২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কিতা কন রনি ভাই! আরে ও তো আমাদের ফজাই

- ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি সিলেট ভ্রমণে আমি যার মেহমান হয়েছিলাম তিনি সবদিক থেকেই ব্যতিক্রমী একজন মানুষ। তার বিনয়, ভদ্রতা ও আতিথেয়তা থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমার সচরাচর অভিজ্ঞতা হলো, ধনীরা অহঙ্কারী হয়। বুদ্ধিমানরা মনে করে তারা সব কিছু জানে এবং বোঝে। ফলে এই শ্রেণীর লোকজন বেশি একটা লেখাপড়া করে না। আর অন্য দিকে, কম বুদ্ধির লোকেরা বেশি লেখাপড়া করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আঁতেল বা আধা পাগলা প্রকৃতির প্রাণীতে পরিণত হয়। এর বাইরে বাবা-মায়ের শাসন-আদরযতœ এবং অতিরিক্ত চেষ্টা তদবিরের ফলে যারা শিক্ষাজীবনে ভালো ফল করে এবং বড় চাকরিবাকরি করে তাদের বিরাট অংশ স্বার্থপর-লোভী এবং ভাবলেশহীন হয়ে পড়ে।

উল্লিখিত অভিজ্ঞতার বাইরে আমার আরো কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে। যেমন দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা এবং অবহেলা-অযতেœর শিকার হওয়া লোকজন যদি সফল হয় তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না। একধরনের হীনম্মন্যতা তাদের পেয়ে বসে এবং তারা যদি সফলতার চূড়ায় পৌঁছে যায় তবে নিজের আত্মীয়-পরিবারকে অস্বীকার করে সৈয়দ বংশের সন্তান হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করে। আর অন্য দিকে, বাবা-দাদাদের সহায়সম্পত্তি ও সুুনাম নিয়ে বড়াই করা লোকজন সবসময়ই অলস-অকর্মণ্য এবং অপদার্থ প্রকৃতির হয়ে থাকে। আমার বাস্তব জীবনে খুব অল্প লোককেই দেখেছি যাদের মধ্যে জ্ঞান-বুদ্ধি-আভিজাত্য, কমনসেন্স, দয়া-মায়া-বিনয় ও নেতৃত্বের গুণাবলি যুগপৎভাবে সন্নিবেশিত থাকে। ফলে এ ধরনের কাউকে পেলে আমি রীতিমতো পাগলপারা হয়ে সেই লোকটির সাথে ভাব বিনিময় করি যেমনটি করেছিলাম সিলেটের ডা: নাসিমের সাথে।

ডা: নাসিম সম্পর্কে আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বেয়াই অর্থাৎ বন্ধুর কন্যার শ্বশুর। আমার বন্ধুটি বয়সে আমার চেয়ে প্রায় ১৫ বছরের বড় এবং তার বেয়াই অর্থাৎ ডা: নাসিমের বয়স আমার চেয়ে ১০ বছর বেশি। তাদের পেশা আমার থেকে ভিন্নতর এবং আর্থিক সঙ্গতি আমার চেয়ে বেশি বৈ কম হবে না। তো এত্ত সব বৈপরীত্য সত্তে¡¡ও তাদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা আমাকে মাঝে মধ্যে আশ্চর্য করে। আমার মতে চিন্তাচেতনা, অভ্যাস এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পারস্পরিক মিল থাকলে পদ-পদবি-বংশ-অর্থ বিত্ত-ক্ষমতা ইত্যাদি কোনো কিছুই বন্ধুত্বের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না এবং সেই কারণে মাত্র তিন দিনের সফরে সিলেটের রাজনীতি-অর্থনীতি এবং সমাজ সম্পর্কে যে ধারণা পেয়েছি তা আমার পক্ষে ইতঃপূর্বে অর্জন করা সম্ভব হয়নি।

আমি সিলেটে বহুবার গিয়েছি এবং প্রথম সারির হোটেলগুলোতে থেকেছি। এবার যখন সিলেটে বেড়াতে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠল, তখন আমার বন্ধু শিব্বির মাহমুদকে বললাম, কই থাকব। তিনি সহাস্যে বললেন, বিয়াইবাড়ি যাচ্ছি- তার নিজেরই হোটেল আছে- থাকাখাওয়া ফ্রি। আমি হোটেলের নাম জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, গ্র্যান্ড নূরজাহান। হোটেলটি সম্পর্কে আমি আগে থেকেই জানতাম। এটি সিলেট শহরের সবচেয়ে বড় হোটেল এবং তারা সম্প্রতি ১৮ তলার উপরে ডাবল হাইট দিয়ে যে ইনফিনিটি টাইপের আকর্ষণীয় সুইমিংপুল করেছে এবং রুফটপ রেস্তোরাঁ করেছে, সেটির বিজ্ঞাপন সবসময় সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ভাসতে থাকে। বিজ্ঞাপনে যা দেখানো হয় তাতে মনে হয় হোটেলটি চারতারকা মানের; কিন্তু আকার আকৃতি বা রুম সংখ্যার বিচারে খুবই বড় হবে। সুতরাং আমার সিলেট ভ্রমণ যে আরামদায়ক হবে তা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম।

ঘটনার দিন সিলেট পৌঁছে বেশ অবাকই হলাম। সিলেট শহরে ২০ তলা বিল্ডিং- তাও আবার হোটেল এবং যা কিনা অতিথিতে পরিপূর্ণ। অর্থাৎ ঘটনার দিন ৯৮ শতাংশ রুমে অতিথি ছিল। বেশির ভাগ রুম অনলাইনের মাধ্যমে বুকিং হয়ে যাওয়ার কারণে হোটেলের ভিআইপি রুমগুলো বহু আগেই বুক করা ছিল। ফলে অন্যান্য সময় আমার বন্ধু ও তার মেহমানদের জন্য যে প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট বরাদ্দ করা হয় তা এই যাত্রায় আমাদের নসিবে জুটল না। ডা: নাসিম এবং তার একমাত্র পুত্র অর্থাৎ আমাদের জামাই নাহিয়ান খুবই লজ্জিত হয়ে পড়লেন এবং আমাদের হোটেল রুমের পরিবর্তে তাদের বাসায় থাকার অনুরোধ জানালেন। তারা হোটেলটির ১৪ তলায় পুরোটা জায়গায় থাকেন- অর্থাৎ প্রায় ১২ হাজার বর্গফুটের সেই বাসায় ঢুকে এবং বাসার সাজসজ্জার এলাহিকাণ্ড দেখে আমার তো রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার অবস্থা।

যা হোক, অনুরোধ সত্তে¡¡ও আমি ও আমার বন্ধু হোটেলরুমে থাকতে ইচ্ছা পোষণ করলাম এবং কথা হলো, থাকব ছয়তলায় অবস্থিত হোটেলটির ভিআইপি জোনে; কিন্তু প্রতি বেলা খাবার খাবো ১৪ তলার বাসভবনে। আমাদের বিয়াই প্রতি বেলা খাবারের সময় স্বয়ং ছয় তলায় এসে আমাদের নিয়ে যেতেন। খানাপিনা শেষে আমরা তার ড্রয়িংরুমে আড্ডা দিতাম কিছুক্ষণ এবং এরপর তিনি আবার নিজে ছয় তলায় এসে রুমে দিয়ে যেতেন। আমাদের ড্রাইভার-বডিগার্ডরাও তার বাসায় খেতেন। অথচ বিশাল হোটেলে আন্তর্জাতিক মানের একাধিক রেস্টুরেন্ট রয়েছে এবং পুরো সিলেটে সেসব রেস্টুরেন্টের সুনাম এতটাই ছড়িয়েছে যে, গভীর রাত অবধি রেস্টুরেন্টগুলো লোকে গিজ গিজ করে।

হোটেল ব্যবসার রমরমা অবস্থা, মেহমানদের সীমাহীন ভিড় এবং অভ্যাগত মেহমান ও হোটেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনন্দ উচ্ছ¡াস দেখে মনে হলো আমাদের বেয়াইয়ের ব্যবসাবাণিজ্য খুব ভালো। আমি ঠাট্টাস্থলে বললাম, আরে ভাই! এত টাকা কী করবেন! তিনি বিনয়ের হাসি দিয়ে তার ব্যবসায়িক সাফল্যের কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন। তার পিতা ব্রিটিশ জমানার একজন নামকরা চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং কর্মজীবনে তিনি চাকরি না করে সিলেটে সেই জমানায় প্রথম বেসরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন, যা এখন পর্যন্ত সুনামের সাথে সিলেট অঞ্চলের মানুষকে সেবা দিয়ে চলেছে। তিনি নিজে ডাক্তারি পাস করার পর পিতার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব নেন এবং ঢাকাতেও স্টোনক্রাশ নামে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।

স্টোনক্রাশ হাসপাতালের নামটি বাংলাদেশে বেশ পরিচিত এবং সেটির মালিক যে ডা: নাসিম তা জানার পর আমি বেশ আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করলাম ভাই, ওই হাসপাতালের খবর কী! তিনি বললেন, ওটা বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ ঢাকা-সিলেট দৌড়াদৌড়ি আমার একদম সহ্য হচ্ছিল না। ফলে লাভজনক হওয়া সত্তে¡ও শান্তিপূর্ণ ব্যক্তিগত জীবনের জন্য ওটা বন্ধ করে দিয়েছি। আমি তার কথা শুনে বেশ আশ্চর্য হলাম এবং চোখে অনেক প্রশ্নের ভাব তুলে তার দিকে তাকাতেই তিনি অনেক দার্শনিক কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করলেন, যার মোদ্দা কথা হলো, বিলাসিতা আরাম আয়েশ টাকা ধনসম্পদের বাসনা সীমাহীন। কেবল পরিতৃপ্ত আত্মা এবং আত্মসংযমই পারে মানুষকে এসব প্রবৃত্তি থেকে রক্ষা করবে।

কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, তার দাদার জমানা থেকেই তারা সুনাম সুখ্যাতি সচ্ছলতা ও শিক্ষাদীক্ষার একটি কাঙ্ক্ষিত বৃত্তের মধ্যে বসবাস করছেন। তিনি যেভাবে তার বাবার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছেন, একইভাবে তিনি তার একমাত্র সন্তানকে শিক্ষিত করেছেন। ফলে পরপর চারটি প্রজন্ম গাণিতিকহারে জীবনের সব ক্ষেত্রে ক্রমাগত সফলতার ক্ষেত্র তৈরি অব্যাহত রাখতে পেরেছে। আমি তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম এবং অনুভব করছিলাম যে, আমারও কিছু বলা দরকার। আমি নিজে তেমন সফল না হলেও আমারও যে ডা: নাসিমের মতো সফল আরো অনেক বন্ধু রয়েছে তা জাহির করার জন্য আমি বাংলাদেশের খুব নামকরা একজন ডাক্তরের কথা বললাম এবং তাকে চমকিত করার জন্য তাকে জানালাম যে, আমার পরিচিত ডাক্তার সাহেব বৃহৎ মালকড়ির মালিক। তিনিও ঢাকার অভিজাত এলাকায় ১০-১২ হাজার বর্গফুটের বিলাসবহুল গেস্ট হাউজে থাকেন। বিশাল বিলাসবহুল দামি দামি গাড়ি, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, দেহরক্ষী, হাসপাতালের মালিকানা আরো কত কী!

আমার কথা শুনে ডা: নাসিম কেমন যেন চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং কোনো কথা না বলে কিছু একটা স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। এ অবস্থায় আমার বন্ধু শিব্বির মাহমুদ সন্দেহ করলেন যে, তার বেয়াই হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করেননি। কারণ ডাক্তারি পেশা, হাসপাতাল ব্যবসা এবং সমাজের উঁচুতলার মানুষের সাথে চলাফেরার কারণে তিনি দেশ-বিদেশের হোমরা-চোমরা সবাইকে চেনেন। ঢাকার বড় বড় লোকজন সিলেটে গিয়ে তার মেহমান হওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকেন। আরা পুরো সিলেট অঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি হোমরা-চোমরা, রাঘববোয়াল থেকে শুরু করে জ্ঞানী-গুণী-পীর-মাশায়েখ সবাই তার বাসায় দু-চার বেলার জন্য অতিথি হওয়াকে সম্মানের বিষয় মনে করেন। সুতরাং আমি যে ডাক্তার সাহেবের কথা বললাম এবং তার টাকা কড়ির যে হিসাব দিলাম তাকে তো নাসিম সাহেবের চেনা উচিত; কিন্তু নাসিম সাহেব ওই নামের অত বড় ধনী কোনো ডাক্তারের নাম স্মরণ করতে না পেরে অনেকটা অসহায়ের মতো চোখ গোল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

নাসিম সাহেবের অবস্থা দেখে আমি কিছুটা বিব্রত হলাম। কারণ আসার পর থেকে তিনি যে মাত্রার মেহমানদারি করছিলেন এবং আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার দেখিয়ে আমাদের সম্মানিত করছিলেন তার বিনিময়ে আমার বক্তব্য শোনার পর তিনি যেভাবে মুখ গম্ভীর করে ফেললেন সেটি দর্শন করে আমি বিব্রত বোধ করতে থাকলাম। ঠিক এমন সময় ডা: নাসিম হো হো করে হেসে উঠলেন এবং সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠলেন, কিতা কন রনি ভাই! তার মুখে এই প্রথম সিলেটী ভাষা শুনে বেশ আশ্চর্য হলাম। কারণ তিনি প্রথমক্ষণ থেকে অনর্গল প্রমিত বাংলা অথবা ব্রিটিশ উচ্চারণে নির্ভুল ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। তো তার মুখে সিলেটী ভাষা শুনে আমি আশ্চর্য হলাম এবং তার পরবর্তী বক্তব্য সোনার জন্য কান খাড়া করলাম। কারণ আমি জানি যে, মানুষ অতিরিক্ত রাগ হলে কিংবা অতিরিক্ত আমোদের মধ্যে পড়লে মনের আনন্দে নিজের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে থাকেন।

ডা: নাসিম বললেন, কি কন রনি ভাই। আরে ও তো আমাদের ফজাই। আমরা ওরে ফজাই ডাক্তার বলতাম। ও কী করে এত টাকার মালিক হলো; আমি তো আপনার কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। পরে আপনার বর্ণনা শুনে ফজাইয়ের কথা মনে হলো। এই কথা বলে তিনি আবার হাসতে লাগলেন। তিনি এ ব্যাপারে আর বিস্তারিত কিছু বললেন না বটে তবে আন্দাজ করে নিলাম যে, বাংলাদেশের সর্বত্র যেভাবে নির্বোধদের দাপট চলছে এবং যেভাবে ধর্ম-কর্ম, পেশা-শিল্প-সাহিত্যের সর্বত্র নকল করার প্রবণতা এবং লোক ঠকানোর মহড়া চলছে সেখানে অতি অল্প সময়ের মধ্যে একজন সাধারণ মানের ফজাই ডাক্তার যদি অসাধারণ হয়ে ওঠেন তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই বলেই আমাদের বেয়াই ডা: নাসিম ফজাইকে নিয়ে আর কথা বাড়ালেন না।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement