২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চীনের সলোমন দ্বীপপুঞ্জে অবতরণ

চীনের সলোমন দ্বীপপুঞ্জে অবতরণ - ফাইল ছবি

গত জুনের শুরুতে সলোমন দ্বীপপুঞ্জে চীন সামরিক লোকবল জড়ো করে। তবে চীনের তরফ থেকে বলা হয়েছে হোনিয়ারাতে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের কোনো ইচ্ছা নেই। একটি ফাঁস হওয়া গোপন নথিতে সলোমন দ্বীপপুঞ্জে চীনের সামরিক উপস্থিতির বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে বলে পশ্চিমারা প্রচার করছে।

সলোমন দ্বীপপুঞ্জের সরকার চীনের সাথে নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল ওই চুক্তি স্বাক্ষরের ঘোষণা দেয় বেইজিং। স্বাক্ষরিত এই নিরাপত্তা চুক্তি পশ্চিমের প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। তারা বলছেন, এটি চীনা সামরিক বাহিনীকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশের নৌপথ খুলে দেবে। পশ্চিমারা দাবি করছেন, চীনের সাথে করা এ চুক্তির বিষয়টি গত মাসে ফাঁস হলে পুরো অঞ্চলে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে খসড়ায় সলোমন দ্বীপপুঞ্জে চীনের নৌবাহিনী মোতায়েনের কথা থাকায় বিষয়টি এত গুরুত্ব পায়। চুক্তিটি ঠেকাতে কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া।

কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। সলোমন থেকে অস্ট্রেলিয়ার দূরত্ব দুই হাজার কিলোমিটারের কম।
চীনের এই চুক্তি পুরো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শিপিং লেনগুলোতে আধিপত্য বিস্তার ও অনুসন্ধান বাড়িয়ে তুলেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ‘গেম চেঞ্জিং এগ্রিমেন্ট’কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দ্বীপগুলোতে ব্যাপক সফর করছেন। চুক্তিকে চীন বলছে, ‘কমন ডেভেলপমেন্ট ভিশন’। অস্ট্রেলিয়া এখানের কিছু সহযোগী দ্বীপরাষ্ট্রসহ পুশব্যাক করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলোর অধিবাসীরা চীন ও বিভিন্ন সুপারপাওয়ারের ভক্ত।

দ্বীপপুঞ্জকে নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই) প্রস্তাব করেছেন। জিএসআই-এর লক্ষ্য ন্যাটো ও কোয়াড-কে প্রতিহত করার জন্য একটি এশিয়ান সিকিউরিটি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা। এশিয়ায় ন্যাটোর সম্প্রসারণের ব্যাপারে বেইজিং সতর্ক হয়ে উঠছে। চীন এরই মধ্যে কোয়াডকে ‘এশীয় ন্যাটো’ বলে অভিহিত করেছে। মার্কিন মিত্র জাপান, ফিলিপাইন ও দক্ষিণ কোরিয়া নিয়েও বেইজিং উদ্বিগ্ন।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এবং ফেডারেটেড স্টেটস অব মাইক্রোনেশিয়া দেশগুলোয় নিয়মিত যোগাযোগ করছেন। ভানুয়াতু, টুভালু, ফিজি, সামোয়া, টোঙ্গা, পাপুয়া নিউগিনি, পূর্ব তিমুর এবং কিরিবাতি- এসব ১০টি ছোট ছোট দ্বীপ চীনের কৌশলে রয়েছে। এই দ্বীপগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাইওয়ানের সাথেও কিছু কিছু দ্বীপের সম্পর্ক রয়েছে। বর্ণিত চুক্তি অনুযায়ী, চীন শান্তি বজায় রাখতে, স্থানীয় পুলিশকে প্রশিক্ষণ দিতে, মৎস্য, বাণিজ্য এবং সাংস্কৃতিক কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট স্থাপনের পরিকল্পনা করার জন্য দ্বীপটিতে সশস্ত্র পুলিশ এবং যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে অধিকার অর্জন করবে।

আগেই বলা হয়েছে, নিরাপত্তা পরিকল্পনায় আপত্তি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও নিউজিল্যান্ড। তারা ভয় পাচ্ছে যে এটি এই অঞ্চলের দ্বীপগুলোতে চীনকে পা রাখতে সহায়ক হবে এবং মার্কিনিদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ ছুটে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা আশঙ্কা করছেন যে, এটি চীনকে সলোমন দ্বীপপুঞ্জে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনসহ কৌশলগত অস্ত্র জমা করলে, যুক্তরাষ্ট্রের গুয়ামের জন্য বিপজ্জনক হবে। কেননা গুয়াম এখান থেকে বেশি দূরে নয়। উল্লেখ্য, ‘হাই অ্যান্ড’ অস্ত্র জমা রাখায় উত্তর কোরিয়া প্রথমে এখানে হামলা পরিচালনা করা হবে মর্মে জানিয়েছিল। যা হোক, দ্বীপগুলোতে চীনের উপস্থিতি মার্কিন স্বার্থ ও তার প্রতিক্রিয়া ক্ষমতা এবং তাইওয়ানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। অস্ট্রেলীয়রা এই অঞ্চলে চীনাদের ভয় পায় এবং তারা চায় যে চীন তাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যের রফতানির ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করুক।

বিশ্বে মার্কিন প্রভাবের সমান্তরাল পাল্লা দেয়ার একটি শক্তি হিসেবে চীন আবির্ভূত হয়েছে। এখন এটি বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তি। চীনকে দমন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি জোট রয়েছে। এমনই একটি জোট হলো কোয়াড। ২০১৭ সালে ফিলিপাইনে ইন্দো-প্যাসিফিকের কৌশলগত সমুদ্রপথকে চীনের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাবমুক্ত রাখা এবং এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্য হ্রাস করার লক্ষ্যে এর প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনকে দমন করতে ভারতকে সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়েছে কিন্তু অধিকৃত লাদাখে ভারতের বিপর্যয়কর পরিণতিতে তার মর্যাদা ক্ষুণ হয়েছে।

চীনের অর্থায়নে সলোমন দ্বীপপুঞ্জে নির্মিত হয়েছে ন্যাশনাল স্টেডিয়াম কমপ্লেক্স। এই কমপ্লেক্স তৈরিতে পাঁচ কোটি ৩০ লাখ ডলার খরচ হয়েছে। ২০২৩ সালে এই কমপ্লেক্সেই প্রথমবারের মতো প্যাসিফিক গেমস আয়োজন করবে দেশটি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে পরাস্ত করার প্রচেষ্টার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মনোনিবেশ করেছে। ২০২২ সালের ২৪ মে জাপানে চতুর্থ কোয়াড হেডস অব স্টেটস বৈঠকের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ১২ মে আসিয়ান নেতাদের প্রথম ওয়াশিংটন শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। লক্ষ করতে হবে যে, মাত্র কিছুদিন আগে চীনা রাষ্ট্রপতি ২১ এপ্রিল গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ, জিআইএস চালু করেন, এভাবে মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের বিরুদ্ধে চীন নিরাপত্তা মসলাযুক্ত পাল্টা পদক্ষেপের তাস খেলে দিয়েছে।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দ্বীপগুলোতে চীন জোর দেয়ার আরো কারণ রয়েছে যে, সমুদ্রের জলরাশিতে রয়েছে অফুরন্ত সম্পদ। এই অঞ্চলটি ভারত মহাসাগর, পশ্চিম ও মধ্য প্রশান্ত মহাসাগর, সমুদ্র এবং দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং ওশেনিয়া অঞ্চল নিয়ে গঠিত। এটি বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ, বিশ্বব্যাপী সম্পদ এবং সব আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের ২৫ শতাংশ শুধু মালাক্কা প্রণালীর মধ্য দিয়ে যায়। এই অঞ্চলটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

ওয়াশিংটন মনে করে চীন তার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে তাই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে প্রতিহত বা নিয়ন্ত্রণ করা। ওবামা প্রশাসন এশিয়ায় তার মিত্রদের মাধ্যমে চীনকে আটকে রাখার জন্য ‘পিভট অব এশিয়া’ কৌশল চালু করেছিলেন। এই অঞ্চলটি অনেক আগ থেকেই চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র লক্ষ্য নিয়ে নতুন জোট গঠন করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রও চায় একটি মুক্ত ও উন্মুক্ত অঞ্চল, যাতে তারা তাদের বাণিজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। এই অঞ্চলের মধ্যে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দক্ষিণ চীন সাগর যা ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের সীমানায় রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরের ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক তাৎপর্য রয়েছে। কারণ এটি সমুদ্র বাণিজ্য রুট এবং শিপিং লেন নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মাছ ধরার জাহাজ দক্ষিণ চীন সাগরে কাজ করে এবং লাখ লাখ মানুষ এর সাথে সংযুক্ত। এটি বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক বাণিজ্যের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ, চীনের বাণিজ্যের ৪০ শতাংশ এবং মার্কিন বাণিজ্যের ৬ শতাংশের বেশি। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আমদানি করা মোট জ্বালানির ৯০ শতাংশই সমুদ্রপথে যায়। তুর্কি সমুদ্রবিজ্ঞানীদের মতে, এই অঞ্চলটির সমুদ্রতলে অনাবিষ্কৃত তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদে পূর্ণ রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাবির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আপত্তি জানিয়ে আসছে। তাই তারা চীনের সাথে কোনো বিরোধে আঞ্চলিক দেশগুলোর স্বার্থকে সমর্থন করে।

দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো পরিকল্পনা প্রতিহত করার জন্য চীন প্রস্তুত এবং তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ২০২১ সালে ভারত, মার্কিন মিত্র হিসেবে তার উপস্থিতি দেখিয়েছিল এখানে, যখন চারটি যুদ্ধজাহাজ কোয়াডের অংশ হিসেবে মহড়ায় অংশ নিয়েছিল। এরপর সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনের সাথে দ্বিপক্ষীয় মহড়া করেছিল। সমুদ্রে ভারতের আরেকটি আগ্রহ হলো যে, ইন্দো-প্যাসিফিক দেশগুলোর সাথে তার বাণিজ্যের ৫৫ শতাংশ দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্য দিয়ে যায়।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, বোয়াও ফোরামের বার্ষিক এশিয়া কনফারেন্স ২০২২ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই) প্রস্তাব তুলে ধরেন, যার লক্ষ্য অভিন্ন, ব্যাপক, সহযোগিতামূলক এবং টেকসই নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে, শীতল যুদ্ধের মানসিকতা এখনো অব্যাহত রয়েছে এবং সেটি প্রত্যাখ্যান করা দরকার। গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভে ছয়টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে। সাধারণ, ব্যাপক, সহযোগিতামূলক ও টেকসই নিরাপত্তার জন্য কাজ করা, সব দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করা, জাতিসঙ্ঘ সনদের উদ্দেশ্য ও নীতি মেনে চলা, অবিভাজ্য নিরাপত্তার নীতি সমুন্নত রাখা, সংলাপ ও পরামর্শের মাধ্যমে দেশগুলোর মতপার্থক্য ও বিরোধের সমাধান করা এবং ঐতিহ্যগত ও অ-প্রথাগত উভয় ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বজায় রাখা।

ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে আলোচনার জন্য চীনের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা একই রকম যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি করেছে! ইন্দো-প্যাসিফিকের তুলনায়, জিএসআই-এ চীন অবশ্য নিরাপত্তার দিকে বেশি মনোনিবেশ করেছে। কারণ চীন ইতোমধ্যে বিআরআই-এর মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক পেশি কাজে লাগাচ্ছে যা অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিআরআইকে টক্কর দেয়ার জন্য গত বছর জি৭ সভায় চীনবিরোধী ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করে ফল পাওয়া অনেক সময়ের ব্যাপার। তাই চীনকে চাপে রাখার কাজে বাইডেন প্রশাসন কাজ করছে বলে প্রতিভাত হচ্ছে। উভয় দেশের কর্মপরিকল্পনার মধ্যে একটি সাধারণ প্রবণতা হলো বহুপাক্ষিকতার ব্যবহার, যা উভয়ই আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান হিসেবে সমর্থন করেছে। চীন জিএসআই কার্যক্রম ছাড়াও এই অঞ্চলের উন্নতির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করার প্রস্তাবও দিয়েছে।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় ১০টি দ্বীপরাষ্ট্রকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা চুক্তিতে রাজি করাতে অবশ্য ব্যর্থ হয়েছে চীন। বলা হচ্ছে, দেশগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, এই প্রস্তাবের মাধ্যমে বেইজিং তাদেরকে তার বৃত্তে নিয়ে যেতে পারে। পশ্চিমারাই কাছাকাছি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মাধ্যমে দ্বীপ দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করছে। ওই সব দেশের নেতাদের সাথে ফিজিতে গত ৩০ মে আলোচনায় বসেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। সেখানে নিরাপত্তাবিষয়ক একটি চুক্তিতে রাজি হয়নি দেশগুলো।

চীন চুক্তির প্রস্তাবে বলেছে, বেইজিং প্রশান্ত মহাসাগরীয় এসব দেশের পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেবে, সাইবার নিরাপত্তায় সংযুক্ত করবে, রাজনৈতিক সম্পর্কের বিস্তার করবে এবং স্থলে ও সমুদ্রে প্রাকৃতিক সম্পদের স্পর্শকাতর ম্যাপিং ও তার সুবিধার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।

প্রণোদনা হিসেবে বেইজিং আর্থিক সহায়তা হিসেবে লাখ লাখ ডলার দেয়ার প্রস্তাব করছে। বিশেষ করে চীন-প্যাসিফিক দেশগুলোর মধ্যে একটি অবাধ বাণিজ্যচুক্তি এবং চীনের ১৪০ কোটি মানুষের বিস্তৃত বাজার সুবিধা পাওয়ার মতো লোভনীয় প্রস্তাবও আছে এতে। এসব সাম্প্রতিক ঘটনার আগে ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়া ও সলোমন প্রশাসন তাদের প্রথম দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এটি একটি বড় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ান পুলিশ, সৈন্য ও সংশ্লিষ্ট বেসামরিক নাগরিকদের দ্রুত মোতায়েনের জন্য একটি আইনি ভিত্তি। অস্ট্রেলিয়া সলোমন দ্বীপপুঞ্জে ১০০ জনেরও বেশি পুলিশ ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য তৈরি করেছে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের একটি বৈসাদৃশ্য স্পষ্টভাবে দেখা যায়। যেমন চীন তার অর্থনৈতিক বিনিয়োগের একটি অংশগ্রহণ করে তার জাতীয় স্বার্থ আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বদা ব্যবহার করে।

বিপরীতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশির ভাগই তার সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। উভয়ই কতটা নিজ নিজ কৌশল প্রয়োগ করে, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। যা হোক, অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, আঞ্চলিক দেশগুলো তাদের এলাকায় সামরিক সঙ্ঘাত ও রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবর্তে অর্থনৈতিক পথ অনুসরণে বেশি আগ্রহী। চীন সে কৌশলটি অনুসরণ করতে চায়। ফলে ছোট ও দরিদ্র দেশগুলো চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা দিয়েছে। চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেংহি ১২ জুন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের লক্ষ্য হচ্ছে একটি বিশেষ দেশকে প্রতিহত করা এবং এ অঞ্চলে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করা।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মে মাসের শেষের দিকে টোকিওতে ১২টি ইন্দো-প্যাসিফিক দেশ, যথা অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামকে নিয়ে নতুন ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রসপারিটি (আইপিইএফ) চালু করেছিলেন। ইন্দো-প্যাসিফিক দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং এ অঞ্চলের জনগণের জন্য বিশেষ সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
‘এ কৌশলটি একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত।’ তিনি আরো জানান, ‘এ কৌশলটি একটি যুদ্ধংদেহী ছোট গ্রুপ প্রতিষ্ঠার নামান্তর।’

তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ‘তথাকথিত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলটি মূলত এ অঞ্চলে জঙ্গিগোষ্ঠী গঠনের জন্য ‘স্বাধীনতা ও উন্মুক্ততা’ এর ব্যানারে বিভেদ সৃষ্টি, সঙ্ঘাত সৃষ্টি এবং শান্তি হ্রাস করার একটি কৌশল, যা এই অঞ্চলের দেশগুলোকে তার আধিপত্যের সেবার জন্য স্থাপন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। চীন ঘোষণা দিয়েছে, এ অঞ্চলে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করা এবং শান্তি হ্রাস করার এই প্রচেষ্টা অল্পসময়ে ব্যর্থ হয়ে যাবে। কেননা লোকজন লাঠির পরিবর্তে গাজর বেশি পছন্দ করে।

সলোমন দ্বীপ প্রদেশগুলোর একটি, মালাইতা দ্বীপ, তাইওয়ানকে সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। মালাইতার প্রধানমন্ত্রী দ্বীপটিতে চীনা কোম্পানিগুলোকে নিষিদ্ধ করেছেন এবং মার্কিন সহায়তা গ্রহণ করেছেন।

বর্তমান বৈঠকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সামুদ্রিক ডোমেইন সচেতনতার উদ্যোগ। ইন্দো-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ ফর মেরিটাইম ডোমেইন অ্যাওয়ারনেস যাকে সামুদ্রিক ডোমেইন সচেতনতা বলা হচ্ছে; এর লক্ষ্য হলো মানবিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা এবং অবৈধ মাছ ধরার বিরুদ্ধে লড়াই করা। এটি ইন্দো-প্যাসিফিক দেশগুলো এবং ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের আঞ্চলিক তথ্য সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করবে।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির দুই প্রধান শক্তি। উভয়েরই রয়েছে অপরিমেয় সম্ভাবনা। দ্বন্দ্বে আসার পরিবর্তে উভয়ে মিলে বিশ্বকে শান্তির আলয় বানাতে পারে।
এমন প্রস্তাব চীন এরই মধ্যেই করেছে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement