২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পদ্মা-যমুনায় সেতু ও ঢাকা বাসঅযোগ্যতা

- ছবি: সংগৃহীত

 

 

পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়েছে। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তার দৃঢ় অঙ্গীকারের কারণে দেশের দীর্ঘতম সেতু নির্মিত হয়েছে।

একই সাথে ধন্যবাদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। তার দৃঢ় অঙ্গীকারের কারণে এর আগে যমুনা সেতু নির্মিত হয়েছে। পরবর্তীতে এর নাম দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সরব এই দুই নেত্রী। রাজনীতি আলোকিত করে আছেন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া। অন্য কথায়, তাদের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতি আলোচিত, আলোড়িত। বাংলাদেশের উন্নয়নেও রয়েছে তাদের অসামান্য ভ‚মিকা। পদ্মা ও যমুনা সেতু তাদের কীর্তি।

পদ্মা সেতুর ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ জেলা রাজধানী ঢাকা ও বাকি অংশের সাথে সড়কপথে যুক্ত হয়ে গেল। সেতুবন্ধন রচিত হলো দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সাথে রাজধানীর। এর ফলে এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনের ভোগান্তির অবসান ঘটল। তেমনি দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিসহ জাতীয় অর্থনীতিকে এই সেতু বেগবান করবে। অর্থনীতিবিদরা ইতোমধ্যে বলেছেন, এ সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে এক দশমিক দুই-তিন শতাংশ হারে অবদান রাখবে। আর দারিদ্র্য বিমোচন হবে দশমিক আট-চার শতাংশ হারে।

শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করে টোল দিয়ে এ সেতু পার হন। রোববার থেকে পদ্মা সেতু সাধারণ মানুষের অর্থাৎ টোল দিয়ে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। আগে যে ফেরির মাধ্যমে পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যেত, খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মা জনগণের বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াত, সেই দুশ্চিন্তা এখন চলে গেছে। প্রমত্তা পদ্মার ওপর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের দীর্ঘ এই সেতু নির্মিতি হওয়ায় মানুষ যানবাহনের সাহায্যে সেটি মাত্র সাত মিনিটে পার হতে পারবে। দ্বিতল এই সেতুতে রেল সংযোগের কাজও এগিয়ে চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেছেন, ৩০ হাজার ১৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এই সেতু হয়েছে। এটা হয়েছে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণের টাকায়।

পদ্মা সেতুকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই সেতু বড় ভ‚মিকা রাখবে। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে সেতুকে কেন্দ্র করে নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষই নয়, সারা দেশের মানুষ আনন্দিত। আসলে দেশের যেকোনো সুখবরেই আনন্দিত হয় দেশের জনগণ। পদ্মা ও যমুনা সেতুর মতো বড় উন্নয়ন বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়। আনন্দেরই বিষয়। এখানে কোনো রাজনীতি নেই। রাজনীতি হলো দেশের স্বার্থ, দেশের উন্নয়ন।

পদ্মা সেতুর বাধা বিঘ্নকে জনগণ গুরুত্ব দেয়নি। তেমনি এর আগে যমুনা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রেও যেসব প্রতিবন্ধকতা এসেছিল তাকেও জনগণ গুরুত্ব দেয়নি।

যমুনা নদীর ওপর বহুমুখী সেতু চালুর পর দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে গেছে। জেলায় জেলায় তৈরি হয়েছে শিল্পকারখানা। এসব কারখানার মধ্যে কৃষি প্রক্রিয়াজাত কারখানাই বেশি। আবার উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কৃষিপণ্য সহজেই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সহজে সরবরাহ হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নিরলস প্রচেষ্টায় যমুনা সেতু নির্মিত হয়েছিল। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত যমুনা সেতুর ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়। বাকি কাজ শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার এসে সম্পন্ন করে এবং ১৯৯৮ সালের জুন মাসে যমুনা সেতু চালু হয়। আওয়ামী লীগ সরকার এর নামকরণ করে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতু। সেতুটি নির্মাণে তখনকার টাকায় তিন হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। যমুনা সেতু নির্মাণের ফলে উত্তরবঙ্গে যেমন শিল্পায়নের দ্বার খুলে যায়, তেমনি দারিদ্র্য বিমোচনেও ওই সেতু ভ‚মিকা রেখে চলেছে। শাক-সবজি ও ফলমূল উত্তরাঞ্চল থেকে দিনে দিনেই ঢাকায় চলে আসছে। ধানের রাজধানী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে নওগাঁ। এসব জেলার ধান-চালের ব্যবসায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হচ্ছে বলে অর্থনীতিবিদরা হিসাব করে বলেছেন।

পদ্মা ও যমুনা সেতু মনে করিয়ে দিচ্ছে শত বছর আগের হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কথা। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেতু। এরপর যমুনা সেতু। এই দু’টি সেতুর বিশাল কর্মযজ্ঞের আগে আমাদের দেশে শত বছর আগে পাবনার পাকশী রেলস্টেশনের দক্ষিণে পদ্মা নদীতে নির্মিত হয়েছিল হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। সেটি ব্রিটিশরা তৈরি কয়েছিল। ব্রিটিশ আমলের প্রকৌশলীরা হার্ডিঞ্জ সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করেছিলেন ১৯১৫ সালে। তখন পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে সেতু উন্মুক্ত হয়। হার্ডিঞ্জ সেতুতে রেলগাড়ি ও পথচারী চলাচলের ব্যবস্থা আছে। হার্ডিঞ্জ সেতুর দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার। যমুনা সেতুর দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। আর পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। অবশ্য হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে যে নকশা, প্রৌকশল ও পদ্ধতির প্রয়োগ হয়েছে শত বছর পর তার অনেক কিছু বদলে গেছে। পদ্মা ও যমুনা সেতু নির্মাণে আধুনকি প্রযুক্তি তথা প্রকৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। পদ্মা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রমত্তা নদীগুলোর একটি। পদ্মা সেতু যেখানে নির্মিত হয়েছে অর্থাৎ মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে নদী প্রায় ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত। ফলে প্রকৌশলীদের সেভাবেই নদীর নকশা, প্রকৌশলগত দিক ও নদী শাসন করতে হয়েছে।

ইতোপূর্বে যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর প্রদান ও সেতুর ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হওয়ায় পর তা প্রত্যক্ষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘সেদিন আর বেশি দূরে নয়, ‘যেদিন তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ ও তামাবিল থেকে ভেটখালী পর্যন্ত জাতীয় মহাসড়কে কোনো ফেরি থাকবে না। অল্প সময়েই দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাতায়াত সম্ভব হবে।’ যমুনা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হলে তিনি বলেছিলেন, যমুনা সেতুর স্বপ্ন বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন। শতাব্দীর এ স্বপ্ন পূরণ হলো সেতুটি নির্মিত হওয়ার মাধ্যমে। যমুনা সেতুর ফলে দেশের পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হলো। তেমনি আজ পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মধ্যেও সংযোগ স্থাপিত হলো। পদ্মা ও যমুনা সেতু আমাদের দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার অনন্য কীর্তি। সেই কীর্তিই এখন দীপ্যমান।

বাস অযোগ্য ঢাকা নগরী
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে গত কিছু দিন ধরেই দেশব্যাপী চলছিল আলোচনা। শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশই এ জন্য বাংলাদেশকে বাহবা দিয়েছে এমন একটি কঠিন কাজ সাধন করাতে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ প্রদান বাতিল করে দিয়েছিল বিশ্ব ব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীরা। সেই বিশ্ব ব্যাংকের বর্তমান কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বল বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ায় আমরা আনন্দিত। দীর্ঘ দিনের সহযোগী হিসেবে আমরা নিবিড়ভাবে বাংলাদেশের পাশে আছি।’ আন্তর্জতিক গণমাধ্যমে পদ্মা সেতু চালু হওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। আল-জাজিরা পদ্মা সেতুকে জাতির গর্বের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে, এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, পদ্মা সেতুর ফলে ঢাকা-কলকাতার দূরত্ব অর্ধেক কমে এসেছে। এনডিটিভি তাদের রিপোর্টে বলেছে, দীর্ঘতম পদ্মা সেতু নির্মাণের পর উদ্বোধন হওয়া বাংলাদেশের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

এটি ঠিক, পদ্মা নদী ও যমুনা নদীতে বিশাল দু’টি সেতু নির্মাণ করে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেছি। এত বড় এবং এত দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো নির্মাণ একদিকে আমরা করছি, অন্যদিকে আমাদের যে গৌরব ও ঐতিহ্য আছে তাকে অবহেলা করে চলেছি। এ চিত্রই ফুটে উঠেছে লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদনে।

বিশ্বের বাসযোগ্য শহরের তালিকার শেষ দিক থেকে সাত নম্বরে আছে রাজধানী ঢাকা নগরীর নামে। রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্বের ১৭২টি শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান ১৬৬তম। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯৯ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের নাম হচ্ছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। শীর্ষ দশের মধ্যে ছয়টি অবস্থানই এবার ইউরোপের দখলে। কানাডার শহরগুলোও অবস্থানের উন্নতি ঘটিয়েছে।

বাসঅযোগ্য সবচেয়ে খারাপ শহর যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক, নাইজেরিয়ার লাগোস, লিবিয়ার ত্রিপোলি, আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স, পাকিস্তানের করাচি, পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোরসবির ও বাংলাদেশের ঢাকা।

কোন শহর কতটা বাসযোগ্য তা বোঝার জন্য স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো, এই পাঁচ মানদণ্ডে বিচার করা হয়। এর মধ্যে অবকাঠামোতে সবচেয়ে কম ২৬.৮ স্কোর পেয়েছে ঢাকা, অর্থাৎ ঢাকার চেয়ে খারাপ দশার নগরী আর নেই। এমনকি সিরিয়ার দামেস্কও ঢাকার চেয়ে ভালো। তাদের স্কোর ৩২.১।

ঢাকা চারশ’ বছরেরও বেশি সময়ের এক ঐতিহ্যবাহী নগরী। এক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শহর। এই নগরীর গৌরবগাথা কিংবদন্তিতুল্য। কিন্তু নগরটির দিকে আমাদরে এখন নজর নেই। আমরা যদি এত বড় পদ্মা সেতু করতে পারি তাহলে এই ঢাকা নগরীকে কি বাস উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারি না? এক সময় বুড়িগঙ্গা ছিল ঢাকার প্রাণ। মুঘল সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৫৬০ সালে এই নগরীর পত্তন করেছিলেন। বুড়িগঙ্গ নদীপথেই তিনি ঢাকায় এসে সদরঘাটের কাছে তার বজরা চাঁদনীর নোঙর করেছিলেন।

জেমস টেলর বুড়িগঙ্গা নদীর সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, বর্ষা কলে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে তাকালে বড় বড় মিনার ও অট্টালিকা শোভিত ঢাকা নগরীকে মনে হতো ভেনিস নগরীর মতো। কিন্তু বর্তমানে বুড়িগঙ্গা নদী যে কারো বুকে হাহাকার সৃষ্টি করে। বুড়িগঙ্গার তীরেই ঢাকা। সিন নদীকে ঘিরে কত সুন্দরভাবে প্যারিস নগরী গড়ে উঠেছে! বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে ঢাকাও এমন হতে পারত।

আশার কথা, ঢাকার দক্ষিণের মেয়র নদীটির সৌন্দর্য বাড়ানো উদ্যোগ নিয়েছেন। অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলা, নদী খনন করে বর্জ্য উত্তোলন, দূষণ ও দুর্গন্ধ দূর করাসহ নদীর উন্নয়নে বিশিষ্টজনদের নিয়ে কাজ করছেন। আগের বুড়িগঙ্গা ও ঢাকা নগরীর সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে পারলে অবশ্যই মেয়র সাধুবাদ পাবেন।

লেখক : সিনিয়র সাংবদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement