১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রোজা পালনের প্রতিটি দিন

-

রমজান এক মহিমান্বিত মাস। মুমিনের জন্য কাঙ্ক্ষিত সময়। ইবাদতে মশগুল থাকার এমন অনন্য সুযোগ রমজান ছাড়া অন্য মাসে পাওয়া যায় না। বরকতময় এ মাসের রহমতের দশক শেষে এখন চলছে মাগফিরাতের দশক।

রমজানের প্রতিটি দিন আমরা কিভাবে কাটাতে পারি তা নিয়ে আলোচনা করা যাক। একটি দিনের কথাই ধরি। রোজা রাখার জন্য সাহরি খাওয়ার আগে তারাবিহ নামাজ দিয়ে সূচনা হলো রোজার আচার। এশার নামাজের জন্য আজান হচ্ছে। আপনি মুয়াজ্জিনের সাথে সাথে আজানের কথাগুলোর জবাব দিন। আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেছেন, ‘যখন তোমরা আজান শুনতে পাও, তখন মুয়াজ্জিন যা বলে তোমরাও তাই বলবে’ (বুখারি)। আজান শেষ হলে মহান আল্লাহর কাছে শান্তি, বরকত ও নেয়ামত কামনা করে দোয়া করুন।

আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন সালাতের জন্য আজান দেয়া হয়, তখন শয়তান পালাতে থাকে যাতে সে আজানের শব্দ শুনতে না পায়। আজান শেষ হলে আবার সে ফিরে আসে। আবার যখন সালাতের জন্য ইকামাত দেয়া হয়, তখন আবার দূরে সরে যায়। ইকামাত শেষ হলে আবার সে ফিরে আসে লোকের মনে কুমন্ত্রণা দেয়ার জন্য (বুখারি)।

আজান শেষ হলে আজানের দোয়া পাঠ করুন। জাবির ইবনু আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি আজান শুনে দোয়া করে- ‘হে আল্লাহ এ পরিপূর্ণ আহ্বান ও প্রতিষ্ঠিত সালাতের আপনিই প্রভু, মুহাম্মদ সা:কে ওয়াসিলা ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী করুন এবং তাকে মাকামে মাহমুদে পৌঁছে দিন, যার অঙ্গীকার তাঁকে আপনি করেছেন, নিশ্চয়ই আপনি এর ব্যতিক্রম করেন না- কিয়ামাতের দিন তিনি শাফাআত লাভের অধিকারী হবেন’ (বুখারি, মুসলিম)।

এশার জামায়াত শুরুর ১৫ মিনিট আগেই মসজিদে পৌঁছে যান। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আজান ও ইকামাতের মধ্যবর্তী সময়ে দোয়া কবুল হয়। সুতরাং তোমরা দোয়া করো’ (মেশকাত, হাদিস : ৬৭১)। দোয়ার পর সুন্নাত নামাজ পড়ুন এবং কিছু সময় জিকির করুন। এরপর জামায়াতে এশার ফরজ নামাজ আদায় করুন। এর ফজিলতও খুব বেশি। হজরত উসমান বিন আফফান রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি এশার নামাজ জামাতে আদায় করে সে মধ্যরাত অবধি নামাজ আদায়ের সওয়াব পায়। আর সে যদি ফজরের নামাজও জামাতে আদায় করে তা হলে সারারাত নামাজ আদায় করার সওয়াব পায়।’ এশার ফরজ শেষে দুই রাকাত সুন্নাত নামাজ আদায় করুন। এরপর ইমামের পেছনে বিশ রাকাত সম্পূর্ণ তারাবিহর নামাজ পড়ার চেষ্টা করুন। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে হালকা কিছু খাদ্য গ্রহণ করুন। ঘুমানোর আগে কুরআন তেলাওয়াত, কুরআনের তাফসির, রাসূল সা:-এর সিরাত পড়তে পারেন, জিকির করতে পারেন। সাড়ে ১০ থেকে ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ুন। এর আগে ঘুমের দোয়া পড়ুন। ৩৩ বার ‘সুবহান আল্লাহ’, ৩৩ বার ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ৩৪ বার ‘আল্লাহ আকবর’ পড়ে দুই হাতের তালুতে ফুঁ দিন এবং শরীরে দুই হাত বুলিয়ে দিন। সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ুন। আয়তুল কুরসি পড়ুন।

রাতের শেষভাগে উঠে পড়ুন, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ুন। যতটুকু পারেন। চার রাকাত, আট রাকাত, বারো রাকাত। এরপর তিন রাকাত বিতর নামাজ পড়ুন। জামাতে তারাবিহ নামাজ শেষে বিতর পড়ে থাকলে আর পড়ার দরকার নেই। তাহাজ্জুদের এ সময়ের ইবাদত আল্লাহ খুব পছন্দ করেন। তিনি সাত আসমানের নিচে নেমে আসেন। বান্দা এ সময় যে দোয়া করে আল্লাহ তা কবুল করেন। সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত থাকে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।’ এ সময় আল্লাহ তায়ালা নিকট আসমানে অবতীর্ণ হয়ে ডাকেন কে আছো আমার বান্দা, কে কী চাইবে, আমি তাকে তা দান করব। কে আছো যে, আমার কাছে ক্ষমা চাইবে। আমি তাকে ক্ষমা করে দেবা’ (বুখারি, মুসলিম)।

আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ খুশি হন। যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদের জন্য ওঠেন এবং নামাজ পড়েন, মুসল্লি যারা নামাজের জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায় এবং মুজাহিদ যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। রমজান মাস তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য খুবই সহায়ক। সাহরি খাওয়ার জন্য আমরা সবাই যেহেতু উঠি, এ সময়টাই হলো তাহাজ্জুদের সময়। রমজানে নফল নামাজের সওয়াব ফরজের সমান এবং ফরজ নামাজের সাওয়াব সত্তর গুণ বেশি। এ জন্যই রমজানে বেশি বেশি করে তাহাজ্জুদ পড়া উচিত।

শরিয়তের পরিভাষায় রোজা পালনের নিয়তে শেষ রাতে খাওয়াকে সাহরি বলা হয়। এর ফজিলত অপরিসীম। হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলে কারিম সা: বলেন, ‘তোমরা সাহরি খাও, কেননা সাহরিতে বরকত রয়েছে’ (বুখারি, ১৮০১)। অন্য এক হাদিসে আছে, নবীজী সা: বলেন, ‘আমাদের রোজা আর আহলে কিতাবদের রোজার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে? এটি হলো সাহরি খাওয়া আর না খাওয়া’ (মুসলিম-১৩১)। তাই রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘সাহরি খাওয়া বরকতময় কাজ। সুতরাং তোমরা তা পরিত্যাগ করো না। এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও সাহরি খাও’ (ইবনে মাজাহ)। শেষ সময়ে সাহরি খাওয়া উত্তম বলেছেন নবীজী সা:। এরপর ফজরের আজান হলে যথানিয়মে আজানের জবাব দিন, দোয়া পড়ুন, আজান ও ইকামাতের মাঝে মুনাজাত করুন। মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে ফজরের সালাত আদায় করুন। সূর্যোদয়ের পর ইশরাক বা চাশতের তথা সালাত উদ দোহা পড়ুন। তাহাজ্জুদের পরে সালাতুদ দোহার নামাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আবুজর গিফারি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে বান্দার শরীরে যতগুলো জোড়া আছে, প্রতিটি জোড়ার পক্ষ থেকে বান্দার আল্লাহর কাছে তাসবিহ, সাদাকাহ পেশ করা উচিত’ (মুসলিম)। কেউ যদি সকালে দোহার নামাজ আদায় করে দুই রাকাত বা চার রাকাত তা হলে সেই সাদাকাহ আদায় হয়ে যায়।

সালাতুদ দোহা শেষ করে কিছু সময় ঘুমিয়ে নিন। ঘুম থেকে উঠে অফিসে বা দৈনন্দিন কাজে লেগে যান। কাজের ফাঁকে ফাঁকে জিকির করুন। জিহ্বাকে গিবত ও পরচর্চা থেকে বিরত রাখুন। ঝগড়া-ফ্যাসাদ এড়িয়ে চলুন। কেউ ঝগড়ায় এগিয়ে এলে তাকে বলুন আমি রোজাদার। জোহরের নামাজের আজান শোনামাত্র আজানের জবাব, আজানের দোয়া পড়ুন, আজান ও ইকামাতের মাঝে মুনাজাত করুন। জোহরের চার রাকাত ফরজ নামাজ আদায়ের পূর্বে চার রাকাত সুন্নাত পড়ুন, ফরজের পর দুই রাকাত সুন্নাত ও নফল নামাজ আদায় করুন। রোজার সময় সুন্নত ও নফল নামাজে অবহেলা করবেন না।

বরং বেশি বেশি নফল নামাজ পড়ুন। সময় পেলে কুরআন তেলাওয়াত করুন। তার পর আবার কাজে ফিরে যান। আসরের আজান কানে আসা মাত্রই আজানের জবাব ও দোয়া করুন। আসরের আগে চার রাকাত সুন্নাত পড়তে পারেন, জরুরি নয়। পড়লে সওয়াব হবে। আসরের নামাজ আদায়ের পর দোয়া করুন। মসজিদে কোনো দ্বীনি আলোচনার ব্যবস্থা থাকলে অংশ নিন বা কুরআন তেলাওয়াত করুন। রমজানে প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াতের এমন সময় বেছে নিন যাতে অন্তত ১০ দিনে এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করা যায়। পুরো রমজানে তিন খতম কুরআন পড়তে পারলে ভালো। কুরআন বোঝার জন্য তাফসিরও পড়ুন। কারণ রোজায় কুরআন তেলাওয়াত ও চর্চা অন্যতম ইবাদত।

ইফতারের অন্তত ১৫ মিনিট আগে ঘরে ফেরার চেষ্টা করুন। ইফতারের আগ মুহূর্তে রোজাদার বান্দার দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। স্ত্রী ছেলেমেয়ে, মা-ভাইবোনকে নিয়ে ইফতারের আগে দোয়া করুন, ইফতার সামনে নিয়ে। রোজায় রোজাদারদের বাসায় ইফতারি দেয়ার বা রোজাদারকে ইফতার করানোর চেষ্টা করবেন। কারণ এতে দ্বিগুণ সাওয়াব হাসিল হয়। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে সে ওই রোজাদারের সমান সওয়াব পাবে; অথচ রোজাদারের সওয়াব থেকে একটুও কমবে না’ (সুনানে তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)। মাগরিবের আজান শোনামাত্র ইফতার শুরুর মাধ্যমে রোজা ভেঙে ফেলুন। কেননা রাসূল সা: বলেছেন, ‘ততদিন মানুষ কল্যাণের মধ্যে থাকবে যতদিন মানুষ দ্রুত ইফতার করবে’ (বুখারি ও মুসলিম)। খেজুর দিয়ে ইফতার করা বরকতময় বলেছেন নবীজী সা:। ইফতারের পর মাগরিবের নামাজ পড়ে নিন জামাতে। ফরজ নামাজের পর দুই রাকাত সুন্নাত পড়ুন। এরপর রাতের খাবার খেয়ে নিন। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে এশা ও তারাবিহ নামাজের প্রস্তুতি নিন। এভাবেই রোজার ৩০ দিন কাটান। রোজার শেষ দশকে বেশি বেশি অর্থাৎ সর্বোচ্চ ইবাদত করুন। চেষ্টা করুন হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রজনী লাইলাতুল কদর যাতে নসিব করতে পারেন। এ জন্য বেজোড় রাতে জেগে থেকে ইবাদত করুন। পারলে শেষ ১০ দিনই বেশি কষ্ট করুন। দান-সাদাকা করুন। ইতিকাফ করুন। বেশি বেশি পড়ুন- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ এবং ‘আল্লাহুম্মা নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউজুবিকা মিনান নার’। আরো পড়ুন ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফউয়া ফাফু আন্নি’। রমজানের শেষ দিনে বেশি বেশি দোয়া করুন। ওই দিনেই আল্লাহ তায়ালা পাওনা মিটিয়ে দেবেন; অর্থাৎ গুনাহ মাফ করবেন। জান্নাতের ফয়সালা করে দেবেন। আসুন এভাবেই আমরা রমজানের ৩০টি রোজা পালন করি।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব।


আরো সংবাদ



premium cement