১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
প্রবাস থেকে

লন্ডনের আকাশে ফকফকা আলো

- ছবি : নয়া দিগন্ত

১০ এপ্রিলের শুরু থেকে ১১ এপ্রিল ২০২২ সালের বিকেল ৫টা (বাংলাদেশ সময়), ৪০ ঘণ্টা নির্ঘুম। টার্কিশ এয়ার। উড্ডয়ন শুরু ০৭১৩ নং আর শেষ ১৯৭৯ নং এয়ারে। উভয় বিমানে ১৩ ঘণ্টা আকাশে, ৪ ঘণ্টা ট্রানজিট আর ২৩ ঘণ্টা ভ্রমণের উত্তেজনা ও পথের বিড়ম্বনা। শুরুতে চেষ্টা করেও ঘুম আনতে পারিনি। ঘুম যখন আসতে শুরু করে তখন অবতরণ আসন্ন। লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্ট। জটিল ইমিগ্রেশন পুলিশ। ২০০৩ সালে প্রথম মুখোমুখি হয়েছিলাম। মনে পড়তেই ঘুমঘুম ভাব পালিয়ে যায়। মাতৃভ‚মি থেকে সাত হাজার ৯৯৭ কিলোমিটার দূরে। সময়ের ব্যবধান ৫ ঘণ্টা। ঘড়ির কাঁটায় হাত দেইনি। হাত দিতে গেলেই দেশের মানুষ ও কাজের সাথে হিসাবটা এলোমেলো হয়ে পড়বে।

টিকিটে উল্লিখিত তফসিলে বাংলাদেশ সময় ১০ এপ্রিল রাত ১০টায় রওনা হয়ে লন্ডন সময় ১১ এপ্রিল সকাল ৯-৫০ মিনিটে হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণের কথা। তফসিল গড়বড় হয় শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টেই। উভয় বিমানের বোর্ডিং কার্ড নিয়েছিলাম ঢাকা থেকেই। অনুরোধ করেছিলাম প্রথম এয়ারের আসনটা মাঝে আর দ্বিতীয়টার আসন জানালার দিকে দিতে যাতে রাতে ঘুমসহ সকালে তুরস্ক থেকে লন্ডনের দৃশ্য দেখতে দেখতে সময়ের ক্লান্তি ভুলে থাকতে পারি। অনুরোধের ফল হয়েছিল উল্টো।

এয়ারের চাকা লন্ডনের মাটি স্পর্শ করার আগে যখন দুলছিল তখন একবার চোখ পড়েছিল ডিম্বাকৃতির জানালায়। আমাদের মাঠের মতো ফসলের সবুজ মাঠ। ছবি তোলার লোভ জেগেছিল। হিথ্রো থেকে বাসায় আসার পথে দুই পাশে ফসলের মাঠ, সবুজ বৃক্ষরাজি, বরফের মতো ধবধবে সাদা, উজ্জ্বল হলুদ ও গাঢ় খয়েরি রঙের ফুলে ফুলে সজ্জিত গাছ। একরের পর একর কর্ষিত জমি। কাছ থেকে দাঁড়িয়ে দেখার ইচ্ছা করছিল । ড্রাইভে হেনা (বড় মেয়ে), সামনে আমি পেছনে নাতি-নাতনী। হেনাকে গাড়ি রাখতে বলি। পার্কিংয়ের সুযোগ না থাকায় বনের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় গাড়ি। গাজীপুরের শালবনের মতো বৃক্ষ বেষ্টিত রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে, Ñআব্বা, আপনারা প্রতিবারই শীতের সময় লন্ডন আসেন। শীতপ্রধান দেশ লন্ডন। শীতে প্রকৃতিসহ নির্জীব হয়ে পড়ে দেশ। তখন লন্ডনের মানুষই লন্ডন ছেড়ে বাইরে চলে যায়। ইংল্যান্ড প্রাণ ফিরে পায় গ্রীষ্মে। আপনাদের বহুবার বলেছি গ্রীষ্মকালে আসতে।

Ñডিসেম্বর মাস কাজ বন্ধ। তাই আসতে পারি। তোমাদের মা প্রকৃতিপ্রেমী নয়, সংসারপ্রেমী। ডিসেম্বরে সবাইকে ঘরে পায়Ñ তাই ডিসেম্বরেই খুশি। এরকম প্রকৃতি দেখানোর জন্য একবার সিলেটের লাউয়াছড়া নিয়ে গিয়েছিলাম। গালি শুনতে হয়েছে। কোভিড-১৯ সব লণ্ডভণ্ড করে না দিলে এবারো ডিসেম্বরেই আসতাম।

Ñকাজ আর কাজ! আর কত কাজ করবেন? আমরা(বাঙালিরা) সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যৎ বেশি নিশ্চিত করতে গিয়ে কখনো কখনো অনিশ্চিত করে ফেলি। সন্তানকে কাঁধে তুলে তরঙ্গসঙ্কুল গাঙ পার না করে সাঁতার শেখান, সাঁতার শেখার সুযোগ দিন, যাতে নিজে নিজেই গাঙ পার হতে পারে।

বাবা-মেয়ের নিগূঢ় কথোপকথন শেষ হওয়ার আগেই আমরা বাসায় চলে আসি। গরম পানির শাওয়ারে গোসল করার ব্যবস্থা ছিল। গোসলের আগে আমার ঘুম দরকার। চিপস-চিকেন খেয়ে বিকেল ৫টায় (বাংলাদেশ সময়) ঘুম যাই। ঘুম ভাঙতেই দেখি, রাত ১২টা। লন্ডনের আকাশে ফকফকা আলো।

আমার তিন মেয়ে ইউরোপের তিন দেশে। করোনা ঝড়ের পর মেয়েদের দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠছিলাম। তারা তাদের বাবার আত্মভোলা স্বভাবের কথা জানে। একা একা মেয়েদের কাছে পৌঁছতে পারার বিষয় কেউ বিশ^াস করত না। তাদের ধারণা, ‘বাবা বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হলেও ইরেজিতে শিশু। সারাজীবন ওকালতি করে, ‘ধস, রং, ধৎব’Ñএর গোলকধাঁধা থেকেই বের হতে পারেননি। এরকম অসম্মানের মন্তব্যের উত্তরে বলেছিলাম, ‘পারি কী না পারি, একবার ছেড়ে দিয়েই দেখো না? ভুল-বিচ্যুতির জন্য ইমিগ্রেশন পুলিশ বরেণ্য লেখক হুমায়ূন আহমদকেও গরাদে ঢুকিয়েছিল। রাখতে পারেনি। আমাকেও রাখতে পারবে না। তাছাড়া এসব জেল-হাজতে লাজ-খোঁটা নেই।’

১০ এপ্রিল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পৌঁছে এক পরিচিত লোকের সাহায্যে মালামালসহ সহজেই ইমিগ্রেশন পার হই। ফুরফুরে মেজাজে হাঁটাহাঁটি করি। নরওয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকায় বঙ্গবাজার থেকে ওভারকোটও সাথে নিই। বেল্টে একজোড়া লাগেজ ছাড়াও হাতে ছিল সাত কেজি ওজনের হাতব্যাগ, দেড় কেজি ওজনের ল্যাপটপ ও চার কেজি ওজনের ওভারকোট। সবাই নিশ্চিত, এই তিন বস্তুর একটা পথে রয়ে যাবে। ল্যাপটপ আর হাতব্যাগ বহুমূল্যবান। তাই, হাতব্যাগের সাথে শক্ত গিট্টু দিয়ে ল্যাপটপ আটকাই। দুই বস্তু কাঁধেও নিতে পারছি নাÑ হাতেও বহন করতে পারি না।

‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ জোন এলাকা হলেও কড়াকড়ি না থাকায় মাস্কের ওপর দরদ ছিল না। সাড়ে ১০টার দিকে সবাই লাইনে। বিমানে প্রবেশের আগে ব্যাগ-বডি তল্লাশিসহ চ‚ড়ান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়। পরীক্ষার কাছাকাছি পৌঁছতেই দেখি, আমার মুখে মাস্ক নেই। ফুরফুরে মেজাজের সময় মুখের মাস্ক কোথায় গেছে মনে করতে পারছি না। হাত ব্যাগের কোনো এক পকেটে অতিরিক্ত মাস্ক আছে, কিন্তু বের করা সহজ নয়। টিকার সার্টিফিকেট, ওষুধ, পাসপোর্ট, টিকিটসহ ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্য ব্যাগের ভিন্ন ভিন্ন পকেটে। মাস্ক খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে মোবাইলের চার্জার, পানের প্যাকেট, এম্বারকেশন কার্ড ইত্যাদি কাগজপত্র। আমার সামনে আর মাত্র একজন যাত্রী। এর পরই আমার ডাক পড়বে। দেখি, দূরে একটি পুরোনো মাস্ক। মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। পায়ে দলেও গেছে কেউ কেউ। এটা আমার মাস্ক নয়। আমার সামনের জনকে দেখি কোমরের বেল্ট, হাতের ঘড়ি, পকেটের মোবাইল, পরিধেয় কোট, চুলের ব্রাশ, পায়ের জুতা, কলম ইত্যাদি খুল খুলে বাস্কেটে রাখতে শুরু করেছে। এসব স্ক্যান করার পর বডি পরীক্ষা। বডি পরীক্ষার জন্য দু’হাত উপরে তুলে দাঁড়াতে হয়। সবার মুখে মাস্ক। এসির ঠাণ্ডার মাঝেও ঘামে গায়ের কাপড় ভিজতে শুরু করে। ফুরফুরে মেজাজটা মুহূর্তে বাষ্পশূন্য বেলুনের মতো চুপসে যায়। এমন সময় ব্যাগের সাইড পকেটে নজল ¯েপ্রর সাথে পাওয়া যায় মাস্কের প্যাকেট।

বিমানে বসতে গিয়ে দেখি, আমার পাশের সিটে এক মেয়ে। মুখে মাস্ক থাকায় বয়স পরিমাপ কঠিন। মেয়েটির হাতে বদরুদ্দীন উমরের ‘জীবন ও কাজ’ নামক গ্রন্থ। গুরুগম্ভীর চালের বই দেখে মেয়েটিকে মননশীল মনে হলো। মননশীল ছাড়া এই বই মাগনা দিলেও কেউ পড়তে চাইবে না। মেয়েটি কোন দেশে যাবে কে জানে! যে দেশেই যাক, কথা বলার সুযোগ পেলে ৮ ঘণ্টার কঠিন সময়টা পার করা যাবে। কী কথা দিয়ে শুরু করতে পারি? শুনেছি মেয়েদের বয়স আর পুরুষদের বেতন সম্পর্কে প্রশ্ন করতে নেই। সহযাত্রীকে, কোথায় যাবেন প্রশ্ন করাও অন্যায়। অতি প্রয়োজন হলে, ‘অনেক দূর যাবেন কি?’ প্রশ্ন করা দোষের নয়। সহযাত্রী ইচ্ছে করলে উত্তর দেবেন, নয়তো ‘না বা হ্যাঁ’ বলে কথা শেষ করে দিতে পারেন। ইমিগ্রেশন পার হয়েই লন্ডনগামী যাত্রী খুঁজছিলাম। কয়েকজনের উত্তর শুনে মনে হয়েছিল, উনারা চান্দের দেশের যাত্রী। পেট থেকে কথা বেরই হতে চায় না। পাশের সহযাত্রী মেয়ে মানুষ। সে কী উত্তর দেয় কে জানে। তার পরও সাহস করে,
Ñআপনি অনেক দূর যাবেন কি?
Ñআমি লন্ডন যাব।
Ñআমিও লন্ডন যাব। বদরুদ্দীর উমর খুবই রাশভারী লেখক। বদরুদ্দীন উমর, গাফফার চৌধুরী অগাধ জ্ঞানের অধিকারী। তাদের লেখাও রাশভারী। স্মার্টফোন, ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকের যুগে রাশভারী লেখার পাঠক ফুরিয়ে গেছে। যদি কিছু মনে না করেন, আপনার পরিচয়সহ জানতে চাই বইটা কার জন্য কিনেছেন?
Ñআমার নাম আরফুমান চৌধুরী, বিশ^ সাহিত্য কেন্দ্রের (ইউকে) কোর মেম্বার এবং ফর্মার নিউজ প্রেজেন্টার এটিএন বাংলা (ইউকে)।

আমি আমার ভিজিটিং কার্ডসহ ১০ তারিখের দৈনিক পত্রিকাটি হাতে দিই। পত্রিকার উপসম্পাদকীয়তে ‘বেয়াই সমাচার’ কলামটি পড়তে শুরু করেন। একটানে পড়া শেষ করে শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান। তখনই আমি আমার যাত্রাপথের অসহায়ত্বের কথা বলি। সে হিথ্রো পর্যন্ত আমার পাশে থাকাসহ যাবতীয় সাহায্যের প্রতিশ্রæতি দেয়। মনে মনে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ, পাশেই লন্ডনের সহযাত্রী পেয়ে। পরিচয় বিনিময়ের পর আরফুমানের সম্বোধন নেমে আসে ‘আঙ্কেলে’, আমার সম্বোধন ‘তুমি’ তে। দুই দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে ঘণ্টা দু’য়েক আলোচনার পর আরফুমান ঘুমিয়ে পড়ে। আমি বিমানের টিভি স্ক্রিনে চোখ রাখি। স্ক্রিনের বিমানটি ঢাকা টু ইস্তাম্বুল বরাবর মাঝামাঝি নয়াদিল্লির এখানে। বিমানটি গণিতের তেল মাখানো বাঁশ ও বানরের মতো উঠানামার অঙ্ক শুরু করে। বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে ৭টার দিকে কোমরে সিটবেল্ট বাঁধার নির্দেশ থেকে বুঝতে পারি, আমরা ইস্তাম্বুল পৌঁছে গেছি।
নামতে গিয়ে জানতে পারি, আরফুমানের পায়ে সমস্যা। তার জন্য হুইল চেয়ার আসবে। নামবে সবার পরে।

তুরস্ক শীতের দেশ। শীতের কাপড় অদল-বদল করতে গিয়ে বিমানের সব যাত্রী বের হয়ে যায়। আরফুমানের পেছনে পেছনে বের হয়ে বাইরে এসেই দেখি, হুইল চেয়ার প্রস্তুত। হুইল চেয়ারের পেছনে পেছনে আমিও হাঁটছিলাম। কিছু দূর গিয়েই বাম দিকে লিফট আর ডান দিকে চলন্ত সিঁড়ি। লিফট শুধু অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য। আরফুমান আমাকে চলন্ত সিঁড়ির দিকে ইশারা করে লিফটে ঢুকে পড়ে। আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি ছাড়া আশপাশে আর কোনো লোকজন ছিল না। কয়েকতলা উঁচু চলন্ত সিঁড়ি। চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে সামনেই একটি রোগীবাহী জিপ। জিপে চারজনের বেশি ধারণক্ষমতা নেই। জিপের কাছে আগেই এক মহিলা দুই সন্তানসহ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। জিপের চালকও মহিলা। মহিলাকে অসুস্থ মানতে নারাজ। এ নিয়ে চালক মহিলার সাথে যাত্রী মহিলার কঠিন বিতর্ক শুরু। ইংরেজি ভাষার বিতর্ক থেকে যা বুঝতে পেরেছি, যাত্রী মহিলার তলপেটে কিছুদিন আগে অপারেশন হয়েছে। ভারী বস্তু উত্তোলনসহ হাঁটাচলা বারণ। মুখে বললেও অপারেশনের সমর্থনে কোনো কাগজপত্র নেই। ড্রাইভারের দাবি, মিথ্যা অজুহাত দিয়ে দীর্ঘ লবি পার হতে চাচ্ছে।। যাত্রী মহিলার তুখোড় ইংলিশ শুনে নিজকে বড় অসহায় মনে হলো। অসহায় মনে হওয়ার কারণ, আমি প্রথম প্রশ্নেই আউট। রোগীর গাড়িতে আমাকে না নেয়া হলে আমার কী উপায় হবে? রোগীর সমর্থনে আমার কাগজপত্রও নেই, ইংরেজিও জানি না। কোন দিকে যাব? তৌহিদ বলে দিয়েছিল, লন্ডনগামী বিমান ছাড়ার ঘণ্টা খানেক আগে জেনে নেবেন কোন জেটি দিয়ে টার্কিশ ১৯৭৯ নং বিমানে প্রবেশ করতে হবে। জিজ্ঞেস করতে সমস্যা হলে রোর্ডিং কার্ড দেখিয়ে জেটির নাম্বার ও অবস্থান জেনে নেবেন। এই বিজন লবিতে জিজ্ঞেস করব কার কাছে? বোর্ডিং কার্ড দেখাব-ই বা কাকে? ৭১৩ নং বিমান থেকে যারা নেমেছে তারা বিভিন্ন দেশের যাত্রী। বিমানের জেটিও ভিন্ন ভিন স্থানে। বিমান থেকে নেমে সবাই নিজ নিজ স্থানে চলে গেছে। মনে করেছিলাম, বিমান থেকে নেমে খেয়া পারাপারের মতো সব যাত্রী এক স্থানে জড়ো হবে। যখন যে দেশের বিমান আসবে তখন সে বিমানের লোকজন ডাকাডাকি করে বিমানে নিয়ে যাবে। একজন যাত্রী বাদ থাকলে যাত্রীর নামসহ মাইকে অ্যানাউন্স করা হবে। আমাদের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঘণ্টা চারেক বসে বসে তো তাই দেখলাম। যখন এসব ভাবছিলাম তখন হুইল চেয়ারে করে আরফুমান হাজির হয়। বাঙালি দেখলেই বাঙালির বুকের বল বেড়ে যায়। বেড়ে যায় আমার বুকের বলও। হুইল চেয়ারে বসেই আরফুমান আমাকে জিপে উঠতে ইশারা দেয়। ড্রাইভার আমাকে প্রশ্ন করার আগেই আমার পক্ষে কথা বলেন আরফুমান। রোগীবাহী গাড়ি দিয়ে আসতে আসতে ভাবলাম, অনেক বাঁচা বেঁচে গেছি। জনমানবহীন বিশাল বিমানবন্দর ইস্তাম্বুুল। এর বায়ান্ন মোড় তিপ্পান্ন গলি পার হয়ে ১৯৭৯ নং বিমানের জেটি খুঁজে বের করা আমার কাছে কঠিন ছিল।

যেখানে পৌঁছার কথা জিপে করে সেখানে পৌঁছে দেখি, মাত্র গোটা তিনেক যাত্রী। বুঝতে পারলাম এই তিনজনই ১৯৭৯ বিমানে লন্ডন যাত্রী। পাসপোর্ট ও বোর্ডিং কার্ড জমা দিয়ে স্বস্তিতে বসে আরফুমানের প্রতি কৃতজ্ঞতাসহ নিজের অসাহয়ত্বের কথা ভাবছি। অনেককেই কফি পান করতে দেখে আমারও ইচ্ছে করছিল। বিশেষ করে আরফুমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনস্বরূপ হলেও তাকে কফি পান করানো আবশ্যক। রাস্তায় খরচ করার জন্য আমার কাছে ডলার পাউন্ডও আছে। আশপাশেই ফাস্টফুড ও কফিশপের দোকান রয়েছে। তাই আরফুমানকে ইশারায় জানিয়ে আমি কফি আনতে বের হই। আশপাশ ঘুরঘুর করে শপ না দেখে একজনকে,
ইফ দেয়ার এনি ফাস্টফুড অর কফিশপ?

লোকটি উত্তর না দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়। আমি পুনরায় একই প্রশ্ন করার পর কী বুঝে কী উত্তর দিলো আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আমার হাল দেখে এগিয়ে যায় আরফুমান। কাছে গিয়ে, Ñআঙ্কেল, চলে আসেন। কফিশপ গ্রাউন্ড ফ্লোরে। খুঁজতে গিয়ে আপনি নিজেই হারিয়ে যাবেন। কিছুক্ষণ পরই হিথ্রোগামী বিমানের লাইন শুরু হবে। হিথ্রো নেমে আমার আর আপনার লাইন আলাদা হয়ে যাবে। হিথ্রোতে ইউকে, ইউইও এবং সাধারণ এই তিন লাইনে চেক আউট হয়। আমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট আর আপনার হবে সাধারণ পাসপোর্টের লাইন।

Ñতোমার কাছে আমার মেয়ে হেনার ফোন নম্বর আছে। হিথ্রো নেমে আমি মেয়ের কাছে ফোন করার কায়দা পাবো না। যেহেতু আমার লাগেজে কোনো নিষিদ্ধ আইটেম নেই এবং যেহেতু তৃতীয়বার লন্ডন আগমন সেহেতু ইমিগ্রেশন পার হতে যাই ঘটুক, ফিরিয়ে দেবেন না।

সাধারণ পাসপোর্টের লাইনের মাথায় ১০-১২টি ইমিগ্রেশন বুথ। লাইন থেকে একজন একজন করে বুথে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার জন্য ডাক পড়ে আমারও। চারটি পাসপোর্ট অফিসারের হাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে রই। প্রশ্ন শুরু করেন। ইংরেজি ভাষায়। তড়িঘড়ি উত্তর দিতে গিয়ে ‘ণড়ঁহমবৎ এবং ঊষফবৎ শব্দ আউলায়ে যায়। বড় কন্যা বোঝাতে উধঁমযঃবৎ-এর আগে ইংরেজি কোন শব্দ হবে, বলতে গিয়েও ‘ণড়ঁহমবৎ এবং ঊষফবৎ’ গুলিয়ে ফেলি। পকেটে পূর্ণাঙ্গ পরিচয়সহ ভিজিটিং কার্ড আছে। ভিজিটিং কার্ড থাকা সত্তে¡ও প্রদর্শন করছি না। কারণ, বছর দশেক আগে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এম্বারকেশন কার্ড পূরণ করতে গিয়ে তিনবার ভুল করেছিলাম। পরে এক পুলিশের সাহায্য নিই। পুলিশ পরিচয় পেয়ে এম্বারকেশন কার্ড পূরণ করতে করতে, ‘স্যার, আপনারা কী পড়ে ওকালতি করেন, এম্বারকেশন কার্ডটাই পূরণ করতে পারছেন না’। এবারো নতুন ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়েছি। সেখানে আমার নামের শেষে লেখা রয়েছে গ.অ (উ.ট) খ-খ ই ্ ঈড়ষঁসহরংঃ. তা দেখে আগের পুলিশের মতো হিথ্রোর পুলিশও যদি আমার পেশা নিয়ে কটাক্ষ করে। অফিসারের ভাবগতি খারাপ দেখে অনেক শক্তি সঞ্চয় করে বললাম, অষষ সু ঢ়ধঢ়বৎং ধৎব মবহঁরহব. ও পধসব যবৎব ঃযৎবব ঃরসবং. বলার পরই শুরু হয় ঘষাঘষি। নতুন-পুরাতন পাসপোর্ট নানাভাবে ঘষাঘষি করে সন্দেহমুক্ত বুঝতে পেলে সহাস্যে ঊঢওঞ দেখিয়ে দেয়। ঊঢওঞ অতিক্রম করে সামনেই দেখি অনিক (নাতি)। অনিক আমার হাত থেকে লাগেজের ক্যারিয়ার নিয়ে নেয়। স্বদেশে ও বিদেশে আমার সাত নাতি-নাতনী। সবাই ইরেজি পড়ছে। বাড়ির ছোট্ট নাতনীটিও ইউটিউব ও স্মার্ট টিভির কল্যাণে পুটুর পুটুর ইংরেজিতে কথা বলে। তা দেখে সখেদে বলতাম, ‘আমার লেখা বই পড়ার লোকও বংশে রাখবি না?’ এখন ভাবছি, ছোট হয়ে আসছে বিশ^, পরিণত হচ্ছে এক পরিবারে। যে পরিবারের ভাষা ইংরেজি। মায়ের ভাষার পাশাপশি ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা না থাকলে আমার মতো ঘাটে ঘাটে মাশুল গুনতে হবে। 
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement