২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দখলমুক্ত ঢাকা এবং

- ছবি : নয়া দিগন্ত

৪০ দিন আগে শুরু হয়েছিল ঢাকার বছিলা খাল উদ্ধারের অভিযান। সেই অভিযানের সূচনা হয় খালের ওপরে স্থাপিত ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদের মাধ্যমে। আর এ অভিযান থমকে দাঁড়ায় বনানীর সেতু ভবনের সামনে এসে। ৩০ মার্চ শেষ হয়েছে ওই খালের উদ্ধার অভিযান।

ওই খালের পুরোটা উদ্ধার করা যায়নি- এ ভাষ্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের। তিনি বলেছেন, বনানীর রাস্তার ওপর দুটি সরকারি বহুতল ভবন উঠেছে। একটি সেতু ভবন, অন্যটি বিআরটিএ ভবন।

‘রাজধানীর যানজট প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে মেয়র আতিকুল বলেছেন, ‘এখন বনানীর সামনে এসে একটি বিশাল যানজটের মধ্যে আটকে থাকতে হয়। আমরা নিজেরাই সেখানে সেতু ভবন করেছি। এর পাশে আবার বিআরটিএর ভবনও করে ফেলেছি।’ (প্রথম আলো/৩১ মার্চ, ২২)
রাস্তা ও খালের ওপর যখন সরকারি অফিসের ক্ষমতাবানরা অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ করতে দ্বিধা করেননি, তখন যারা ক্ষমতার বাইরের মানুষ, যারা দখলদার মানসিকতার মানুষ, যারা অবৈধ দখলদার এ রাজধানীর অনেক খালসহ অনেক সরকারি খাস জমির, তারা তো দুঃসাহস পেয়েছে সরকারি অফিসের তরফ থেকেই। সরকারি দফতর যখন অবৈধ কাজ করতে পারে, জেনে-বুঝে ও অন্যায়ভাবে, তখন আমাদের পক্ষে কি ন্যায়বাচক কোনো কথা বলা শোভা পায়? নাকি সরকারি তরফে কোনো ন্যায় ও কল্যাণকর কথা, বক্তব্য বলা শোভা পায়? না, পায় না। কিন্তু তারপরও আমরা মন্ত্রী-মিনিস্টারদের মুখে ন্যায়-কল্যাণ ও উন্নয়নের কথা অহরহই শুনছি। আমরা সে-সব কথা শুনে অনেক সময়ই বিভ্রান্ত হই। আমরা বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝ বরাবর অবস্থান করি। মানে, আমরা সেসব বিশ্বাসও করি, আবার অবিশ্বাসও করি। এই দোলাচলের ভেতরে সাধারণ মানুষের পক্ষে সত্যে পৌঁছা কঠিন। তারা চায় কংক্রিট কিছু।

পোশাক শিল্পপতিদের বহুতল ভবন (বিজেএমইএ ভবন) ভেঙে দেয়া হয়েছে কেবল অবৈধ জায়গায় সেটি নির্মিত হয়েছিল বলে। তারা এতটাই পাওয়ারফুল যে সরকারের স্থাপনা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান রাজউকের কাছে থেকে পারমিশন নেয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি তারা। খাসজমি দেখভালকারী ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকেও বরাদ্দ নেয়নি। তারা এতটাই ক্ষমতাবান যে সেই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করিয়েছিলেন সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে। আজকের সরকার সেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ভূমি দখলদারদের বিরুদ্ধে (তাদেরকে কী ভূমিদস্যু বলা যাবে?) একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সেই সাথে সরকারের নৈতিক শক্তিরও প্রকাশ ঘটিয়েছেন সরকার, যা সাধারণ মানুষের কাছে এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। কারণ ওই সিদ্ধান্তটি বসতি জনগণের প্রত্যাশিত ছিল। সরকারি জায়গা যা মূলত জনগণের সম্পদ, সেখান থেকে অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করা আইনত ও নৈতিকতার দিক থেকে সমর্থনযোগ্য। আমরা সমর্থন করেছি। আমরা সেতুভবন ও বিআরটিএ ভবনও উচ্ছেদের পক্ষে। কারণ তা রাস্তা দখল করে নির্মিত। ওই দুই ভবনের কারণে বনানীতে দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে। রাস্তার জায়গা দখল করে যদি সেতু কর্তৃপক্ষ ভবন রাজউকের পারমিশন নিয়েও তুলে থাকে, সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ পেয়েও থাকে, তাহলেও ওই ভবন বা স্থাপনা অবৈধ। ভূমি মন্ত্রণালয় ও রাজউক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষ যদি অনুমোদন দিয়েও থাকে, তাহলেও তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। একে আমরা বলতে পারি পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে এটা করা হয়েছে।
এই পারস্পরিক যোগসাজশে কেবল এই দুটি ভবনই নির্মিত হয়নি, তত্ত্ব-তালাশ করলে দেখা যাবে ঢাকার শতকরা ৬০ ভাগ ভবনই নিয়মবহির্ভূতভাবে নির্মিত হয়েছে। ডিজাইন বিকৃত করে ভবন উঠেছে হাজারে হাজার। এসব ব্যক্তিগত ভবন কি রাজউক ভেঙে দিতে পারবে? না, পারবে না। কারণ তারা বিল্ডিং কোড অনুযায়ী নকশা অনুমোদন দিয়েছে ঠিক, কিন্তু অন্যরকমভাবে সেই নকশা এড়িয়ে যাওয়ার পন্থাও তারা অনেককে বাতলে দিয়ে থাকে। অবৈধ পথ খোলার জন্য এসব সরকারি কর্মকর্তাদের নালা-নর্দমা বের করার জুড়ি নেই। সেতুভবন নির্মাণের সময়ও নিশ্চয়ই রাজউক আশ্বস্ত করেছে সেতু কর্তৃপক্ষকে। অর্থাৎ পারস্পরিক যোগসাজশেই এই ধারার মুখ খুলেছে ও আজো অব্যাহত রয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকবে যতদিন পর্যন্ত না জড়িত লোকদের বিরুদ্ধে ন্যায় ও আইনি অ্যাকশন নেয়া হবে। পত্রিকায় পড়লাম, ডিএনসিসির একজন কেরানি, যিনি রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব নিয়োজিত ছিলেন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের, তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে রসিদ ছাড়া ৫০ হাজার টাকা নেয়ার অপরাধে। এটা একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করল ডিএনসিসি। তদন্ত করলে দেখা যাবে ওই অফিস সহকারী বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছে। এর আগে আমরা স্বাস্থ্য দফতরের একজন ড্রাইভারের শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার খবর পড়েছি সংবাদপত্রে।

একটি প্রশ্ন করা যায় যে, কেন একজন অফিস সহকারীকে দিয়ে রাজস্ব সুপারভাইজারের কাজ করানো হয়েছিল? কেন তাকে রাজস্ব আদায়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল? কেন সেই শূন্য পদে নতুন জনবল নিয়োগ করা হয়নি। কোন স্বার্থ রক্ষার জন্য ওই পদায়ন করা হয়েছিল একজন অফিস সহকারীকে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পারলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। সিটির এলাকা ভাগাভাগিতেও যে কি রকম অন্যায় হয়েছে এবং জট সৃষ্টি করা হয়েছে, তার একটি নমুনা রামপুরার বনশ্রী প্রজেক্ট। রামপুরা বনশ্রীকে দুই টুকরো করে এক অংশকে উত্তরে, অন্য অংশকে দক্ষিণে দেয়া হয়েছে। এতে কি এমন সুবিধা হয়েছে আমরা জানি না? তবে বনশ্রীর বাসিন্দাদের, বিশেষ করে এখানকার বাড়ির মালিকরা পড়েছে ফাঁপরে। সিটি করপোরেশনের এ সমস্যার কারণে এখানকার বসতি/বাড়িওয়ালারা মারাত্মকভাবে মর্মাহত ও দিশেহারা।

এখানকার বসতি/বাড়িওয়ালারা হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়েও বিপাকে পড়ে ঝুলে আছেন। জট খুলছে না বা খোলা হচ্ছে না। বাড়ির মালিকরা দিতে পারছে না তাদের হোল্ডিং ট্যাক্স। আবার মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্স ধরে নাজেহাল করা হচ্ছে তাদের। আবার সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ে জট পাকানো হয়েছে। এসবই ওই রাজস্ব সুপারভাইজারের মতো অফিস সহকারী বা কর্তাদের অন্যায় ক্ষমতার দাপটে করা হচ্ছে। এতে করে বদনামের ভাগিদার হচ্ছেন রাজনৈতিক মেয়রদ্বয়। বিষয়টি অচিরেই সমাধান দরকার। আমরা মনে করি, মহানগরীর এমন বহু এলাকায়ই এই ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে কণ্টকিত। এসব বিতর্ক ও সিদ্ধান্তহীনতার গোল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে মেয়রদের।

বছিলা খালের উদ্বোধনের পর আমাদের মনে আশা জেগেছে যে, খাল উদ্ধারের কাজ থেমে যায়নি। মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস কোনো শক্তিশালী চক্রের হাতের মোয়া হননি। তারা সত্যিকারভাবেই ঢাকার খালই কেবল উদ্ধার করে চলেননি, উচ্ছেদ করে চলেছেন ঢাকার ফুটপাথ দখলকারীদেরও। ঢাকার ফুটপাথ দখল করে থাকে প্রধানত বিভিন্ন শ্রেণীর দোকানদাররা, তাদের পণ্য সাজিয়ে রেখে। বিশেষ করে নির্মাণসামগ্রীর দোকানদারদের রড-সিমেন্টসহ বিভিন্ন রকম দোকানের দখলে আছে ফুটপাথ। এদের উচ্ছেদ করে, ফুটপাথ পথচারীদের হাঁটাচলা করার সুবিধা তৈরি করা হোক।

ফুটপাথে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। গত রোববার ২২টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে সিটি করপোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে।

এই উচ্ছেদ অভিযানের ফলে পথচারীদের মনে এ বিশ্বাসের ছাপটি পড়ল যে মেয়রদ্বয় বসে নেই, তারা জনগণের পক্ষে কাজ করে চলেছেন। কিন্তু একটা কথাই আমরা বারে বারে বলতে চাই, ঢাকা মহানগরকে যদি বাসযোগ করে গড়ে তুলতে হয়, তাহলে এসব উচ্ছেদ অভিযানের পাশাপাশি সড়কের ট্রাফিক শৃঙ্খলাও ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই শৃঙ্খলার নাম হচ্ছে লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি সড়ক থেকে তুলে নেয়ার সাঁড়াশি অভিযান। বাস মালিকরা সংঘবদ্ধ, তারা সড়কে নরক সৃষ্টি করে সরকার ও মেয়রদের সুনামে কালি ঢেলে দিতে কার্পণ্যবোধ করবে না। ডিজেলের দাম বাড়ানোর খেসারত এখনো দিচ্ছে যাত্রীরা। তারা যাত্রীদের সাথে যেমন অন্যায় আচরণ করে তেমনি গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রেও আইন মানে না। ফলে সড়কগুলো জমে থাকে জ্যামে। এভাবে এখানকার বসতিরা, বিশেষ করে ধনবান ও গরিব মানুষরা নাখোশ তীব্রভাবে। তরুণদের একটা শ্রেণী তো দেশান্তরি হতে চায় দুটি কারণে। তার একটি নারকীয় ট্রাফিক জ্যাম আর ঢাকার বাতাসের কোয়ালিটি এতটাই খারাপ যে, এ শহরে বাস করার মানে হচ্ছে ধীরে ধীরে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া। ঢাকার বাতাসের কোয়ালিটি ভালো করতে না পারলে কারোপক্ষেই এ শহরে বাস করার সুযোগ সহজ থাকবে না।

ঢাকার বাস-ট্রাক চালকদের ট্রাফিক আইন মেনে চলাচল করতে হলে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। ট্রাফিক বিভাগ লাইসেন্সধারী ড্রাইভারদের লাইসেন্সের ওপর প্রয়োগ করতে পারেন আইনি ছড়ি। যেমন ট্রাফিক আইন ভেঙে গাড়ি চালালে তাকে ফাইন দিতে হবে। আর সেই ফাইনের পরিমাণ হবে বেশ মোটাসোটা অঙ্কের। সেই সাথে তাদের লাইসেন্সে লাল দাগ পড়বে। এভাবে তারা চিরতরে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স হারাবে। আর কোনো দিন লাইসেন্স পাবে না। প্রতিটি রাস্তায় ট্রাফিক লাইটের সাথে ক্যামেরা সেট করেও অবৈধভাবে গাড়ি চালানো পরখ করা যেতে পারে। তাদের টিকিট দিয়ে কেবল সতর্ক করাই নয়, তাদের ড্রাইভিং স্কুলেও পাঠানো হবে। আমার ধারণা, এ পথে আমরা ঢাকার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারি। ট্রাফিক অমান্যকারী গাড়ি, সেটা যদি মন্ত্রীদেরও হয়, তাদের ফাইন করতে হবে চার/পাঁচ ডবল। তাতে তাদের সম্মানে আঘাত লাগবে, তবে তারা আর অবৈধভাবে সড়কে গাড়ি চালাবেন না। উপরমহল থেকে প্রভাব বিস্তার না করলে, এ ব্যবস্থায় সড়ক অনেক নিরাপদ হতে পারে।

একটি মেগা সিটির সড়ক পরিকল্পনা ও সড়ক ডিজাইন, উড়াল সড়কের সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন, মহানগরকে গতিময় করার অন্য কোনো বিকল্প নেই। সৌন্দর্য বিস্তারে সহায়তা দিতে পারে বসতিদের নান্দনিক চেতনা ও মেয়রদের সাংস্কৃতিকবোধ। আমরা কি আমাদের রাজধানী শহরকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা মহানগরে পরিণত করতে চাই না?


আরো সংবাদ



premium cement
গাজাবাসীর প্রধান কথা- ‘আমাদের খাবার চাই’ অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্যের বিকল্প নেই : ডা: শফিকুর রহমান সোনাগাজীতে জামাতে নামাজ পড়ে বাইসাইকেল পুরস্কার পেল ২২ কিশোর গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা ভিয়েনায় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের ইফতারে ইসলামিক রিলিজিয়াস অথোরিটি আমন্ত্রিত

সকল