২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী একজন কলামিস্ট ছিলেন

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী - ছবি: সংগৃহীত

‘আগাচৌ’ বলতে কী বুঝায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর মানে যে, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী- এটা বলাই বাহুল্য। এর কারণ তিনি প্রায় ছ’দশক কালজুড়ে নিয়মিত দু’হাতে লিখে গেছেন। এত দীর্ঘকাল যাবৎ এতগুলো নামকরা দৈনিক পত্রিকায় এতটা নিয়মিত আর কোনো কলামিস্ট ছিলেন না। গাফ্ফার চৌধুরীর আলোচনা-সমালোচনা যা-ই হোক না কেন, তিনি মৃত্যুশয্যা থেকেও লিখেছেন।

আগা চৌ সাধারণত বাঙালি জাতীয়তাবাদী মহলের বুদ্ধিজীবী শিরোমনি ছিলেন। তিনি যে একজন সেকুলার সাবেক বামপন্থী ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী তা বলা নিষ্প্রয়োজন। তাই তিনি বলেছেন, ‘আমিও মুসলমান। তবে ‘ÔNon practising muslim.’ তিনি জানিয়েছেন এক লেখায়- তিনি পবিত্র হজ পালন করেছেন ১৯৯৮ সালে। তখন তার সঙ্গী ছিলেন মরহুম আমিনুল হক বাদশাহ। যিনি একজন প্রখ্যাত অভিনেতা ভিলেনের ভাই ছিলেন। আগাচৌ নির্দ্বিধায় বলে গেছেন, মুসলমান দু’রকম- Practising ও Non practising. অর্থাৎ যথাক্রমে এর দৈনন্দিন আদেশ-নির্দেশ পালনকারী ও অ-পালনকারী। ইসলামের ধর্মবেত্তারা যদিও এটা স্বীকার করেন না, তবুও তিনি তার বিশ্বাসে অটল ছিলেন।

মরহুম অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সদ্য মরহুম আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একজন আন্তরিক শুভাকাক্সক্ষী। তিনি দুঃখ করে বলেছেন, ‘গাফ্ফার সমসাময়িকতার কাছে তার প্রতিভাকে বিসর্জন দিয়েছে।’ এমনকি, আগা চৌ নিজেও বলেছেন, কেন তিনি গল্প-কবিতা ছেড়ে কলাম লেখায় মনোযোগী হয়েছেন। তার মতে, ‘কবিতা ও গল্প লেখকরা পান সামান্য পারিশ্রমিক। সে তুলনায় কলামে আয় অধিক।’ কবি ও গল্পকাররা যে, আজো এ সমাজে বঞ্চিত এবং ন্যায্য পারিশ্রমিক পান না তা অস্বীকার করা যাবে কি? এ দিক দিয়ে তিনি সঠিক কথাই বলেছিলেন। আমি নিজে গাফ্ফার চৌধুরীকে চিনি গল্পকার রূপে, আর তিনি তো একুশের গানের রচয়িতা হিসেবে এমনিতেই সুপরিচিত। আমাদের ক্লাস সেভেন কি এইটের পাঠ্যবইতে তার লেখা গল্প পাঠ্য ছিল। সে কথাসাহিত্য অনন্য। বড় হয়ে আর তার নতুন গল্প-উপন্যাস না দেখে অবাক হয়েছি!

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার দীর্ঘ কর্মজীবনে একপর্যায়ে দৈনিক ‘জনপদ’ বের করেছিলেন ঢাকা থেকে। এটা বের হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার অল্প পরে। জানা যায়, মুজিব মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য মরহুম এ এইচ এম কামারুজ্জামান (রাজশাহী) ছিলেন এর স্বত্বাধিকারী। এতে ‘মুজিববিরোধী’ হিসেবে পরিচিত লোকজনকেও চাকরি দেয়া হয়েছিল। এর মাধ্যমে মূলত পেশাগত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাকেই মূল্যায়ন করেছিলেন গাফ্ফার চৌধুরী। দৈনিক জনপদের কাটতি ছিল বেশ এবং তাতে ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা কর, প্রভু’ নামে এক নিবন্ধ লিখে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বেশ সমালোচনায় পড়ে যান কোনো কোনো মহলের। যা হোক লন্ডন জীবনে গাফ্ফার চৌধুরীকে প্রশংসা ও সমালোচনা, দুটোরই পাত্র করা হয়েছে।

মুজিব প্রশস্তির কারণে তিনি বিপুলভাবে ধন্য হয়েছেন রাজনীতির এক পক্ষ থেকে। আবার সমালোচিত হন অন্য অংশ থেকে। তেমনি যে একুশের গান তার অলঙ্কার ও অহঙ্কার, সেটা নিয়ে সমালোচনা পর্যন্ত করেছেন কোনো কোনো মহল। বলা হয়েছে, ‘আসলে শহীদ আলতাফ মাহমুদের করা সুরই এর জনপ্রিয়তার মূল কারণ।’ একই কথা মরহুম এরশাদের প্রশংসা ও সমালোচনা করা নিয়েও। ভাগ্য ভালো যে এই শাসক স্বৈরাচারীর খপ্পর থেকে শিগগিরই বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। এটা অনস্বীকার্য, ‘আগোচৌ’কে যারা কলামিস্ট হিসেবে মানবেন না, তাদের পক্ষেও তার একুশের গানকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।

মরহুম বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক স্মরণীয় উজ্জ্বল নাম। তার বিরাট ইমেজ জনমনে এরকম যে, তিনি খুব নীতিনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ, সৎ ও পক্ষপাতমুক্ত। এই ইমেজের প্রমাণ তিনি রেখেছিলেন ’৯১ সালের ঐতিহাসিক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। তার ইমেজের বিরুদ্ধে ২০০২ সালের দিকে আগাচৌ ‘বোমা’ ফাটিয়েছিলেন পরপর কয়েকটি কলাম লিখে ঢাকায় একটি দৈনিক পত্রিকায়। তা তার স্বীয় মহলে যেমন প্রশংসিত, তেমনি বিপক্ষ দ্বারা ব্যাপকভাবে সমালোচিত। হয়তো গাফ্ফার ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব হতো না এমনটা লেখার।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলামের পাঠক ও অপাঠকদের মধ্যে অন্ধ ভক্ত ও অন্ধ বিরোধী- দুই-ই ছিলেন। তার সমর্থকদের মধ্যে অনেকে তাকে সম্পূর্ণ অভ্রান্ত বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। “করহম পধহ ফড় হড় ৎিড়হম.” (রাজা কোনো ভুল করতে পারেন না) ধরনের বিশ্বাস তাদের। অনেকে তার ভক্ত হয়েও হয়তো তার লেখা নিয়মিত পড়তেন না এটা ভেবে যে, তিনি তো ঠিক কথাই লিখবেন। সেটা আবার পড়তে হবে নাকি সব সময়? আর তার বিরোধীদের মধ্যেও এ দু’রকম লোক ছিলেন। তাদের অনেকে তার লেখা ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ মনে করতেন। আর অনেকে খুঁত ধরতেন তার কলাম পড়ে।

এ সমাজে কথিত প্রগতিশীল অনেকেই ধর্মকর্ম কিংবা মাদরাসার নাম শুনতে পারেন না। গাফ্ফার চৌধুরী এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন বৈকি। তিনি কয়েক বছর আগে বরিশালে গিয়ে নিজের বাল্য পড়ার স্মৃতিবিজড়িত মাদরাসায় গিয়েছেন। বাংলাদেশে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলে মাদরাসাপড়ুয়া অপেক্ষাকৃত বেশি। ভারতীয় উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের জনকতুল্য ‘কাকাবাবু’ এবং সিপিএম নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহমদ (১৮৮৯-১৯৭৩) নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার বামনি মাদরাসার ছিলেন ছাত্র। তেমনি বরিশালের গণ্ডগ্রামে গাফ্ফার চৌধুরীও এক মাদরাসাতে পড়েছেন। এটা তিনি লুকাননি। লন্ডনে প্রবাস জীবনে ছিলেন সেই ১৯৭৪ থেকে একাধারে। সেখানে তাকে জানাজার নামাজে ইমামতিও করতে হয়েছিল অতীতে ‘তালেব এলেম’ ছিলেন বলে। এটা তার মৃত্যুর পরে জানা গেছে এক লেখায়। দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক নিবন্ধে জনৈক লেখক এ কথা বলেছেন।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভক্ত ও বিরোধী- কোনোটা কম ছিল না রাজনীতির কারণে। তিনি সমালোচনা করতেন প্রচণ্ডভাবে। আবার প্রধানত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যতীত সবার কোনো না কোনো দিক নিয়ে সমালোচনা করেছেন একবার হলেও। সনাতনী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস মতে, তাদের দেবী দুর্গা দশভুজা। অর্থাৎ, এই দেবী একত্রে দশ হাতে কাজ করেন বলে তাদের বিশ্বাস। তেমনি গাফ্ফার চৌধুরীও যেন দশ হাতে লিখতেন। এ জন্য তিনি স্বপক্ষে ‘নমস্য’ আর প্রতিপক্ষের কাছে ‘ভয়ঙ্কর’। তিনি বাংলাদেশের অনেক বড় বড় পত্রিকা ও প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে লিখেছেন। তবে তার তীব্র সমালোচনার মুখে অনেকেই চুপ থাকতেন। কারণ তারা জানতেন, তিনি তাদের কথার তীক্ষ্ন জবাব দেবেন।
বাংলাদেশের একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি পত্রিকার তিনি কড়া সমালোচনা সত্ত্বেও জবাব মেলেনি এ কারণে। আর তিনি অবাধে নিন্দা করে গেছেন পছন্দ না হলে।

১৯৯২ কি ’৯৩ সালের কথা। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) বার্ষিক সভা। সময়টা সম্ভবত ’৯২ সালের ডিসেম্বর কি ’৯৩ সালের গোড়া। একাংশে মরহুম আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আর অন্য অংশে তার একই বাড়ির ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মরহুম বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী প্রধান বক্তা ও অতিথি। অনুষ্ঠান শেষে বিচারপতি সাহেব জিজ্ঞাসিত হয়ে গফফার চৌধুরীর সমালোচনা করলেন। আর আগা চৌ কী বলেছিলেন, জানি না। তবে তিনি তাড়াতাড়ি চলে যান বলে মনে আছে। এর অল্প আগে রাজনৈতিক কারণে সাংবাদিকদের মাঝে বিভক্তি এসেছে।

একটা কথা চালু আছে যে, ‘আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী একই সাথে পরস্পরবিরোধী দু’টি পত্রিকায় লিখতে পারতেন।’ কথাটা কতখানি সত্য, জানি না। তবে এটা তার পেশাদারিত্ব ও সক্ষমতারও পরিচায়ক বটে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি তৎকালীন বামপন্থী হলেও কথিত ‘ডানপন্থী’ ইত্তেফাকের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মানিক মিয়ার স্নেহধন্য সাহচর্য্য লাভ করেছেন। তখন কোনো কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তিনি ওই পত্রিকায় লিখেছেন। প্রতিপক্ষ পত্রিকায় এর পাল্টা লিখতেন কে, আল্লা মালুম। প্রতিপক্ষের লোকজন বলে থাকেন, ‘আগাচৌ কখনো জীবিত ব্যক্তির রেফারেন্স দিতেন না।’ জানি না, এ অভিযোগ কতদূর সত্য। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন নিয়ে তার লেখাগুলো সবার প্রশংসা পেয়েছে। যারা তার রাজনীতির সাথে ভিন্ন মত পোষণ করেন, তারাও এগুলো পড়েছেন। তিনি লন্ডনে বসে পাশ্চাত্যের সমালোচনা করা প্রমাণ করে, তারা কতটা উদার ও গণতান্ত্রিক।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আরএসপি (বাংলাদেশে লুপ্ত) অর্থাৎ রেভোলিউশনারি সোস্যালিস্ট পার্টির সাথে প্রথম জীবনে জড়িত ছিলেন। এ দল এখনো ভারতে রয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গের সাবেক ক্ষমতাসীন বাম ফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত। সাংবাদিক আবদুল খালেক খান, নির্মল সেন ও মোজাম্মেল হকও এ দলে ছিলেন। মোজাম্মেল সাহেব ১৯৬৫ সালে কায়রোতে সিআইও বিমান দুর্ঘটনায় আরো অনেকের সাথে মারা যান। তখন তিনি অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা (তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান) পত্রিকার বার্তা সম্পাদক। নির্মল বাবুও সে পত্রিকায় দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। সম্ভবত খালেক খানও। এখন তাদের কেউ বেঁচে নেই।

যা হোক, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর চিরবিদায়ের সাথে সাংবাদিকতার একটি যুগের অবসান হলো।


আরো সংবাদ



premium cement