২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বায়ুদূষণ, বিপদের চোখ রাঙানি ও একটি জিজ্ঞাসা

-

২০২১ সালে ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ ১০টি স্থানের বায়ুমান নিয়ে গবেষণা করে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয় ২৭ জানুয়ারি, ২০২২, বৃহস্পতিবার; ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (বাপা) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে।

গবেষণা থেকে স্পষ্ট, বায়ুর মানদণ্ডে সারা বিশ্বে ঢাকা খুব বাজে অবস্থানে আছে। বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ে কখনো প্রথম, কখনো দ্বিতীয় অবস্থানে থাকছে ঢাকা। এখানে বায়ুর দূষিত অবস্থা সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায়ই সাড়ে ছয়গুণ ছাড়িয়ে যায়। ঢাকা যে বাতাসকে বিপজ্জনক করে তুলল, তার অনেকটাই হয়েছে উন্নয়নের নামে। এই নগরীতে বায়ুর মান খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে সৃষ্ট ধূলিকণা। এখানকার বায়ুতে ৩০ শতাংশ দূষণ হয় অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাস্তা কাটা ও নির্মাণকাজের কারণে। এরপর ইটভাটা ও কলকারখানার ধোঁয়া ২৯ শতাংশ দূষণের জন্য দায়ী এবং যানবাহনের কালো ধোঁয়ার কারণে ঘটে ১৫ শতাংশ বায়ুদূষণ। আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণের প্রভাব, গৃহস্থালি ও রান্নার চুলা থেকে নির্গত দূষক এবং বর্জ্য পোড়ানোর কারণেও বাড়ছে বায়ুদূষণ। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের গাছপালায় প্রতিদিন ৪৩৬ টন ধূলিকণা জমে। সেই হিসাবে প্রতি মাসে ১৩ হাজার টন ধুলা জমার হিসাব নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই জমে থাকা ধুলা দিনের বেলা বাতাসের সাথে মিশে যেমন দূষণ বাড়ায়, তেমনই রাতে গাড়ির অতিরিক্ত গতির সাথে বাতাসে উড়তে থাকে। ফলে দিনের চেয়ে রাতের বেলায় বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়।

সংস্থাটি রাজধানীর ৭০টি স্থানের বায়ু চারবার পর্যবেক্ষণ করে এ তথ্য পেয়েছে। পরিবেশ অধিদফতর থেকে শব্দ ও বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণের জন্য এই ৭০টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল। এসব স্থানে এয়ার ভিজ্যুয়ালসহ মোট চারটি সংস্থার বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বায়ুর মান মাপা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারণ করা মানমাত্রা ধরে দূষণের এই হিসাব করা হয়েছে। মূলত বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম-২.৫ এর পরিমাণ পরিমাপ করে বায়ুর মান নির্ধারণ করা হয়। এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসাবে, বায়ুর মান শূন্য থেকে ৫০ থাকলে ওই স্থানের বায়ু ভালো। আর মান ২০০ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকা মানে খুবই অস্বাস্থ্যকর। বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি থাকা মানে ওই স্থানের বায়ু ‘বিপজ্জনক’। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের হিসাবে, ঢাকার বায়ুর মান ৩৩২ অবধি উঠছে। এখানকার বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম-২.৫ এর পরিমাণ বেশি। এটি সাধারণ জীবাশ্ম পোড়ানো জ্বালানি থেকে আসে। অর্থাৎ যানবাহন, শিল্পকারখানা ও জৈব বস্তু পোড়ালে যে ধোঁয়া বের হয়, তা থেকে আসে।
শুধু ঢাকা নয়, দূষণ বিপদগ্রস্ত করছে দেশের নানা অঞ্চলকে। ক্যাপসের গবেষণায় বাংলাদেশে অতিরিক্ত দূষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ১৮টি জেলাকে।

গাজীপুরে বায়ুদূষণের মাত্রা সবার উপরে। এর পরেই আছে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ, যেখানে বায়ুতে অতি ক্ষুদ্রকণার মাত্রা বাংলাদেশের আদর্শ মান প্রতি ঘনমিটারে ৬৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে বহুগুণ বেশি।

আর বায়ুদূষণের জন্য দায়ী যে অতি ক্ষুদ্র কণা সেটি আদর্শ মাত্রায় আছে কেবল ১০টি জেলায়। সর্বনিম্ন বায়ুদূষণ পরিমাপ করা হয়েছে মাদারীপুর, পটুয়াখালী ও মেহেরপুরে।

এই অতি ক্ষুদ্রকণা বলতে ২.৫ মাইক্রন বা তার কম আকারের বস্তুকণার কথা বলা হচ্ছে। একটি চুলের সাথে তুলনা করলে এসব ধূলিকণার আকার চুলের প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগের সমান। যা সহজেই মানবদেহের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করতে পারে। সহজেই এসব ক্ষুদ্রকণা মানুষের চোখ-নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে রক্তের সাথে মিশে যায় এবং ফুসফুস, হার্ট, কিডনি লিভার আক্রান্ত করে থাকে।

ঢাকা শহরের বাতাস এমন ধূলিবন্যায় প্লাবিত। সব মিলিয়ে ঢাকা দিন দিন দুর্ভোগের নগরীতে পরিণত হচ্ছে। কোনো মৌসুমেই নগরবাসী স্বাচ্ছন্দ্যে রাস্তাঘাটে চলাচল করতে পারে না। বর্ষাকালে রাজধানীবাসীকে ভুগতে হয় জলাবদ্ধতায় আর শুষ্ক মৌসুমে পোহাতে হয় ধুলার দুর্ভোগ।

শুষ্ক মৌসুম আসা মানেই ঢাকা মহানগরীতে ধুলাদূষণের প্রকোপ বেড়ে যাওয়া। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ঢাকার প্রায় সব রাস্তাই একযোগে খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে। ঢাকায় যে হারে উন্নয়ন কাজের নামে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, তাতে ধুলাদূষণের মাত্রা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এর ফলে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে ধুলাজনিত রোগব্যাধির প্রকোপ। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে রোগ জীবাণুমিশ্রিত ধুলা ফুসফুসে প্রবেশ করে সর্দি, কাশি, ফুসফুস ক্যান্সার, ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসজনিত কষ্ট, হাঁপানি, যক্ষ্মা, অ্যালার্জি, চোখ জ্বালা, মাথা ব্যথা, বমি ভাব, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। এর মধ্যে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিরাই ধুলাদূষণের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।

শুধু ধুলো নয়, রাসায়নিক পদার্থ, গ্যাস ও দুর্গন্ধ ইত্যাদি আবহাওয়া বিষিয়ে তুলছে। জীব ও প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য যা হয়ে উঠছে ধ্বংসাত্মক। মুশকিল হলো, ঢাকার বাতাসের দূষিত উপাদান বাতাসেই রয়ে যাচ্ছে। শহরে বড় প্রকল্পের কাজ, নির্মাণাধীন ভবনের কাজ, যানবাহনের ধোঁয়ায় ঢাকার বায়ুর চাপ বেশি। এই দূষিত অংশ বায়ুর নিম্নস্তরে ২০০-৩০০ ফুট উপরে অবস্থান করছে।

কার্বন মনোক্সাইড বুকে ব্যথাসহ শ্বাসতন্ত্রের নানা অসুখের জন্য দায়ী। নিঃশ্বাসের সঙ্গে এটি গ্রহণ করলে হৃদরোগও হতে পারে। নাইট্রোজেন অক্সাইডের কারণে নানা ধরনের প্রদাহ হয়, সালফার ডাই অক্সাইডের কারণে হতে পারে হাঁপানিসহ হৃদরোগ, ওজোন গ্যাস ফুসফুসের কার্যক্ষমতার ক্ষতি করে এবং সীসার কারণে শিশু ও বয়স্ক মানুষেরা খুব দ্রুত শ্বাসকষ্টজনিত অসুখে এবং শ্রবণ ও স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া এমনকি ক্যান্সারেও আক্রান্ত হতে পারে।

তবে বায়ুদূষণের জন্য দায়ী এসব ক্ষতিকর পদার্থ বাংলাদেশে সবটুকু উৎপন্ন হয়, তা বলা যাবে না। রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য প্রায় ৩০ ভাগ দায়ী ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা এসব অতি সূক্ষ্ম পদার্থ।

এসব পদার্থের মধ্যে রয়েছে অ্যামোনিয়া, নাইট্রিক অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, সীসা, কার্বন, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড, ওজোন গ্যাস ইত্যাদি।

ঢাকায় পরিবেশ বিষয়ক একটি গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন বা এসডোর চালানো গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত তিন বছর ধরে এসব গবেষণা চালানো হয়।

গবেষণায় স্পষ্ট হয় যে, যেহেতু তিন দিক থেকে বাংলাদেশকে ঘিরে রেখেছে ভারত আর মিয়ানমারের সঙ্গেও আমাদের সীমান্ত রয়েছে, তাই বায়ুদূষণের জন্য দায়ী ক্ষতিকর বহু পদার্থ সেসব দেশ থেকে বাংলাদেশে আসতে পারছে সহজেই। ভারতের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম রাজ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে শিল্প ও কলকারখানা, আছে বেশ কিছু কয়লার খনি। যা থেকে নির্গত হচ্ছে প্রচুর দূষণকারী পদার্থ, বাতাসের সাথে মিশে তা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।

মিয়ানমার থেকে আসা অন্যতম দূষণকারী পদার্থ হলো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে তৈরি নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার। মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় প্রচুর পরিমাণে গাছপালা পোড়ানো হয়। যার ফলে সেখানে যে ‘কার্বন ছাই’ তৈরি হয়, যা বাতাসে ভেসে বাংলাদেশে চলে আসে অনায়াসেই। এসব পদার্থ যখন উড়ে আসে তখন বাতাসের গতিবেগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ঢাকা এবং ময়মনসিংহের কাছে এসে বাতাস দুর্বল হয়ে নেমে যায়। ফলে দূষণকারী পদার্থগুলো ঢাকা এবং তার আশপাশে বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জে গিয়ে জমা হয়।

উত্তর দিক থেকে যখন বাতাস বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট বাতাস দক্ষিণ দিক দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে বাধার সৃষ্টি করে। বাতাসের দূষণকারী পদার্থগুলোর ঢাকায় জমা হওয়ার পেছনে এটাও একটা কারণ বলে মনে করা হয়। কখনো যদি বাতাসের প্রবাহ আরো দূরে চলে যায়, তখন উঁচু উঁচু পাহাড়ের কারণে সিলেটের কাছে গিয়ে সে প্রবাহ শেষ হয়ে যায়। ফলে সিলেটের বায়ুদূষণও বিপজ্জনক মাত্রায় উপনীত হয়।

এদিকে বাংলাদেশেও জন্ম নিচ্ছে বিপুল পরিমাণে দূষণ-উপাদান। উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া ধুলোবর্জ্য এর মধ্যে আছে সবার উপরে। ২০২২ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত উন্নয়নকাজ থেকে ‘ঢাকায় এত বায়ুদূষণ, ঝুঁকিতে আপনিও’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার আসিফ মুজতবার অভিজ্ঞতা বয়ান করা হয়। ২৫ বছর ধরে বক্ষব্যাধির চিকিৎসক আসিফ মুজতবা জানান, আগে তারা বেশির ভাগ সংক্রামক রোগের রোগী পেতেন। গেল কয়েক বছর ধরে যেসব রোগী তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসছে, তাদের বেশির ভাগ বায়ুদূষণের শিকার। এটি স্বীকৃত যে, বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে- তার বেশির ভাগই বায়ুদূষণজনিত। এক্ষেত্রে ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের ভয়াবহ মাত্রা লক্ষ্য করলে এখানে বসবাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। বায়ুদূষণ এখানকার জীবনকে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে, তা বহুমাত্রিক।

তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে প্রজনন স্বাস্থ্যে। কেননা গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বায়ুদূষণ বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এতে পুরুষের শুক্রাণু তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটে, শুক্রাণুর মান কমে যায়। অন্যদিকে মেয়েদের ডিম্বাণু কমে যায় কল্পনাতীত মাত্রায়। আবার যেসব ডিম্বাণু থাকে, সেগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে না, ঘটছে এগুলো।

৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ এ বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত ‘বায়ুদূষণ : প্রধান যে কারণগুলো দায়ী, ঝুঁকিতে প্রজনন স্বাস্থ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদন আমাদের সেই সাবধানবাণী শুনিয়েছিল। প্রতিবেদক সানজানা চৌধুরীর সাথে আলাপে ডা: রাশিদা বেগম স্পষ্ট করেন, প্রজনন স্বাস্থ্যের ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তবতা। যেখানে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মরে যাওয়া ও নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়াবহ চিত্র উপস্থাপিত। ডা: রাশিদা জানান, ‘এসব দুর্বল বা নষ্ট ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর যখন নিষেক ঘটে, এতে যে ভ্রূণ তৈরি হয় সেটা গর্ভে জায়গা করতে পারে না, আবার জায়গা করতে পারলেও বাঁচে না, গর্ভপাত হয়ে যায়। আর এই সমস্যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বর্তাতে পারে।’

এক দিকে প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য বিপদের বাজনা বাজছে, বিকলাঙ্গ সন্তান জন্মগ্রহণের ঝুঁকি প্রবল হচ্ছে, অপর দিকে দূষণের কারণে সারা বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস।

শুধু মানুষের জন্য দুঃসংবাদ, তা নয়। বায়ুদূষণ গাছের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া বা সালোকসংশ্লেষণকে বাধাগ্রস্ত করছে। এর প্রভাব পুরো প্রাণিজগতের ওপর পড়ছে। যেখানে বায়ুদূষণ যে মাত্রায় বাড়ে, সেখানে খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে উদ্ভিদ নিজেও বিপদে পড়ে এবং উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীরাও বিপদে পড়ে সমানমাত্রায়। সমানমাত্রায় বাধাগ্রস্ত হয় উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও প্রজনন। কিন্তু উদ্ভিদের জৈবনিক প্রক্রিয়া যদি ঠিক না থাকে, তাহলে খাদ্যশৃঙ্খল ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। এর মানে পরিষ্কার। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকায় একটি সর্বগ্রাসী মানবিক বিপর্যয় ঘটে চলছে।

কিন্তু সরকার কি দায়বোধ করছে এ ব্যাপারে? প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের সমন্বিত, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ কোথায়? রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের ফলে জন্ম নেয়া দূষণ কমানোর জন্য ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করা যেত। নির্মাণকাজের মাধ্যমে দূষণ বন্ধ করতে এ সময় চলমান নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখার ও নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করতে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া যেত। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে আসা পরিবেশ দূষকসমূহের ধ্বংসকারিতা থেকে সুরক্ষার জন্য ভারত-মিয়ানমারসহ নিকটবর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সমাধানমূলক কূটনৈতিক পদক্ষেপ জারি রাখা যেত। পরিবেশদূষণ রোধে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হবে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা, যার ঘাটতি রয়েছে তীব্রভাবে।

এ ঘাটতি না থাকলে আমরা দেখতাম শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরগুলোয় দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছেটানোর ব্যবস্থা হয়েছে, নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থানে প্রয়োজনীয় আড়াল নিশ্চিত করা হয়েছে, নির্মাণকাজের স্থানগুলোকে নীতিমালায় নিয়ে আসা হয়েছে, নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নেয়া হচ্ছে, রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা হচ্ছে, অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়ানো হয়েছে, ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, গাছ লাগানো, ছাদবাগানে উৎসাহিত করা, জলাধার সংরক্ষণ সেই সাথে নির্মল বায়ু আইনের বাস্তবায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণে বাজেটে যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে।

আমাদের নগর পরিকল্পনায় রয়েছে তীব্র ঘাটতি, আইনে রয়েছে দুর্বলতা, আইন প্রয়োগে রয়েছে সীমাবদ্ধতা। এগুলোর মোকাবেলা করতে হবে। জরুরি এসব পদক্ষেপ উপেক্ষা করে নগর উন্নয়নের নামে এমন কর্মকাণ্ডকে কিভাবে সত্যিকার উন্নয়ন বলা যায়, যা আমাদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়?

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement