১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সিংহাসন বনাম সংবিধান

- ছবি : নয়া দিগন্ত

রাজা বা রানী (অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, সরকার, সম্রাট, বাদশাহ, রাষ্ট্রনায়ক তথা শাসকগোষ্ঠী) ভিন্ন ভিন্নকালে বা সময়ে রাজত্ব দখল করেছে বিভিন্ন কৌশলে, কোথাও অস্ত্রের জোরে, কোথাও নিষ্ঠুর বর্বরতার মাধ্যমে, কোথাও ক‚টকৌশলে, কোথাও পারিবারিক অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে, কোথাও উত্তরাধিকারসূত্রে, কোথাও নির্বাচন নামক একটি পদ্ধতি বা প্রহসনমূলক আমলানির্ভর নির্বাচনের মাধ্যমে। ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রনায়করা যখন সাধারণ মানুষের মৌলিক বা জন্মগত অধিকার ছিনিয়ে নিতে থাকে এবং অধিকারবঞ্চিত মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখনই গণমানুষ রক্ত ঝরিয়েছে এবং এ রক্তের বিনিময়ে পর্যায়ক্রমে গণমানুষের অধিকার আদায়ের রক্ষাকবচ হিসেবে রচিত হয়েছে সংবিধান, যা কোথাও লিখিত বা কোথাও অলিখিত।

সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ দার্শনিক লক এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো প্রমুখের লেখায় এ কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয় যে, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগেই মানুষ যেসব অধিকার স্বভাবতই অর্জন করছে রাষ্ট্র সেগুলো কেড়ে নিতে পারে না। তাদের মতে, জীবনের অধিকার, স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগেও ছিল। ঝড়পরধষ ঈড়হঃৎধপঃ বা সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করে এবং রাষ্ট্রকে নির্দেশ দেয় এসব অধিকার রূপায়ণের। সুতরাং বলা যায়, মানুষ রাষ্ট্রের কাছে তাদের অধিকারগুলো সমর্পণ করেনি বরং সেগুলো আমানত রেখেছে মাত্র। তারা বলেন, ‘রাষ্ট্র কখনো মানুষের স্বভাবজাত অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কারণ মানুষ জন্মেছে বিবেক আর যুক্তি নিয়ে এবং যা কিছু যুক্তি ও বিবেকের বিরুদ্ধে তা-ই মানবতার বিরুদ্ধে। বস্তুত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানবতার যে আহ্বান তা-ই হচ্ছে মানবাধিকারের ভিত্তি’ (সূত্র : বাউবি সমাজকল্যাণ বিভাগের গবেষণাপত্র)।

মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার বা জন্মগত অধিকার একই সূত্রে গাঁথা। অধিকার হচ্ছে এমন এক বিষয় যা আদায়যোগ্য। মানুষ এক প্রকার জীব বা প্রাণী, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর সাথে তারতম্য হলো চিন্তা ও উদ্ভাবনের ক্ষমতা মানুষকে অন্যান্য প্রাণী জগৎ থেকে আলাদা করে রেখেছে। এই শক্তি ও ক্ষমতা নিয়েই মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে, অথচ শাসক গোষ্ঠী এ জন্মগত অধিকারই ছিনিয়ে নিয়েছে বারবার। কিন্তু গণমানুষ যখন জেগে উঠেছে তখনই তারা তাদের অধিকারকে ফিরে পেয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে একটি বহুল প্রচারিত প্রবাদ ‘করহম পধহ ফড় হড় ৎিড়হম’; অর্থাৎ রাজা ন্যায়, অন্যায়, জুলুম, অত্যাচার যাই করুক না কেন, তা অন্যায় বা ভুল হিসেবে গণ্য হবে না। এ প্রবাদের সূত্র ধরে রাজার প্রতিনিধি রাজ কর্মচারী, আমলা, চাকর-বাকর সবাই সাধারণ মানুষের ওপর যেভাবে খুশি সেভাবেই নিপীড়ন, নির্যাতন করত। উল্লেখ্য, হাউজ অব লডস অফধসং বনাম ঘধুষড়ৎ (১৯৪৬) এবং জড়ুংঃবৎ বনাম ঈধাবু দু’টি মামলায় ‘রাজা অন্যায় বা ভুল করতে পারে না’, প্রবাদের ওপর ভিত্তি করে গণমানুষের অধিকার লঙ্ঘনকারী ব্রিটিশ রানীর প্রতিনিধির পক্ষে রায় ঘোষণা করলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ‘ঞযব ঈৎড়হি চৎড়পবফরহম অপঃ’ ১৯৪৭ পাস করে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে ‘রাজা অন্যায় বা ভুল করতে পারে না’ প্রবাদটির শক্তি অনেকাংশে ক্ষুণœ করে দেয় (সূত্র : গবঃৎড়ঢ়ড়ষরঃধহ পড়ষষবমব ড়ভ ষধি প্রণীত পড়হংঃরঃধঃরড়হধষ ষধি পৃষ্ঠা-৯৭)। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট স্বাধীন ও স্বার্বভৌম ছিল বলেই উল্লিখিত আইনটি পাস করা সম্ভব হয়েছিল, এমনটি আমাদের দেশে এখন সম্ভব কি?
বর্তমান বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলো স্বাধীন ও সার্বভৌম বটে, কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। কোনো না কোনোভাবে অন্য কারো উপরে নির্ভর করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- র‌্যাব ও কতিপয় উচ্চপদস্থ আমলার ওপর আমেরিকা সম্প্রতি যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তা প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের সাহায্য কামনা করেছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌমিকতার কমজোরির কথা এখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় প্রকাশ পেয়েছে।

অনুরূপভাবে পার্লামেন্টকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বলা হলেও বাস্তবতা ও সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রকৃত অর্থে সার্বিকভাবে একে কি স্বাধীন বলা যায়? সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যেকোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইয়া সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করলে তার সদস্য পদ বাতিল বা শূন্য হইয়া যাইবে।’ অন্য দিকে পার্লামেন্টে যিনি সরকার দলীয় নেতা তিনিই প্রধানমন্ত্রী। অতএব, প্রধানমন্ত্রীর কোনো অন্যায় বা ভুল সিদ্ধান্ত বা কাজের সমালোচনা করলে বা বিরুদ্ধাচরণ করলেও মন্ত্রিত্ব বা সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে। সাংবিধানিক এ বাধ্যবাধকতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও একজন প্রধানমন্ত্রীকে স্বৈরাচারী হওয়ার পথ সুগম করে দেয়। বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগের ভারসাম্য নিয়েও অনেক তর্কবিতর্ক রয়েছে।

টাকার মান কমে যাওয়া, বেকারত্ব, শিক্ষাব্যবস্থার মানের ক্রমাবনতি, লাগামহীন দ্রব্যমূল্য, সামাজিক বৈষম্য, রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুসম বণ্টনের আকাশ পাতাল তারতম্য, ধনী দিন দিন ধনকুবে পরিণত হওয়া, অন্য দিকে গরিব ভিটেমাটি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে রাজধানীর বস্তিতে অবস্থান নিচ্ছে, ব্যাংক উজাড় করে হাজার হাজার কোটি ঋণ নেয়া অর্থ লোপাট, মুদ্রা পাচার প্রভৃতি সমস্যা যখন প্রকট তখনো সরকার জনমনে জোর করে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে, ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’

সরকার প্রচার করছে অবকাঠামোর দিক দিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু সংবিধানে উল্লিখিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার গণমানুষ কতটুকু ভোগ করতে পারছে? সংবিধান ছাপার অক্ষরে কাগজে মোড়ানো কোন জড়বস্তু নয়, বরং এটি একটি চেতনা ও চলমান শক্তি। কিন্তু শাসকরা যখন তাদের প্রয়োজন তখনই এ চলমান শক্তিকে কাগজে মোড়ানো একটি জড়বস্তুতে পরিণত করে আসছে।

মানবাধিকারের অন্তর্নিহিত বিষয় হচ্ছে মানুষ ও অধিকার। মানুষ হিসেবে জন্মেছে বলেই এসব অধিকার তার প্রাপ্য রয়েছে। এ পাপ্যতা কেউ কাউকে দান করতে পারে না; পারার কথা নয়। কারো কৃপা বা করুণার ওপর এ প্রাপ্তি নির্ভরশীল নয়। মানুষের জীবনমৃত্যু যেমন মানুষ থেকে অবিচ্ছেদ্য তেমনি এসব অধিকার অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য। জাকাত যেমন দয়া বা দান নয়, বরং সম্পদশালীদের অপরিহার্য দায়িত্ব। এ দায়িত্ববোধ যার নেই সে ইসলাম ধর্ম মোতাবেক ঈমানদার নয়। তেমনি অধিকার পাওয়া একটি ন্যায্য দাবি, যা অধিকারবঞ্চিত মানুষগুলো বুঝতে চায় না বা তাদের বোধগম্য হয় না।

পৃথিবীব্যাপী মানবাধিকার বা অধিকার হরণ করা হচ্ছে অধিকার রক্ষার নামে। জনগণের অধিকার হরণে সম্মিলিত যে আইন প্রণয়ন ও জারি করা হয় সেখানেও লেখা থাকে জনস্বার্থে আইনটি জারি করা হলো। গণমানুষের অধিকার হরণ করে যারা জটিল করে আইন প্রণয়ন করেছেন সে আইনে তারাই জেল খেটেছেন এমন নজিরও আছে, নিয়তির এ পরিণতি দেখেও শিক্ষা হয় না। শাসকদের স্বার্থে অধিকার হরণকারী আইন নিকট ভবিষ্যতের আইন প্রণেতাদের জন্য সুফল দেখা গেলেও দূরবর্তী ভবিষ্যতের জন্য সার্বিকভাবে কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনি, বরং বুমেরাং হয়েছে।

মানুষ বিদ্রোহ করে, বিপ্লব করে, প্রতিরোধ করে, প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত নিয়মের বিরুদ্ধে, অনিয়মের বিরুদ্ধে, অন্যায় অত্যাচার ও নিপীড়ন উৎপীড়নের বিরুদ্ধে। মানুষ বিদ্রোহ করে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে। কিন্তু কখন মানুষ বিদ্রোহ করে? মানুষ তখনই বিদ্রোহ করে যখন স্বাভাবিকভাবে অন্যায়, অত্যাচার, অনিয়ম ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়া যায় না। যখন আইনের অনুশাসন সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে না তখনই মানুষ বিদ্রোহ করে, বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়। প্রকৃতপক্ষে বিদ্রোহ সরল স্বাভাবিক কোনো পথ নয়। এটি প্রতিকারের সর্বশেষ উপায়। মানুষ যাতে এ চূড়ান্ত পথটি গ্রহণ করতে বাধ্য না হয়, যাতে বিদ্রোহের আশ্রয় করতে না হয় সে জন্য আইনের অনুশাসন সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা দরকার। আইন যদি মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতাকে সুরক্ষা করে তা হলে মানুষ বিদ্রোহের পথে এগোবে না। তবে আইন হতে হবে সর্বজনীন। ক্ষমতার লোভে সমাজে প্রভাবশালী, সম্পদশালী ও শাসকগোষ্ঠী যেভাবে দিন দিন বিবেকহীন হয়ে পড়ছে সেখানে বিদ্রোহ ছাড়া অন্য কোনো পন্থা খোলা আছে কি? সম্প্রতি পাশের রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement