২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ছোট হয়ে আসছে বিশ্ব

-

স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলে তিন ঘণ্টায় ঢাকা টু বরিশাল। ছোট হয়ে আসছে বিশ^। হারিয়ে যাচ্ছে বড় বিশে^র অনেক কিছু। হারিয়ে গেছে গয়না বোট, পালের নাও, রূপকথা আর রাক্ষস-খোক্কসের গল্প। বছর দশেক আগে ঢাকা সদরঘাট থেকে এমভি পারাবত করে বরিশাল গিয়েছিলাম। সময় লেগেছিল ১০ ঘণ্টা। বরিশালকে আমরা বলতাম ভাটি অঞ্চল। ভাটি অঞ্চলের নাম শুনলেই পিলে চমকে যেত। শৈশবে নৌকা করে আমার এক ভাইয়া গিয়েছিলেন বরিশালের সুন্দরবন। দুই মাসেও ফিরে না আসায় ধরেই নিয়েছিলাম, সুন্দরবনের বাঘ ভাইয়াকে খেয়ে ফেলেছে। সুন্দরবনের পরই সাগর। সাগরের ওই পাড়ে আছে একটি ভয়ঙ্কর রাক্ষস। রাক্ষসের সামনে একটি বড় পাথর। রাক্ষস পাথরটা লেহন করে করে খায়। লেহনে লেহনে পাথরটা যখন একেবারে ছোট হয়ে পড়ে তখনই পাথরের আশা বাদ দিয়ে সাঁতার দেয় রাক্ষস। অর্ধেক সাগর সাঁতরানোর পর, ‘আবার আসবে’ বলে ফিরে যায়। ফিরে গিয়ে দেখে পাথরটা আগের মতো বড় হয়ে গেছে। আবার লেহন শুরু। তাই আর সাগর সাঁতরানো শেষ হয় না। লেহন করতে করতে যেদিন পাথরটা একেবারে শেষ হয়ে যাবে সেদিনই রাক্ষসটা সাঁতরিয়ে সাগরের এই পাড়ে চলে আসবে। রাক্ষস যে দিন এই পাড়ে চলে আসবে সে দিন মানুষসহ জীবজন্তু সব খেয়ে শেষ করে ফেলবে।’ শৈশবে এই গল্প বলতেন দাদীমা। তাই শৈশবে দক্ষিণের সাগরদেশের নাম শুনলেই ভয়ে মুখের পানি শুকিয়ে যেত।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ‘ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল’ বাক্যটির সাথে পরিচয়। এর অর্থ প্রচুর ধান হয় বরিশালে। ভাটির দেশ বরিশাল আর উজানের দেশ সিলেট ধানের প্রধান এলাকা। বেপারিরা বড় বড় নৌকা নিয়ে ধান কিনতে যেতেন দেশের উজান ও ভাটির দেশে। শুধু ধান নয়, নারকেল, গোলপাতা ও সুন্দরী কাঠ সংগ্রহ করতে কয়েক মাসের জন্য ভাটির উদ্দেশে বাড়ি ছাড়তেন। ছয় দশক আগেও ভাটির দেশ ছিল ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদসঙ্কুল। বেপারিরা সাহসী ও জোয়ান মাঝি-মাল্লা ছাড়া ভাটি অঞ্চলে যাত্রা করতেন না। যে কয় মাস ভাটি অঞ্চলে অবস্থান করতেন সে কয় মাস ভয়ে বাড়ির লোকের নির্ঘুম রাত কাটত। বাড়ি এলে মাঝি-মাল্লাদের মুখে শুনতাম সুন্দরবনের বাঘ-মানুষের লড়াইয়ের গল্প। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা ধরে নৌকা চালনাসহ সুন্দরবনের বাঘ ও মানুষের লড়াইয়ের কাহিনী আরব্য উপন্যাসের রাক্ষস-খোক্কসের কাহিনীকেও হার মানাত। দাদীমার রাক্ষসের কাহিনীর সাথে গুলিয়ে ভাটি অঞ্চলের প্রতি বিরূপ সেই শৈশবেই।

ছোট মেয়ে মল্লিকার বিয়ে হয় সেই ভাটি অঞ্চলে। ভাটি অঞ্চলের নাম শুনেই বেঁকে বসেছিল সালমা। বিয়ের পরপর এডুকেশন ভিসায় দু’জনই লন্ডন। প্রস্তাব আসে বিয়াইবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার। প্রস্তাব আসতেই সালমাকে-
-চলো না, ভাটি অঞ্চল থেকে ঘুরে আসি। বিয়াইবাড়ি দেখতে গিয়ে দেখা হবে ষাটগম্বুজ মসজিদ, খানজাহান আলীর মাজার, সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটাসহ সুন্দরবনও।
সুন্দরবনের নাম শুনেই চমকে উঠে সালমা বলে-
-সেই ভয়ঙ্কর সুন্দরবন! যে বনে ভাইয়া হারিয়ে গিয়েছিল। বাঘ ধরে নিয়ে গেছে সংবাদ প্রচারের পর কান্নাকাটিসহ আহার-নিদ্রা ছেড়ে মায়ের হয়েছিল মরণদশা। তাই সুন্দরবনের নামটাই আমার কাছে আতঙ্ক।
-তখনকার সুন্দরবন আর এখনকার সুন্দরবন এক নয়। বাঘ তো দূরের কথা, সারাদিন ঘুরলে একটা হরিণ-শিয়ালেরও দেখা পাওয়া যাবে না। শৈশবের শোনা কাল্পনিক সুন্দরবন আর বর্তমানের সুন্দরবন এক নয়। তোমাকে ছাড়া তোমার মেয়ের বাড়ি আমি একা যাই কী করে?
-আবুল হোসাইনকে নিয়ে যান। ভ্রমণের নাম শুনলে ওর মাথা ঠিক থাকে না।
-আবুল হোসাইন, সাথে সাথে তোমাকেও যেতে হবে। প্রস্তুত হও। প্রকাণ্ড লঞ্চ। লঞ্চে রয়েছে হাটবাজার ও ব্যাংক। সেই লঞ্চে করেই যাবো। লঞ্চভ্রমণ আমার অনেক দিনের শখ। তোমাকেসহ পূরণ হবে লঞ্চ ভ্রমণের শখটাও।

১৪ ডিসেম্বর ২০১২ ভাগিনার ফলের আড়ত থেকে এক খাঁচা ফল ও এক কার্টন খেজুর নিয়ে আমরা তিনজন এক সন্ধ্যায় রওনা হই। সদরঘাট গিয়ে দেখি লঞ্চের সংখ্যার চেয়ে যাত্রী কম। আমাদের সিট আগেই বুকিং করা ছিল কেবিনে। ডেকে জনপ্রতি ভাড়া ছিল ২০০ টাকা। ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশে এমভি পারাবত-১০, সুন্দরবন-১০, সুরভিসহ আরো কয়েকটি লঞ্চের কর্মচারীরা ‘ডেকে একশ’ ‘ডেকে একশ’ বলে যাত্রী ডাকাডাকি শুরু করেন।

প্রায় একই সময়ে ঢাকা ছাড়ে দক্ষিণাঞ্চলগামী সব ক’টি লঞ্চ। রাতে চা খাওয়ার জন্য ডেকে নেমে দেখি এলাহি কাণ্ড। শত শত নারী-পুরুষ। আলাদা আলাদা ও পরিবার-পরিজনসহ। কিছু দূর পরপর ঝুলছে টিভি। কেউ ঘুমুচ্ছে, কেউ গল্প করছে, লুডু খেলছে, জোটবদ্ধ হয়ে তাস খেলছে কোথাও কোথাও। মাত্র ১০০ টাকায় এত রকমের বিনোদনসহ এমন ঘুমের স্থান কোনো দেশে আর কোথাও পাওয়া যাবে না। ১০০ টাকা যদি ঘুমের মাশুল হয়ে থাকে, তবে লঞ্চভাড়া ও বিনোদন ফ্রি কিংবা ১০০ টাকা যদি লঞ্চভাড়া হয়ে থাকে ঘুমের মাশুল ফ্রি।

সালমা ঘুমিয়ে গেলে কেবিনের পাশে লঞ্চের আঙিনায় বসে রাতের আকাশ, নির্জন নদী ও দূরের বাতি দেখেছি গভীর রাত পর্যন্ত।। লঞ্চের ঝিরিঝিরি শব্দে ঘুম এসেছিল। ঘুম ভাঙতেই দেখি বরিশাল লঞ্চ টার্মিনাল। ফজরের আজান হলেও ভোরের আলো ছড়ায়নি। এখন টার্মিনালে ভিড়তে গেলেই হুড়মুড় করে যাত্রী নামতে শুরু করবে। যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই লঞ্চ নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ঘাটে নামতেই দেখি বিয়াইবাড়ির লোকজন। লঞ্চঘাট থেকে সোজা ঝালকাঠি দীর্ঘপথ। দু’পাশের খাল-বিল, নদী-নালা, বন-বাদাড় ও দিগন্তবিস্তৃত ধানের জমি দেখতে দেখতে বিয়াইদের ভাড়াবাসা ঝালকাঠি রাজাপুর এলাকা। সকালে বিয়াইসহ আমি ও আবুল হোসাইন হাঁটতে বের হই। রাজাপুর হাইস্কুল পার হয়ে ডান দিকে খাল। খালের পাড়ে সুন্দর একটি বাড়ি। জানতে পারি, বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা মুহাম্মদ শাহজাহান ওমর বীর উত্তমের বাড়ি। বাড়ির পাশের খালে ইট ও বালুবাহী বড় বড় নৌকা। পাড়ে বালু তুলছেন শ্রমিকরা। তীব্র স্রোতে খালের পানি ঘোলা। জানতে পারি, এটি খাল নয়, ধানসিঁড়ি নদী। ধানসিঁড়ি নাম শুনেই কণ্ঠ থেকে বের হয়ে পড়ে-
‘?আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;
বিস্মিত হয়ে বিয়াইর কাছে প্রশ্ন করি, এই সেই জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত ধানসিঁড়ি?
-জি, এই সেই জীবনানন্দ দাশের ধানসিঁড়ি। ঝালকাঠির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির দৈর্ঘ্য ১৬০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ছিল ৪৯০ মিটার। সর্পিলাকারে এখান থেকে সুগন্ধা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ধানসিঁড়ি। ছিল প্রচণ্ড স্রোতও। কিন্তু বর্তমানে নদীটির অবস্থা করুণ। দীর্ঘ ৯ কিলোমিটার নদীর দুই পাশ সঙ্কুচিত হতে হতে এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। চর জেগে উঠতে শুরু করেছিল আমাদের জন্মের আগেই। ধানসিঁড়ির বুকে বাড়িঘর হয়ে হারিয়ে যায় নদী- শেষ চিহ্ন হিসেবে ধানসিঁড়ির স্মৃতি ধরে রেখেছে এই খাল। এখন এর প্রস্থ কোথাও ২৫ ফুট আবার কোথাও এর কম।

আমরা বরিশাল ঘুরে দেখতে আড়াই হাজার টাকা রোজ করে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করি। বিয়াইসহ চারজন প্রতিদিন সকালে বের হই। বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বরিশাল এক অসাধারণ স্থান দখল করে আছে বলে জানা যায়। দেশের অনেক কীর্তি আর কৃতিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে বরিশালের নাম। জীবনানন্দ দাশ, মহান নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, কুসুমকুমারী দাশ, অশ্বিনীকুমার দত্ত, আরজ আলী মাতুব্বর, বিজয়গুপ্ত, কামিনী রায়, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, কবি মুকুন্দ দাস, কবি সুফিয়া কামাল, ইত্যাদির হানিফ সংকেতসহ আরো অনেক কীর্তিমান ব্যক্তির জন্ম বরিশালে। হবে না কেন, নৈসর্গের রানী দক্ষিণাঞ্চল- ধানের ক্ষেতের ধারে দাঁড়ালে কণ্ঠ থেকে কাব্য অমনি অমনি বের হয়ে পড়ে।

কীর্তিমান ব্যক্তিদের মতো রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান ও স্থাপনাও। বরিশাল বিভাগের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান হলো পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, মাধবপাশার দুর্গাসাগর দীঘি, চাখারের শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক জাদুঘর ও উজিরপুরের গুঠিয়া বায়তুল আমান মসজিদ। এ ছাড়াও সুগন্ধা নদীর ওপাড়ে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ ও খানজাহান আলীর মাজার।

সালমা পীরবাড়ির মেয়ে। তার খুশির জন্য প্রথমেই ষাটগম্বুজ মসজিদসহ খানজাহান আলীর মাজার দর্শনের সিদ্ধান্ত নিই। ভোরে রওনা হয়ে ঘণ্টাখানেক পরই নদী সুগন্ধা। তীরে ছোট্ট বাজার। গুঁড়ো চিংড়ি প্রতি কেজি মাত্র ৩০০ টাকা। মেঘনাপাড়ের মানুষ তাই নদীর তাজা মাছ দেখলেই নজর যায়। নদীতে তীব্র স্রোত। অনেক কষ্টে গাড়ি নিয়ে ফেরি পার হই। সুগন্ধা নদীতে ভাসতে দেখেছি শতবর্ষের পুরনো (দুই পাশে পাখা বসানো ইঞ্জিন) মডেলের স্টিমার।

দূর থেকেই নজরে আসে মসজিদটি। ষাটগম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম স্থাপত্যের প্রধান চিত্তাকর্ষক নিদর্শন। খান আল-আজম উলুগ খানজাহান, বাংলার এক বৃহৎ অংশ জয় করে তৎকালীন সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহের সম্মানে বিজিত অঞ্চলের নামকরণ করেন খলিফাবাদ। তিনিই সম্ভবত ষাটগম্বুজ মসজিদের নির্মাতা। মসজিদে নফল নামাজ আদায় করে ভেতরের বিস্ময়কর নির্মাণ ও কারুকাজ দেখে বাইরে আসি। বাইরে উত্তর দিকের প্রাচীন গাছটির গোড়া বাঁধাই করা। বাঁধাই করা গাছের গোড়ায় বসতেই আবুল হোসাইন আমাদের দু’জনকে ক্যামেরাবন্দি করেন।

মসজিদের পেছনে পদ্মপুকুর। পদ্মপুকুর পাড়ের শীতল বাতাসে বিশ্রাম নিয়ে রওনা হই খানজাহান আলীর রহ:-এর মাজার দর্শনে। অনুসন্ধান করে জানা যায়, ‘খানজাহান আলী রহ: ছিলেন একজন মুসলিম ধর্মপ্রচারক এবং বাংলাদেশের বাগেরহাটের স্থানীয় শাসক। খানজাহান আলী ১৩৬৯ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আকবর খাঁ এবং মায়ের নাম আম্বিয়া বিবি। তার পূর্বপুরুষরা তুরস্কের অধিবাসী ছিলেন। খানজাহান আলীর প্রাথমিক শিক্ষা তার পিতার কাছে শুরু হলেও তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন দিল্লিস্থ বিখ্যাত ওলিয়ে কামিল পীর শাহ নেয়ামত উল্লাহর কাছে। তিনি কুরআন, হাদিস, সুন্নাহ ও ফিকহ শাস্ত্রের ওপর গভীর জ্ঞানার্জন করেন।

খানজাহান আলী ১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সেনাবাহিনীতে সেনাপতির পদে কর্মজীবন শুরু করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধান সেনাপতি পদে উন্নীত হন। ১৩৯৪ এ মাত্র ২৬-২৭ বছর বয়সে তিনি জৌনপুর প্রদেশের গভর্নর পদে যোগ দেন। পরবর্তীতে সুলতান খানজাহানের নেতৃত্বে ৬০ হাজার সুশিক্ষিত অগ্রবর্তী সেনাদলসহ আরো দুই লাখ সেনা নিয়ে বাংলা আক্রমণ করলে রাজা গণেশ দিনাজপুরের ভাতুরিয়াতে আশ্রয় নেন। ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে খানজাহান যশোরের বারবাজারে অবস্থান নেন এবং বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার শুরু করেন।

খানজাহানের প্রথম স্ত্রীর নাম সোনা বিবি। কথিত আছে, সোনা বিবি ছিলেন খানজাহানের পীর নুর-কুতুবুল আলমের একমাত্র কন্যা। খানজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী রূপা বিবি ওরফে বিবি বেগনি ধর্মান্তরিত মুসলমান ছিলেন। খানজাহান আলী তার দুই স্ত্রীর নাম অনুসারে সোনা মসজিদ এবং বিবি বেগনি মসজিদ নামে মসজিদ নির্মাণ করেন। হজরত খানজাহান আলী অক্টোবর ২৫, ১৪৫৯ (মাজার শরিফের শিলালিপি অনুযায়ী ৮৬৩ হিজরি ২৬ জিলহজ) ষাটগম্বুজ মসজিদের দরবার গৃহে এশার নামাজরত অবস্থায় ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। (গুগলের সৌজন্যে)

ষাটগম্বুজ মসজিদের কাছেই তার মাজার। মাজারের সামনে বিশাল পুকুর, যে পুকুরে একসময় জোড়া কুমির বাস করত। এখন কুমির নেই- আছে একদল লোক যারা সহজ সরল ধর্মভীরু মানুষকে ধোঁকা দিয়ে নানাভাবে টাকাকড়ি আদায় করে। বৃহত্তর পুকুরের শোভা দর্শনসহ সানবাঁধানো ঘাটলায় বসে মহানন্দে খেয়েছিলাম ডাবের পানিসহ কচি নারকেল।

ফিরে আসার পথে সুগন্ধা নদীতে পূর্ণ জোয়ার। যাওয়ার পথে যেখানে একপাল মহিষ কচুরিপানা খেতে দেখেছি, সেখানে এখন পরিপূর্ণ নদী। নদীর পাড়েই বিশাল এলাকাজুড়ে চলছে ওরসের আয়োজন। কোনো এক বিখ্যাত পীরের মাজারে ওরস মাহফিলের জন্য বাঁশ-খুঁটি দিয়ে প্যান্ডেল নির্মাণের তোড়জোড় চলছিল। জানা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পীরদের খুব আধিপত্য ছিল। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আধিপত্য কমতে থাকে।

আসার পথে শেরেবাংলা এ কে এম ফজলুল হকের মামার বাড়ির পাশে থামি। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও বাংলার বাঘ খ্যাত শেরে বাংলার ঝালকাঠি জেলা রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়ার মিয়া বাড়ি মাতুলালয়। বসবাস অনুপযোগী পুরনো পাকা মিয়া বাড়ি। ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর এই বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলার বাঘ। পরদিন সকালে প্রথমেই যাই বাংলা স্মৃতি জাদুঘরে। বানারীপাড়ার চাখারে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বসতভিটায় ২৭ শতক জমির ওপর গড়ে উঠেছে শেরেবাংলা স্মৃতি জাদুঘর। চার কক্ষবিশিষ্ট জাদুঘরে রয়েছে একটি অফিস রুম ও একটি লাইব্রেরি রুম। ঢুকেই হাতের বাম দিকে শেরে বাংলার একটি বিশাল প্রতিকৃতি, তার জীবনাদর্শের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সামাজিক রাজনৈতিক, পারিবারিক ছবি, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত শেরেবাংলার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড।

পরিপাটি সরু রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে মনে হলো, বরিশালটাই ফসলের মাঠ আর ছায়াঘেরা পথ। ছায়াঘেরা পথ ধরে ঘণ্টাদেড়ের পরেই একটা সুবৃহৎ ও সুউচ্চ ফটকের সামনে এসে থামে আমাদের ট্যাক্সি। ফটক পার হয়ে সামনে সানবাঁধানো ঘাট। জেলার অন্তর্গত একটি বৃহৎ দীঘি। বরিশাল শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে স্বরূপকাঠি-বরিশাল সড়কে মাধবপাশায় এর অবস্থান। শুধু জলাভূমির পরিমাণ ২৭ একর। পার্শ্ববর্তী পাড় ও জমিসহ মোট আয়তন ৪৫.৪২ একর। ১৭৮০ সালে চন্দ্রদ্বীপের পঞ্চদশ রাজা শিব নারায়ণ এই বিশাল জলাধারটি খনন করেন। তার স্ত্রী দুর্গামতির নামানুসারে নামকরণ করা হয় দুর্গাসাগর।

১৯৭৪ সালে সরকারের উদ্যোগে দীঘিটি আবার সংস্কার করা হয়। বাবুগঞ্জ উপজেলায় সম্পূর্ণ দীঘিটি উঁচু সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এই দুই দিকে প্রবেশের জন্য দু’টি গেট আছে। দীঘির মাঝখানে জঙ্গলপূর্ণ একটি ছোট দ্বীপ আছে। শীতকালে এখানে অতিথি পাখির সমাগম হয়। চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পবিত্র স্নানের উদ্দেশে সমবেত হন। মানুষের মুখে মুখে অনেক গল্প ও কল্পকাহিনী রয়েছে এই দুর্গাসাগর ঘিরে। বর্তমানে ‘দুর্গাসাগর দীঘির উন্নয়ন ও পাখির অভয়ারণ্য’ নামে একটি প্রকল্পের অধীনে বরিশাল জেলা প্রশাসন দীঘিটির তত্ত্বাবধান করছে।

বৃহত্তর মসজিদ দেখতে আমরা বানারীপাড়া সড়কে। উজিরপুর উপজেলা সড়কের পাশে গুঠিয়ার চাংগুরিয়া গ্রাম। এ গ্রামেই আছে দক্ষিণাঞ্চলের বৃহৎ মসজিদ। ২০০৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর উজিরপুরের গুঠিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা। শিক্ষানুরাগী এস সরফুদ্দিন আহম্মেদ সান্টু চাংগুরিয়ার নিজ বাড়ির সামনে ১৪ একর জমির ওপর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে গুঠিয়া বাইতুল আমান জামে মসজিদ, ঈদগাহ কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শুরু করেন। ২০০৬ সালে ওই জামে মসজিদ, ঈদগাহ কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। এই মসজিদ কমপ্লেক্সের ভেতরে ২০ হাজারের বেশি লোকের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ঈদগাহ ময়দান, এতিমখানা, একটি ডাকবাংলো, গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, লেক-পুকুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের বাগান রয়েছে। কমপ্লেক্সের মূল প্রবেশ পথের ডান দিকে বড় পুকুর। পুকুরের পশ্চিম দিকে মসজিদ, একসাথে প্রায় দেড় হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন। মসজিদ লাগোয়া মিনারটির উচ্চতা ১৯৩ ফুট। ঈদগাহর প্রবেশ পথের দুই ধারে দু’টি ফোয়ারা আছে। এই মসজিদের প্রায় দুই লাখ ১০ হাজার নির্মাণশ্রমিক কাজ করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়। (তথ্য : গুগল)

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement