২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মধ্যপ্রাচ্যে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে?

লেবানন-ইসরাইল বিরোধপূর্ণ সমুদ্রাঞ্চল - ছবি : মিডল ইস্ট আই

মধ্যপ্রাচ্যে কি ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে? এ প্রশ্নটা বর্তমান অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতির কারণেই কেবল উঠছে এমন নয়। এখন এমন কিছু ঘটনা ঘটছে যার পেছনে অনেক সঙ্কেত সুপ্ত রয়েছে বলে মনে হয়। কয়েক দিন আগে তুর্কিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগান সংসদে ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের এক সভায় উত্তর সিরিয়ায় ৩০ কিলোমিটার নিরাপদ জোন গঠনের জন্য মানবিজসহ কয়েকটি কুর্দি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ ঘটনার পর পর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ যেকোনো কিছুর বিনিময়ে এ অভিযান প্রতিরোধ করার কথা জানান। ইরান যথারীতি সিরিয়ার অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানায়।

দৃশ্যপটের অন্তরালে কী ঘটেছে, সেটি স্পষ্ট নয়। তবে তুরস্ক এখনো সে অভিযান শুরু করেনি। খুব দ্রুত শুরু করবে এমন আভাসও দেখা যাচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরের ঘটনাপরম্পরা পর্যবেক্ষণ করেন এমন এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, রাশিয়া এ অভিযান মেনে না নেয়ার শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। নিরাপদ জোন গঠন করে সেখানে সিরীয় শরণার্থীদের পুনর্বাসনের বিষয়ে রাশিয়ার সাথে একসময় তুরস্কের সমঝোতা চুক্তি হলেও এর মধ্যে বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিশেষত ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযানের পরে দৃশ্যপট অনেকখানি পাল্টে গেছে। এ সময়ে সম্ভবত রাশিয়া তার মিত্রদের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে কঠোর বার্তা দিতে চাইছে। আর সিরিয়ায় তুর্কিয়ে অভিযানে বাশার আসাদের সরকার ও ক্রেমলিন দু’পক্ষই কুর্দি ওয়াইপিজি গেরিলাদের সজ্জিত করে এ অঞ্চলে নতুন যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করতে চাইছে। এটি হলে তুরস্ক নিরাপদ জোটগঠনে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যেসব অভিযান চালিয়েছে এ অভিযান সে রকম নাও হতে পারে। ইউক্রেনের মতো মধ্যপ্রাচ্যে এটি হতে পারে যুদ্ধের আরেকটি ক্ষেত্র। যেখানে পরস্পর বিপরীত পক্ষে থাকতে পারে ইরান ও তুরস্ক।

দ্বিতীয় আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো লেবাননের হিজবুল্লাহ ভূমধ্যসাগরের বিতর্কিত সামুদ্রিক অঞ্চলে ইসরাইলের তেল-গ্যাস উত্তোলনের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। তারা বলেছে, এটি করা হলে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাইপলাইন ও তেল-গ্যাস উত্তোলন কাঠামো উড়িয়ে দেবে। হিজবুল্লাহর সক্ষমতার ব্যাপারে ধারণা ও বাস্তবতা যাই হোক না কেন, এ হুঁশিয়ারি সাদামাটা কোনো বিষয় নয়। আর এটি ইরান সমর্থনপুষ্ট একটি ক্ষুদ্র আরব রাষ্ট্রের মিলিশিয়া দলের হুমকিই যে কেবল নয়, তাতে সন্দেহ নেই। এ হুমকির পেছনে ক্রেমলিনের সুস্পষ্ট সমর্থন রয়েছে বলে মনে হয়। ইসরাইলের সমুদ্রসীমার তেল-গ্যাস ক্ষেত্রের একটি বড় অংশ লেবাননের দাবিকৃত অংশে। এ নিয়ে লেবানন আন্তর্জাতিক আদালতে মামলাও করেছে। এটি ইসরাইল ভালো করে জানে বলেই লেবাননে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি করে সমুদ্রসীমার ব্যাপারে প্রতিবাদহীন নিস্তব্ধ করে রাখার কৌশল নিয়েছে। বৈরুত বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ আর সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর সরকার গঠনে অচলাবস্থা তৈরি করে রাখার পেছনে ইসরাইলের গভীর হাত রয়েছে বলে মনে করা হয়।

আর ভূমধ্যসাগরের যে ৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ তা পাইপলাইনে সরবরাহ করা গেলে ইউরোপের চাহিদার একটি অংশ মেটানো সম্ভব হবে। একসময় সাইপ্রাস গ্রিস হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ এই প্রকল্পের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতার প্রশ্ন তুলে এর পৃষ্ঠপোষকতা থেকে সরে আসে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর কার্যত প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। এরপর তুরস্কের ভূমধ্যসাগর দিয়ে যে বিকল্প পাইপলাইনের প্রস্তাব সেটি সামনে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। এই পাইপলাইনে সংযুক্ত হলে ইসরাইল, কাতার ও আজারবাইজানের গ্যাস ইউরোপের চাহিদা পূরণে ব্যবহার হতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়ার গ্যাসনির্ভরতা দূর করতে এটি হতে পারত একটি বড় বিকল্প।

তেলসমৃদ্ধ মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ইউরোপে তেল ও গ্যাস সরবরাহকারী জ্বালানি করিডোর হিসেবে তুরস্ক গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশটি প্রথমে নিজস্ব জ্বালানি চাহিদা মেটাতে চায়। এরপর তারা আঞ্চলিক চাহিদা মেটাতে আগ্রহী। তুরস্কে চারটি গ্যাস পাইপলাইন চালু আছে। তাদের মধ্যে দুটি এসেছে প্রাকৃতিক গ্যাসের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী রাশিয়া থেকে। ২০১৬ সালে মোট ব্যবহারের ৫৩ শতাংশ এই সোর্স থেকে এসেছে। এর পরেই রয়েছে ইরান ও আজারবাইজান, গত বছর মোট চাহিদার ৩১ শতাংশ সরবরাহ এসেছে এই দুই উৎস থেকে।

ট্রান্স-আনাতোলিয়ান প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন হলো তুরস্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন। এটি দক্ষিণ গ্যাস করিডোরের কেন্দ্রীয় অংশ, যা দক্ষিণ ককেশাস পাইপলাইন এবং ট্রান্স অ্যাড্রিয়াটিক পাইপলাইনের মাধ্যমে আজারবাইজানের বিশাল শাহ ডেনিজ গ্যাসক্ষেত্রকে ইউরোপের সাথে সংযুক্ত করে। আজারবাইজান ও তুরস্ক উভয়ের জন্য পাইপলাইনের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। এটি তুরস্কের বাইরে ইউরোপে প্রথম আজারবাইজানি গ্যাস রফতানির সুযোগ সৃষ্টি করে। এটি আঞ্চলিক শক্তির কেন্দ্র হিসেবে তুরস্কের ভূমিকাকেও শক্তিশালী করে। ১,৮৪১ কিলোমিটার লম্বা পাইপলাইনের নির্মাণকাজ মার্চ ২০১৫ সালে শুরু হয় আর এটি জুন ২০১৮ সালে উদ্বোধন করা হয়। নাগরনো কারাবাখকে কেন্দ্র করে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে একটি কারণ হতে পারে এই গ্যাস পাইপলাইন। যাতে এটি ইউরোপের জন্য রুশ গ্যাস সরবরাহের কোন বিকল্প হতে না পারে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ২০১১ সালে আরব বসন্তের জের ধরে সিরিয়ায় যে গণ-অভ্যুত্থানের শুরু হয়েছিল তার পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দেশটিতে পাশ্চাত্যের অনুকূল সরকার প্রতিষ্ঠা। আর এর বিরুদ্ধে রাশিয়ার নির্মম সামরিক অভিযানের পেছনে কারণ হিসেবে সক্রিয় ছিল সিরিয়ার ওপর রুশ নিয়ন্ত্রণ ও সেখানে সামরিক ঘাঁটি করে ভূমধ্যসাগরে নজরদারি করা আর কাতারের গ্যাস যাতে পাইপলাইনে ইউরোপ নেয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা। এরপর সিরিয়ার ওপর দিয়ে কাতারের গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের উদ্যোগ কার্যত আর এগোয়নি।

এসবের পেছনে ইউরোপের রুশ জ্বালানিনির্ভরতা হ্রাসের বিকল্প উৎস বন্ধের একটি সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হয়। অন্য দিকে ভূমধ্যসাগরে লেবাননের সমুদ্রসীমা বিরোধ মীমাংসা ছাড়া তেল-গ্যাস উত্তোলনের প্রচেষ্টা গুঁড়িয়ে দেয়ার হিজবুল্লাহর হুমকির সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। ইসরাইলের গ্যাস উত্তোলন ও তা ইউরোপে তুরস্কের পাইপলাইনের মাধ্যমে পাঠানোর প্রচেষ্টা যদি সফল হয়, তা হলে আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাশিয়ার সক্ষমতা অনেকাংশে দুর্বল হবে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ঘটনার পর পুরো বিশ্ব পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ইউরোপের নিরাপত্তা আতঙ্ক এতটাই বেড়েছে যে সুইডেন ফিনল্যান্ডের মতো দেশ যারা শত বছর ধরে নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিল, ন্যাটোতে যোগ দিতে মরিয়া প্রচেষ্টা নিয়েছে। জার্মানি বহু দশক ধরে সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে সামাজিক উন্নয়ন খাতে খরচ বাড়িয়েছিল। এখন ইউক্রেন সঙ্কটের পর তাদের সামরিক বাজেট দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। রাশিয়ার হুমকির মুখে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের বিষয়েও চিন্তাভাবনা করছে বার্লিন।

রাশিয়া ইউক্রেনে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় সফল হলে শুধু ইউরোপ নিরাপত্তাহীন হবে এমন নয়, মধ্য এশিয়ার স্বাধীন মুসলিম প্রজাতন্ত্রগুলোও হুমকিতে পড়তে পারে। তুর্কিয়ে ভাষাভাষী এসব দেশ একটি পৃথক তুর্কিয়ে রাষ্ট্র সংস্থা গঠন করে ভিন্ন একটি নিরাপত্তাবলয় তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু পুতিনের মহাপরিকল্পনায় এসব দেশকে রুশ অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় রয়েছে বলে এখন সন্দেহ করা হচ্ছে। কাজাখস্তানে রুশ সামরিক হস্তক্ষেপের পর তুর্কিয়ে রাষ্ট্র সংস্থার কাজ বেশ থমকে গেছে। এখন পুতিনের উপদেষ্টারা সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোতে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পরামর্শ দিচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে। সম্প্রতি পুতিন রুশ সা¤্রাজ্যের অধিপতি পিটার দ্য গ্রেটের প্রশংসা করে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি এ সময়ের পিটার হতে চান। পুতিনের তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে খ্যাত আলেক্সান্ডার ডুগিন অর্থোডক্স খ্রিষ্টবাদের ওপর ভিত্তি করে পিটার দ্য গ্রেটের রুশ সা¤্রাজ্য ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন পুতিনকে। পুতিনের এই নতুন কথায় রাশিয়াকে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান বলে মনে হচ্ছে।

ডুগিনের যে তত্ত্ব অনুসারে জর্জিয়ায় অভিযান, ক্রাইমিয়া দখল ও ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপ চলছে; তার পরবর্তী ধাপে রয়েছে মধ্য এশিয়া। কাজাখস্তানের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রাশিয়া গ্রহণ করেছে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। আজারবাইজান পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হতে পারে বলে মনে করা হয়। মধ্য এশিয়ার অন্যান্য প্রজাতন্ত্রেও রাশিয়া নানা অজুহাতে সেনা প্রেরণের পরিকল্পনা করছে বলে জানা যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে একপর্যায়ে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের যে ঐতিহাসিক বৈরিতা রয়েছে তা আবার ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েছে। এর আগে দুই দেশের মধ্যে তেরো বার যুদ্ধের কথা জানা যায়।

উত্তর সিরিয়ার তুর্কিয়ে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ৩০ কিলোমিটার প্রশস্ত নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে সেখানে সিরীয় শরণার্থীদের পুনর্বাসনের যে পরিকল্পনা এরদোগান গ্রহণ করেছেন, তাতে মস্কোর বাধা দেয়া অনেক বার্তা প্রদান করে। প্রথমত, পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইরান ও তার প্রক্সি মিত্রদের সমর্থন জোগাতে পারে রাশিয়া। ইরানের মাধ্যমে এবং সরাসরি আর্মেনিয়াকে আজারবাইজানের মাধ্যমে সমর্থন দিয়ে তুর্কিয়ে ভাষাভাষী রাষ্ট্রগুলোতে তুরস্কের প্রভাব দুর্বল করার চেষ্টা হতে পারে। সেলজুক সময় থেকে সাকাফি তথা পারসিয়ানদের সাথে যে ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব তুর্কিয়েদের ছিল, হয়তো তারই ধারাবাহিকতায় আজারবাইজান শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও তুর্কিয়ে বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে ইরান তার প্রতিপক্ষ অর্থোডক্স খ্রিষ্টবাদের প্রাণকেন্দ্র আর্মেনিয়াকে সমর্থন করে। এ অঞ্চলে নতুন কোনো সঙ্ঘাত তৈরি হলে মধ্যপ্রাচ্য ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের এই দ্বন্দ্বে ইরান ও তার মিত্রদের কঠিনভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারে রাশিয়া। এর অংশ হিসেবে সিরিয়া-তুরস্ক দ্বন্দ্বে ইরান-রাশিয়া দামেস্কের পক্ষে সামরিকভাবে মাঠে নামলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর এ দ্বন্দ্বে ওয়াইপিজি-পিকেকে টুলস হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এর মধ্যে সেই ইঙ্গিত মস্কো দিয়েছে। এ ছাড়া ইসরাইল সিরিয়ার বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় যে অব্যাহতভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল, সে ব্যাপারেও রাশিয়া কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। এটি এমন একসময় করা হচ্ছে যখন যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরব, আমিরাত ও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক মেরামত করার চেষ্টা করছে।

এই ধারায় চললে তুরস্ক ন্যাটো সদস্য হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়ার সাথে অনেক ইস্যুতে যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছিল, তা হুমকিতে পড়ে যেতে পারে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার ঐতিহ্যগত মিত্র সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরাইল, মিসরের সাথে বিরোধ কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে তুরস্ক। এ বলয়টি ধীরে ধীরে চীন-রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়াকে বাইডেন প্রশাসন ঠেকাতে চাইছে বলে মনে হয়। এ কারণে মুহাম্মদ বিন সালমানের ব্যাপারে আপত্তি একপাশে ঠেলে ইসরাইলের পাশাপাশি সৌদি আরব সফরে যাচ্ছেন জো বাইডেন। এ সফরে তথাকথিত আব্রাহাম চুক্তি সৌদি আরব পর্যন্ত সম্প্রসারণ করার একটি এজেন্ডা বাইডেনের রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির একজন পর্যবেক্ষক জানিয়েছেন, এ অঞ্চলে কয়েকটি দেশে শাসন পরিবর্তনের প্রচেষ্টা আবার চাঙ্গা হতে পারে। এর বড় শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে জর্দানের বাদশাহ আবদুল্লাহর। রাসূল সা:-এর সরাসরি বংশধর আবদুল্লাহর পূর্বপুরুষ একসময় জাজিরাতুল আরবের শাসক ছিলেন। উসমানীয় খেলাফত ভেঙে ফেলার পর ব্রিটিশরা এ অঞ্চলকে সৌদ পরিবারের কাছে দিয়ে জর্দানের শাসক করে আবদুল্লাহর পূর্বপুরুষদের। এ বংশের লোকেরা ইরাকেরও শাসক ছিলেন। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা থেকে বিদায় করা হয়। মডারেট চিন্তার ব্যক্তিত্ব বাদশাহ আবদুল্লাহ মসজিদুল আকসার আনুষ্ঠানিক খাদেম। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানেরও ইসলামের এই তৃতীয় পবিত্র প্রতিষ্ঠান আল আকসার খাদেম হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ পায়। কয়েক বছর আগে আবদুল্লাহর সৎভাই প্রিন্স হামজাকে দিয়ে জর্দানে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হয়। এতে বিন সালমানের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। সেই ধরনের আরেকটি পরিকল্পনা নতুন করে শুরু হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

হামজা বাদশাহ হলে কৃতজ্ঞতাবশত মসজিদুল আকসার খাদেমশিপ সৌদি আরবের হাতে ছেড়ে দিতে পারে বলে জানা যাচ্ছে। এসব কিছুর সাথে বিন সালমানের বাদশাহর পদে বসার সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সমঝোতা ছাড়া বাদশাহ সালমান কোনোভাবেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে চান না। বিন সালমান উম্মাহ লাইনের এসব চিন্তাভাবনা পরিত্যাগ করেছেন। ফলে তিনি বাদশাহ হলে সৌদি সমাজ ও পররাষ্ট্র কৌশল পুরোপুরি সেক্যুলার হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সব ধরনের রূপান্তরপ্রক্রিয়া তিনি শুরু করে দিয়েছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের এই উন্নয়নে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ‘আইটুইউটু’ জোট গঠন। বিশ্বে খাদ্যনিরাপত্তা জোরদার করা এবং কৃষি খাতে প্রযুক্তিসহায়তা বাড়ানো এই জোটগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য বলা হচ্ছে। যে আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বিন জায়েদের সাথে বাইডেনের ব্যক্তিগত পর্যায়ের বৈরিতা রয়েছে বলে মনে করা হয়, সেই দেশকে সাথে নিয়ে এ জোট গঠন করা হয়েছে। একই সাথে জোটের অন্য শরিক ভারত ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা অবস্থানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে রাশিয়ার জ্বালানি তেল, গম, ভোজ্যতেল আমদানি করছে। দিল্লি কৌশলগত পর্যায়ের সংবেদনশীল নানা সামরিক চুক্তি করেছে ক্রেমলিনের সাথে। কোয়াডের পর সেই ভারতের সাথে ইসরাইলকে পার্টনার করে নতুন জোটগঠনে রহস্যজনক বার্তা পাওয়া যাচ্ছে।

আমেরিকার গভীর ক্ষমতাবলয় মুখে যাই বলুক না কেন ইসরাইল এবং আমিরাতের মতো মুসলিম মিত্র দেশ আর সে সাথে ভারতকে তারা বিকল্প শক্তির অংশ বানাতে চায় বলে মনে হয়। প্রশ্ন হতে পারে বিশ্বের চার দিকে যেখানে যুদ্ধের ডঙ্কা, সেখানে কৃষি উৎপাদন ও প্রযুক্তি সহায়তার কথা কেন বলা হচ্ছে? বিংশ শতকের শেষার্ধ ছিল জ্বালানি তেলের বিশ্ব পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং রাশিয়া তাদের ক্ষমতা সংহত করার ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলকে কাজে লাগিয়েছে। হাইব্রিড প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারে বিশ্ব অনেক দূর এগিয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। ফলে কয়েক দশক পরে জ্বালানি তেলের এই নির্ণায়ক প্রভাব বিশ্বে থাকবে না। তখন দু’টি বিষয়ের ওপর কর্তৃত্ব বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ এনে দিতে পারে। এর একটি হলো রেয়ার আর্থ বা মূল্যবান ধাতব, যা কম্পিউটার সামগ্রী, চিপস, সাব-কন্ডাক্টর ইত্যাদি বানাতে ব্যবহার করা হয়। আর অন্যটি হলো কৃষিপ্রযুক্তি। রেয়ার আর্থের ক্ষেত্রে চীনের বিশাল মজুদ ও কর্তৃত্ব রয়েছে। এখন কৃষি প্রযুক্তির কর্তৃত্ব নিতে চায় পাশ্চাত্য। কৃষির এ প্রযুক্তির সাথে আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি কৌশলের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইসরাইল অনেক দূর এগিয়ে আছে। আর বিশ্বের ধনবান ব্যক্তিরা রহস্যজনক কারণে ব্যাপকভাবে আফ্রো-এশিয়ায় কৃষিজমি কিনতে শুরু করেছে। সম্ভবত তথ্যপ্রযুক্তির কর্তৃত্ব দিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকা যেভাবে বিশ্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে, সে রকম নতুন প্রভাব বিস্তারের টুলস হতে পারে কৃষিপ্রযুক্তি। এ ক্ষেত্রে ইসরাইল এখন এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, যা আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মরুভূমিতেও বৃষ্টি ঝরিয়ে চাষাবাদ করতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সৌদি আরব ইসরাইলের কাছ থেকে সেই প্রযুক্তি কিনছে। যুক্তরাষ্ট্র আইটুইউটু জোটে প্রযুক্তির জন্য ইসরাইলকে, কৃষি জমির জন্য ভারতকে আর মুসলিম বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের জন্য আমিরাতকে বেছে নিয়ে থাকতে পারে।

এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা এ ক্ষেত্রে কী হবে। ইসরাইল আমেরিকার কৌশলগত অংশীদার হলেও রাশিয়া ও চীনের সাথে একটি গভীর সমঝোতামূলক সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে এত দিন। এ সম্পর্কের গভীরতা কতখানি, তা বোঝা যায় ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে এডলফ হিটলারের মতো ইহুদি ইতিহাসের অংশীদার বলে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভের মন্তব্যে ইসরাইলি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পর পুতিনের দুঃখ প্রকাশে। রাশিয়ার সাথে ইসরাইল গোপন সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করবে। দেশটির এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী রুশ বংশোদ্ভূত ইহুদি। তবে ইউরোপে ইসরাইলের গ্যাস রফতানির বিষয়টি রাশিয়া মেনে নেবে বলে মনে হয় না। আর এ জন্য লেবানন ও হিজবুল্লাহকে ব্যবহার করা হতে পারে। অন্য দিকে চীনের সাথে ইসরাইলের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের গভীর সম্পর্কে বোঝা যায় দুই দেশের মধ্যকার সুপ্ত সম্পর্কের বিষয়টি। চীনও ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে ভারসাম্য বজায় রাখবে বলে মনে হয়। বিশ্বে ইসরাইলের কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী অন্যতম দেশ হলো চীন।

এখন প্রশ্ন হলো, মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক কৌশলগত যে পরিবর্তনের লক্ষণ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে তাতে বৃহৎ শক্তিগুলোর সাথে ইসরাইলের এই সমীকরণ ও আঞ্চলিক মুসলিম শক্তিগুলোর সম্পর্কের মধ্যে কি কোনো পরিবর্তন হবে? এ প্রশ্নের জবাব নিশ্চিতভাবে দেয়া কঠিন হলেও এ কথা বলা যায় যে, মধ্যপ্রাচ্যে বড় রকমের সঙ্কট তৈরি হতে যাচ্ছে। ইসরাইল তার জ্বালানি ও অর্থনৈতিক স্বার্থে লেবাননকে দেউলিয়া রাষ্ট্র করে হিজবুল্লাহর অস্তিত্বে আঘাত হানতে চাইবে। ইরান সেটি বরদাশত করবে না। ইসরাইল আব্রাহাম চুক্তির সম্প্রসারণের মাধ্যমে সৌদি আরবকে নিরাপত্তা সমর্থনের দোহাই দিয়ে নিজস্ব বলয়ে আনার প্রচেষ্টা নেবে। বিনিময়ে বিন সালমান সৌদি রাজতন্ত্র ও সৌদি আরবের নিরাপত্তার গ্যারান্টি চাইতে পারে। ইরানের সাথে সৌদি আরবের ব্যাক চ্যানেলে আলোচনা অব্যাহত থাকলেও চূড়ান্ত সমঝোতা হবে বলে মনে হচ্ছে না।

তুরস্ক শক্তিমান মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে একটি বলয় করার প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছিল। পাকিস্তানে শাসন পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা সেটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মালয়েশিয়া এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও ইন্দোনেশিয়ায় নতুন করে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে অনাহূত পরিস্থিতি তৈরি হবে সিরিয়া অথবা আজারবাইজানকে কেন্দ্র করে তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে প্রত্যক্ষ সঙ্ঘাত তৈরি হলে। দুই দেশের নেতৃত্ব এই সময় তেমন কিছু এড়াতে চায় বলে মনে হয়। তবে এ সঙ্ঘাত বাধিয়ে দিয়ে ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্র মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে দিতে একটি পক্ষ কাজ করছে বলে মনে হয়। সেটি সফল হলে তা এ অঞ্চলের জন্য ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি নিয়ে আসতে পারে; যার প্রভাব থেকে দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত থাকবে না।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement