২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নেতা ও পিতার ছায়ায় সোহেল তাজ

- ছবি : নয়া দিগন্ত

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জীবন স্মৃতি ‘নেতা ও পিতা’। লিখেছেন তার বিদূষী কন্যা শারমিন আহমদ। এই স্মৃতিকথার অক্ষরে অক্ষরে, শব্দে শব্দে ও প্রতিটি বাক্যে ফুটে উঠেছে একজন বিশ্বস্ত নেতার বর্ণাঢ্য জীবন কাহিনী। জীবন কাহিনীটি যারা পড়েছেন, তাদের সবারই হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার কথা। অতিক্রান্ত সময়ে ইতিহাস প্রামাণ্য হয়ে ওঠে। তাই তাজউদ্দীনের জীবনহানির অনেক পরে ২০১৪ সালে যখন এটি প্রকাশিত হয়, তখন রাজনীতিতে খানিকটা ঝড় ওঠে। কোনো বিতর্ক বা বিরোধী মতামত পরিদৃশ্য না হলেও যে কঠিন সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে এই গ্রন্থে, তা ‘নিজগুণে হরিণী বৈরী’-এর মতো সত্য।

লেখিকা শারমিন আহমদের ভাষায় ‘আজকের ও আগামীর তরুণ যখন বইটি পড়বে তখন সে হয়তো এর মধ্যে খুঁজে পাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এমন এক ব্যতিক্রমধর্মী, মৌলিক চিন্তাশীল, বিস্ময়কর রকমের ন্যায়নিষ্ঠ, দুর্দান্ত রকমের সত্যপ্রিয়, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, নিরহঙ্কার, আত্মপ্রচারবিমুখ ও স্বাধীনচেতা মানুষকে, যার নির্মল জীবনাদর্শকে অনুসরণের মধ্যে শান্তি ও ন্যায়ের সুকঠিন পথটি নির্মাণ করা সম্ভব।’ এই মন্তব্যের বাস্তব নমুনা ধরেই যেন তাজউদ্দীন আহমদের সন্তান সোহেল তাজের আগমন। প্রচলিত রাজনৈতিক ধারায় তার পিতার মতোই তিনি এক ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্র। তার পুরো পরিবারটি তাজউদ্দীন আদর্শের সার্থক ধারক।

জোহরা তাজউদ্দীন একটি ক্রান্তিকালে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। তিনি কী পেয়েছিলেন আর কী পাননি- তার হিসাব স্বাভাবিকভাবেই তারা করেননি। কিন্তু মানুষ সবই জানে ও বোঝে। এ যেন ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাজউদ্দীন পরিবারের জন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর পরই তার স্থান। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহকর্মী হিসেবে তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাটিয়েছেন। ওই গ্রন্থেও তার পরিপূর্ণ বর্ণনা আছে। জীবন শেষে বঙ্গবন্ধুর সেই বিশ্বস্ততায় ছেদ এসেছিল। তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। জোহরা তাজউদ্দীনের কথা তো আগেই বলেছি। আফসার উদ্দীন তাজউদ্দীন আহমদের আপন ভাই। তিনি আধা মন্ত্রিত্বও পেয়েছিলেন। পরিণতি ভালো হয়নি। ক্রমধারায় একপর্যায়ে সোহেল তাজও প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন।

রাজপ্রাসাদের খবরাখবর বাইরে প্রকাশিত হয় খুব কমই। তবে আকাশে-বাতাসে গুজব রটে। তাজউদ্দীন তনয়কে অপমানজনকভাবে বিদায় নিতে হয়েছিল বলে জনশ্রæতি আছে। এরপর তিনি অভিমানে বিদেশ চলে গিয়েছিলেন। আবারো গুজব, সাধাসাধিতে তিনি নরম হননি। ফিরে আসেননি। তাজউদ্দীন পরিবারের রাজনীতিতে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের কারণে শাসক দলের প্রয়োজন ছিল পারিবারিক প্রতিনিধিত্বের। অবশেষে সোহেল তাজের পরিবর্তে তার বোন সিমিন হোসেনকে এমপি বানানো হয়। বিগত প্রায় দেড় দশক ধরে সোহেল তাজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনুপস্থিত। কিন্তু মাঝে মধ্যেই আবিভর্র্‚ত হন ধূমকেতুর মতো। যখনই আসেন জাতিকে বার্তা দিতে চান। চমক সৃষ্টি হয় তখন। এবারো তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাবেক এই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী গত রোববার গণভবনে গিয়েছিলেন রাজনৈতিক দাবি নিয়ে। অনেক লোকজন তাকে অনুগমন করে। তার মূল দাবি- ১০ এপ্রিলকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে ঘোষণা করা। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। সেই সাথে স্বাধীনতার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং তাৎপর্য ঘোষিত হয়। লক্ষণীয় যে, এই দিনটি ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে খুব গুরুত্বসহকারে কখনো পালিত হয়নি। সোহেল তাজ সম্ভবত সেই ঘাটতি পূরণ করতে চান। তা ছাড়া সেই ঘোষণাপত্রে স্বাধীনতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা ঘোষিত হয় তার সাথে পরবর্তীকালে নাগরিক সাধারণ বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো সেই ঘোষণাপত্র উল্লেøখ করে বারবার শাসক দলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এ কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করা হয় যে, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করিলাম...।’ ঘোষণায় আরো বলা হয়, সরকার ‘বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অন্যান্য সকল কার্য করিতে পারিবেন।’ এই ঘোষণাপত্রে কয়েকটি শব্দ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ, যা আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে মহিমান্বিত করেছে। সেগুলো হলো- সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, নিয়মতান্ত্রিকতা ও ন্যায়ানুগতা। এখনকার বাংলাদেশে এই নীতিবোধক শব্দগুলোর অনুপস্থিতি নাগরিক সাধারণকে অসম্ভবভাবে ক্ষুব্ধ করছে। সোহেল তাজ হয়তো প্রজাতন্ত্র দিবস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে চান।

তিনি যে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন তাতে তিনটি বিষয়ের উল্লেøখ রয়েছে- ১. ১০ এপ্রিল প্রজাতন্ত্র দিবস ঘোষণা করতে হবে; ২. ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করতে হবে ও ৩. জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অবদান ও জীবনীসহ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস যথাযথ মর্যাদা এবং গুরুত্বের সাথে সর্বস্তরের পাঠ্যপুস্তক ও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে জেলহত্যা দিবস পালন করেছে। সরকারিভাবে যে গুরুত্ব এই দিবস দাবি করে তা কখনো প্রদর্শিত হয়নি। তা ছাড়া বিষয়টি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি। জেলহত্যাকাণ্ডের বিচার এখনো শেষ হয়নি বলে যথাসম্ভব মনে পড়ে। অথচ বিশেষ ট্রায়ালে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়েছে।

বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের একটি সংবেদনশীল সময়ে চার নেতা- তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা ৩ নভেম্বরের টালমাটাল সময়ে বিদেশে পালানোর আগে ঝড়ের গতিতে কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করে এবং নির্মমভাবে তাদের হত্যা করে। যেকোনো মানবিক বিচারে জেলবন্দীদের এই হত্যা ছিল ক্ষমাহীন অপরাধ। অথচ পরবর্তীকালে যথাযথ প্রক্রিয়ায় এই বিচার অনুষ্ঠিত হয়নি। সন্দেহ নেই, এই বিচার প্রক্রিয়া খুবই জটিল ও দুরূহ। তবে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়- এটা সবাই বোঝে। তাই সোহেল তাজ যথার্থভাবেই দাবিগুলো উত্থাপন করেছেন। সোহেল তাজ জাতীয় সংসদ থেকে রোডমার্চ করে গণভবনে যান। সোহেল তাজের সাথে তার দুই বোন সিমিন হোসেন এমপি ও মেহজাবিন আহমদ ছিলেন। সিমিন হোসেন সরকারি দলের সংসদ সদস্য হওয়া সত্তে¡ও সোহেল তাজের সাথে ছিলেন। এটি তাদের পারিবারিক ঐক্যেরও প্রমাণ দেয়। গণভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে স্মারকলিপি গ্রহণ করা হয়েছে। সোহেল তাজের এই আকস্মিক কার্যক্রম রাজনীতিতে বেশ ঔৎসুক্যের সৃষ্টি করেছে। জনাব তাজ দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশের বাইরে ছিলেন। ২০১২ সালের এপ্রিলে তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগ করে বিদেশে চলে যান। এর আগে ২০০৯ সালের মে মাসে তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন।

সোহেল তাজের এই কার্যক্রম নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার এই কার্যক্রমকে কতটা সহজভাবে গ্রহণ করবে সেটিই বিবেচ্য বিষয়। অতি সাম্প্রতিককালে সরকার কোনো ধরনের বাদ-প্রতিবাদ এমনকি দ্রব্যমূল্যের প্রতিবাদ করাকেও সহজে গ্রহণ করছে না। এই সে দিন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে লিফলেট বিতরণ করাকালে বিএনপির উদীয়মান নেতা মেয়র পদপ্রার্থী এবং মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। সোহেল তাজের এই নীরব প্রতিবাদটি এমন সময়ে হলো, যখন ক্ষমতাসীন সরকার কিছুটা বিপাকে রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর সরকার বিব্রত অবস্থায় রয়েছে। তারা আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য দেনদরবার করে যাচ্ছে। ওদিক থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাহী আদেশে এই বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়। বরং যে অবস্থায় বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে সে অবস্থার উন্নতির মাধ্যমেই বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হতে পারে। এ ছাড়া সরকারবিরোধী দল ও জোট বড় আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনের সূচনা করেছে। সরকার এসব আন্দোলন কঠোরভাবে পুলিশি কার্যক্রমের মাধ্যমে দমন করছে। এমনিতেই সামগ্রিকভাবে জনগণ সরকারবিরোধী হয়ে পড়েছে বলে মনে করা হয়। বিরোধীদের সূচনাকৃত গণ-আন্দোলনে সোহেল তাজের এই কার্যক্রম নীরব সমর্থন জোগাবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।

চলমান গণ-আন্দোলনে যদি সোহেল তাজের আরো কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়, তা গণতন্ত্র তথা নির্বাচন ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে বেগবান করবে। সবচেয়ে বড় কথা, ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ গ্রন্থে তাজউদ্দীন আহমদের রাজনীতির যে আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিধৃত হয়েছে সোহেল তাজের এই প্রতিবাদী, সাহসী ও সময়োপযোগী আন্দোলন তারই প্রতিধ্বনি করে। গ্রন্থে তাজউদ্দীন আহমদকে সত্য, ন্যায়, সুন্দর ও স্বাধীনতার প্রতীক বলে বর্ণনা করা আছে। দৃশ্যত সোহেল তাজের কার্যাবলিতে প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত সে আদর্শের প্রতিরূপ লক্ষ করা যাচ্ছে। শারমিন আহমদ ওই গ্রন্থে তার ভ‚মিকায় অবশেষে আশা প্রকাশ করেছেন ‘স্নেহভাজন ছোট ভাই তানজিম আহমদ সোহেল বাবা ও মায়ের আদর্শকে সমুন্নত রেখে, অন্যায়ের সাথে আপস না করার জন্য, রাজনীতিতে তার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছে সেটিও এই বই লেখাকে অনুপ্রাণিত করেছে।’ বাংলাদেশে লাখ লাখ ‘বঙ্গতাজ’ ভক্ত সোহেল তাজের সংগ্রামী ভ‚মিকায় অনুপ্রাণিত হবেন- সবাই সেটিই প্রত্যাশা করে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement