২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ড. হাসান মোহাম্মদের সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার বিচিত্রতা

ড. হাসান মোহাম্মদের সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার বিচিত্রতা - ছবি : নয়া দিগন্ত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান ড. হাসান মোহাম্মদ ইন্তেকাল করেছেন এক বছর হয়ে গেল। তিনি ছিলেন মৌলিক রাষ্ট্রচিন্তক ও রাজনীতি ও সমাজ গবেষক। তার সাথে আমার পরিচিতি ঘটে যখন আমি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি কোর্সে গবেষণা করি। তার মার্জিত আচরণ, সৌজন্যবোধ ও নিরহঙ্কার জীবনধারা আমাকে মুগ্ধ করে এবং তার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। তিনি ছিলেন শেকড়সন্ধানী এক গবেষক ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। তার প্রতিটি কথার সাথে অনেকে হয়তো একমত হবেন না বা অনেকের ভিন্নমত থাকতে পারে কিন্তু তার নির্মোহ ও দলনিরপেক্ষ পর্যালোচনা প্রশংসার দাবি রাখে। তার মন্তব্য ও সুপারিশগুলো উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিবেচনায় আনা যেতে পারে। অথবা কোনো গবেষক ভিন্ন সুপারিশও করতে পারেন।

প্রফেসর ড. হাসান মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালে সন্দ্বীপের সারিকাইতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে মাইটভাঙ্গা স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে ওই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ও পরবর্তীতে উপাচার্য মরহুম ড. আর আই চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে তিনি ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ : নেতৃত্ব, সংগঠন ও আদর্শ’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০২০ সালে তিনি প্রফেসর হিসেবে অবসর নেন। ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল এ মনীষী ইন্তেকাল করেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। বিভাগীয় চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, চবি জাতীয়তাবাদী শিক্ষকসমাজের সংগঠন ‘সাদা’ দলের আহ্বায়ক, বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক, চবি শিক্ষক ক্লাবের সভাপতিসহ অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। আলিম পরিবারে তার জন্ম। বিয়ে করেছেন আলিম পরিবার থেকে। ছাত্রজীবনের প্রারম্ভে কিছু দিন মাদরাসায়ও অধ্যয়ন করেন। কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ে এসে তিনি বাম রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হন। পরিণত বয়সে তিনি বামধারা পরিত্যাগ করে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী বলয়ে যুক্ত হন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ইসলামী অনুশাসনচর্চায় অত্যন্ত মনোযোগী হয়ে ওঠেন।

প্রফেসর হাসান মোহাম্মদের প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। তার ফিল্ড অব স্টাডি বৈচিত্র্যময়। বিপরীতমুখী বিষয় নিয়ে তিনি গবেষণা করেন। তিনি কমরেড মুজাফফর আহমদ, বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন ও বাংলার সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন নিয়ে যেমন কলম ধরেছেন তেমনি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, তাবলিগ জামায়াত, শহীদ জিয়া, বিএনপি, ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, মাদরাসা শিক্ষা এবং করিডোর ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়েও গবেষণা করেন। প্রকাশিত রচনাবলির মধ্যে নিম্নোক্ত গ্রন্থগুলো উল্লেখযোগ্য-

১. কমরেড মুজাফফর আহমদ ও বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন (১৯৮৯), ২. জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ : নেতৃত্ব, সংগঠন ও আদর্শ (১৯৯৩), ৩. বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার আলোকে করিডোর ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট (২০০০), ৪. তাবলিগ আন্দোলন ও তাবলিগ জামায়াত (২০০০), ৫. জাতীয়তাবাদ : প্রসঙ্গ বাংলাদেশ (২০০১), ৬. শহীদ জিয়া, বিএনপি ও বাংলাদেশের রাজনীতি (২০০৩),৭. বাংলাদেশ : ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি (২০০৩), ৮. বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা (২০০৩), ৯. বাংলার সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন (২০০৩), ১০. সম্পাদিত গ্রন্থ, সন্দ্বীপ সমীক্ষা (১৯৯৯)।

বাংলাদেশে ইসলামী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটছে এবং সাধারণ জনগণের মাঝে এর বিস্তৃতি ঘটছে। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্ম ইসলাম জাতীয় রাজনীতিতে অপরিহার্য ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। কারণ হিসেবে প্রফেসর ড. হাসান মোহাম্মদ মনে করেন, ‘সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের মতাদর্শিক বিতর্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ দেশ কর্তৃক সমাজতন্ত্র ত্যাগ, বাংলাদেশের বাম রাজনীতিতে বিভাজন ও শক্তিহীনতা প্রভৃৃতি এদেশের যুবসমাজের ওপর থেকে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রভাব কমে যেতে সহায়ক হয়েছে। আদর্শপ্রবণ যুবসমাজের এক উল্লেখযোগ্য অংশ বর্তমানে ইসলামী রাজনীতির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ কর্তৃক আধুনিকতাবাদী ইসলাম অনুসরণের অকার্যকারিতাও বাংলাদেশের কিছু মানুষকে ইসলামী আন্দোলনের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস প্রতিস্থাপন, সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী দ্বারা ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা ইত্যাদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের প্রাধান্য বৃদ্ধির উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের এ ক্রমবর্ধিষ্ণু প্রাধান্য ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকামী সংগঠনসমূহকে আশাবাদী করে তুলতে সহায়ক হয়েছে।’ (জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ : নেতৃত্ব, সংগঠন ও আদর্শ, ঢাকা, ১৯৯৩,পৃষ্ঠা-১০)।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. হাসান মোহাম্মদ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নেতৃত্ব, সাংগঠনিক কাঠামো ও আদর্শ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে জামায়াতের প্রশংসা যেমন করেছেন, তেমনি জামায়াতের বিচ্যুতি তুলে ধরতেও কুণ্ঠিত হননি। তিনি পরামর্শ স্বরূপ কিছু মন্তব্যও করেছেন, যা পর্যালোচনার দাবি রাখে। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত বর্তমানে একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান চারটি রাজনৈতিক দলের একটি হিসেবে জামায়াত বিবেচিত হয়। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থাকামী সংগঠনসমূহের মধ্যে জামায়াতের স্থান সর্বোচ্চে। সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও ঐক্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে জামায়াতের সাফল্য বাংলাদেশের অন্য যেকোনো সংগঠনের তুলনায় অনেক বেশি, বলা যায়। বাংলাদেশকে একটি ইসলামী আদর্শানুসারী রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে পরিচালিত জামায়াতের কার্যক্রম কখন সফল হবে কিংবা কখনো পুরোপুরি সফল হবে কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব না হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে জামায়াত তার অবস্থান দীর্ঘদিন বজায় রাখতে সক্ষম হতে পারে। জামায়াত অনুসৃত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা-বিষয়ক ইসলামী নীতিমালা কোন কোন ক্ষেত্রে অপরিবর্তনীয় বলে মনে করা হয়। ওই বিষয়গুলো সম্পর্কিত পরিবর্তনশীল চিন্তা-ভাবনার সাথে জামায়াতের পক্ষে কতটা খাপ খাইয়ে নেয়া সম্ভব হবে সে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা কঠিন। অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতার সাথে জামায়াতের সমন্বয়প্রচেষ্টা আমরা লক্ষ্য করেছি। এ প্রচেষ্টায় যত বেশি সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হবে আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রত্যাশী বাংলাদেশের মুসলিম জনগণের কাছে জামায়াতের গ্রহণযোগ্যতাও ততবেশি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৫৭)

প্রফেসর ড. হাসান মোহাম্মদ তার গবেষণায় আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইসলাম ধর্মের প্রভাব সুস্পষ্ট। তবে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের মাত্রার প্রশ্নে এখানকার ইসলামপ্রিয় জনগণও ঐকমত্য পোষণ করেন না। বাংলাদেশের ইসলামী শাসন কায়েমেচ্ছু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হতে সক্ষম। মূলত জামায়াত ব্যতীত অন্য কোনো ইসলামী সংগঠন খুব বেশি নতুন সদস্য ও সমর্থক সৃষ্টি করতে পারছে না। সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রী সংস্থা ও মাদরাসা ছাত্রদের মধ্যে কার্যরত জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া দ্বারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের এক উল্লেখযোগ্য অংশকে জামায়াত তার আন্দোলনের সমর্থক সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। জামায়াত তার আন্দোলনে বিভিন্ন পেশার মানুষকে আকৃষ্ট ও সংযুক্ত করার অনেকগুলো অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন গড়ে তুলেছে। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বিরোধী শক্তিসমূহ ইসলামী রাজনীতির অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করার জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করছে। রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করে সুবিধা লাভ করতে চায় এমন লোকজনও মৌলবাদ বিরোধিতার কারণ দেখিয়ে জামায়াতকে প্রতিহত করতে চায়। দেশের আলেমদের এক বড় অংশও জামায়াতবিরোধী। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতও বাংলাদেশের মৌলবাদের শক্তি বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতের সম্প্রসারণবাদী ভূমিকার প্রতিক্রিয়াও ভারতের প্রতিবেশী মুসলিমপ্রধান দেশের রাজনীতিতে ইসলামী আদর্শের আবেদন জোরদার হয়ে উঠার পেছনে কাজ করেছে বলে অনেকে মনে করেন।’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠ : ৯-১০)

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আদর্শ, নেতৃত্ব, সহযোগী সংগঠন নিয়ে অনুপুঙ্খ গবেষণা পরিচালনা করেন প্রফেসর ড. হাসান মোহাম্মদ দীর্ঘদিন। জামায়াতের প্রকাশিত এবং দলের বাইরে অন্যদের লিখিত এতদসংশ্লিষ্ট গ্রন্থগুলো তিনি নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করেন। নেতাদের সাথে কথা বলেছেন। জামায়াতের কার্যক্রম কাছে থেকে অবলোকন করেন। তথ্যসূত্র ও নির্ঘণ্ট দেখলে তা সহজে বোঝা যায়। জামায়াত নিয়ে তার বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। তার পর্যবেক্ষণের সাথে ভিন্নমত পোষণ করার সুযোগ আছে। তিনি মনে করেন, ‘ইসলামী আদর্শানুসারী ক্যাডার সংগঠন জামায়াত তার সদস্যদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। এ জাতীয় সংগঠন সদস্যদের স্বাধীন চিন্তাশক্তি বিকাশে সাধারণত সহায়ক হয় না। পাশ্চাত্যের সর্বাত্মকবাদ আদর্শানুসারী সংগঠনগুলোর প্রভাব বিস্তারকরণ প্রচেষ্টার সাথে এ ক্ষেত্রে জামায়াতের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃত্বের যোগ্যতা, বৈধতা, মহিলা নেতৃত্ব, নেতৃত্বপ্রার্থিতা, ইসলামী সংগঠনের সদস্যপদ লাভ, সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, জাতীয়তাবাদ, জাতীয়রাষ্ট্র ইত্যাদি বিষয়ে জামায়াতের তত্ত্বগত ধারণার সাথে প্রয়োগের পুরোপুরি সাদৃশ্য দেখা যায় না। আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস সত্ত্বেও জাতীয়রাষ্ট্রের সার্বভৌম আইন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ, সার্বভৌম আইনসভার আইন প্রণয়ন কার্যে অংশগ্রহণ, আধুনিক গণতন্ত্রে বিশ্বাস না করেও এ ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ প্রভৃতি স্ববিরোধিতা বা অসঙ্গতি জামায়াত রাজনীতিতে পরিদৃষ্ট হয়। আদর্শবাদী ক্যাডার সংগঠন জামায়াত জনপ্রিয় গণ-সংগঠনে পরিণত হতে চাইছে বলে নেতৃত্ব, সংগঠন ও আদর্শের বিভিন্ন বিষয়ে বর্তমানে নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করছে। জামায়াতের ব্যাপ্তি বাড়ার সাথে সাথে সংগঠনের নিয়ম-শৃঙ্খলা, সদস্যরা কর্তৃক সংগঠন নির্ধারিত দায়িত্ব পালন ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে কঠোরতা অবলম্বন করার কথা তাতেও ধীরে ধীরে শিথিলতা আসছে বলে ধারণা করা যায়।’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৫৮)

প্রফেসর ড. হাসান মোহাম্মদ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অর্থানুকূল্যে ‘শিক্ষা ও উন্নয়ন : প্রসঙ্গ বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা’ বিষয়ে যে গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন তার ওপর ভিত্তি করেই ‘বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা’ গ্রন্থটি রচিত হয়েছে ২০০৪ সালে। তিনি আলিয়া, নিউস্কিম ও কওমি মাদরাসার ইতিহাস, পাঠক্রম, উপযোগিতা, ধর্ম ও জাগতিক শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করার প্রয়াস পেয়েছেন। সমাজে মাদরাসার অবদানকে চিত্রায়িত করেন। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে জীবনঘনিষ্ঠ করার ওপর জোর দেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের ধর্মনিষ্ঠ জনগণের অনুভূতির সাথে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বহু চড়াই ও দুর্দিন অতিক্রম করে হৃদয়বান মুসলমান ও আলিম সমাজের ত্যাগের কারণে এ ব্যবস্থাটি গুণগত না হলেও সংখ্যাগত দিক দিয়ে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। কওমি মাদরাসাগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতিরেকে টিকে আছে। তাই বলা যায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের মাদরাসার উপস্থিতি হচ্ছে বাস্তবতা। ব্যাপক জনগণের অনুভূতির পরিপূরক মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে তাই সদর্থক দৃষ্টিতে দেখে একে আরো জীবনমুখী ও কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। উপেক্ষা নয়, দরদি মন নিয়ে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতাসমূহ দূরীভূত করে এর উন্নতি সাধন প্রয়োজন।

সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত মাদরাসাগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন এবং অন্যান্য গবেষণা কাজে আলোচনা থাকলেও কওমি মাদরাসা সম্পর্কে কোনো পর্যায়ে বিশেষ কোনো গবেষণাকর্ম হয়নি। প্রফেসর ড. হাসান মোহাম্মদের গবেষণায় অনালোচিত বিষয়টি ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের কওমি মাদরাসার শিক্ষা সমাপনকারী ছাত্ররা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বলে সাধারণত কোনো সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত সংস্থায় চাকরি পায় না। জাগতিক বিষয়গুলোর জ্ঞানের অভাবে বেসরকারি সংস্থায়ও হয় না কর্মসংস্থান। বলা হয়ে থাকে, কওমি মাদরাসায় ধর্মশিক্ষা আছে, কর্মশিক্ষা নেই। এ জাতীয় মাদরাসায় আরবি ও ফার্সি ব্যাকরণ শিখতে অত্যন্ত বেশি সময় ব্যয় করতে হয়। সরকারি মাদরাসার আলিম ও ফাজিল পাস ছাত্ররা এখন ব্যাপকভাবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য চেষ্টা করে থাকেন। উদ্দেশ্য, সাধারণ শিক্ষা অর্জন করে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে আসা ও কর্মসংস্থানগত সুবিধা অর্জন। ফলে দেখা যাচ্ছে, কেবল সরকারি মাদরাসার শিক্ষা দ্বারা এখনো একজন শিক্ষার্থী তার আশানুরূপ কর্মসংস্থান লাভ করতে পারছে না। মাদরাসার সনদ নয়, সাধারণ শিক্ষার সনদই বৃত্তিগত ক্ষেত্রে তার জন্য সবিশেষ প্রয়োজনীয়। কেবল মাদরাসা শিক্ষা সমাপনকারী ব্যক্তিরা মাদরাসায় শিক্ষকতা, স্কুলের ধর্ম-বিষয়ক শিক্ষক, মসজিদের ইমামতি, বিবাহ নিবন্ধক, পীর, ধর্মীয় বক্তা প্রভৃতিকে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতাবলে পেশা হিসেবে নিতে পারে। (বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা, ঢাকা, ২০০৪, পৃষ্ঠা-৪১,৬১)
তিনি মনে করেন, মাদরাসায় বাণিজ্য বিষয়ে লেখাপড়ার কোনো সুযোগ নেই। খুব কমসংখ্যক মাদরাসায় বিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে। বাংলা, ইংরেজি ও বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়ানোর শিক্ষকেরও রয়েছে স্বল্পতা। বিজ্ঞান-বিষয়ক শিক্ষার জন্য গবেষণাগার সুবিধা নেই বললে অত্যুক্তি হবে না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে লিখিত ইসলামের ইতিহাস আলিয়া মাদরাসায় পাঠ্যবিষয় হিসেবে রয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি ও বিকাশসহ স্বদেশকে জানার উপযোগী বিষয়গুলো এখনো বিশেষভাবে পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সরকারি ও কওমি উভয় প্রকার মাদরাসার পাঠক্রমে বিভিন্ন ধর্মতত্ত্ব, ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার, ইসলামী আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, আইন প্রভৃতি সম্পর্কেও শিক্ষা দানের বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। কওমি মাদরাসা এখনো ব্যাপকভাবে দরসে নিজামি অনুসরণ করছে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি মাদরাসার নিম্নস্তরের পাঠ্যসূচিতে বাংলা ও অঙ্ক বর্তমানে অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছে যদিও এগুলো কওমি মাদরাসায় খুব গুরুত্ব লাভ করে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, ধর্মীয় বিষয়সমূহ এমনকি আরবি ভাষা বলতে ও লিখতেও প্রায় ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো দক্ষতা অর্জন করে না। কেবল শুদ্ধভাবে কুরআন পাঠ, হাদিসের প্রাথমিক জ্ঞান লাভ এবং কিছু ধর্মীয় বিধি-নিষেধে জ্ঞান সীমাবদ্ধ থাকে। ব্যতিক্রম ব্যতীত অধিকাংশ শিক্ষার্থী লাভ করে না বাংলা, উর্দু কিংবা আরবি ভাষায় শুদ্ধভাবে মনের ভাব প্রকাশ করার জ্ঞান। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ২৩, ৪৩)

উপসংহারে তিনি যে মন্তব্য করেন তা সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। ‘বাংলাদেশকে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলা করতে হলে আমাদেরকে মানবসম্পদে বলীয়ান হতে হবে। আমাদের মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা সে লক্ষ্য পূরণে কতটা সহায়ক, এর দুর্বল দিকগুলো নির্ধারণ, কিভাবে সেসব দুর্বলতা কাটিয়ে একে ধর্মীয় ও জাগতিক চাহিদা পূরণক্ষম করে তোলা যায় সে সম্পর্কে সরকারি উদ্যোগে আরো অনুসন্ধান চালানো যেতে পারে। আমাদের রাষ্ট্রের ঐক্য, সংহতি, স্বাতন্ত্র্য ও সব ধরনের আধিপত্যবাদের মোকাবেলায় এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মবিশ্বাস, ঐতিহ্যপ্রভাবিত সংস্কৃতি হচ্ছে অন্যতম মূল প্রেরণাশক্তি। এটি লালনে মাদরাসা শিক্ষার্থী ও মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত জনগণকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতির মূল উৎস হচ্ছে ওইসব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মবিশ্বাসপ্রভাবিত সাংস্কৃতিক ঐক্য। এ কারণে বাংলাদেশের ব্যাপক ধর্মনিষ্ঠ জনগণের আবেগ-অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত এবং প্রধানত জনগণের অর্থানুকূল্যে পরিচালিত মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে অগ্রসর দেশপ্রেমিক জনগণ এবং দেশপ্রেমিক সরকার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করবেন এটিই ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত।’
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক

drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement