২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ

- ছবি : সংগৃহীত

রাজনীতি কি রাজনীতিতে আছে, নাকি রাজনীতি হয়ে উঠেছে প্রকাশ্যে এমন সব কথা বলার মঞ্চ, যা প্রতিপক্ষকে উসকানি দিয়ে চলে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে হুমকি-ধমকি হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কোনো রকম অসদাচরণেরই সুযোগ নেই। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পদ্মা সেতু থেকে নিচে ফেলে দেয়ার কথা বলেছেন সরকারপ্রধান। আর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পদ্মার পানিতে চুবানোর কথাও বলেছেন তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অপরাধ তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে কটূক্তি করেছেন। আর ড. ইউনূসের অপরাধ তিনি নাকি বিশ্বব্যাংককে নিষেধ করেছেন পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করতে। সেই অপরাধে তাদের কপালে ওই রকম শাস্তির নির্দেশনা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন উক্তি আমরা প্রত্যাশা করি না। তিনি যখন ক্ষমতার শপথবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, তখন বলেছিলেন কারো প্রতি অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। প্রত্যেককে সমানভাবে, সমান চোখে দেখবেন। সেটাই রাষ্ট্রের নৈতিক শক্তির উৎস। কিন্তু সেই শপথের মর্যাদা এমন বাক্যে কতটুকু রক্ষা পায় তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বেগম খালেদা জিয়া পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে হাস্যকর মন্তব্য করেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না। সেই কথারই জবাব হিসেবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের প্রাক্কালে খালেদা জিয়াকে পদ্মা সেতু থেকে তাকে ফেলে দেয়ার যে পরামর্শ দিয়েছেন সরকারপ্রধান তা গণতান্ত্রিক রাজনীতির আওতায় পড়ে না। সত্যিই আমাদের প্রজ্ঞামতী প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হতে পারেন, বিক্ষুব্ধ হতে পারেন, তিনি মর্মে মর্মে বেদনায় নীল হতে পারেন, কিন্তু ক্ষমতার মসনদে বসে এমন একটি বাক্যও বলতে পারেন না, যা সৌজন্যবোধের হানি ঘটায়।

আবার বিএনপির মহাসচিবের এ-সংক্রান্ত বক্তব্যেও আমরা শরমিন্দা হয়েছি। তিনি বলেছেন, পদ্মা সেতু কারো বাবার টাকায় নির্মিত হয়নি। কথাটা যতই সত্য হোক না কেন, এই ভাষায় কথা বলাটা সৌজন্যের দিক থেকে মানানসই নয়। ফখরুল ইসলাম আলমগীর যে তার নেত্রীর বিরুদ্ধে বলা প্রধানমন্ত্রীর জবাব দিয়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু একজন গণতন্ত্রমনস্ক রাজনীতিক তার রাজনৈতিক সৌজন্য থেকে সরে গেলে তা এনার্কির দিকেই চলে যায়- সেটা নিশ্চয় জনাব আলমগীর বোঝেন। সরকারের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পই কারো নিজের টাকায় হয় না। সেই টাকার মালিক মূলত দেশের মেহনতি জনগণ। জনগণের ট্যাক্সের টাকা ও তাদের কাঁধে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ চাপিয়ে দিয়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়। উচ্চ সুদে আনা ঋণ আর বাণিজ্য ঋণের নানা ফ্যাঁকড়া আছে, সেই প্যাঁচের মধ্যে পড়ে প্রতি বছরই সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা সুদ গুনতে হয়। সেই টাকাটাও কারো বাপের পকেট থেকে যায় না। যায়, এই দেশের মালিক জনগণের কষ্টার্জিত তহবিল থেকে। রিজার্ভে যে বৈদেশিক মুদ্রা জমেছে, তার মালিকও শ্রমজীবী মানুষ। সেই মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যেই যদি পদ্মা সেতু নির্মিত হয়ে থাকে, তাতে সরকারের বগল বাজানোর কিছু নেই। শেষাবধি পদ্মা সেতু ব্যবহারকারীরাই বুঝবেন, এর উপকারিতা তাদের জন্য কতটা হয়েছে। নাকি তা শুধু রাজনৈতিক বিভা ছড়ানোর জন্য তৈরি হয়েছে। ১২-১৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প যখন প্রাক্কলিত ব্যয়ে ও সময়ে সম্পন্ন না হয়, তখন রাজনৈতিক সরকারের প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে এবং সেটাই যথার্থ এবং জনগণের তরফে দেশের বিরোধী রাজনীতিকরা তার সমালোচনা করবেন, এটাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির রীতি। সেই রীতিতেই খালেদা জিয়া কড়া মন্তব্য বা বিরূপ কথা বলে থাকতে পারেন। তাই বলে তার জবাব সরকারপ্রধান হিসেবে ওই ভাষায় দেয়া অনভিপ্রেত। এটা শুধু উসকানিই নয়, যেন পরোক্ষে বিএনপিকে রাজনৈতিক ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পথে নামতে উসকানি দেয়া। এই উসকানি ক্ষমতাসীন দলের সবশ্রেণীর নেতাদের কণ্ঠেও শোনা যাচ্ছে। গণতন্ত্রবিহীন রাজনীতির ময়দানে এমনটাই হওয়ার কথা। দেশে একটি নৈরাজ্যের পরিবেশ তৈরি করতে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য আমাদের অসহায় করে তুলছে।

অসহিষ্ণু রাজনৈতিক নেতাদের হাতে তাই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কেউ দেয় না। প্রতিমন্ত্রী ও এমপি মুরাদের কদর্য ভাষায় বিরক্ত হয়েই সরকার তাকে বিদায় করেছে। একজন রাজনীতিকের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। ধীর-স্থির ও ঠাণ্ডা মাথায় রাজনীতিকদের সরকার চালাতে হয়।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহমর্মিতা, শ্রদ্ধাবোধ, ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিকতা, আদর্শ ও বিদ্যাশিক্ষার এখন আকাল চলছে। এ-কথার জন্য ক্ষমা করবেন মাননীয় ক্ষমতাবান যারা সরকারে আছেন ও সরকারের বাইরে আছেন। বিদ্যাশিক্ষা কেবল ডিগ্রি অর্জন নয়, তার ভেতরে আরো কিছু নিহিত আছে যা কালচারকে চিহ্নিত করে।

আওয়ামী লীগ যেমন বিএনপিকে শত্রু বিবেচনা করে, তেমনি বিএনপিও আওয়ামী লীগকে শত্রু মনে করে। এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের গণতান্ত্রিক সমাজের বড় শত্রু। এই শত্রুকে অপসারণ করাই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান কর্তব্য। ক্ষমতাকেদ্রিক রাজনীতি জনগণ-বিচ্ছিন্ন, এটা প্রমাণ হয়েছে অনেক আগেই। সে-কারণেই ভোটের সময় আসন-দখল ও ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বিজয় অর্জনে কোনো লজ্জা-শরম পান না রাজনৈতিক কর্মীরা। সেখানে পুলিশও রাজনৈতিক সরকারের কর্মী হিসেবে কাজ করে। জাতির মন মানস থেকে, লজ্জাবোধ উবে যাওয়ায়, আমরা প্রকাশ্যে বোমা মেরে প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে উদ্যত হই। এ রকম চিন্তা যখন রাজনীতির ভেতরে ঢোকে, তখন বুঝতে হবে, রাজনীতি এখন হঠকারীদের দখলে। রাজনীতি মানুষ হত্যা, রাজনীতিক হত্যা করা নয়, রাজনীতি মানুষের বৃহত্তর কল্যাণে। রাজনীতি ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথরেখা, দলীয় চিন্তার লোভের পথ তৈরি নয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো গত ৫০ বছর ধরে সেই পথেই হেঁটেছে, যে-পথে জনগণ নেই, জনগণের কোনো কিছু ছিল না। যে উন্নতিটুকু হয়েছে, তার বেশির ভাগই অপরিকল্পিত। তাই তো ঢাকা মহানগর ক্রমবর্ধমান একটি গার্বেজ ফ্যাক্টরিমাত্র।

২.
আমাদের প্রিয়জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির সাবেক অধ্যাপক, সাহিত্যিক, গল্পকার সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম দুদিন আগে (বৃহস্পতিবার) বলেছেন, আমরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখন বিসিএস চর্চায় আছি। আমি বলি, ‘বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয় বলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হোক। সেখানে প্রিলিমিনারি, ‘ভাইভা, ইত্যাদি নামে বিভাগ থাকবে। দারুণ চলবে কিন্তু।’

বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে এক পাবলিক লেকচারে সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এসব কথা বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাজমুল করিম স্টাডি সেন্টার ‘৫০-এ বাংলাদেশ : অতীত, বর্তমান এবং চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এই বক্তৃতার আয়োজন করে। (প্রথম আলো/১৯ মে, ২২)
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ক্ষোভ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা আমরা বুঝতে পারি। কারণ শিক্ষার্থীগণ এখন আর পড়াশানা করেন না, এক ধরনের নোটবই সৃষ্টি হয়েছে বাজারে, সেই জ্ঞানবুকই তাদের বিসিএস পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেয়। আর আছে রাজনৈতিক সরকারের ততোধিক রাজনৈতিক ক্যাডার প্রশাসনিক বাহিনী, যারা তাদের পাস করিয়ে দিয়ে সহযোদ্ধা করে নেন। দখলদার ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের হাতে তৈরি ও পরিত্যক্ত প্রশাসন ধারা জোড়াতালি দিয়ে আজ পর্যন্ত চালিয়ে নেবার জন্য ‘মাননীয় সরকারগুলোকে’ পুরস্কৃত করা উচিত বর্তমান ব্রিটিশ সরকারের। তারা কি দেখতে পাচ্ছেন না, আমাদের চেতনায় কেবল নকল করা আর শর্টকাটে পাস করার বিদ্যা তারাই অসতর্কতায় দিয়েছিলেন। আমরা সেটাই বহন করছি। আমরা একবারও ভাবছি না যে পৃথিবী এগিয়ে গেছে অনেক দূর, মানে ডিজিটাল যুগের আলোয় আমরা আলোকিত, উদ্ভাসিত-তারপরও সেই আলোতে নিজেদের চেহারা দেখতে পারছি না। এটা কি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক নয়? নাকি একে আমরা সৌভাগ্য বলব? আমাদের গ্রামের অনেকেই স্বাক্ষর করতে পারে না, প্রাইমারি স্কুলের অভাবে, কিন্তু আমরা ডিজিটালের রঙিন স্বপ্নের গীত গাইছি।

প্রগতি শব্দটি আমাদের বহমান সংস্কৃতি থেকে উবে গেছে। আজকাল আর কেউ ওই শব্দটি ব্যবহার করেন না। তারা ব্যবহার করেন ডিজিটাল শব্দটি। কিন্তু ডিজিটালের গতি এতটাই নন-ডিজিটাল যে কি বলব। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে সরকারি ভাষ্যে, কিন্তু জ্ঞানের আলো পড়ার ব্যবস্থা হয়নি আজো। এতেও আমরা লজ্জিত নই, কেন না, ওই ভূষণটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের তির্যক বক্তব্য আমাদের হুঁশ ফেরাতে পারবে বলে মনে হয় না। কেননা, আমরা তো জ্ঞানার্জনের পথে নেই। আমরা কেবল সার্টিফিকেট-সর্বস্ব হয়ে জ্ঞানার্জনকে বিতাড়িত করে চলেছি। আজকে এই যে রাজনৈতিক সরকারের ভেতরে অসৌজন্যতা, তার পেছনে ওই অশিক্ষা-রাজনৈতিক কুশিক্ষাই দায়ী।

এই রাজনৈতিক কু-সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এর জন্য দায়িত্ব নিতে হবে দেশের তৃণমূলের শিক্ষার কারিকুলাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম রচনার হোতাদের। জাতির ন্যায় ও লক্ষ্য স্থির করবে সেই শিক্ষা ও আদর্শ।


আরো সংবাদ



premium cement