২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশের ভূত!

-

ভারতীয় মিডিয়ার স্বাধীনতার কথা একসময় খুব শোনা যেত। বলা হতো সত্য প্রকাশ, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, ঘুষ-দুর্নীতি ও পেশিশক্তির বিরুদ্ধে ভারতীয় মিডিয়ার নাকি রয়েছে শক্তিশালী ভূমিকা। সরকার কিংবা সন্ত্রাসী-মাস্তানদের রক্তচক্ষুকে কখনোই নাকি ভয় পায় না সেখানকার গণমাধ্যম।

তবে গ্লোবাল মিডিয়া ওয়াচডগ রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) এবার ভারতীয় মিডিয়ার মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। তেমনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) উন্মোচন করে দিয়েছে ভারত কিভাবে সত্য আড়াল করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারীতে মৃত্যুর যে অফিসিয়াল সংখ্যা বের হয়েছে তার চেয়ে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর সংখ্যা ২.৭ শতাংশ বেশি। কিন্তু ভারতে যে মৃত্যু দেখানো হয়েছে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি মারা গেছে মহামারীতে। সে হিসাবে করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ভারতে। বিশ্বব্যাপী করোনায় প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা দেড় কোটি (১.৫ মিলিয়ন) আর সরকারি রেকর্ডে দেখানো হয়েছে সাড়ে ৬২ লাখ। ভারতে সরকারি হিসাবে মৃত্যু পাঁচ লাখ দেখানো হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এ মৃত্যু সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি।

ভারতীয় মিডিয়ার এ কী হাল!
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স ৩ মে বিশ্ব মুক্তগণমাধ্যমে দিবস উপলক্ষে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার যে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে তাতে ভারতের অবস্থান গত বছরের (২০২১ সাল) চেয়ে আট ধাপ নেমে গেছে বলে উল্লেখ করেছে। ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে’ বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান এখন ১৫০ নম্বরে। গত বছর তা ছিল ১৪২তম । রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স আরো বলেছে, মিডিয়ার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ভারতের রেকর্ড কখনোই খুব আহামরি ছিল না। কিন্তু ইদানীং-পরিস্থিতির অবনতি এতটাই ঘটেছে যে, ভারতের মূল ধারার মিডিয়াগুলো সরকারের বশংবদে পরিণত হচ্ছে। প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান উইমেনস প্রেস কোর ও প্রেস অ্যাসোসিয়েশন আরএসএফদের রিপোর্ট সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিবিসিকে বলেছে, ভারতে এক দিকে যেমন সাংবাদিকদের কাজের নিরাপত্তা কমছে, তেমনি মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। প্রতিষ্ঠানগুলো একবাক্যে বলছে, তুচ্ছ ও ঘোলাটে কারণে বিভিন্ন ড্রাকোনিয়ান আইন প্রয়োগ করে সাংবাদিকদের শুধু ভয়ই দেখানো হচ্ছে না, তাদের জীবনও অনেক সময় হুমকির মুখে পড়ছে। গত এক বছরে সাংবাদিকদের এ ধরনের যে চরম হেনস্তার মধ্যে পড়তে হয়েছে, তার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে টাইম ম্যাগাজিন ও নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট রানা আইয়ুবের ওপর নির্যাতন ও হেনস্তা। উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদে এক মুসলিম বৃদ্ধের হেনস্তার ভাইরাল হওয়া ভিডিও টুইটারে শেয়ার করার অভিযোগে কলামিস্ট রানা আইয়ুবের বিরুদ্ধে রাজ্য পুলিশ মামলা দিয়েছে। বিবিসিকে আইয়ুব বলেন, সরকারের সমালোচকদের ওপর নির্যাতন তো করা হচ্ছেই, আমার বেলায় যে দিন পুলিশ মামলা করে, ঠিক সে দিনই কেন্দ্রীয় সরকারের অন্তত তিনটি এজেন্সি আমাকে ও আমার পরিবারের সদস্যদের সমন পাঠিয়ে জানতে চায় কে আমাদেরকে টাকা-পয়সা দিচ্ছে, আমি কেন বিদেশী পত্রিকার জন্য লিখি, নরেন্দ্র মোদিকে কলঙ্কিত করার অ্যাজেন্ডায় আমি যুক্ত কি না ইত্যাদি। গত এক বছরের মধ্যেই লখিমপুর খেরিতে সাংবাদিক রমন কাশ্যপকে নেতার গাড়ি পিষে দিয়েছে, বিহারে পুড়িয়ে মারা হয়েছে ছোট শহরের এক সাংবাদিক অবিনাশ ঝাকে। তেমনি লিকার মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে প্রাণ হারিয়েছেন সুলভ শ্রীবাস্তব, খবর কভার করতে গিয়ে ছত্তিশগড়ে মাওবাদীদের পাতা মাইনে নিহত হয়েছে রোহিত বিসওয়ালা। ভারতশাসিত কাশ্মিরেও ২০১৮ সাল থেকে জেলে আছেন সাংবাদিক আসিফ সুলতান। উত্তর প্রদেশের হাতরাসে গণধর্ষণের ঘটনা কভার করতে গিয়ে ২০২০ সাল থেকে আটক আছেন কেরালার সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান।

বিবিসিকে দিল্লির সিনিয়র সাংবাদিক স্মিতা গুপ্তা বলেন, ভারতের সাংবাদিকদের কাজ বরাবরই বিপজ্জনক ছিল, তবে বিপদের ক্ষেত্রে এখন তাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। একেবারে সর্বোচ্চ স্তর থেকেই বিপদের বার্তাটা আসে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার আগে দেশের প্রধানমন্ত্রী বছরে একবার হলেও সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতেন, বিদেশ সফরেও সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে খোলাখুলি মতবিনিময়ের সুযোগ পেতেন। সেই চর্চা এখন উঠে গেছে। সরকার চায় তাদের হ্যান্ডআউট বা বিবৃতিই যেন হয় খবরের একমাত্র উৎস। এর পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করেও সরকার বাছাই করা সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে, যে চাপ অনেকেই আর নিতে পারছে না।

কলকাতার বর্ষীয়ান সাংবাদিক সুদীপ্ত সেনগুপ্ত বিবিসিকে বলেন, ভারতে মিডিয়ার ওপর সরকারি চাপ অতীতেও ছিল, তবু তখন কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান মেরুদণ্ড সোজা রাখার সাহস অন্তত দেখাত। কিন্তু এখন সেটি কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছে। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা ইমার্জেন্সির সময়ও মিডিয়ার একটি অংশ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলতে যা বোঝায় সেই নাগরিক অধিকার, মৌলিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোনো একটা সংবাদপত্র কিংবা চ্যানেল সরকারের বিরুদ্ধে খবর প্রচার বা প্রকাশ করলেই এটি সরকারের চক্ষুশূল বা না-পছন্দ হয়ে যায়। সাত-আট বছর ধরে যে পরিবর্তন হয়েছে তা হলো সামগ্রিকভাবে সরকার সব মিডিয়াকেই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার একটি সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর সরকারের এ চাপের কাছে সব মিডিয়াই পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে। টিভি চ্যানেলগুলোর মালিকানা করপোরেট হাউজগুলোর হাতে চলে গেছে। এসব হাউজের মালিকদের অনেকেই শাসকদলের সংসদ সদস্য কিংবা কোনো সংস্থার কর্ণধার। ফলে সরকারের অ্যাজেন্ডা এরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। মিডিয়া নিজেরাই নিজেদের ওপর সেলফসেন্সরশিপ আরোপ করে নিয়েছে। সাংবাদিক সুদীপ্ত সেনগুপ্তের ভাষায়- ‘মিডিয়াগুলো যেন সরকারেরই বশংবদ একটি শাখা’। আরএসএফের এই প্রতিবেদন পড়লে যে কারো মনে হবে এ যেন হুবহু বাংলাদেশের মিডিয়ারই চিত্র।

বিশ্ব মুক্তগণমাধ্যম দিবস ও বাংলাদেশ
গত ৩ মে মঙ্গলবার ছিল বিশ্ব মুক্তগণমাধ্যম দিবস। এ দিন বাংলাদেশে পালিত হয় পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদের কারণে দিবসটি নিয়ে তেমন মাতামাতি হয়নি। বিশ্ব মুসলিমের সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন এই ঈদ। এ দিনটি খুশির দিন। কিন্তু এ খুশির দিনটিতে বাংলাদেশের জন্য খারাপ খবর বয়ে এনেছে ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডার্স-আরএসএফ। সংস্থাটি ২০২২ সালের গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক যে সূচক প্রকাশ করে তাতে বলা হয়, বাংলাদেশ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে গত বছরের তুলনায় ১০ ধাপ পিছিয়ে গেছে। বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩তম। গত বছর তা ছিল ১৫২তম। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র মিয়ানমার ছাড়া সূচকে সবার নিচে বাংলাদেশের নাম। সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারের স্থান ১৬তম।

বিশ্ব মুক্তগণমাধ্যম দিবসে বাংলাদেশে ঈদের ছুটি থাকায় সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন বিএফইউজে ১ মে এ বিষয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল প্রেস ক্লাবে। এতে সাংবাদিক নেতারাসহ বিশিষ্ট সমাজচিন্তুক ফরহাদ মজহার, রাজনীতিবিদ ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় বাংলাদেশের সর্বশেষ মিডিয়া পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছিল। বাংলাদেশের পরিস্থিতি খারাপ হবে তা বক্তারা তাদের বক্তব্যে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে এক লাফে সূচক ১০ ধাপ নিচে নেমে যাবে এমন অবনতির ধারণা কারো মধ্যে ছিল না। কিন্তু রিপোর্ট প্রকাশের পর দেখা গেল ‘বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ শব্দগুলো উচ্চারণের মতো অবস্থাও এখন আর আমাদের নেই।

বিশ্ব মুক্তগণমাধ্যম দিবসের এবারের আলোচ্য বিষয় ইউনেস্কো ঠিক করেছে ‘জার্নালিজম আন্ডার ডিজিটাল সিজ’ অর্থাৎ ‘ডিজিটাল অবরোধে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’। স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী, সামরিক ও কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো মুক্ত সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রণে নতুন কৌশল হিসেবে ডিজিটাল জগতকে ব্যবহার করেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর প্রতি ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সাংবাদিক ও নাগরিক গোষ্ঠীর ওপর বেআইনি নজরদারি থেকে নিবৃত্ত থাকা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি বেশি প্রযোজ্য। কারণ বাংলাদেশের সাংবাদিকতা তো ডিজিটাল নজরদারির মধ্যে বেঁধে ফেলা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ ৩ মে বিশ্ব মুক্তগণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে দেয়া বিবৃতিতে এ বিষয়টিই উল্লেখ করেছে। তারা বলেছে, ডিজিটাল যুগে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এর মধ্যে যেটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে তা হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ বিবৃতিতে বলেছেন, ডিজিটাল নজরদারি ও আক্রমণের মুখে সাংবাদিকতা বিশ্বজুড়েই হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশে অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে এবং অনেকে গ্রেফতারও হয়েছেন। শুধু সাংবাদিকই নন, বিভিন্ন ক্ষেত্রের অ্যাক্টিভিস্ট, শিল্পী, লেখকরাও এ আইনের মুখোমুখি হয়েছেন। এ আইনটির যে অপব্যবহার হয়েছে কিছু দিন আগে আইনমন্ত্রীও উল্লেখ করেছেন। তেমনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন। কিন্তু এ আইনের নিবর্তনমূল ধারাগুলো সংশোধন তো হয়ইনি, উপরন্তু গণমাধ্যমকর্মী আইন নামে আরেকটি কালো আইন করতে যাচ্ছে সরকার। সাংবাদিক সুরক্ষার নামে প্রস্তাবিত এ আইনটিতে সাংবাদিকদের ‘সাংবাদিক’ পরিচয়ই মুছে ফেলা হয়েছে। নতুন এ আইনটি হলে বাংলাদেশ কার্যত একটি নজরদারিমূলক রাষ্ট্রেই পরিণত হবে। ভিন্নমত, বাকস্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার অবশেষটুকুও আর থাকবে না।

ডিজিটাল নিবর্তন কোন পর্যায়ে গেছে তা কয়েক দিন আগে প্রকাশিত গভর্ন্যান্স স্টাডিজের গবেষণাতেই উঠে এসেছে। তারা গত অক্টোবর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৬৬৮টি মামলার সন্ধান পেয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রতি চারজনের একজন হলেন সাংবাদিক। গ্রেফতারকৃত ৪৯৯ জনের মধ্যে ৪২ জনই সাংবাদিক।
একসময়ের ভালোবাসার পেশা!

সাংবাদিকতাকে ভালোবেসে এ পেশায় এসেছিলাম। রসায়নশাস্ত্রে মাস্টার্স ডিগ্রি নেয়ার পর ওষুধ কোম্পানি গ্ল্যাক্সোতে সহকারী কেমিস্ট হিসেবে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। দৈনিক বাংলার সম্পাদক শ্রদ্ধেয় আহমেদ হুমায়ূন ভাই গ্ল্যাক্সো কোম্পানির চাকরিটা নেয়ার জন্য বারবার অনুরোধও করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘চাকরিটা নাও, নইলে পরে পস্তাবে’। তার কথা শুনিনি, দৈনিক বাংলার চাকরিতেই থেকে গেলাম সাংবাদিকতার প্রতি টান থেকে। তখন জেনারেল এরশাদের আমল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তখনো ছিল না। পিআইডির টেলিফোন যেত পত্রিকা অফিসে। অবশ্য তখন রাজনৈতিক খবরের ওপরই ছিল বেশি খবরদারি। অন্য বিষয় নিয়ে লেখালেখিতে বড় বাধা আসেনি। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে, সাংবাদিকতার চাকরি ততই ঝুঁকি হয়ে উঠেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে এসে দৈনিক বাংলা, টাইমস, বিচিত্রা ও আনন্দ বিচিত্রা বন্ধ করে দিলো। বেকার হয়ে গেলাম। হুমায়ূন ভাইয়ের কথা বারবার মনে হলো।

১৯৭৫ সালের ১৬ জুনও চারটি পত্রিকা রেখে সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। শত শত সাংবাদিক বেকার হয়েছিলেন। জীবিকার জন্য ফলের দোকান, মুদি দোকান পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। এ অবস্থায় না পড়লেও কিছু দিন পর অন্য পত্রিকায় যোগ দিয়ে সাংবাদিকতা টিকিয়ে রেখেছিলাম। ২০০৪ সালে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বের করেছিলাম আমরা। কিন্তু সেটিও বন্ধ করে দেয়া হলো দু-দু’বার। অভিযোগ ভিন্নমতের সাংবাদিকরা ওখানে কাজ করে। এই ভিন্নমতের অজুহাতে দৈনিক বাংলাও বন্ধ করা হয়েছিল। এভাবে এ সরকারের আমলে তিনবার বেকার হওয়ার তিলক জুটেছে আমার ও আমার অনেক সহকর্মীর কপালে। তেমনি চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টেলিভিশন ও বহু সংবাদপত্রও বন্ধ করে শত শত সাংবাদিককে বেকার করে দেয়া হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ন্যূনতম সুযোগটুকুও নেই। আলজাজিরা বাংলাদেশকে নিয়ে এক ঘণ্টার একটি রিপোর্ট করেছিল। ওই রিপোর্ট নিয়ে সরকার খুব চটেছিল। কিন্তু আলজাজিরা আন্তর্জাতিক মিডিয়া হওয়ায় তাদের তেমন অসুবিধা হয়নি। সেই অনুসন্ধানী রিপোর্টটি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। জেনারেল আজিজের তিন ভাইয়ের কাহিনী ছিল রিপোর্টটিতে। এমন রিপোর্ট বাংলাদেশের কোনো মিডিয়া করার কথা কল্পনাও করে না। বাংলাদেশে এখন যে সাংবাদিকতা চলছে, তা নামেই সাংবাদিকতা। শুধু চাকরিটা করে যাওয়া ও মাস শেষে বেতন পাওয়া নিশ্চিত করা একটুকুই। বেতনও ঠিকভাবে পাওয়া যায় না কর্তাব্যক্তিদের মর্জি অনুযায়ী কাজ করেও। জীবিকার জন্য ঝুঁকি নেয়ার বিষয়টি একেবারেই গৌণ। একজন সাংবাদিক চাইলেই তার ইচ্ছানুযায়ী কোনো রিপোর্ট করতে পারেন না। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা হলো- ‘তিনি বলেন, তিনি আরো বলেন’। অর্থাৎ বক্তৃতাবাদীর মধ্যে তাদের সাংবাদিকতা সীমাবদ্ধ। ২০১৩ সালে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা চালু করে সাংবাদিকতাকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সাংবাদিকদের আন্দোলনের ফলে তা বাতিল হলেও তিন বছর আগে করা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ আইনে ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা সন্নিবেশ করে কঠিন বেড়ি পরিয়ে দেয়া হয় সাংবাদিকতাকে। এ আইনে ২০টি ক্ষেত্রে সাজার বিধান করা হয় যার ১৪টিই জামিন অযোগ্য। এভাবে সাংবাদিকদের মধ্যে প্রবল ভীতি তৈরি করে দেয়া হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে গিয়েছিলেন। রিপোর্টটি করার আগেই অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে তাকে গ্রেফতার করা হয়। একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ব্যবহার করে এমন মামলা এই প্রথম। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার খুনি চিহ্নিত কিংবা গ্রেফতার হওয়া তো দূরের কথা, তদন্ত রিপোর্টও আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। চৌকস বাহিনী বলে খ্যাত র‌্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলেন মহামান্য হাইকোর্ট। র‌্যাব এ তদন্তের এখনো কোনো কূলকিনারা করেনি। রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্য সর্বশেষ ৮৮ বারের মতো সময় নিয়েছে। আরএসএফ তাদের রিপোর্টে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের দুরবস্থা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্বের কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বরাবরের মতো সরকার একে ‘ষড়যন্ত্র’, ‘বিদ্বেষ’ প্রভৃতি বলে উড়িয়ে দিয়েছে। আগেই বলেছি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের সাংবাদিকতাকে মহা আতঙ্কের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এর মধ্যে আরেকটি নতুন আইন হচ্ছে ‘গণমাধ্যমকর্মী আইন’ নামে। সামনে নির্বাচন। এ আইনের লক্ষ্য হয়তো ওই নির্বাচন। এভাবে এক দিন হয়তো আমরা দেখব দেশ থেকে সাংবাদিকতা নামক পেশাটি হারিয়ে গেছে। এর স্থান দখল করেছে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি উইং পিআইডি। আমাদের এই সাংবাদিকতার ভূত প্রতিবেশী ভারতকেও পেয়ে বসেছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের রিপোর্ট সেই কথাই বলছে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব।
ই-মেইল : abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement