২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শুধুই মনে হয় তারা মানুষ

শুধুই মনে হয় তারা মানুষ -

ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা ২৬ মে একটি নিউজ চ্যানেলে নবী মুহাম্মদ সা:কে অপমান করেছিলেন। এতে ভারতীয় মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হন। ১ জুন নবীন কুমার জিন্দাল, বিজেপির দিল্লি মিডিয়া প্রধানও একটি টুইটে নবী মুহাম্মদ সা:-কে অপমান করেছিলেন। এতেও মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হন। বিজেপির টনক নড়েনি। ৪ জুন ১৬টি মুসলিম দেশ বিজেপির নিন্দাসহ ভারতের পণ্য বর্জন শুরু করলে টনক নড়ে বিজেপির। ৫ জুন নূপুর শর্মাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

গত ৫ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইনে একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘নির্বাচনের আগে ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা! মার্কিন গুপ্তচর বাহিনীর।’ রিপোর্টে বলা হয়, হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তি হিন্দু ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পেরুনোর চেষ্টা করলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা। কথাটির সমর্থন রয়েছে, ২৬ মে থেকে ২৭ জুন পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির মধ্যে।

ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পেরুনোর চেষ্টা নতুন নয়। ০২ ডিসেম্বর ২০১৮ চিকিৎসার উদ্দেশে মৈত্রী এক্সপ্রেসে কলকাতা আসার পরদিনই গো হত্যার প্রতিবাদে বুলন্দশহরে পুলিশ হত্যার ঘটনাটি ঘটে। ৪ ডিসেম্বর দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় শিরোনাম ছিল, ‘ভারতের উত্তর প্রদেশের বুলন্দশহর জেলায় গো-হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভের মুখে পুলিশসহ দুই ব্যক্তি নিহত’ খবরে প্রকাশ, ‘গত সোমবার জেলার স্যানা মহকুমাধীন মাহুগ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

জানা যায়, গত সোমবার সকালে মাহুগ্রামের পাশে জঙ্গল লাগোয়া একটি মাঠ থেকে প্রায় ২৫টি গরুর মাংস উদ্ধার করা হয়। এ খবর রটে গেলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। স্থানীয় গো-রক্ষা সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় বেআইনিভাবে মাংস বিক্রি করতেই এত বিশালসংখ্যক গরু হত্যা করা হয়েছে। এই প্রতিক্রিয়ায় উত্তেজিত গো-রক্ষক সমাজ ট্রাক্টর ও ট্রলিতে উদ্ধারকৃত মাংস নিয়ে রাস্তা অবরোধ করে।

প্রায় ৪০০ মানুষ এই অবরোধে শামিল হয়। স্থানীয় একটি মুসলিম সংগঠন মাংস খাওয়ার জন্য গো-হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করতে থাকেন তারা। এদিকে খবর পেয়ে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করলে খণ্ডযুদ্ধের অবতারণা হয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে উত্তেজিত জনতা পাথর ছুড়ে মারতে শুরু করে।

জেলা শাসক অনুজ কুমার ঝা জানান, বিক্ষোভকারীদের প্রথমে অবরোধ তুলে নিতে অনুরোধ করে পুলিশ, অনুরোধ উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে অনবরত ইট পাটকেল ছুড়তে শুরু করে। উত্তেজিত জনতার মধ্য থেকে দুষ্কৃতকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় বলেও অভিযোগ করেন তিনি। পরে গো-রক্ষা সমাজ চিংবারটি পুলিশ ফাঁড়িতে চড়াও হয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়।

আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় একটি পুলিশভ্যানে। সে সময় বিক্ষোভকারীদের সরাতে পুলিশ গুলি চালায়। দুষ্কৃতকারীদের ছোড়া গুলিতে গুরুতর জখম হন পুলিশ পরিদর্শক সুবোধ কুমার সিং ও স্থানীয় বাসিন্দা সুমিত। সাথে সাথে তাদের হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৫ কোম্পানি র‌্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। রাজ্যের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আনন্দ কুমার জানান, এলাকা উত্তপ্ত থাকলেও পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে।’

এক দিকে মুসলমানদের খাদ্য তালিকায় ভাতের পরেই গোশতের স্থান। বিশেষ করে গরুর গোশত ছাড়া বাঙালি মুসলমানের চলেই না। গোশত খাওয়া ছাড়াও কোরবানি ইসলাম ধর্মের অপরিহার্য অংশ।

অপরিহার্য অংশটি পূরণ করা হয় প্রধানত গরু দিয়ে। বুলন্দশহরের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের তিন দিনব্যাপী একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছিল। মুসলিম ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রথম পছন্দ গরুর গোশত। হয়তো মনে করেছিল জঙ্গলের নির্জন স্থান, কেউ জানবে না। দ্বিতীয়ত, ভারতে গরু সহজলভ্য। তাতেই ঘটে গিয়েছিল লঙ্কাকাণ্ড।

৭ ডিসেম্বর ২০১৮ বেলা ৩টার দিকে অপারেশন থিয়েটার থেকে আমাকে যখন সিসিইউতে নেয়া হয় তখন আমার পাশের বেডেই ছিলেন ভারতের ইংলিশ সিরিয়ালের অভিনেতা সমীর মুখার্জি। কথাবার্তায় রাশভারী। রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম ও দর্শন ইত্যাদি সব বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। আমরা যখন হাসপাতালে তখনো বাইরের অবস্থা ছিল উত্তপ্ত। এসব বিষয়ে সমীর মুখার্জির সাথে আলাপ হয়। সহাস্যে জানতে চাই,

-দাদা, একটি কথা মাথায় ঢুকছে না। রোগের বেলায় কোনো ধর্ম নেই, নেই ওষুধের বেলায়ও। আমার আপনার ডাক্তারও এক, দু’জনের বেডের বেলায়ও নেই কোনো বাছ-বিচার, শুধু ‘ধর্ম’ নামক বস্তুটা আমাদের আলাদা করছে কেন? ৩ ডিসেম্বর যা ঘটেছে তা মুসলমান কর্তৃক হয়ে থাকলে ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে গরু জবাই, সনাতন ধর্মের দৃষ্টিতে গো-হত্যা, আইনের দৃষ্টিতে কী?

-ধর্মান্ধ সব ধর্মেই আছে। ধর্মান্ধের হাতে ধর্ম আর জন্মান্ধের হাতে গাড়ি, দু’জনের ড্রাইভই বিপজ্জনক। ধর্মের কোন নীতি কোন উদ্দেশ্যে কখন অপরিহার্য ছিল তা জানা আবশ্যক। ঋগ্বেদ এবং সংহিতাগুলোতে অশ্বমেধ যজ্ঞের ন্যায় গোমেধ যজ্ঞের কথাও বলা আছে। কিন্তু তৎকালীন কৃষিতে গরুর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তাই এই নির্বিচার গো-হত্যার ফলে খাদ্যের আবাদে সমস্যা শুরু হয়। তাই ধর্মীয় অনুশাসনের মোড়কে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়। আর ধর্মের জন্ম হয়েছিল সুন্দর জীবনব্যবস্থার জন্য।

সুন্দর জীবনব্যবস্থার জন্য প্রতিটি মানুষকে কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলতে হয়। যখন আইন ছিল না তখন ধর্মই ছিল সে নিয়ম-শৃঙ্খলার ধারক-বাহক। এখন আইন আছে ধর্মের প্রয়োজন কী? এখন ধর্মটা রাখা হয়েছে রাজনীতির প্রয়োজনে। লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য আইনের বুলি যেখানে অচল সেখানে ধর্মের বুলি ব্যবহার করে। ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে উদ্দেশ্য হাছিল করে।

রাজনীতির ক্ষেত্রে কথাটা ঠিক। ধর্মকে হাতিয়ার করে ক্ষমতায় আসার কারণেই ধর্মান্ধদের কার্যকলাপকে মৌন সম্মতি দিয়ে যাচ্ছেন। উদাহরণ, ধর্মান্ধদের হাতে বাবরি মসজিদের ধ্বংস। অজগর হরিণশাবককে যেভাবে আস্তে আস্তে গ্রাস করে তেমনি প্রশাসনও আস্তে আস্তে গ্রাস করেছে বাবরি মসজিদকে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ডিএইচপি) এবং অন্যান্য হিন্দু সংগঠনকে দায়ী করা হলেও মৌন সম্মতি ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রেরও। ঘটনার ধারাবাহিকতা তাই বলে। যে ধর্মান্ধদের হাতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছিল, এখন ক্ষমতায় তারাই।

১৫২৭ সালে সম্রাট বাবরের আমলে নির্মিত মসজিদটি নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ শুরু ১৮৫৩ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ১৪০ বছরের ঘটনাক্রম পর্যালোচনা করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বাবরি মসজিদ নিয়ে যত বিরোধ হয়েছে ততবারই ফসল উঠেছে ধর্মান্ধ করসেবকদের ঘরে। পরিশেষে হজম প্রক্রিয়ার সফল সমাপ্তি।

শুরু হয়েছে তাজমহল ধ্বংসের নীলনকশাও। ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের পর্যটন তালিকা থেকে তাজমহলের নাম বাদ পড়েছে বহু আগেই। মধ্যযুগের বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি তাজমহল। ২০ হাজার লোক ২২ বছরে কোনো স্থাপনা নির্মাণের ইতিহাস বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। তাজমহল নির্মাণে যত টাকা ব্যয় হয়েছে তার চেয়েও দ্বিগুণ টাকা ব্যয় হয়েছিল ময়ূর সিংহাসন নির্মাণে। ১৬২৮ -১৬৩৫ আট বছরে আট কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ময়ূর সিংহাসন আজ ভারতে নেই। মুঘলরাজ্যের পরবর্তী আকর্ষণ কোহিনূর। হংকং-এর হীরা প্রদর্শনীতে বিক্রি হওয়া হীরার মূল্যের সাথে তুলনা করলে কোহিনূরের আনুমানিক মূল্য হয়ে যায় ১,৫০০০ হাজার কোটি টাকা। হীরকটি হিন্দু, পারসি, মুঘল, আফগান, শিখ হয়ে পরিশেষে ঠাঁই পেয়েছে ব্রিটিশ রানীর মুকুটে। বর্তমানে হীরকটি ব্রিটিশ রাজপরিবারের সম্পত্তি। অবশিষ্ট ছিল তাজমহল।

ভারতের ঢেউ সীমানা পার হয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। ১৭ জুন নূপুর শর্মাকে নিয়ে ইতিবাচল পোস্ট করেন রাহুল দেব। ১৮ জুন স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোসহ জ্বালিয়ে দেয়া হয় কয়েকটি মোটরসাইকেল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হওয়ার পর ২৭ জুন জনৈকা আসমা উল হুসনা লিখেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছেন, বেশ করেছেন। কিন্তু মানুষের মগজের একটু উন্নয়নও কি প্রযোজন নেই? এত উগ্র ধর্মান্ধ তো আমাদের দেশ ছিল না, এখন কেন হয়ে গেল? কেন আইন আদালত থাকতেও পাবলিক বিচার করে আর পুলিশ চেয়ে চেয়ে দেখে? এভাবে কি একটা সভ্য দেশ চলতে পারে?’

আসমা উল হুসনার পোস্টকে সমর্থন করে আমি লিখেছিলাম, অন্তরের অন্তস্তল থেকে শ্রদ্ধা, সম্মানসহ দীর্ঘয়ু কামনা করি আসমা উল হুসনার জন্য। আল্লাহর কাছে কামনা, ঘরে ঘরে যেন এমন সাহসী সন্তানের জন্ম হয়।

পোস্ট করতে না করতেই আক্রমণ শুরু আমার পোস্টের বিরুদ্ধেও। মানুষের সব অঙ্গ থেকে জটিল অঙ্গ মগজ। মগজের কারণেই অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষ অনন্য। মানুষের মগজ ১০ লাখ আধুনিক কম্পিউটারের চেয়েও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। মঙ্গল গ্রহে জীবজন্তু থাকা না থাকার বিষয়টিও মানুষ বোঝে- শুধু বোঝে না ধর্মকে নিয়ে রাজনৈতিক ঘুঁটির চাল। ‘ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু আর বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ’ আলবার্ট আইনস্টাইনের সর্বজনস্বীকৃত জানা সত্ত্বেও অন্ধের দলে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হতে চলছি।

সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং চিকিৎসা জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি ড. দেবী প্রসাদ শেঠী সবাই ভারতবর্ষের এবং সনাতন ধর্মাবলম্বী। ডা. দেবী শেঠীর প্রতিষ্ঠিত নারায়ণ ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সাইন্সেস হাসপাতালে একই ছাদের নিচে মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও গুরুদুয়ারা। পাশাপাশি যার যার মতো প্রার্থনা করার অভূতপূর্ব দৃশ্য। তাদের জীবনাদর্শ আলোচনা করতে গিয়ে একবারও মনে হয় না তারা সনাতন ধর্মের লোক, শুধুই মনে হয় তারা মানুষ।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
ই-মেল: adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement