১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কিভাবে বুঝবেন একটি দেশে গণতন্ত্র নেই

- ছবি : নয়া দিগন্ত

গণতন্ত্র হলো গ্রিক শব্দ ‘Demos’ (জনগণ) ও ‘kratia’ (শাসন) শব্দ দু’টির মিলিত রূপ। এটি এমন একটি রাষ্ট্র বা সরকারব্যবস্থাকে নির্দেশ করে, যা একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের বিপরীত। জনগণের ইচ্ছানুসারে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলা হয়। বিশ্বে রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই ছিল মানুষের সেরা আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম। যেসব দেশ প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সফলভাবে প্রয়োগ করেছে সেসব দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এই তিনটি স্তম্ভ হলো- এক. কার্যনির্বাহী বিভাগ (Executive department). দুই. নির্বাচিত প্রতিনিধি বিভাগ (legislative department) এবং তিন. বিচার বিভাগ (Judicial department)। এই তিনটি বিভাগের মধ্যে আর্দশগত সংযোগ এবং ক্ষমতার সুষম বণ্টন থাকলে একটি গণতান্ত্রিক দেশে শাসনব্যবস্থা ভালোভাবে পরিচালিত হয়। বিভাগগুলো পরস্পরের থেকে যত বেশি পৃথক থাকে তা গণতন্ত্রের জন্য তত মঙ্গলজনক। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হলো সংবাদমাধ্যম বা গণমাধ্যম। মুক্ত ও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুশাসনের অন্যতম শর্ত হিসেবে মনে করা হয়। সমতা, সুশাসন ও সুবিচার থাকলে দেশটিতে গণতন্ত্র আছে বলে মানুষ মনে করে।

আজ পৃথিবীর বহু দেশে গণতন্ত্রের ধস নেমেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর সমাপ্তি বছর পর্যন্ত অনেক দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কার্যকর ছিল। একবিংশ শতাব্দীতে এসে চিত্রটা অনেকটা বদলেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের গবেষণায় জানা যাচ্ছে, বতর্মান বিশ্বের অনেক দেশে গণতন্ত্র নামমাত্র কার্যকর রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মতো সরাসরি সামরিক শাসন না থাকলেও বহু দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো একনায়কতন্ত্রের মতো আচরণ করছে। আবার অনেক দেশে পূর্ণ সিভিল সরকার কার্যকর থাকলেও গণতন্ত্র কতটা সক্রিয় তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এসব দেশে সব ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে কেন্দ্রীভূত। এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এখন আর উদার গণতন্ত্র বা জনগণের গণতন্ত্র বলতে চাইছেন না। ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট নতুন এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এখন হুমকির মুখে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বার্ষিক গণতন্ত্র সূচকে বলা হয়, বিশ্বের মাত্র ১৯টি দেশে পূর্ণ গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে আছে পশ্চিম ইউরোপের ১৪টি দেশ। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিশ্ব জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীন। এর বড় অংশ চীনের জনগোষ্ঠী। এই সূচকে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে নরওয়ে, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড প্রথম সারিতে আছে। পূর্ণ গণতন্ত্র আছে বলেই দেশগুলো সুখী দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। একসময়ের উন্নতমানের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভেনিজুয়েলার বর্তমান অবস্থান কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার দেশগুলোর কাতারে যুক্ত হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বজুড়েই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবনতি ঘটেছে।

২০১৭ সাল থেকে গণতান্ত্রিক চর্চার চরম অবনতি শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষ বিশ্বাস হারাচ্ছে। জনগণের বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা অনেক কমে গেছে। অনেক দেশের রাষ্ট্র গণমাধ্যমের এবং সাধারণ মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করেছে। নিরাপত্তা বা সুরক্ষা আইনের নামে ভিন্ন মতাদর্শের মানুষদের গুম, হত্যা এবং রিমান্ডের মাধ্যমে জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয়েছে। অন্য দিকে ২০১৭ সাল থেকে গাম্বিয়া গণতন্ত্র চর্চায় সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে (তথ্য সূত্র, ওয়ার্ল্ড ইনসাইট ৩ ফেব্রæয়ারি ২০১৮)।

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের হিসাব মতে, বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে মাত্র ২০টি দেশে পূর্ণ মাত্রার গণতন্ত্র আছে। ৫৫টি দেশ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের তালিকায়। ৩৯টি দেশ হাইব্রিড রেজিমের তালিকায় এবং ৫৩টি দেশ স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় রয়েছে। সবচেয়ে কম গণতন্ত্র আছে এমন দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে উত্তর কোরিয়া, লাওস, চীন, কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়া, ভিয়েতনাম, নেপাল ও হংক। জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেরটেলসমান স্টিফটুং অন লাইনের ২৪ মার্চ ২০১৮-এর প্রতিবেদনে দেয়া সূচকে গণতন্ত্রের মানের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে উরুগুয়ে, দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এস্তোনিয়া, তিন নম্বরে আছে তাইওয়ান। সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে চীন ১০৯ নম্বরে, এর পরের অবস্থান যথাক্রমে ইয়েমেন, সিরিয়া ও সোমালিয়ার। রাশিয়ার অবস্থান ৮১ নম্বরে। বাংলাদেশের অবস্থান ৮০ নম্বরে। সূচকে ভারতের অবস্থান ২৪ এবং শ্রীলঙ্কার ৪২। ওই প্রতিবেদনে আরো দাবি করা হয়, পাঁচটি দেশ গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করছে না। দেশগুলো হলো- বাংলাদেশ, লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া ও উগান্ডা। এই পাঁচটি দেশ গত কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে খারাপ মানের নির্বাচনপদ্ধতি অনুসরণ করছে, যা কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পড়ে না। এই দেশগুলোতে বছর পরিক্রমায় গণতন্ত্রের ভিত ক্রমাবনতিশীল হয়ে পড়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর একাধিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছেন, বাংলাদেশ এখন মূলত একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু আছে।

আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারে বহু বছর ধরে সামরিক শাসন চালু আছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরক্কো, জর্দান, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া, কুয়েত, মিসর, কাতার, ওমান, বাহরাইন, ব্রুনাই এবং সোয়াজিল্যান্ড, মোনাকো, ভ্যাটিকান সিটি, ভুটানসহ আরো বহু দেশে গণতন্ত্র নেই। এসব দেশে আছে রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে একদলীয় শাসন। বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনের পর ব্রিটেনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যে রিপোর্ট প্রকাশ করে সেখানে গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় নেই বাংলাদেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র সামিটে বাংলাদেশকে বয়কট করছে। সামিটে পাকিস্তান, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাকে দাওয়াত দেয়া হলেও বাংলাদেশকে ডাকা হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে যে চিত্র দেখা গেছে তা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নির্দলীয় সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেখানে পরাজিত দল বরাবরই অভিযোগ তুললেও সাধারণভাবে সেসব নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বমহলে। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র উল্টা পথে হাঁটতে শুরু করে বলে জনগণ বিরূপ মন্তব্য উত্থাপন করেছে। সর্বশেষ নির্বাচনের (২০১৮) পর এটি আরো জোরালো হয়েছে। একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, সর্বশেষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থার পুরো কাঠামোই ভেঙে পড়েছে। এর পর থেকেই সাধারণ মানুষের নির্বাচনের ওপর আস্থা উঠে গেছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য ছিল অশনি সঙ্কেত। একটি দেশে গণতন্ত্র নেই, সেটি বোঝা যায় প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে, যেখানে সাধারণ মানুষ ভোট দেয়ার আগ্রহ পায় না। যেসব দেশে বেসামরিক একনায়কতন্ত্র আছে সেখানেও নিয়মিত নির্বাচন হয়। এর বিরুদ্ধে জনগণ প্রতিবাদ করলে তা সহিংসভাবে দমনের চেষ্টা করা হয়। অনেকসময় কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্র দেখে অনেক সামরিক সরকারও লজ্জা পাবে। এ ধরনের নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণ কমে যায়। সংসদ হয় একদলীয়। নিরাপত্তাবাহিনীর প্রভাব বাড়ে। নির্বাচন কমিশন, সংসদ ও বিচার বিভাগ ভঙ্গুর অবস্থার দিকে অগ্রসর হয়। মানুষ মতপ্রকাশে ভয় পায় এবং দেশে দুর্নীতিও বেড়ে যায়। সরকার ব্যবসায়ী ও আমলানির্ভর হয়ে পড়ে।

৯ জানুয়ারি ২০১৯ ব্রিটেনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-ইআইইউ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ ৫ দশমিক ৫৭ স্কোর পেয়ে হাইব্রিড রেজিম তালিকায় রয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের মাঝামাঝি অবস্থান হাইব্রিড রেজিম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৬ সালে গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৬ দশমিক ১১। এই সূচকটি ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল, এই এক দশক পর্যন্ত বাংলাদেশ গণতন্ত্র সূচকে হাইব্রিড রেজিমে অবস্থান করেছে। ইকোনমিস্ট গ্রুপ ২০০৬ সালে এই সূচক প্রকাশ শুরু করার পর ২০১৭ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫ দশমিক ৪৩ এবং এটাই ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে অবস্থান। বাংলাদেশ এই বাজে অবস্থান থেকে আর বের হতে পারেনি। ইআইইউ’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র বিদ্যমান। অন্য দিকে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তানে আছে হাইব্রিড রেজিম ও আফগানিস্তানে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা।

গণতান্ত্রিক সূচকে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৮৭ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে উপরের অবস্থানে ছিল নরওয়ে। অন্য দিকে, মাত্র ১ দশমিক ০৮ স্কোর নিয়ে উত্তর কোরিয়ার অবস্থান সবার নিচে।
লেখক : গ্রন্থকার ও কলামিস্ট
e-mail:harunrashidar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
মাত্র ২ বলে শেষ পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টি জেলে কেজরিওয়ালকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দলের ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা তোকে যদি এরপর হলে দেখি তাহলে খবর আছে, হুমকি ছাত্রলীগ নেতার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা করা হয়নি : প্রধানমন্ত্রী দাওয়াতী ময়দানে সকল নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেল শ্রমিকদের মাঝে ইসলামের আদর্শের আহ্বান পৌঁছাতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে বিমানবন্দরের টার্মিনালে ঢুকে গেলো বাস, ইঞ্জিনিয়ার নিহত গোয়ালন্দে প্রবাসীর স্ত্রী-সন্তানকে মারধর, বিচারের দাবিতে মানববন্ধন

সকল