউ বের হতে পারবে না। এ আদেশ অমান্য করে বের হয়ে জিনের সামনে পড়লে প্রাণহানির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ কথার পর কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার দুঃসাহস দেখায়নি। জিন যে ঘরে হাজির হবে, অনেকের সাথে সে ঘরে উপস্থিত ছিলাম আমিও। গভীর রাতে প্রথমে পরপর টিনের ঘরের চালে কয়েকটি ঢিল পড়ে। ঢিলের সাথে সাথে পিনপতন নীরবতা। সেই সময় চিকন সুরে পাতার বাঁশির সুর কানে আসে। এখনই হাজির হবে জিন। সবার সামনে প্রকাশ করবে চোরের নাম। ভয় ও উত্তেজনায় একেবারে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা।

এমন সময় আর্তচিৎকারের শব্দ কানে আসে। নিশ্চয়ই কোনো হতভাগা কবিরাজের আদেশ অমান্য করে বাইরে বের হয়েছিল। আহারে, কোন মায়ের কোনো পুত যেন! জিন লাশ না বানিয়ে ছাড়বে না। ঘরের মধ্যে ডাকাডাকি করে কবিরাজকে না পেয়ে কেউ একজন দরজা খোলেন। দরজা খোলার পর কয়েকজন বের হয়ে যায় আর্তচিৎকার যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে। মাইরের চোটে ধরাশায়ী হতভাগার কাছে বাতি নিয়ে দেখতে পায়, স্বয়ং শালুপরিচ্ছদধারী কবিরাজ বেটা। সবাই ধরেই নিয়েছিল, জিন কবিরাজের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কবিরাজকে ধরাশায়ী করার ‘জিন’ ছিলেন আমার বাবা স্বয়ং।

পরের ঘটনাটি ঘটেছিল তোমাদের ঘরের পাশে। নতুন গোরস্তানের ভূত নিয়ে। রাস্তা থেকে অনেক দূরে ছিল গাঁয়ের গোরস্তান। অনেকেই গোরস্তানের ভূতের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। সর্বশেষ আক্রান্ত ব্যক্তি আবদুর রহমান মুন্সি। তিনি সম্পর্কে আমার তালই হন। তার ছিল মুদি দোকান। গ্রাম থেকে তিন মাইল দূরে চন্দনপুর বাজার। সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে। হাটের দিন সকালে মাথায় করে সওদা নিয়ে বাজারে যান, ফিরে আসেন সন্ধ্যার পর। রাতও হয়ে যায় কোনো কোনো দিন। এমনই এক রাতে মাথার বোঝাসহ আসার পথে যখন গোরস্তান বরাবর আসেন; তখন পেছনে ঠকঠক আওয়াজ শুনতে পান। ভয়ে গায়ের পশম খাড়া হয়ে যায়। একনজর পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পান, একটি জানোয়ারের আকৃতি লাফিয়ে লাফিয়ে তার দিকেই আসছে। ভয়ে শরীর ঢোলের মতো ফুলে যায়। মাথায় বোঝা, হাতে কেরোসিন তেলের টিন। টিন ফেলেই বোঝাসহ সাধ্যমতো দৌড়াতে শুরু করেন গাঁয়ের দিকে। পেছন পেছন আসতে থাকে জানোয়ারটাও।

গাঁয়ের প্রথম বাড়ির কাছে এসেই চিৎকার দিয়ে পড়ে যান। পড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই অজ্ঞান। সারা গাঁয়ের লোক তাকে দেখতে যায়। দেখতে গিয়েছিলাম আমিও। ডেকে আনা হয়েছিল পাশের গাঁয়ের কবিরাজও। জ্ঞান ফিরে আসার পর কবিরাজ জবানবন্দি নিতে শুরু করেন। জবানবন্দি শোনার পর কবিরাজ ‘ভয়ঙ্কর খারাপ আত্মার কর্ম’ মর্মে রায় দেন। নতুন গোরস্তানে পাশের গাঁয়ের এক মেয়েকে কবর দেয়া হয়েছিল। মেয়েটি মরেছিল ফাঁসি দিয়ে। ফাঁসির মরার আত্মাই নানা বেশে মানুষ খোঁজে।

গোরস্তানের ভূত ওই মৃত মেয়ের আত্মা। বড় করে ভোগ না দিলে দূর হবে না। সারা গ্রাম থেকে চাল ও টাকা তুলে ভোগ দিতে হবে। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে কবিরাজের যুক্তি মানতে পারছিলাম না। আমি না মানলে কী হবে, গাঁয়ের সবাই কবিরাজের পক্ষে।

যে ঘাট দিয়ে রহমান মুন্সি উঠেছিলেন সে ঘাটের দু’দিকে ঝোপঝাড়। আমরা কয়জন অনুসন্ধিৎসু চোখ নিয়ে ঝোপঝাড়ের পাশে ঘুরছিলাম। হঠাৎ একটি ভেড়া চোখে পড়ে। ভেড়াটি ধরে মুন্সি সাহেবের কাছে এনে জানতে চাই-

-দেখুন তো, আপনাকে যে জানোয়ারটা তাড়া করেছিল দেখতে এমন কি-না?
-অনেকটা এমনই।

পাশের গাঁয়ের লোকের কিছু জমি আছে গোরস্তানের পাশে। দিনের বেলা যখন হালচাষ করতে আসেন তখন গরু-বাছুরের সাথে ভেড়াটিও ছিল। ভুলক্রমে ভেড়াটি আর গরু-বাছুরের সাথে যেতে পারেনি। শিয়ালের ভয়ে লুকিয়ে ছিল করলা ক্ষেতের ডেরায়। ভীতসন্ত্রস্ত ভেড়াটি মানুষের পায়ের শব্দ পেয়েই সঙ্গ নেয় গাঁয়ে আসতে। আমার কথা আর কে শোনে, মৃত মেয়ের দুষ্ট আত্মা দূর করার জন্য পরদিনই শুরু হয় চাল তোলা।

মোল্লাবাড়ির ঢিলমারা জিনও আমরাই তাড়িয়ে ছিলাম। বেলা ডুবলেই শুরু করত ঘরে ঢিলমারা। টিনের চালে ঢিলের কারণে সন্ধ্যার পর কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস করত না। মহিলারা লোটা নিয়ে অজু করতে বের হলে জিন হাত থেকে পানির লোটা ছিনিয়ে নিয়ে যেত। তিন মাস ধরে চলতে থাকা জিনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হুজুরের কাছে যান। মসজিদের হুজুর বদ জিনের কাণ্ড মর্মে বর্ণনা করেন। তার বর্ণনায়- মসজিদের পাশেই ছিল শত বছরের পুরনো কুড় (গভীর মজাপুকুর)। কুড়ে গাবগাছের গোড়ার মতো বড় বড় গজার মাছ ভেসে থাকত। এগুলো অভিশপ্ত বদ জিন। বদ জিন তাড়াতে হলে খরচ করতে হবে। সারা গাঁ থেকে চাল তুলে খরচ করার আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় জিনের খবর কানে পৌঁছে। জুনিয়র বন্ধুদের নিয়ে এক রাতেই রহস্য বের করে ফেলি। যে হুজুর বদ জিনের কাহিনী সাজিয়ে মহাযজ্ঞের আয়োজন শুরু করেছিলেন সে হুজুরের ছেলেই ছিল ঢিলমারা জিনের নাটের গুরু। এতসব ঘটনার পরও তুমি আমার কথা বিশ্বাস না করে ওই বাটপাড় কবিরাজ বেটার কথা বিশ্বাস করবে?

-আমি এত সব বুঝি না। দাঁতের ব্যথার কী করবেন করেন। নয়তো কালই আমি আপনাদের বাড়ি থেকে চলে যাব। দাঁতের ব্যথা না সারা পর্যন্ত আর আসব না। দাঁত ব্যথা নিয়ে আমি আপনাদের বাড়ির কোনো কাজই করতে পারব না।

-কাল শনিবার। আনন্দবাজার হাট। হাটে একজন দাঁতের ডাক্তার বসেন। হাটের দিন গরুর হাটের উত্তর দিকের রাস্তায় চাটাই পেতে পসরা সাজিয়ে দাঁতের চিকিৎসা করতে দেখেছি। চাটাইয়ের ওপর থাকে নানা রকমের দাঁত ও মাড়ির ডাইস। দাঁত উঠানোর সরঞ্জামও আছে। অনেকে এখান থেকে দাঁত তোলেন। হালকা পাতলা বয়স্ক দাঁতের ডাক্তার। অভিজ্ঞ। কাজ করতে করতেই চুল পেকেছে। কালই যাব আনন্দবাজার। দাঁতের ডাক্তার না নিয়ে বাড়ি ফিরব না।

পরদিন আনন্দবাজার গিয়ে পেয়ে যাই ডাক্তারকে। নদী পার হয়ে গাঁয়ে আসতে চাননি কিছুতেই। নদী পারাপার খরচ বাদ দিয়ে ১০ টাকা দিতে সম্মত হওয়ার পর রাজি হন। পাঁচ টাকা অগ্রিম দিয়ে আসি। পরদিন সকাল ১০টার মধ্যেই আসেন দাঁতের ডাক্তার। সব দেখে শুনে, দাঁতটি উঠিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। উঠিয়ে ফেলার কথা শুনে সবাই ভয় পেয়ে যায়। আমাদের ভয় পেতে দেখে ডাক্তার অভয় দিয়ে বলেন,

-চেতনানাশক ইঞ্জেকশন দিয়ে নেব, দাঁত তুলতে রোগী টেরই পাবে না। সামান্য জ্বালাপোড়া করবে। পরে একবার এসে মাপটা নিয়ে যাব। নতুন দাঁত লাগানোর পর বুঝতেই পারবে না দাঁত উঠানোর বিষয়টি। সব শুদ্ধ টাকা বিশেক খরচ পড়বে।

দাঁতের গোড়ায় ইঞ্জেকশন দেয়ার সময়ই কান্না শুরু করেছিল সালমা। বাঁকানো প্লাস দিয়ে টানাটানির সময় রক্তারক্তি অবস্থা। রক্তারক্তি অবস্থার পর দেখা গেল, যে দাঁত উঠানোর কথা সেটি না উঠিয়ে পাশের অন্য একটি দাঁত উঠিয়ে ফেলেছে। তা দেখে চিকিৎসকের সাথে হইচই শুরু করি। তার যন্ত্রপাতি আটক করতে যাই। আমার মারমুখো অবস্থা দেখে পাঁচ টাকা না নিয়েই ভয়ে সটকে পড়েন দাঁতের ডাক্তার। (‘সালমার সংসার’ ৭৫ পৃষ্ঠা থেকে ৭৯ পৃষ্ঠা সংক্ষিপ্ত)। পরিপক্ব উচ্চ বুদ্ধিসম্পন্ন জ্ঞানই প্রজ্ঞা। আল্লাহ বলেন, ‘শপথ প্রজ্ঞাময় কুরআনের (৩৬ : ২)। ‘(হে রাসূল আপনি) বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে যারা উচ্চ বুদ্ধিসম্পন্ন (সূরা আজ জুমার, আয়াত-৯)’। বোধ বুদ্ধিসম্পন্ন লোক আল্লাহ পছন্দ করেন।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্যের বিকল্প নেই : ডা: শফিকুর রহমান সোনাগাজীতে জামাতে নামাজ পড়ে বাইসাইকেল পুরস্কার পেল ২২ কিশোর গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা ভিয়েনায় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের ইফতারে ইসলামিক রিলিজিয়াস অথোরিটি আমন্ত্রিত এবার বাজারে এলো শাওমির তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি

সকল